০
২০৮১ বার পঠিত
পুলিশ অধিদপ্তরের আওতাধীন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সাংগঠনিক কাঠামোতে একটি স্থায়ী পার্বত্য ব্যাটালিয়নের(র্যাব-১৫) জন্য ৬৭৭ জনের জনবল অনুমোদন করা হয়েছে। গত বুধবার(০৬/১১/২০১৯) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব আজীজ হায়দার ভূইয়া স্বাক্ষরিত এক সরকারী আদেশে একথা জানানো হয়।
উক্ত ব্যাটালিয়নের জন্য বিভিন্ন পদবীর মোট ৬৭৭টটি পদ সৃজন, ৮৪টি যানবাহন, এবং ১৫টি সরঞ্জামাদি(সিসিটিভি) টিওএন্ডই-তে অন্তর্ভূক্ত করণে সরকারী মঞ্জুরি জ্ঞাপন করা হয়েছে।
যেসব পদের বিপরীতে ৬৭৭ জনবল অনুমোদন করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে-
পরিচালক-১টি, উপ-পরিচালক-৬টি, সিনিয়র সহকারী পরিচালক-৩৫টি, আরএমও-১টি, উপ-সহকারী পরিচালক-৫৪টি, ধর্মীয় শিক্ষক-১টি, এস আই-১৩০টি, এএসআই-১৫২টি, হিসাব রক্ষক-১টি, ক্যাশিয়ার-১টি, নায়েক-৩৫টি, কনস্টেবল-২৩৬টি, কুক কনস্টেবল-২২টি ও মেস ওয়েটার-২টি।
(১)
সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়নের ভিত্তি আরো ব্যাপকভাবে জোরদার করার লক্ষ্যে র্যাবের স্থায়ী পার্বত্য ব্যাটালিয়ন(র্যাব-১৫) অনুমোদন দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়নের ভিত্তি অধিকতর শক্তিশালী হলে আদিবাসীদের অস্তিত্ব চরম হুমকির মূখে দাবিথ হবে। কারণ এই সামরিকায়ন’ই পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জীবন প্রণালী সম্পূর্ণ সামরিকতন্ত্র ও সেনাতন্ত্রের দখলে নিয়ে নিয়েছে। সামরিকায়নের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জাতিসত্তাসমূহের উপর চরমভাবে চাঁপানো হয়েছে হয়রানিমূলক বাস্তবতা। রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সব ধরনের অধিকার থেকে পরিপূর্ণভাবে একপাশে রাখা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সামরিকায়নের প্রভাবে। এই সামরিকায়নের প্রভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী কতৃক অকালে প্রাণ হারাচ্ছে শত শত নিরীহ আদিবাসী। নানাভাবে হয়রানির শিকার করা হচ্ছে সহজ সরল নিরীহ নিরপরাধ আদিবাসীদের। সন্ত্রাসীর তকমা লাগিয়ে দিয়ে ঠান্ডা মাথায় গুলি করা হচ্ছে খেতে খাওয়া আদিবাসী জেলেদের। গত বছর বান্দরবানে ৭ম শ্রেণীর ছাত্র লাকাসিং তঞ্চঙ্গ্যাকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করেছিলো সেনাবাহিনীরা। এবছর ক্রসফায়ারে হত্যা করা হলো জ্ঞান শংকর চাকমাকে, বাঘাইছড়ি সাজেকে সুমন চাকমাকে(লাকী বাপ) এবং তার দু-তিন দিন পরেই দীঘিনালার শান্তিপুরে সেনাবাহিনীরা তিন জন আদিবাসী যুবককে রাতের অন্ধকারে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে ক্রসফায়ারে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা এবং সর্বশেষ বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুমে বিজিবি কতৃক দুই তঞ্চঙ্গ্যা আদিবাসীকে প্রকাশ্য ক্রসফায়ারে গুলি করে হত্যা। যার বিচার এখনো হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবেনা। কারণ এই বাংলাদেশ চলে বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে।
(২)
পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনায় কোনায় অহরহ সেনাক্যাম্প থাকা সত্তেও কেন অধিকভাবে প্রকত হচ্ছে আদিবাসী নারী ও নারী শিশুদের নিরাপত্তাহীনতা ও ধর্ষণ, ধর্ষণের পর নৃসংশভাবে হত্যা সংস্কৃতির সহিংসতা। অবশ্যই হওয়ারই কথা…!!! কেননা সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থান নিয়েছে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর উপর নিরাপত্তাহীনতা দূর করতে নয়, বরং নিরাপত্তাহীনতা জোরদার করতে। ২০১৭ সালে রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার অরাছড়ি গ্রামে রাতের অন্ধকারে দীঘলছড়ি সেনা জোনের দুই সেনা সদস্য এক পরিবারের দুই মার্মা কিশোরী বোনকে ধর্ষণ করেছিলো। সেনাবাহিনী কতৃক আদিবাসী নারী ধর্ষণের ছোট বড় ঘটনা অহরহ।সেসব নরপিশাচ ধর্ষক সেনা সদস্যদের বিরুদ্ধে কোন আইনী বিচার হয়না। আদিবাসী নারী ধর্ষণের ঘটনা থেকে যায় সম্পূর্ণ বিচার বহিঃর্ভূত। কেবল পাহাড়ে নয় সমতলের প্রান্তে সারাদেশে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিৎ করতে সরকার ব্যার্থ, দেশের সোনার ছেলে সেনাবাহিনীরা ব্যার্থ। আমরা সমতলের সোহাগী জাহান তনুর ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা কমবেশি সবাই জানি। আমরা জানি চলন্ত বাসে রূপাকে ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা। পাহাড়ের প্রান্তজুরে এখনো ভেসে বেড়ায় সবিতা চাকমা, ছবি মার্মা, তুমাচিং সহ ১০ বছর বয়সী ছোট্ট কোমলমতি কৃত্তিকা ত্রিপুরাদের আত্মচিৎকার। সেটেলার বাঙালী নরপশু কতৃক ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিলো এদের…!!!বিচার হয়নি, বিচার চাওয়াও দোষের। সম্পূর্ণ বিচার বহিঃর্ভূত এসব ঘটনা।
(৩)
র্যাবের স্থায়ী পার্বত্য ব্যাটালিয়ন হবে পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি, অরাজক পরিস্থিতি, অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির নতুন সমীকরন। সরকারের এই উদ্দ্যোগ পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সামগ্রীক স্বার্থে নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আদিবাসী জাতিসত্তাসমূহের অস্তিত্ব আমূলভাবে উৎখাত করতেই সরকার এহেন আদিবাসী স্বার্থ পরিপন্থী স্বীদ্ধান্ত গ্রহন করেছে। সরকার মূলত আদিবাসী বান্ধব নয়।
র্যাবের কাজ হচ্ছে বিচার বিশ্লেষণহীনতায় সাধারন জনগনকে ক্রসফায়ারে বলি দেওয়া। র্যাবের পার্বত্য ব্যাটালিয়ন পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থাপন করা হলে সামরিকায়ন ও সেনা শাসনের ভিত্তি শক্তিশালী হবে। নির্বিচারে নিরীহ আদিবাসীদের গুলি করে হত্যা করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। আদিবাসী নারী হেনস্তার পরিকল্পনা সুদৃঢ় হবে। অতঃপর হুমকির মূখে আদিবাসী অস্তিত্ব উৎখাত হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটি থেকে।
(৪)
“পার্বত্য চুক্তি” অনুযায়ী কথা ছিলো পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সকল প্রকার অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়া। কিন্তু এক দুইটি বাদে বাকী একটিও প্রত্যাহার করা হয়নি অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প। উল্টো গেল মাস কয়েক আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাঙ্গামাটি সফরে এসে প্রত্যাহারকৃত সেনা ক্যাম্প পুনস্থাপনের কথা বলে গেলেন কান্ডজ্ঞানহীনভাবে। ধারাবাহিকভাবে একের পর এক পার্বত্য চুক্তি লঙ্ঘন করা হচ্ছে তো হচ্ছে তারউপর আবার পার্বত্য চুক্তি ও আদিবাসী স্বার্থ পরিপন্থী করে র্যাবের স্থায়ী পার্বত্য ব্যাটালিয়ন অনুমোদন। এমতাবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যদিকে মোড় নিবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। অস্থিতিশীল থেকে চরম অস্থিতিশীলতার ঝুঁকিতে পরবে পার্বত্য চট্টগ্রাম। সরকার বাধ্য করছে আদিবাসীদের সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ধরতে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যা করণীয় সেটাই করবে পাহাড়ের আদিবাসীরা।
(৫)
অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারের এহেন আদিবাসী স্বার্থ ও পার্বত্য চুক্তি পরিপন্থী পরিকল্পনা বাতিল করা হোক। এর ব্যাতিরিকে যদি এই পরিকল্পনা অব্যাহত রাখা হয় এবং তার জন্য যদি কোন অস্থিতিশীলতা পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটি দুর্গ স্থাপন করে তার জন্য দায়ী থাকতে হবে সরকারকেই।
বাংলাদেশকে ভালো রাখতে হলে, সুস্থ রাখতে হলে পাহাড়কেও তার ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করে ভালো রাখুন,সুস্থ রাখুন।
ভালো থাকুক বাংলাদেশ, ভালো থাকুক পাহাড়।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন