[লজ্জা-সম্মানের নিগড়ে আবদ্ধ গোষ্ঠি-ভিত্তিক পুরুষতান্ত্রিক আফগান সমাজে কলঙ্ক-লাঞ্ছনার ভীতি কিভাবে জনতাকে কাবু করতে পারে, তার উপর আফগান লেখিকা সাহার সাবা’র একটা ব্যতিক্রমধর্মী লেখা। বাংলাদেশও অনেকটা সেরূপ ইসলামি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হওয়ায়, লেখাটা বাঙ্গালী পাঠকের জন্য প্রযোজ্য হবে বিধায় বাংলায় অনুবাদের খায়েশ বোধ করলাম।]
বেশীরভাগ আফগানবাসী তালেবান নৃশংসতাকে ততটা ভয় করে নি, যতটা করেছে মানুষের উপর তাদের ‘অপমানের কালিমা’ ঢালার প্রবৃত্তিকে।
তালেবান শাসনকালে আমার বাবা-মা দুই সহোদর-সহ আফগানিস্তানের ফিরে যান আমাদের বাকী সবাইকে পেশোয়ার শরনার্থী শিবিরে রেখে। তারা এক গুপ্ত প্রতিরোধ-বাহিনী সদস্য হিসেবে কাজ করার জন্য ফিরে যায়। আমার এক ভাই, যে রাওয়ালপিণ্ডিতে পড়াশুনা করতো, সে একবার গ্রীষ্মের ছুটিতে মা-বাবা’কে দেখতে যায়। বেশীরভাগ কিশোরদের মত সে লম্বা চুল রাখতো। তালেবান শাসনকালে যুবকদের লম্বা চুল রাখা নিষিদ্ধ ছিল। আমার বাবার হুশিয়ারী সত্ত্বেও ভাইটি চুল কাটা থেকে বিরত থাকে। সে তার লম্বা চুল পছন্দ করতো। “আমি অল্প কয়েকদিন থাকছি মাত্র। ওরা আমাকে দেখতে পাবে না,” জবাব দেয় সে।
আমার পরিবার শহর উপকূলের এমন এক এলাকায় বাস করতো, যেখানে পাপকর্ম তদারককারী তালেবান পুলিশ কদাচিত যেত। কিন্তু আমার ভাইয়ের দুর্ভাগ্য, একদিন এক ঘূর্ণমান তালেবান বাহিনী তাকে বাড়ির কাছাকাছি কোথাও দেখে ফেলে। লম্বা চুল দেখে তার চেচিয়ে উঠে এবং তাকে স্থির দাড়াতে বলে। কিন্তু ভীত-সন্ত্রস্ত আমার ভাইটি পালানোর পথ বেছে নেয় এবং সহি-সালামতে বাড়ি পৌঁছে যায়।
কিন্তু বিধি বাম। সম্ভবত তালেবানের হুমকিতে প্রতিবেশী কেউ আমাদের বাড়ির কথা বলে দেয়। অল্পক্ষণ পড়েই তালেবানরা আমাদের বাড়ির দ্বারে হাজির হয়ে ঘর তল্লাসী দাবী করে।
বাবা তখন বাড়িতে ছিলেন না। মা সাহসের সাথে দরজা আটকে ধরে তাদেরকে ঘরে ঢুকতে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। মাকে তালেবান নাজেহাল বা গ্রেফতার করতে পারে সে ভয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ১৮ বছর-বয়সী আরেক ভাই বলেঃ “যেহেতু আমার ভাই এখন বাড়িতে নেই, আপনারা তার অপরাধের জন্য আমাকে শায়েস্তা করতে পারেন।”
তালেবান রাজী হলো এবং জনসমক্ষে ভাইটির মাথা ন্যাড়া করে দিল। সে প্রকাশ্য কলঙ্ক-লাঞ্ছনা ভাইটিকে বহুদিন পিড়ীত করতে থাকে।
সেদিন থেকে আমি এ অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, তালেবানরা প্রকাশ্য লাঞ্ছনাকে শক্তিশালী সামাজিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। বার্তা-মাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রায়শঃ তালেবানদের নানান প্রকাশ্য শাস্তির কথা প্রচার করেঃ যেমন, চুরির দায়ে অংগহানী, ব্যাভিচারের দায়ে পাথর-ছুড়ে হত্যা, মাদক চালানির দায়ে প্রাচীরের নীচে ফেলে জ্যান্ত করব দান, এবং অশালীনতার জন্য দোররা মারা ইত্যাদি। তালেবানকে তারা প্রদর্শিত করে বর্বর, গাজাখুরি, পশ্চাৎপদ ও নারী-নির্যাতক হিসেবে।
আমার মতে, পশ্চিমা বার্তা-মাধ্যম আফগানিস্তান দখলের অনেক আগে থেকেই তাদের পছন্দমত তালেবানকে এমন-সব বদনামে রঞ্জিত কোরে দানবায়িত করে সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে… আফগান নারী-পুরুষকে প্রকাশ্য লাঞ্ছনার তালেবানী কৌশল পশ্চিমা সাংবাদিকরা আজও উপেক্ষা কোরে চলেছে।
আসুন পরখ করে দেখি নারীর শরীর কীভাবে তালেবানের এ প্রক্রিয়াগত কৌশলের শিকার হয়। মহিলাদেরকে সামান্য ভুল, যেমন উচু জুতা পড়া, চুড়ি পড়া বা উচ্চ-স্বরে হাসা ইত্যাদির দায়ে জনসমক্ষে লাঞ্ছিত করার মাধ্যমে তালেবান সহজেই তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কর্মকাণ্ড উপড়ে ফেলে। কেননা, আফগান সমাজে পুরুষতান্ত্রিক অবকাঠামো শক্ত হওয়ায় পুরুষরা নমনীয়তার সাথে তালেবানের নির্দেশ অনুসারে জনসমক্ষে নারীদেরকে আড়াল করে। অন্য কথায়, মহিলাদের শরীরকে জনসমক্ষে লাঞ্ছিত করা থেকে রক্ষার জন্য আফগান পুরুষরা তাদের নারীদেরকে কড়া পাহারায় রাখে। এভাবে তালেবান লাঞ্ছনার ত্রাস ছড়িয়ে দিয়ে জনগণের প্রকাশ্য ও পারিবারিক জীবনের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।
আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাসঃ বেশীরভাগ আফগানরা তালেবান নৃশংসতাকে ততটা ভয় করে নি, যতটা করেছে তালেবান-কর্তৃক তাদের উপর কলঙ্ক-লাঞ্ছনা চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাকে। এ কৌশল পাকিস্তানেও উদারহস্তে প্রয়োগ করেছে তালেবান।
এমন এক দৃষ্টান্ত ঘটে পাকিস্তানের স্বোয়াত অঞ্চলের এক মহিলা স্কুল শিক্ষিককে কেন্দ্র করে। প্রকাশিত খবরানুসারে, সে শিক্ষিকা বাচ্চাদেরকে লালন করার জন্য পড়ানোর পেশা ধরেছিল। মেয়ে হয়ে চাকরি করায় পাকিস্তানি তালেবান তাকে বেশ্যা নাম দিয়ে পায়ে ঘুংরু পরিয়ে নাচায়ে বেড়ায়। এভাবে চরম অপমানিত, লাঞ্ছিত করার পর তাকে হত্যা করে তালেবান।
পীর সামিউল্লাহর কাহিনী আরও সাংঘাতিক। সামিউল্লাহ ছিলেন প্রথম স্থানীয় গোত্রপতি, যিনি স্বোয়াতে এক বৃহৎ তালেবান-বিরোধী লষ্কর বা গোত্রীয় বাহিনী দাড় করিয়েছিলেন। পীর সামিউল্লাহর অধীনে তার শিষ্য ও গুজ্যর গোত্রের সদস্যরা মিলে ১০,০০০ সদস্যের এক বেসরকারী সামরিক বাহিনী তৈরী করেছিল তালেবানের উৎপীড়ন থেকে ২০টি গ্রাম রক্ষার জন্য। তালেবান তাকে কিছু শিষ্যসহ হত্যা করে।
লাঞ্ছিত করা জন্য পীর সামিউল্লাহকে জ্যান্ত ধরতে না পারায়, হত্যার পর তার কবর-দেওয়া মৃতদেহ তালেবানরা গোর খুড়ে বের করে এবং জনসমক্ষে ফাসিতে দিয়ে ঝুলিয়ে রাখে। কেউ কেউ মনে করেন যে, তালেবান পীর সামিউল্লাহর মৃতদেহ ঝুলিয়ে রেখেছিল তত্ত্বগত বিরোধের জন্য। কিন্তু তালেবানের এক মুখপাত্র বিবিসি’র উর্দু প্রতিনিধির কাছে তা খোলাসা করে বলেনঃ পীর সামিউল্লাহর মৃতদেহ ঝুলানো হয়েছিল জনগণকে এটা দেখানোর জন্য যে, যারা তালেবানের বিরোধীতার করবে তাদের জানাজাও মিলবে না।” এভাবে তারা তাদের প্রতিপক্ষকে শুধু নৃশংসতার লক্ষ্য করে নি, তাদেরকে অবমানিতও করেছে (জানাজা না পেলে দোজখ অবধারিত?)।
পীর সামিউল্লাহর কাহিনী নুতন কিছু নয়। ১৯৯৬ সালে পাকিস্তানের পোষ্য তালেবান ক্ষমতা দখলের পর কাবুলে পরাজিত ও ধৃত প্রেসিডেন্ট ডঃ নজিবুল্লাহ ও তার ভাইকেও একই শাস্তি দিয়েছিল – ডঃ নজিবুল্লাহকে খোজা কোরে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তারপর তার রক্তভেজা মৃতদেহ ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে রাখা হয় মুখের ভিতর আমেরিকান ডলার গুজে দিয়ে।
তালেবানের এক উচ্চস্থানীয় নেতা মুল্লা মুহাম্মদ রাব্বানী তখন দাবী করেছিল যে, সে পরিণাম নজিবুল্লাহর প্রাপ্য ছিল, কেননাঃ “সে বহু ইসলামপন্থীকে মেরেছিল, ইসলাম-বিরোধী ছিল এবং তার অপরাধ এতটাই সুস্পষ্ট ছিল যে বিচার-আচার ছাড়াই সে শাস্তি ভোগের যোগ্য ছিল। সে ছিল সমাজতন্ত্রী।” আবারও দেখি, তালেবান একজন প্রতিপক্ষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তাকে লাঞ্ছিল, অবমানিত করেছে।
নিচে দেখুন লাহোর-ভিত্তিক ডেইলি টাইমস পত্রিকায় কয়েক বছর আগে প্রকাশিত অনুরূপ আরেক ঘটনাঃ
পেশাওয়ার – খাইবার এজেন্সির শিনওয়ারী ও আফ্রিদি গোত্রের প্রতিনিধিরা বলে যে, তারা দুর্ব্যবহার ও লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে লষ্কর-ই-ইসলাম নামক এক বেসরকারী বাহিনী হাতে, যারা ‘গোত্রীয় সংস্কৃতি ও ইসলামি মূল্যবোধ বলবত রাখার’ দায়িত্ব নিজ মাথায় তুলে নিয়েছে।
“লষ্কর-ই-ইসলাম কর্মীরা চেকপোস্টে আমাদের প্রতি যেরূপ আচরণ করে, তাতে আমি অপমানিত ও লাঞ্ছিত বোধ করি,” বলেন এক গোত্রীয় নেতা – যিনি খাইবারে লষ্কর-ই-ইসলাম ও তালেবান কর্মীদের উপদ্রবের কারণে পেশাওয়ারে অভিবাসিত হয়েছেন।
চাঁদাবাজিঃ তোরখাম সদর রাস্তা (হাইওয়ে) দিয়ে যাতায়াতকারো যাত্রীদের কাছে থেকে গান-বাজনার রিং-টোন ওয়ালা মোবাইল ফোন ও ছবি বাজেয়াপ্ত করে তারা; গাড়িতে গান-বাজনা থাকলে ৫০০ রুপি জরিমানা আদায় করে, এবং যে স্থানীয় টুপি না পড়বে তাকে ১০০ রুপি জরিমানা দিতে হবে, জানা গেছে গোত্রীয় সূত্র থেকে।
“শিনওয়ারী ও আফ্রিদিরা কখনোই এমনভাবে অসম্মানিত ও লাঞ্ছিত হয় নি। মাঝে মাঝে ভাবি, খাইবারের গর্বিত জনতা আজ এতই দুর্বল যে, এ লোকগুলোর মুখোমুখি হওয়ার সাহস পায় না।”
শিনওয়ারী ও আফ্রিদি গোত্রীবাসীকে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশী পীড়া দেয়, তা হচ্ছেঃ এসব ইসলামপন্থী বাহিনীর কর্মীরা মহিলাদের সামনে তাদেরকে গালাগাল দেয়।
সে গোত্রীয় অঞ্চলে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নিযুক্ত এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা বলেনঃ গোত্রবাসীরা পরিবারের মহিলাদের সামনে “নির্লজ্জ” বলে গাল খাওয়ার চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করে।
“গোত্রবাসীরা পুরুষ হওয়ায় গর্ব বোধ করে এবং যখন কেউ তাদেরকে মহিলাদের সামনে অসম্মান করে, তা যেন তার সে পৌরুষেয় অহংকার ছিনিয়ে নেওয়ার তূল্য,” জানান সে কর্মকর্তা।
যাতায়াতঃ “আমরা লন্দিকোতাল ও পেশাওয়ারের মাঝে যাতায়াত বন্ধ করেই দিয়েছি এ অপমান এড়ানোর জন্য,” বলেন সে গোত্রীয় নেতা।
পাশ্চাত্যে যারা ধারনা করে যে, তালেবান কেবলই এক পাশ্তুন প্রতিরোধ বাহিনী মাত্র কিংবা সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী প্রতিপক্ষ মাত্র, তারা তাদের অনুসিদ্ধান্তকে একটু পরখ করে দেখতে পারেন তালেবান চেকপোস্ট দিয়ে একবার পরীক্ষামূলকভাবে যাতায়াত করে।
—
[[{“type”:”media”,”view_mode”:”media_large”,”fid”:”79″,”attributes”:{“alt”:”সাহার সাবা, আফগান নারী অধিকার কর্মী”,”class”:”media-image”,”height”:”110″,”style”:”width: 130px; height: 110px; margin-left: 4px; margin-right: 4px; float: left; “,”typeof”:”foaf:Image”,”width”:”130″}}]]কাবুলে জন্মগ্রহণকারী ও লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে আইনশাস্ত্রে ডিগ্রীধারী লেখিকা সাহার সাবা একজন আফগান নারী অধিকার কর্মী। বহুদিন তিনি বিপ্লবী আফগান নারী সংঘ (RAWA)-এর মুখপাত্র ছিলেন। সম্প্রতি তিনি আফগান নারীদের পক্ষে বক্তব্য দেওয়ার জন্য অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন।