০
১১৪২ বার পঠিত
নামের আগে ডক্টরেট আছে এমন একজনকে বলেছিলাম, আপনার শিক্ষা আছে, জ্ঞান নেই। প্রচণ্ড খেপে গিয়েছিলেন আমার উপর। তারপরও অনেকটা জোর করেই বলেছিলাম, শিক্ষা মানে হলো, যা শিখতে হয়। এতে আপনার নিজস্বতা কিছু নেই। অন্য যা বলেছে তা আপনি শিখছেন। কিন্তু জ্ঞান আহরণ করতে হয়। এটা একান্তই নিজস্ব। হ্যাঁ, শিক্ষা জ্ঞানের জন্যও কাজের। জ্ঞান যদি ঘর হয়, শিক্ষা ঘর সাজানোর উপকরণ। ঘরকে সুন্দর করতে যেমন আসবাব লাগে, তেমন আসবাব। কিন্তু মূল হলো ঘর।
শিক্ষা হলো হাতের কাজের মতন, শিখতে হয়। কারিগরি বিষয়টা তাই শিক্ষার সাথে যুক্ত। সেজন্যই কারিগরি শিক্ষা, জ্ঞান নয়। জ্ঞান হলো চিন্তা। ওই যে আকাশের উড়ার চিন্তা, তার রূপ দেয় শিক্ষা। এখানে চিন্তাটাই মূল। মানুষের উড়ার চিন্তা না থাকলে, বিমান আবিষ্কার হতো না। মানুষের চিন্তা করার শক্তিটাই হলো জ্ঞান।
অনেকক্ষন চুপ করেছিলেন সেই ডক্টরেট ভদ্রলোক। মুখ খুললেন যখন, তখন বললেন, একদম ঠিক বলেছেন। জ্ঞান হলো নতুন কিছু মানুষের সামনে উন্মুক্ত করে দেয়া। শিক্ষাই যদি প্রধান হতো তাহলে, নতুন কিছু থাকতো না, সব গতানুগতিক হয়ে যেতো।
লালন শিক্ষা নয়, জ্ঞান অর্জন করেছিলন।
২
সাউথ ইন্ডিয়ান একটা ছবি দেখেছিলাম। নায়ক এক এমএলএ’র গাড়ি থামিয়ে আহত একটা বাচ্চাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেই এমএলএ তো নায়কের উপর রেগে ভূত। পারে তো নায়ককে গাড়ি নেয়ার অপরাধে জেলে ঢোকায়। মাঝখানে দৃশ্যচিত্র পুরো উল্টো করে দেয় রিপোর্টাররা। তারা প্রচার করে, এমএলএ এতই মহানুভব যে, তিনি তার গাড়ি দিয়ে দিয়েছেন পথে আহত এক বাচ্চাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে। বেকুব পাবলিকও আবেগাকুল হয়ে পড়ে। তারা দাবী করে সেই এমএলএ কে মন্ত্রী করার। পাবলিক ডিমান্ড, সেই এমএলএ মন্ত্রী হয়ে যান।
বাস্তবের অবস্থাও তাই। সারাদেশের বাচ্চারা কলেজ-ভার্সিটিতে ভর্তি হবার সুযোগ পাচ্ছে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে শিক্ষাকে নির্লজ্জ ভাবে বাণিজ্যিক করা হয়েছে। নিম্নবিত্তের বাচ্চাদের কাছে শিক্ষা এক দুর্লভ বস্তু। টেনেমেনে প্রাথমিক, খুব উচ্চাকাঙ্খী হলে মাধ্যমিক। তারপর হয় দোকানের সেলমম্যান, না হয় বাসের হেলপার। বেশি হলে কোনো অফিসের পিওন। এমন ভয়াবহ কন্ট্রাস্টের মধ্যেও বিনোদন দেন দায়িত্বশীলরা। খুঁজেপেতে এক দরিদ্র পরিবারের সন্তানকে বের করে তার পড়াশোনার দায়িত্ব নেয়ার ঘোষণা দেন। একেবারে সাউথ ইন্ডিয়ান মুভি। চারিদিকে ধন্য ধন্য। অথচ যারা ধন্য ধন্য করে তাদের নিজের ছেলেটাই হয়তো বাসের হেলপারি করছে, বিক্রি করছে পান-বিড়ি কিংবা গলিতে মহল্লায় হাঁকছে পণ্যের নামে।
এই যে দায়িত্বশীলদের স্টান্টবাজি এতে মুভির মতনই রিপোর্টারদেরও বাস্তব ভূমিকা রয়েছে। তারা অসংখ্য মৌলিক অধিকার বঞ্চিতদের মধ্যে একজনকে নিয়ে ছবিসহ রিপোর্ট করে দেন। ব্যাস, আর কী লাগে। দায়িত্বশীলরা সেই রিপোর্টকে লুফে দেন। সেই অভাবী একজনের দায়িত্ব নেয়ার ঘোষণা দিয়ে লাখোজনকে সুযোগ বঞ্চিত করার পাপ স্খলনের কোশেস করেন। সেই রিপোর্টারও দুনিয়া বদলে দেয়ার আবেশে গোঁফে তা দেন। লাভও হয়। অফিসের বাহবা পান, দায়িত্বশীলদের কাছ থেকেও কখনো বকশিস। খুব যে বড় ধরণের লাভ তা নয়, সামান্যই। কুছ পরোয়া নেই। এদেশের সবাই শিব, অল্পতেই তুষ্ট।
৩
কথা প্রচলিত রয়েছে, বারো বছর শিক্ষকতা করলে নাকি ‘ইয়ে’ হয়ে যায়। কথাটা সবক্ষেত্রেই সত্যি নয়। আমার অনেক শিক্ষক ছিলেন, যারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শিক্ষকই ছিলেন, ‘ইয়ে’ হননি। আবার কথাটা একেবারে মিথ্যেও নয়। বারো বছর লাগে না, অনেকে ‘ইয়ে’ হয়েই শিক্ষকতায় ঢোকেন। কেন ‘ইয়ে’ হন বলছি। শিক্ষার সাথে নিজ ইচ্ছে ও আনন্দের একটা ব্যাপার রয়েছে। আমির খানের ‘থ্রি ইডিয়টস’ যারা দেখেছেন, তারা ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন সহজেই। আমির খান তার প্রিন্সিপাল ও কলেজ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এখান থেকে প্রতিবছর গাধা বের হয়’। কথাটা সর্বাংশে মিথ্যে নয়। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কথাই ধরা যাক। একটা ছেলে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়। চান্স হলেও হাতেগোনা কজন ছাড়া নিজের পছন্দমত বিষয় বেছে নেয়ার অধিকার পায় না। একটা ছেলে হয়তো ইংরেজি সাহিত্য পড়তে চাচ্ছে, কিন্তু ওকে দেয়া হয়েছে দর্শন। এখানেই ইচ্ছে ও পড়ার আনন্দটা মরে যায়। ফলে বাধ্য হয়েই পাশ করার জন্য পড়তে হয়। চাকরি তথা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা অর্জনই যার প্রধানতম লক্ষ্য। ফলে শিক্ষাটা শুধু খেয়ে-পরে বাঁচাতে পর্যবসিত হয়। এমন একটা ছেলে যখন শিক্ষক হয়, তখন তো সে ‘ইয়ে’ হবেই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায় আনন্দহীন শিক্ষার ব্যাপারটি। ইচ্ছে ও আনন্দের সমন্বয়হীন শিক্ষা নিয়ে যারা বেরোন তাদের লক্ষ্য শুধুই অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, খেয়ে-পরে বাঁচা। যারা আরেকটু উচ্চাভিলাষী তাদের লক্ষ্য বিসিএস। সরকারি চাকুরে হওয়ায় মজাই এখন আলাদা। অর্থনৈতিক থেকে সকল ধরণের নিরাপত্তা তাদের থাকে। যার ফলে অনেক চিকিৎসক, প্রকৌশলীকেও দেখা যায় নিজ পড়াশোনার সাথে যার দূরতম সম্পর্ক নেই, বিসিএস দিয়ে সেই চাকরি করতে। আজব না। আমি এমন অনেককেই জানি। তাদের মধ্যে একজনের কথা বলি, করেন পুলিশের চাকরি। কিন্তু তার মাথায় ঘোরে সবসময় পড়ানোর চিন্তা। শিক্ষকের মানসিকতা। চিন্তা করেন একটা ভালো স্কুলের, যেখানে ছেলেমেয়েরা সঠিক শিক্ষা পেতে পারে। লাভ কী, নিজে তো নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিয়েছেন পুলিশের চাকরি। তিনি তো আর শিক্ষার্থীদের উদাহারণ হতে পারবেন না। বলতে পারবেন না আনন্দময় শিক্ষা অর্জনের কথা। নৈতিক কারণেই পারবেন না।
শেষ কথা : যা লিখলাম তা সবই শিক্ষা সম্পর্কিত। জ্ঞান ও শিক্ষার প্রভেদ লেখার তিনটি ভাগেই রয়েছে। প্রথম ভাগে তা সরাসরি। আরেকটু সরাসরি বললে, বানরও শিক্ষিত হতে পারে। তাকে শিখিয়ে খেলা দেখানো যায়। খবরে দেখলাম একটা হাতিও ছবি আঁকতে পারে। কুকুরকে প্রশিক্ষিত করার ব্যাপারটা সবারই জানা। কিন্তু মানুষ হতে হলে জ্ঞানটা থাকতে হয়। জ্ঞান না থাকলে মানুষের ক্ষেত্রে শিক্ষাটা অর্থহীন।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন