বর্তমান সময়ে ব্যাটারি প্রযুক্তি নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে যেটা এর আগে কখনো এতোটা মনোযোগ পায়নি। ব্যাটারি বৈদ্যুতিক গাড়ির উন্নয়নের জন্য অন্যতম ‘বটলনেক’। ভবিষ্যতে আমরা জীবাশ্ম জ্বালানীর উপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে শক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারব কি না সেটা ব্যাটারির মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয়ের গবেষণার উপরে নির্ভর করছে। বৈদ্যুতিক গাড়িসহ শক্তির দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে হলে ভাল, টেকসই ব্যাটারি প্রযুক্তির বিকল্প নেই। আগামী দশ বছরে ব্যাটারি প্রযুক্তিতে অগ্রগতি এবং যুগোপযোগী আবিষ্কার না হলে বর্তমানের বৈদ্যুতিক গাড়ি নিয়ে উচ্চাশায় ভাটা নেমে আসবে।
ইতালিয়ান বিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টা ১৮০০ সালে প্রথম বিজ্ঞানের জগতে ব্যাটারির ধারণা দেন। ওনার আবিষ্কৃত বৈদ্যুতিক কোষ ভোল্টার বিদ্যুৎ কোষ নামে পরিচিত। এতে তিনি তামা এবং দস্তার পাতকে পরপর বসিয়ে স্তুপাকৃতি দেন। তামা আর দস্তার পাতের মাঝে লবণ-পানিতে চুবিয়ে রাখা কাঠের টুকরা ব্যবহার করেন। তারপরে সেটাকে একটা মৃত ব্যাঙের সাথে সংযোগ করলে মৃত ব্যাঙটি নড়েচড়ে ওঠে।
ব্যাটারি প্রযুক্তিতে এখনো ভোল্টার দেখানো সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। সাধারণত এতে একটা পজিটিভ আর নেগেটিভ প্রান্ত থাকে যাদেরকে ইলেকট্রোলাইট নামক দ্রবণ দিয়ে সংযুক্ত করা হয়। ভোল্টাকে সম্মান দেখাতে বিদ্যুতের শক্তি বুঝাতে ভোল্ট একক ব্যবহার করা হয়।
ভোল্টার বিদ্যুৎ কোষের পরে এখন পর্যন্ত মোট চার প্রকারের ব্যাটারি আবিষ্কৃত হয়েছে যেগুলোর বাণিজ্যিক গুরুত্ব আছে,যেগুলোকে রিচার্জ করা যায়। এগুলো হলো, লেড এসিড, নিকেল ক্যাডমিয়াম, নিকেল ধাতব হাইড্রাইড এবং লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি। এই ব্যাটারিগুলোর আবিষ্কার এবং বাণিজ্যিকীকরণের পেছনে অনেক শ্রম ও অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে।
ভোল্টার বিদ্যুৎ কোষের পরে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বহুল ব্যবহৃত প্রযুক্তি হলো লেড-এসিড ব্যাটারি প্রযুক্তি। আধুনিক সকল গাড়িতে একটি করে লেড-এসিড ব্যাটারি আছে, যেটি ছাড়া গাড়ি অচল। যত দামী আর লাক্সারি গাড়ি হোক না কেন সেটাকে একটা লেড ব্যাটারি দিয়ে ইঞ্জিন চালু করতে হয়। বাংলাদেশে রহিম আফরোজ, নাভানা এসব কোম্পানি লেড এসিড ব্যাটারি বানায় যেটা গাড়ি, ইউপিএস, সৌর বিদ্যুৎ সংরক্ষণ, টেলিগ্রাফ, টেলিফোনের লাইনে ব্যবহার করা হয়।
লেড ব্যাটারিতে পজিটিভ আর নেগেটিভ দুটোই সীসা দিয়ে তৈরি। একটাতে থাকে সীসার পাত, আরেকটাতে সীসার যৌগ, লেড অক্সাইডের পাত। এদেরকে যখন পরপর সাজিয়ে তাতে সালফিউরিক এসিডের জলীয় দ্রবণ বা ইলেক্ট্রোলাইট দেয়া হয় তখন ব্যাটারি কাজ করে। লেড ব্যাটারি অনেক দিন কাজ করতে পারে, কিন্তু অনবরত চার্জ আর ডিসচার্জ করার ফলে একসময় সীসার পাতগুলো ক্ষয়ে আসে তখন ব্যাটারি পাল্টাতে হয়। লেড-এসিড ব্যাটারি গাড়ির জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় উপাদান হলেও সীসা দূষণের কারণে উন্নত বিশ্বে এটি উৎপাদন করা হয় না। তারা এসব ডার্টি প্রযুক্তি তৃতীয় বিশ্বের গরীব দেশে তৈরি করিয়ে নেয়।
লেড-এসিড ব্যাটারির পরে আসল নিকেল-ক্যাডমিয়াম ব্যাটারি। কিন্তু ক্যাডমিয়াম থেকে ক্যান্সার ছড়ানোর কারণে মানুষ এই প্রযুক্তি থেকে সরে আসে। তারপরে নিকেল ধাতব হাইড্রাইড ব্যাটারি জনপ্রিয় হয়। তবে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি আসার পরে গুনে-মানে ভালো হওয়ায় মানুষ সেটাতে ঝুঁকে পড়ে। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি আবিষ্কারের জন্য ২০১৯ সালে বিজ্ঞানী John B. Goodenough, M. Stanley Whittingh এবং Akira Yoshino কে রসায়নে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়।
প্রথম দিকে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির দামও অনেক বেশি ছিল, কিন্তু ৯০ এর দশকে ব্যাপক হারে ব্যাটারি উৎপাদন শুরু হলে দাম কমে আসে। তারপরে কোবাল্ট আর নিকেলের দাম কমে যাওয়ায় অনেকদিন ব্যাটারির দাম কমেনি। ২০১০ সালের দিকে এসে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার বাড়ার কারণে ব্যাটারির দাম কমে আসে।
লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিঃ
যে কোন ব্যাটারি যাতে শক্তির পরিবাহক হিসেবে লিথিয়াম আয়ন ব্যবহার করা হয় তাদেরকে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি বলা যাবে। লিথিয়াম আয়ন বলতে বুঝায় লিথিয়াম ধাতুর আয়নিক রূপ। সাধারণত ধাতব আয়ন পজিটিভ হয় সেজন্য লিথিয়াম আয়নও ধনাত্মক, এরা ব্যাটারিতে শক্তির পরিবাহক হিসেবে কাজ করে। ব্যাটারি যখন চার্জ বা ডিসচার্জ হচ্ছে না তখন এসব পরিবাহকের একটা থাকার জায়গা দরকার সেগুলো হলো ব্যাটারির পজিটিভ এবং নেগেটিভ প্রান্ত। লিথিয়াম আয়ন ছাড়াও পজিটিভ ও নেগেটিভ প্রান্তের নামানুসারে তারা আরো অনেক নামে পরিচিত যেমন, “LFP,” “NCA,” “NCM” ইত্যাদি।
লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি চার্জের সময় সাধারণত লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির পজিটিভ প্রান্তের ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে, আর ডিসচার্জের সময় নেগেটিভ প্রান্তের ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে। এই প্রক্রিয়ায় নতুন কোন রাসায়নিক বন্ধন ভাঙে বা তৈরি হয় না, ফলে উভয়মুখী এই প্রক্রিয়া অনেকবার চলতে পারে। একটা উদাহরণের সাহায্যে ব্যাপারটা ভালোভাবে বুঝা যেতে পারে।
ব্যাটারির পজিটিভ প্রান্ত যেটাকে বলা হয় এনোড সেটাকে যদি একটা মিলনায়তন হিসেবে কল্পনা করা যায় তাহলে চার্জের সময় লিথিয়াম আয়নগুলো এনোডের সেই মিলনায়তনে গিয়ে বিশ্রাম নেয়। আবার একই হলের আরেক প্রান্তে যদি ক্যাথোডের একটা মিলনায়তন থাকে তাহলে ডিসচার্জের সময় লিথিয়াম আয়নগুলো সেখানে গিয়ে বিশ্রাম নেয়।
লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিতে এনোড হিসেবে এখন পর্যন্ত একটা বস্তুই সবচেয়ে কার্যকর সেটি হলো গ্রাফাইট, কার্বনের একটা রূপ। বাজারের শতকরা ৯৯ ভাগ ব্যাটারি গ্রাফাইটের কোন একটা রূপ ব্যবহার করে থাকে। অপরদিকে ক্যাথোড বা ঋণাত্মক প্রান্তের জন্য দুটি গ্রুপ আছে। প্রথমটি হলো, বেশি ভোল্টেজ, উচ্চ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন নিকেল কোবাল্ট এলুমিনিয়াম (NCA), অথবা নিকেল কোবাল্ট ম্যাঙ্গানিজ (NCM)। আর দ্বিতীয় প্রকারের ক্যাথোড হলো, নিম্ন ভোল্টেজ, এবং নিম্ন ধারণ ক্ষমতার লিথিয়াম আয়রণ ফসফেট (LFP)। নিকেল এবং কোবাল্ট ধাতুর দাম বেশি হলেও লোহার ব্যাটারির চেয়ে আকারে ছোট এবং উচ্চ ধারণ ক্ষমতার কারণে চুড়ান্ত বিচারে সমপরিমাণ শক্তির জন্য দামে শস্তা। সেজন্য ব্যাটারি কোম্পানিগুলো নিকেল ও কোবাল্ট দিয়ে ব্যাটারি বানাতে বেশি আগ্রহী। কোবাল্ট মাইনিং এবং সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় শিশু শ্রমের ব্যবহার পরিবেশ দূষণ ও অনেক মানুষের জীবনহানি ঘটলেও লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির প্রযুক্তি কোবাল্টের উপর নির্ভরশীল।
লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিকে শক্তি এবং ক্ষমতার ভিত্তিতে দু’ভাবে ভাগ করা যায়। বেশিরভাগ ব্যাটারিকে এই দুটি পরিমাপক দিয়ে বিচার করা যায়। কিছু ব্যাটারি আছে যেগুলো দামে কম এবং বেশি শক্তি সঞ্চয় করতে পারে, যেমন প্যানাসনিক ব্যাটারি এগুলোকে বলা যেতে পারে শক্তি সঞ্চয়ী কোষ। আবার কিছু ব্যাটারি আছে যাদের বেশিবার রিচার্জ করা যায়, এবং তাড়াতাড়ি রিচার্জ করা যায়, যেমন CATL এর লিথিয়াম আয়রন ফসফেট ব্যাটারি, এগুলোকে বলা যেতে পারে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কোষ। আরো ছোটখাটো অনেক বিষয় আছে যেগুলো নিয়ে কাজ করা যায়। মোট কথা ব্যাটারির ক্ষেত্রে আপনাকে শক্তি সঞ্চয় এবং ক্ষমতা এই দুইটার মধ্যে একটা সন্ধি স্থাপন করতে হবে। বেশি পরিমাণে শক্তি চাইলে সেটা চার্জ করতে বেশি সময় লাগবে। আবার তাড়াতাড়ি চার্জ করতে চাইলে সেটাতে বেশি শক্তি সঞ্চয় করা যাবে না। এদের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য, মধ্যবর্তী অবস্থান বের করা নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে, সমস্যা হলো কোন একটা ভালো দিক নিলে সেটার সাথে সংশ্লিষ্ট খারাপ কিছু বিষয়ও চলে আসে, ইউ ক্যান্ট গেট দ্য বেস্ট অফ দ্য টু ওয়ার্ল্ড।
শক্তি সঞ্চয়ী ( Energy Cell) ব্যাটারিঃ
আজকের শক্তি সঞ্চয়ী ব্যাটারির অনেকগুলো ভালো গুনাবলী আছে যেমন প্রতি লিটারে ৭২০ ওয়াট-ঘন্টা শক্তির ঘনত্ব, কিলোওয়াট-ঘন্টার উৎপাদন খরচ ১০০ ডলারের কাছাকাছি। কিন্তু এসব ব্যাটারি ৫০০০ বার চার্জ-ডিসচার্জ করা যায় না। ১০০০ বার চার্জ-ডিসচার্জ করার পরে ব্যাটারি ক্ষয় হয়ে আসে। এর মানে হলো প্রতিবার চার্জে একটা বৈদ্যুতিক গাড়ি যদি ২০০ থেকে ৩০০ মাইল যেতে পারে তাহলে ক্ষয় হবার আগে একটা ব্যাটারি দিয়ে সর্বোচ্চ ২ থেকে ৩ লাখ মাইল যাওয়া যাবে। বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্ষেত্রে এসব ব্যাটারিতে সাধারণত NCA বা NCM ক্যাথোড ব্যবহার করা হয়। নিকেল কোবাল্ট ম্যাঙ্গানিজের ক্ষেত্রে NCM-622 বা NCM-811 ব্যবহার করা হয় যেখানে সংখ্যাগুলো যথাক্রমে ধাতুগুলোর অনুপাতের সমান। ৮ঃ১ঃ১ অনুপাতে ৬ঃ২ঃ২ অনুপাতের চেয়ে কম কোবাল্ট ব্যবহার করা হয়। এনোডের জন্য সবাই গ্রাফাইট ব্যবহার করে। বর্তমানে সবচেয়ে ভালো শক্তি সঞ্চয়ী ব্যাটারি হলো Panasonic 2170 টেসলা কোম্পানি যেটা ব্যবহার করে। এতে ক্যাথোডের ধারণক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নিকেলের সর্বোচ্চ পরিমাণে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া এনোডেও গ্রাফাইটের সাথে ৫% সিলিকন মেশানো হয়। এসব কারণে ব্যাটারির শক্তি সঞ্চয় ক্ষমতা অনেক বাড়ে এবং সঙ্গত কারণে দামেও কম হয়। কিন্তু ব্যাটারির ডিজাইনে শক্তি সঞ্চয়ের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়ায় ব্যাটারির জীবন চক্র ও চার্জ করার ক্ষমতা কমে আসে।
দ্রুত চার্জ করার ক্ষমতাসম্পন্ন ( Power Cell) ব্যাটারিঃ
দ্রুত চার্জ করা যায় এমন ব্যাটারিগুলো জীবনচক্রে ৫০০০ হাজার বার চার্জ-ডিসচার্জ এর মধ্য দিয়ে যেতে পারে এবং চার্জ করতে মাত্র ১০ মিনিট সময় লাগে। কিন্তু এসব ব্যাটারির দাম শক্তি সঞ্চয়ী ব্যাটারির চেয়ে শতকরা ২৫ থেকে ৫০ ভাগ বেশি এবং শক্তির ঘনত্বের দিক থেকেও অনেক কম, প্রতি লিটারে মাত্র ৪৫০ ওয়াট-ঘন্টা। এই ব্যাটারিগুলোতে নিকেল কোবাল্টের বদলে আয়রণ ফসফেট ব্যবহার করা হয়। আগের মিলনায়তনের উদাহরণের মতো করে বলা যায়, এক্ষেত্রে মিলনায়তনের আকার একই কিন্তু সিট সংখ্যা অনেক কম এবং পাশাপাশি সিটের মধ্যে অনেক ফাঁকা জায়গা। যার ফলে লিথিয়াম আয়নগুলো খুব দ্রুত মিলনায়তনে ঢুকে সিটে বসে যেতে পারে। সিট সংখ্যা যেহেতু কম সেজন্য তাদের চার্জও কম। দামে বেশি এবং চার্জ ঘনত্ব কম হওয়া সত্ত্বেও চিনের বৈদ্যুতিক গাড়িগুলোতে তাড়াতাড়ি চার্জ হওয়া ব্যাটারির চাহিদা বেশি। ব্যাটারি হিসেবে নিম্নমানের হলেও লোহার ব্যাটারি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, নিকেল আর কোবাল্টের দাম এবং দুষ্প্রাপ্যতা এর অন্যতম কারণ। আগামী ১০-২০ বছরে কোবাল্টের খনিগুলো থেকে ভালো মানের আকরিক শেষ হয়ে যাবে। সামনের দিকে এসব ধাতুর দাম আরো বাড়বে যেটা ব্যাটারির দাম বাড়িয়ে দিবে। তাছাড়া লোহার ব্যাটারিতে নিকেল কোবাল্ট ব্যাটারির চেয়ে আগুন ধরার সম্ভাবনা কম। এসব কিছু মিলিয়ে ভবিষ্যতে হয়ত লোহার ব্যাটারির দাম কমে আসবে এর সাথে যদি এক ব্যাটারি দিয়ে ৫০০০ বার চার্জ-ডিসচার্জ করে ১০ লাখ মাইল গাড়ি চালানো যায় তাহলে ভবিষ্যতের বাজারে এই ব্যাটারির চাহিদা বাড়বে।
লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির সীমাবদ্ধতাঃ
বর্তমানে একটা লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি থেকে ১০০ ডলারে এক কিলোওয়াট-ঘন্টার বিদ্যুৎ সঞ্চয় করা যাবে, যাতে শক্তির ঘনত্ব প্রতি লিটারে ৭২০ ওয়াট-ঘন্টা, ব্যাটারির আয়ু ১০ বছর, মোট ৫০০০ বার চার্জ এবং ডিসচার্জ করা যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো কোন ব্যাটারি এই সবগুলো কাজ একসাথে করতে পারবে না। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির সমস্যা হলো কোন ব্যাটারি একদিকে ভালো হলে আরেকদিকে খারাপ হবে। সেজন্য একধরণের ব্যাটারির সাথে অন্যধরণের ব্যাটারির তুলনা করা ঠিক না।
ব্যাটারি উৎপাদনে সবচেয়ে বড় বাধা এর মূল্য, প্রতি কিলোওয়াট-ঘন্টা শক্তির জন্য যত কম খরচ হবে ততো ভালো। বিশেষ করে বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্ষেত্রে এটা বেশি সত্য। ব্যাটারির আয়ু এবং শক্তি ধারণ ক্ষমতা কিছু কম-বেশি হলে সেটা মানিয়ে নেয়া যাবে, কিন্তু শক্তি সঞ্চয়ের খরচ কমে আসলে সেটা হবে সবচেয়ে বড় উন্নয়ন। কারণ বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্য প্রতি কিলোওয়াট-ঘন্টা ($/kWh) শক্তির মূল্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বড় খরচ। ব্যাটারির উপরে গাড়ির দূরপাল্লার দূরত্ব, রিচার্জের সময়, নিরাপত্তা, মূল্য ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো জড়িত। বর্তমানে ব্যাটারিতে শক্তির ঘনত্ব বাড়ানোর জন্য গবেষণা চলছে, যেটা পরিমাপ করার অন্যতম পরিমাপক হলো কিলোওয়াট হিসবে ব্যাটারির দাম কমছে কি না সেটা দেখা।
নেক্সট জেনারেশন লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির উন্নয়নে গবেষণাঃ
লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির দক্ষতা বাড়াতে হলে চারটি বিষয় নিয়ে গবেষণার দরকার, এনোড, ক্যাথোড, ইলেক্ট্রোলাইট এবং সেপারেটর।
এনোড গবেষণাঃ
বর্তমান প্রযুক্তিতে ব্যাটারিতে গ্রাফাইটের ব্যবহার অন্যতম একটা দূর্বল দিক, কারণ অন্যান্য উপাদানের চেয়ে গ্রাফাইট ব্যাটারিতে অনেক জায়গা দখল করে। গ্রাফাইটের বদলে সিলিকন এনোড হতে পারে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির জন্য বড় একটা পরিবর্তন। এতে শক্তির ঘনত্বও বাড়বে এবং ব্যাটারির দামও কমে আসবে।
সিলিকন লিথিয়াম আয়নকে নিজের মধ্যে স্থান দেয় না বরং সিলিকন লিথিয়ামের একধরণের সংকর তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ায় চার্জ আর ডিসচার্জ প্রক্রিয়ায় রাসায়নিক বন্ধন ভাঙে ও তৈরি হয়। রাসায়নিক বন্ধন ভাঙতে ও তৈরি করতে অনেক শক্তির প্রয়োজন হয় এবং সে কারণে বেশি শক্তি সঞ্চয় করা সম্ভব।
একটা সিলিকন পরমাণু চারটা লিথিয়াম আয়নকে জায়গা দিতে পারে, অপরদিকে চারটি লিথিয়াম আয়নকে জায়গা দিতে মোট ২৪ টি কার্বনের প্রয়োজন হবে। এর মানে সিলিকন বেশি পরিমাণে লিথিয়ামকে ধারণ করতে পারে ফলে ব্যাটারিকে আকারে ছোট করা সম্ভব।
সিলিকন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো চার্জ করার সময় সিলিকন ব্যাটারি ফুলে-ফেঁপে তিনগুন বড় হবে, আবার ডিসচার্জের সময় তিনগুন ছোট হবে। কার্বনের বেলায় সেট মাত্র ৭%। ব্যাটারির এই ফুলে যাবার ব্যাপারটা এখন পর্যন্ত গ্রাফাইটকে সরিয়ে সিলিকন ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা হয়ে আছে।
বর্তমানে ব্যাটারি প্রযুক্তিতে গ্রাফাইটের সাথে শতকরা ৫ ভাগ পর্যন্ত সিলিকন মিশিয়ে ব্যাটারির শক্তি ঘনত্ব কিছুটা বাড়ানো হচ্ছে। এর বেশি বাড়াতে ব্যাটারির আয়ু কমে যায়। সিলিকনের ফুলে ওঠা নিয়ন্ত্রণে রাখতে নতুন ডিজাইন এবং নতুন ধরণের কণিকার প্রয়োজন যার ভেতরে সিলিকন ফুলে উঠবে কিন্তু ব্যাটারির আকার পরিবর্তিত হব না। এরজন্য অনেক গবেষণার প্রয়োজন এবং ব্যাটারির উপাদানগুলোকে অবশ্যই সহজপ্রাপ্য হতে হবে।
ক্যাথোড গবেষণাঃ
বর্তমানে ক্যাথোড গবেষণার অন্যতম ফোকাস এতে নিকেল এবং কোবাল্টের পরিমাণ কমানো। এতে করে ব্যাটারির দক্ষতা হয়ত আরো ৫% ভাগ বাড়ানো যাবে। বড় ধরণের পরিবর্তনের জন্য আমাদের বর্তমান প্রযুক্তি অর্থাৎ ক্যাথোডে লিথিয়াম আয়ন প্রবিষ্ট করা থেকে বেরিয়ে রাসায়নিক বন্ধন সৃষ্টির দিকে যেতে হবে। মানে এনোড প্রযুক্তিতে সিলিকন যেই কাজ করছে ক্যাথোডেও সেই কাজটা করতে হবে। বর্তমানে গ্রাফাইট এনোড খুবই দূর্বল সেজন্য ক্যাথোডের গবেষণাও আরো এগিয়ে নেয়া সম্ভব হচ্ছে। সিলিকন এনোডের গবেষণা কিছুটা এগিয়ে গেলে ক্যাথোড নিয়ে আরো গবেষণা সম্ভব হবে। উন্নত ক্যাথোড এবং এনোড যোগ করে তখন বর্তমানের দ্বিগুণ শক্তি ঘনত্ব, প্রতি লিটারে ১৪০০ ওয়াট-ঘন্টা উৎপাদন করা সম্ভব।
ভবিষ্যতে ধাতব ফ্লোরাইড যেমন আয়রণ ফ্লোরাইড, কপার ফ্লোরাইড ভিত্তিক ক্যাথোড বাজারে আসতে পারে এছাড়া সালফার যৌগও ক্যাথোড হিসেবে আসার সম্ভাবনা আছে।
ক্যাথোড, এনোড ছাড়াও ব্যাটারির ইলেক্ট্রোলাইট এবং পৃথকীকরণের উপাদানগত পরিবর্তন আসবে। বর্তমানে বারবার চার্জ এবং ডিসচার্জের কারণে ইলেক্ট্রোলাইট ভেঙে যায় এবং ক্যাথোড ও এনোডের গায়ে একটা নিষ্ক্রিয় স্তর তৈরি করে যার কারণে ইলেক্ট্রোলাইট কম নষ্ট হয়। ভবিষ্যতে নতুন ধরণের ইলেকট্রোলাইট বের হবে যেটা সহজে নষ্ট হবে না এবং ক্যাথোড ও এনোডের গায়ে স্থায়ী নিষ্ক্রিয় স্তর গঠন করবে যাতে করে ব্যাটারি আরো বেশিদিন টিকবে।
বর্তমানে ব্যবহৃত পলিমারের পর্দার বদলে সিরামিকের ব্যবহার বাড়বে। সিরামিকের তাপ সহনশীলতা, উচ্চ চাপ সহ্য করার ক্ষমতা এবং বিশেষ গঠন ব্যাটারিকে আরো নিরাপদ, শক্তিশালী ও দ্রুত চার্জ করতে সহায়তা করবে।
ব্যাটারি গবেষণার একটা বড় সুবিধার দিক হলো এই সকল প্রযুক্তি আবিষ্কারের সাথে সাথেই গাড়ির ব্যাটারিতে প্রয়োগের দরকার পড়বে না। তার আগে দৈনন্দিন ব্যবহৃত সামগ্রীতে ব্যবহার করে সেগুলোকে পরীক্ষা করা হবে, যেটা গবেষকদের সঠিক পথ দেখাতে সাহায্য করবে। উন্নত ব্যাটারির জন্য বস্তুগত উন্নয়নের সাথে সাথে ব্যাটারি নির্মাণ প্রক্রিয়াতেও উন্নয়নের প্রয়োজন হবে। বর্তমানে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে মোট তিনভাগে ভাগ করা যায়, এনোড-ক্যাথোড বা ইলেক্ট্রোড প্রস্তুতি, ব্যাটারির কোষ তৈরি, এবং চার্জ-ডিসচার্জ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোয়ালিটি চেক করে ফিনিশিং। পুরো প্রক্রিয়া সমাপ্ত হতে অনেক সময় লাগে এবং এতে অনেক জৈব দ্রাবক ব্যবহার করা হয় যেটা কমিয়ে আনতে হবে। বর্তমানে প্রচলিত উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যাটারির ডিজাইন থেকে শুরু করে এসেম্বলি সব জায়গাতে অনেক ধরণের উন্নয়ন সম্ভব। আগামী ১০ বছরে সেটা সম্পন্ন হবে বলে আশা করা যায়।