১
১২০৭ বার পঠিত
সেদিন কথায় কথায় উচ্চারণ (যাকে ইংরেজিতে বলি accent) নিয়ে কথা হচ্ছিল। মনে পড়ল ১৯৯০ সালে যখন প্রথম পশ্চিমবঙ্গে বেড়াতে যাই, সেসময় বাঙালদের ঘটি উচ্চারণে কথা বলা রপ্ত করার কসরত দেখে খুব ব্যথিত হয়েছিলাম। ১৯৭১-এর পরে বাংলাদেশ থেকে যারা পশ্চিমবঙ্গে গেছেন তাদের সবসময় একটা অবৈধতা কিংবা অনুপ্রবেশের ভয় কাজ করে। তাই মূলস্রোতে মিশে যা’বার প্রয়াসে অনেকেই এ উচ্চারণ রপ্তের পাহাড়সমান প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। এটা সবসময় যে সুখকর হয় সেটা বলা যাবে না। বিশেষত মালদা-দিনাজপুর কিংবা শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি অঞ্চলে কিছুটা কাছাকাছি পৌঁছা গেলেও দক্ষিণের জেলাগুলো বিশেষত কলকাতায় যে কতো দুরূহ সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কারো পক্ষে অনুমান করাও সম্ভব নয়।
অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষকেও দেখেছি জন্ম পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু বাবা-মা পূর্ববঙ্গের। বাড়িতে পূর্ববঙ্গের উচ্চারণে কথা বলেন, বাইরে কলকাতার উচ্চারণে। তবুও কী সঠিক উচ্চারণে বলা যায় সবসময় ঘটিদের মতো ঠিকঠাক?
এক ঢাকাইয়া কাম কলকাত্তাইয়া্র অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রচলিত কৌতুকটির মতো, ‘সন্ধ্যায় গঙ্গার ধার দিয়ে হাঁটছিলুম। এক পছলা ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি নাবলো, কাদা হয়ে গেল চলার পথটুকুন। হঠাৎ পা দু’টো কাদায় হান্দাইয়া গেল‘।
সেদিন কৌতুকটি যখন বলছিলাম, পাশেই ছিলেন বাংলাদেশের এক বিখ্যাত সাহিত্যিক ও গবেষক। তিনি বললেন,
“তোমার এ ‘হান্দাইয়া‘ শব্দটি তো আগে শুনিনি”।
এটি বৃহত্তর ঢাকা বিশেষত পুরানো ঢাকা, বিক্রমপুর, নবাবগঞ্জ, ধামরাই, মানিকগঞ্জ অঞ্চলের একটি বহুল প্রচলিত আঞ্চলিক শব্দ। শব্দটির উৎপত্তি আমার মতে সিঁধানো ( যেমন সিঁধেল চোর, মানে সিঁধ কেটে যে চোর ঘরে ঢুকে)>> সাঁন্ধানো>> হান্দানো>> হান্দাইয়া… এরকমভাবে এসেছে। তাই বলে ঢুকে যাওয়া আর সিঁধে যাওয়া বা হান্দাইয়া যাওয়া কিন্তু এক নয়। আঞ্চলিক শব্দগুলো ব্যবহারের তাৎপর্য মনে হয় এখানেই।
যেমন, বরিশাল অঞ্চলের একটি শব্দ ‘চ্যানো‘, মানে জা্নো। কিন্তু যখন কেউ রাগান্বিত হয়ে বলে , ‘হালাপু হালা, তুই মোরে চ্যাআনো?’ চ্যানো শব্দটির উচ্চারণে এমনভাবে জোর দেয়া হয় যে, যাকে বলে তার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। সাধারণ ‘জানো‘ শব্দের অর্থ থেকে যোজন দূরে এই ‘মোরে চ্যাআনো‘ এর অবস্থান।
তেমনি ‘হান্দাইয়া‘ শব্দটিও। ধামরাই অঞ্চলে এক পাগল ছিল। সে সাপ্তাহিক হাটবারে হাটে গিয়ে ঝোলাগুড়ের হাঁড়িতে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে পাশের মুড়ির দোকানের মুড়ির বস্তায় সে গুড়মাখানো হাতখানি ঢুকিয়ে দিয়ে বলতো,
“ভয় পাইলেই ভয়, হান্দাইয়া দিলে আর কীসের ভয়?”
অর্থ্যাৎ পুরোহাতে ঝোলাগুড়ের সাথে যে মুড়ি লেগে এসেছে, তা তার পেটের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য প্রয়োজন ছিল। ভয়ে সে মুড়ি কিংবা গুড় চুরি করে খেতে ভয় পাচ্ছিল কিন্তু নিরুপায় হয়ে সে ঝোলাগুড় ও মুড়ির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে মানে ‘হান্দাইয়া‘ দিয়ে সে ভয় কাটিয়েছে। অর্থ্যাৎ সাধারণ ঢুকানো অর্থে নয় ‘নিরুপায় হয়ে ঢুকিয়ে দেয়া মানেই হান্দানো‘।
মনে পড়ে তখন অভিবাসী হয়ে নতুন এসেছি। কর্মসংস্থান ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মহাসঙ্কটে নিমজ্জিত সবাই। পুরানো ঢাকার আমার এক বন্ধু মাঝে মধ্যেই ফোন করে বলে,
“গেল সপ্তাহে আর একটি নতুন চাকুরিতে হান্দাইয়া গেলাম।”
অর্থ বুঝে নিই আমি, বন্ধুর অসহায়ত্ব এবং হতাশা এই একটিমাত্র আঞ্চলিক শব্দেই ফুটে ওঠে।
এরকম অনেক অনেক শব্দের অপার অসীম প্রকাশ ক্ষমতা আছে। কিন্তু মূল সমস্যা হলো ‘ইয়ে‘ এবং যথাস্থানে ‘ইয়ে‘; তা হোক না সেটা আঞ্চলিক কিংবা মৌলিক (?) যে কোন ধরনের শব্দই!
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
আগস্ট ২৯, ২০১৭; ৫:৩১ পূর্বাহ্ন
ভালো লাগলো। বিনোদনও বটে। অনেক ধন্যবাদ লেখককে।