বর্তমান দুনিয়ায় চালু অর্থনৈতিক তত্ত্বের নাম নিওলিবারেলিজম বা নব্য উদারনীতিবাদ। এ নীতির মূল কথা হলো, অর্থনৈতিক উদারীকরণ, ব্যক্তি মালিকানার প্রসার, সরকারের ব্যয় হ্রাস, নাগরিকদের অর্থনৈতিক কৃচ্ছতা সাধন, নাগরিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা জাল অপসারণ, অবাধ মুক্ত বাণিজ্য, শিল্প-বানিজ্য নীতির উদারীকরণ।
১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোর অর্থনীতি বিভাগ তাদের নব্য উদারনীতিবাদী অর্থনৈতিক তত্ত্বের প্রচার ও প্রসারের কারনে সারা দুনিয়ায় বিখ্যাত হয়। ১৯৬৯ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরষ্কার প্রবর্তনের পর থেকে শিকাগো অর্থনীতি স্কুলের অনুসারীদের মধ্য থেকে ৩০ জনের মত অর্থনীতিতে নোবেল পুরষ্কার পান। অবস্থাদৃষ্টে এটা মনে হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয় যে, শিকাগো স্কুলের অনুসারীদের পুরষ্কার দেবার জন্যই যেন অর্থনীতিতে নোবেল পুরষ্কারের প্রবর্তন করা হয়। এদের মধ্যে ফ্রেডারিক হায়েক, মিল্টন ফ্রিডম্যান, জর্জ স্টিগলার, জেমস বুকানন এর নাম উল্লেখযোগ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রোনাল্ড রেগান এবং ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচার ক্ষমতা নেবার পরে উন্নত বিশ্বে তাদের অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়নের ফলে তাদের প্রভাব বাড়ে।
১৯৪০ সালের আগে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা ব্রিটিশ উদারনীতিবাদী অর্থনীতিক এডাম স্মিথ, জেরেমি বেন্থাম, জন স্টুয়ার্ট মিল এদের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু ৮০’র দশকে এসে তারা অর্থনৈতিক উদারতাবাদী (লিবারটারিয়ান) ফ্রেডারিক হায়েক এবং মিল্টন ফ্রিডম্যানের অনুসারী হয়। স্মিথের উদারনীতিবাদ সময়ে সময়ে অর্থনীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপের বিধান রাখে, বিশেষ করে অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতের উন্নয়ন, শিল্প, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের চর্চা বজায় রাখতে সরকারের হস্তক্ষেপ কাম্য বলে মনে করা হয়। যেমন, ১৯৪০ সালেও শিকাগো স্কুল সম্পত্তির পূনর্বিনিময় করে যাতে নাগরিকদের সবাই মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে জীবন মানের একটা স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখতে পারে এমন নীতির সমর্থক ছিল। চল্লিশের দশকে শিকাগোর অর্থনীতিবিদ হেনরি সিমন্স দেখিয়েছেন একটা মুক্ত,স্বাধীন সমাজের জন্য সম্পত্তির বন্টন এবং সমাজে অর্থনৈতিক ক্ষমতার পূনর্বিন্যাস করে বেশি মানুষের অংশগ্রহণ ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার ভাগীদার হওয়া অত্যন্ত জরুরি। এমনকী হায়েক পর্যন্ত তার ১৯৪৪ সালের বই ‘দ্য রোড টু সার্ফডোম’ এ পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ এবং রাষ্ট্রচালিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী সমর্থন করেন। কিন্তু ৪০ ও ৫০ এর দশকের প্রভাবশালী অর্থনীতির পন্ডিতেরা অবসরে গেলে হায়েক এবং ফ্রিডম্যান দুজনেই তাত্ত্বিকভাবে কট্টর উদারতাবাদীতে পরিণত হন। তাদের প্রবর্তিত নব্য উদারনীতিবাদে রাষ্ট্র অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে কোন হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, অর্থনীতির সকল খাতে ব্যক্তি মালিকানার প্রাধান্য থাকবে।
চিত্রঃ নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান।
শিকাগো অর্থনীতি স্কুলের ফ্রিডম্যান শিষ্যদের তত্ত্বের প্রথম প্রয়োগ হয় লাতিন আমেরিকার দেশ চিলেতে। সেখানে প্রথম অর্থনৈতিক উদারনীতিবাদ চালু করার জন্য বড় ধরনের ‘শক’ বা ‘ক্রাইসিস’ এর সময়কে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত নিওলিবারেল অর্থনীতির বর্ণনায় সবাই রেগান বা থ্যাচারের কথা বলে, চিলের কথা এড়িয়ে যায়। গত শতাব্দীর ৫০ এবং৬০ এর দশকে লাতিন আমেরিকাতে চিলি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছিল, সরকার স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং শিল্পখাতে বিনিয়োগ করছিল। আমেরিকান কর্পোরেট এতে শংকিত হয়। এর প্রতিকার করতে আমেরিকার পররাষ্ট্র বিভাগের পরামর্শে চিলে এবং দক্ষিণ আমেরিকার নানা দেশ থেকে ছাত্রদের মিল্টন ফ্রিডম্যানের ফ্রি মার্কেট অর্থনীতি শেখাতে আমেরিকাতে পড়াশোনার সুযোগ দেয়া হয়। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে রকফেলার ফাউন্ডেশান ও ফোর্ড ফাউন্ডেশান অর্থ বিনিয়োগ করে। প্রকল্পের অংশ হিসেবে চিলের ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটির সাথে আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তি সম্পাদিত হয়। ছাত্ররা শিকাগো এসে অর্থনীতিতে পিএইচডি করে চিলেতে ফেরত যায়, তারপর সান্টিয়াগোর ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয় চিলের ‘লিটল’ শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়। শিকাগো ফেরত এসব অর্থনীতিবিদেরা ‘শিকাগো বয়েজ’ নামে পরিচিত। এ প্রোগ্রামের দায়িত্বে থাকা আরনল্ড হারবার্জার এসব অর্থনীতিকদের বর্ণনা করেন, ‘seriously dedicated missionaries’ হিসেবে।
১৯৭০ সালে সালভাদোর আয়েন্দে চিলের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভ করে দেশের বড় বড় এবং ভারী শিল্পগুলোকে জাতীয়করণের চেষ্টা চালান। তখন চিলের ফোন কোম্পানি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আইটিটি কর্পোরেশানের। লাতিন আমেরিকাতে কম্যুনিজমের প্রসারে আমেরিকা শংকিত হয়ে পড়ে। প্রথমে সিআইএ আয়েন্দেকে ক্ষমতা গ্রহন থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে। তাতে ব্যর্থ হয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন চিলির অর্থনীতি স্থবির করে দেবার নির্দেশ দেন, এবং সামরিক ক্যু এর আয়োজন শুরু হয়। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে চিলেতে ‘শিকাগো বয়েজ’রা কাজে নেমে পড়ে, তারা তাদের অর্থনৈতিক নীল-নকশার বর্ণনা দিয়ে ‘দ্য ব্রিক’ নামে ৫০০ পৃষ্ঠার এক পুস্তক রচনা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সহযোগিতায় দেশের অর্থনীতি অচল করে দেবার সব ধরণের উদ্যোগ নেয়া হয়। ট্রাক ড্রাইভাররা সবাই ধর্মঘট ডাকে, কাঁচামালের অভাবে কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৩ সালের ২৯ জুনে ব্যর্থ ক্যু এর পরে, সে বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখে জেনারেল পিনোশের নেতৃত্বে আবারো ক্যু হয়, এবং প্রেসিডেন্ট আয়েন্দেকে ক্ষমতাচ্যুত করে হত্যা করা হয়। এর সাথে আজকের সারা বিশ্বে গনতন্ত্রের ফেরিওয়ালাদের কল্যাণে চিলের ৪১ বছরের টানা গনতন্ত্রের সমাধি হয়। চিলেতে নির্বাচিত গনতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত এবং আয়েন্দের হত্যাকান্ড দুনিয়ার প্রথম ‘নাইন–ইলেভেন’। গণ অসন্তোষ থামাতে এ সময় হাজার হাজার মানুষকে বন্দী করা হয়। চিলের ‘শিকাগো বয়েজ’ রা পিনোশের হাতে তাদের অর্থনীতিক ম্যানিফেস্টো তুলে দেয়। দেশের লোকজন যখন ভয় আর আতঙ্কের মধ্য ডুবে আছে, তখন পিনোশে শিকাগোর অর্থনীতিক তত্ত্ব বাস্তবায়ন করা শুরু করে। ফ্রিডম্যানের ভাষায়,
“In 1975, when inflation still raged and a world recession triggered a depression in Chile, General Pinochet turned to the “Chicago Boys”; he appointed several of them to powerful positions in the government.”
তাদের উদ্যোগে আমদানী উপরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া, সরকারের কাছ থেকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ তুলে নেয়া , রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দেয়া, সরকারের ব্যয় কমিয়ে আনা ইত্যাদি অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। ফ্রিডম্যান নিজে পরবর্তীতে স্বীকার করেছেন যে চিলে নিয়ে পরীক্ষা করাটা তাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারন এর ফলে দেশটি কম্যুনিজম থেকে মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে ফেরত আসে।
কিন্তু চিলেতে শিকাগোর দেয়া অর্থনীতির প্রয়োগ কাজ করেনি। একবছরের মধ্যে চিলের মুদ্রা ৩৭৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়, এর আগে বিশ্বের কোথাও এমন নজির দেখা যায়নি। পরিস্থিতি স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করতে আর্নল্ড হারবার্গার এবং মিল্টন ফ্রিডম্যান ১৯৭৫ সালের মার্চে সান্টিয়াগোতে যান। সেখানে মিল্টন চিলের অর্থনীতির অসুখ সারাতে ‘শক ট্রিটমেন্ট’ এর প্রস্তাব করেন। বর্তমানে নব্যউদারনীতিবাদী নানা দেশে অর্থনৈতিক মন্দা ও অচলাবস্থা কাটাতে এমন শক দেয়ার সিস্টেম চালু থাকলেও চিলেতে প্রথম এর প্রয়োগ করা হয়। এ থেরাপির মূল কথা হলোঃ জাতীয় দূর্যোগ, দূর্বিপাকের সময় মানুষ যখন শোকে মূহ্যমান থাকে অথবা পরিস্থিতির ব্যাপকতা সামলে নিতে টাল-মাটাল অবস্থায় থাকে তখন শাসক গোষ্ঠী এরকম শোক এবং দূর্যোগের পরিস্থিতির মধ্যে আরো ভয়ানক কাজ সেরে নেয়। একে বলা হয় ‘শক ডকট্রিন‘, মানে একটা ভয়ানক ঘটনার সাথে সাথে জনগনের দৃষ্টি যখন অন্যত্র নিবদ্ধ, ঠিক তক্ষুনি আরেকটা ভয়ানক, ক্ষতিকর, বিতর্কিত লুটপাটের ঘটনা ঘটিয়ে ফেলা। এতে করে শকের উপর শক খেয়ে জনগনের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায়, প্রতিবাদের শক্তি থাকে না, এদিকে কাজ হাসিল হয়। চিলে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ তত্ত্ব প্রয়োগের পরে এখন খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শক ডক্ট্রিন চালু হয়েছে যেমন, ২০০৫ সালে হারিকেন ক্যাট্রিনায় যখন লুইজিয়ান অঙ্গরাজ্যের বিখ্যাত নিউ অর্লিয়েন্স শহর বিপর্যস্ত ঠিক তখন সেখানকার সরকারি স্কুলগুলোকে বেসরকারি খাতে দিয়ে দেয়া হয়। ক্যাট্রিনার আগে যেখানে মোট ১২৩ টি সরকারী বিদ্যালয় ছিল, সেখানে ক্যাট্রিনার পরে মাত্র ৪ টি সরকারী বিদ্যালয় দেখা যায়।
শক থেরাপি চালুর ফলে চিলেতে বেকারত্বের হার অনেক বেড়ে যায়,মানুষকে তার আয়ের ৭৫ ভাগ টাকা শুধু খাবারের পেছনে খরচ করতে হয়। পিনোশে স্কুলে বাচ্চাদের বিনামূল্যে দুধ দেবার সরকারি কর্মসূচি তুলে নেয়। মানুষ খুব দ্রুত বুঝতে পারে ফ্রিডম্যানের অর্থনৈতিক নীতি গরীবের সর্বনাশ করে বড়লোকদের আরো বড়লোক বানাচ্ছে। সাধারন মানুষের উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়, মুক্ত বাজার অর্থনীতির সাথে স্বাধীনতা এবং গনতন্রের যে সম্পর্কের কথা উচ্চকণ্ঠে প্রচারিত হয়, তা যে কত বড় মিথ্যা চিলের সাধারন জনগন তা হাড়ে হাড়ে টের পায়। চিলেতে কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প চালু হয়, তিন বছরে লক্ষাধিক লোককে গ্রেফতার করে কারান্তরালে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আয়েন্দের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের খুন করা হয়। তারপর পিনোশে টানা ১৭ বছর ক্ষমতায় থেকে চিলেতে ‘মুক্ত বাজার’ অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করে যায়। লাতিন আমেরিকাতে কেবল চিলেতেই শিকাগো অর্থনীতি চালু হয়নি, ফ্রিডম্যানের শিষ্যেরা ব্রাজিলের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন, তারা উরুগুয়ে সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করে। তারপর ১৯৭৬ সালের ২৪ মার্চ সামরিক ক্যু এর মাধ্যমে আর্জেন্টিনার ইসাবেল পেরন সরকারকে উৎখাত করা হয়।
বর্তমানে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পরে ‘শিকাগো স্কুল’ এর অর্থনৈতিক চিন্তা-ভাবনা নতুন করে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। আমেরিকাতে লেহম্যান ব্রাদার্সের পতনের পরে রাষ্ট্রকে আবার অর্থনীতিতে বিশাল হস্তক্ষেপ করে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে ভূমিকা রাখতে দেখা যায়। আমেরিকাতে ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত্ব করা হয়, এ সময় অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করতে নানান ছাড় দেয়া হয়, এছাড়া আক্ষরিক অর্থে বাজারে বিপুল পরিমাণে টাকা ছাড়া হয়।
গত কয়েক বছরে পৃথিবীর নানা দেশে অর্থনৈতিক কৃচ্ছতা সাধনের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত হতে থাকে। গ্রিসে সিরিজা, ব্রিটেনে জেরেমি করবাইন, আমেরিকাতে বার্নি স্যান্ডার্সের উত্থান ‘অর্থনৈতিক নব্যউদারনীতিবাদ’ কে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সারা দুনিয়াতে ক্রমবর্ধমান অসাম্য, নাগরিক সুবিধার হ্রাস, অর্থনৈতিক স্থবিরতা, কর্মক্ষেত্রে বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কমে যাওয়ার জন্য নিওলিবারেল ভাবনা-চিন্তাকে দায়ী করা হয়।
চিত্রঃ নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জেমস বুকানান।
বর্তমান আমেরিকার ডানপন্থী সরকার শিকাগো স্কুলের আরেক নোবেল পুরষ্কার পাওয়া অর্থনীতিবিদ জেমস বুকাননের অনুসরণ করছে। তার জীবদ্দশায় বুকানন শ্রমিকদের সংগঠন বিলুপ্তি, ভোটাধিকার হ্রাস, এবং সরকারি স্কুল ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেবার জন্য কাজ করে গেছেন। শিকাগো স্কুলের অর্থনীতির তত্ত্বকে বুকানন রাজনৈতিক বিষয়াবলীকে নতুন দৃষ্টিতে তাকাবার কাজে, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করেছেন। বুকাননের মতে পুঁজিবাদ চালাতে হলে গনতন্ত্রকে শৃঙ্খলিত করতে হবে, তা না হলে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের চাপে ধনীদেরকে তাদের সম্পত্তি হারাতে হবে।
আজকের আমেরিকার স্বাস্থ্যখাত নিয়ে বিতর্কে সেটাই হচ্ছে, সবাই বুঝতে পারছে রিপাবলিকানদের প্রবর্তিত বিল পাশ হলে প্রতিবছর অনেক মানুষ চিকিৎসার অভাবে মারা যাবে। ধনী, কর্পোরেট স্বার্থের কাছে বাঁধা রাজনীতিকরা তারপরেও সেটা করতে চাচ্ছেন। কিন্তু আমেরিকাতে গনতন্ত্র এখনো পুরোপুরি মরে যায় নি, নেতাদের কারো কারো এখনো নিজের এলাকার মানুষের মতামতকে মূল্য দিতে হয়, সবাই লবিয়িস্টদের পকেটে ঢুকে পড়েনি, তাই তারা এ বিলকে সমর্থন করা থেকে পিছিয়ে আসছেন।
বর্তমান ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকারের অন্যতম এজেন্ডা হলো অর্থনৈতিক, সেবামূলক কর্মকান্ডকে রাষ্ট্রিয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ মূক্ত করা (Deconstruction of Administrative State), তারা ‘জনস্বার্থ’ (পাবলিক ইন্টারেস্ট) কথাটা বুঝতে চায় না, এরকম কিছু আছে বলেও মানে না। যার কারণে সামাজিক নিরাপত্তা মূলক ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ, গবেষণা ইত্যাদি খাতে সরকারের বিনিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ আজ হুমকির মুখে। এক সময় অনেক পরিশ্রম,আন্দোলন সংগ্রাম করে জনগনকে এসব অর্জন করতে হয়েছে। কিন্তু ধনী কর্পোরেশানের দীর্ঘদিনের অপপ্রচার, তাদের প্রতিষ্ঠিত নানা গবেষণা প্রতিষ্ঠান (টেম্পলটন ফাউন্ডেশান, কাটো ইন্সটিট্যুট) ও এদের ফান্ডিং পাওয়া গবেষণা থেকে অনবরত প্রকাশ হতে থাকা প্রপাগান্ডা মূলক গবেষণাপত্র জনমতে চিড় ধরাচ্ছে। যার ফলে সামাজিক নিরাপত্তা, সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা (মেডিকেয়ার, মেডিকেইড), পরিবেশ রক্ষা আইন, সার্বজনীন সরকারি শিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে কিছু মানুষের মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দেয়া গেছে। অর্থনীতিবিদ জেমস বুকানন এসব কাজের জন্য নীল নকশা প্রণয়ন করেন, তারই পরামর্শে কোক ভাইয়েরা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে ব্যক্তি মালিকানায় নিয়ে আনা, শিক্ষার ব্যক্তি মালিকানাকরণ ইত্যাদি লক্ষ্য অর্জনে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহন করে।
আমেরিকা এবং দুনিয়ার নানান দেশে নব্য উদারনীতিবাদী অর্থনৈতিক কর্মসূচির কারনে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ অতীষ্ঠ, ক্রমাগত জীবন মানের অবনমন হওয়ায় গরীব মানুষেরা আজ এর ভূক্তভোগী। অনেক লড়াই সংগ্রাম করে পাওয়া এসব অর্জন চলে গেলে সহজে আর ফেরত পাওয়া যাবে না।
সহায়ক গ্রন্থঃ
“Democracy in Chains: The Deep History of the Radical Right’s Stealth Plan for America.” – Nancy Mclean
The Shock Doctrine: The Rise of Disaster Capitalism- Naomi Klein