০
৫৭৪ বার পঠিত
একাই একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠা এই মানুষটার আজ জন্মদিন। মুষ্টিমেয় কয়েকটি মানুষ যারা এই আমাদের মতো নগণ্য কিছু পাঠকের কাছে এনে দিয়েছে বুক ভরা তাজা হাওয়া তাদের অগ্রণী এই আলো হাতে এগিয়ে আসা মানুষটি। মনে আছে সেই ২০০০ সালের কিছু পরের দিকে খুব সম্ভবত ২০০৩ নাগাদ আমাদের কলকাতা বইমেলায় এসেছিলেন তাসলিমা। সুযোগ হয়েছিল সরাসরি কথা বলার। অভিযোগ করেছিলাম মুখের ওপর, আপনাদের কেন কোন ভালো ওয়েবসাইট নেই? কেন নেই কোনো মননশীল লেখার জায়গা। উনি মেনে নিয়েছিলেন, তারপর খুব যত্ন করে লিখে দিয়েছিলেন একটা সাইট। হ্যা, মুক্তমনা। এরপরের দিনগুলো ছিল অতীব বিস্ময়ের। একের পর এক মনিমুক্তো আহরণ করেছি ওই জায়গা থেকে। আপনাকে চিনেছি সেই দিন থেকেই!
হ্যা, আমি অভিজিৎ রায় এর কথাই বলছি। আজ তাঁর জন্মদিনের উপলক্ষে নাম নিলাম আমাদের পথপ্রদর্শকের। আপনি পথ দেখিয়েছেন সচলয়াতনে, নিজের পদচারণা করার মুক্তমনাতে। আমরা হাত পেতে থাকতাম আপনার লেখা পড়ার জন্য। তা সে অনেক দিন হয়ে গেল, আজ মরলে কাল দু’দিন শুনেছিলাম, কে বলে? এই তো সেদিনের কথা মনে হয়! তার লেখা বই এর সংখ্যা মাত্র ১০টি হলেও অজস্র ছোট লেখা ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন জায়গায়। একটি লেখা ও কোনো ব্যক্তিগত রাগ অনুরাগের না, তথ্য উপাত্ত আর পড়াশোনা করে করা। আমাদের কাজ আপনি অনেক কমিয়ে দিতেন এই অমানুষিক পরিশ্রম করে। অনেক একলা অনুভব করছি, তবে অসহায় না! কারণ পথ প্রদর্শক তো আপনিই!
আপনার অধ্যাবসায় কী মুগ্ধ করতো তা বোঝাই কী করে? শিখেছি , ধর্মকে কীভাবে সার্বিক ব্যর্থ করার শাণিত অস্ত্র প্রয়োগ করতে হয় প্রখর যুক্তির ভারে। না, আপনি কোনোদিন কাউকে ব্যক্তি আক্রমণ করেছেন ওটা দেখি নি। শিখেছি ওতে শক্তিক্ষয় হয়, বুদ্ধির চর্চা হয় না। আপনি শিখিয়েছেন কীভাবে মাটিতে পা রেখে চলতে হয়। দুটো পি, এইচডি নেওয়া সর্বোপরী দু’টো পেটেন্টের অধিকারী আপনাকে কোনোদিন নিজের ঢাক পেটাতে দেখি নি।
আমি নিতান্ত সাধারণ এক অকিঞ্চিৎকর মানুষ, মোটা দাগের রসিকতা করি, অবসরে গ্রহ-উপগ্রহ নক্ষত্র গ্যালাক্সি-প্রোটন-নিউট্রন-ইলেক্ট্রন-বোসন বা অতীব দুঃসাহসে হেড্রন কোলাইডার ইত্যাদি নিয়ে আবোল তাবোল লিখি। আসলে আমি ভীরু আর সীমিতবুদ্ধির মানুষ, জটিল বিজ্ঞানের এই অসীমে কুলকিনারা পাই না। যা পড়ি, যা শুনি ওইসব নিয়ে লিখি বা আগে ও লিখতাম আপনার আর আপনার মতো আরো কয়েকজন কে সামনে রেখে। আপনার লেখা থেকে রসদ পেতাম। আপনি শিখিয়েছিলেন নিজেকে নক্ষত্রের অংশ ভাবার।
আজো স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি যখন উপলব্ধি করি একজন মানুষ মহাবিশ্ব নিয়ে লিখতেন, গ্রহনক্ষত্র গ্যালাক্সি ব্ল্যাক-হোল বিগ ব্যাং নিয়ে লিখতেন, লিখতেন বিবর্তন নিয়ে, লিখতেন যুক্তিবাদের কথা, লিখতেন অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণের কথা-সেই মানুষকে হত্যা করা হলো অজস্র মানুষের চোখের সামনে। এ কী হতে পারে? আলো হাতে চলা যাত্রীকে এইভাবে থামিয়ে দেবে অন্ধকারের শক্তি?
নাহ, আজ তার জন্মদিনে কোনো সর্বংদুঃখ হয়ে কিছু শোনাতে আসি নি। ২০১৩ পরবর্তী এক অন্ধকারের সময়ে অনেকের মতোই স্বেচ্ছা নির্বাসনে নিয়েছিলাম নিজেকে। মনে হয়েছিল, কী হবে এইসব করে? তারপর আবার প্রত্যাবর্তন করি। কেন? কারণ এই ব্লগেই পেলাম অভিজিতের জীবনের কিছু অংশ, তার বাবার কথাগুলো। ভাবলাম, আরে! একজন পিতা যদি তার সন্তানের লড়াই এই বয়সে চালাতে পারেন, তাহলে আমি পালিয়ে আসবো কেন?
যখন অজয় বাবুর জীবনের কিছু অংশ জানি তখন আরো লজ্জিত হই এই ভেবে যে, কত কম ধাক্কায় আমি ভেঙে পড়ছিলাম। যারা জানেন না তাদের অবগতির জন্য বলি, অজয় রায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক তাঁর পোস্ট ডক্টরেট করেন লিড্স্ থেকে। তারপরে সেই একই ট্র্যাডিশন, তিনি পারতেন বিদেশে সুখের জীবন নিতে, তা না করে, বেছে নেন দেশকে সেবা করার। দেশে ফিরে শিক্ষকতা, গবেষণার পাশাপাশি যুক্ত হয়ে যান প্রিয় মাতৃভূমিকে পাকিস্তানি শোষকদের হাত থেকে রক্ষার আন্দোলনে। ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চের কালো রাতে পৃথিবীর ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাংলাদেশের নাগরিকদের ওপর। ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় পুরো পৃথিবীর সাথে। তাঁকে মারতে এসেছিল পাক সেনা, বুদ্ধিমান অজয় বাবু দরজায় নকল তালা লাগিয়ে নিজেকে এবং তার অন্তঃস্বত্বা স্ত্রীকে রক্ষা করেন তিনি। পরবর্তীতে ঢাকায় আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে আশ্রয় নেন অজয় রায়। এরপর ঢাকা ত্যাগ এবং কুমিল্লা দিয়ে ভারতে ঢোকেন। আসামে ওএনজিসি’তে কর্মরত বড় ভাইয়ের কাছে স্ত্রীকে রেখে চলে যান অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে। রণাঙ্গনে নতুন লড়াইয়ে যোগ দেন এই অকুতভয় মানুষটি। এরপর ক্রমশঃ তিনি তাজউদ্দীন সাহেবের সাহচর্যে আসেন এবং পরবর্তীতে প্রবাসী সরকারের পরিকল্পনা বিভাগে এবং আমলাতান্ত্রিক কাজে তাঁকে নিয়োজিত হতে হয়। এইসময়ে সেপ্টেম্বরের বারো তারিখ রোববার সকাল ১২:৪২ মিনিটে শিবসাগর জেলার নাজিরাতে একটি মাতৃসেবা হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন অভিজিৎ রায়। বাবা অজয় রায় তাঁর সন্তানকে তখন দেখার সুযোগ পান নি। এরপর ঐতিহাসিক ১৬ই ডিসেম্বরের পরে ফিরে আসেন স্বপরিবারে নিজের বাড়িতে আর যোগ দেন নিজের পুরোনো পেশায়।
এরকম পিতার সন্তান বতর্মান রণাঙ্গনে থাকবেন না ওটা কী হয়? সরাসরি যুদ্ধের রণাঙ্গন আপেক্ষিক সহজ একটি ক্ষেত্র, আপনি জানেন কে ভাই আর কে শত্রু। এইখানে আপনি জানেন না, শত্রু আপনাকে প্রতিরোধ করার সময় দেবে না দেবে না কোনো প্রথাগত প্রশিক্ষণের সুযোগ। ফলে অনেক কঠিন এই লড়াই। তাই অভিজিৎ এবং এই আলোর দিশারীরা অকালে হারিয়ে যায়। তাদের শেষ করা হয় যাতে এই লড়াই চিরতরে শেষ করে ফেলা যায়। ওইখানেই কিন্তু আমাদের কাজ শুরু।
কীভাবে? এই মানুষটির দু’একটা কথা একটু শুনবেন?
১. নিজের পরিচয় একটু আড়ালে রাখুন
২. আত্বপরিচয় না দিতে পারলে ভালো, সোশ্যাল মিডিয়া বা অন্য কিছুর সাথে নিজের লেখার আড়াল রাখুন
৩. সমমনা মানুষদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ান, মনে রাখবেন জোটবদ্ধ না হলে আমাদের শেষ হয়ে যেতে হবে
৪. তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যম থাকুক খুব গোপন
৫. পারস্পরিক জ্ঞান-এর বিনিময় দরকার। দরকার ওপেনসোর্স প্যাটার্ন এর সার্ভার এর
৬. কোনো কারণে সন্দেহজনক কার্যাদি দেখলে সরাসরি নিজেদের মধ্যে এর এলার্ম দিন
৭. ব্যক্তিগত ইগো আর ঝগড়া আমাদের একটা বড় শত্রু, একটু অস্ত্র সম্বরণ করুন। এক সাথে অনেক গুলো যুদ্ধাঙ্গন খুলবেন না!
আরো অনেক কিছুই হয়তো আছে, আমি আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে যা মনে হলো বললাম, বললাম কারণ আমরা অতীতকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, তবে কর্মপদ্ধতিকে দিয়ে ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে পারি। চিনতে পারি রকমারি ইত্যাদি স্রোতের সাথে চলা ক্লীবের পরিচয়।
মৌলবাদীদের হত্যার পরোয়ানা সত্ত্বেও প্রিয় বাংলাদেশে এসেছিলেন অভিজিৎ রায়। এসেছিলেন অসুস্থ মা’কে দেখতে, অসুস্থ বাবাকে দেখতে, বইমেলার প্রাণের মেলায় অংশ নিতে, মাতৃভূমিকে ভালোবেসে। তিনি এসেছিলেন বাংলাদেশের অতিথি হয়ে। এই অপজাতকদের তিনি এতো বড় সমস্যা ভাবেন নি। ওটাই তো ভুল! ওই ভুল আমরা যেন আর না করি!
ব্যক্তিগতভাবে ফারাবী’কে ভার্চুয়াল সঙ্গম করে ভেবেছিলাম বিরাট বাঘ মেরেছি, বুঝিনি এদের ক্ষতি করার ক্ষমতা। আসুন ওই ভুল আর কেউ যেন না করি। আর হ্যা, সরকার সে যেই দেশের-ই হোক আমাদের জন্য আশ্রয় না। আমাদের আশ্রয় আমাদের নিজেদের বুদ্ধি আর একজোট হয়ে থাকা; না হলে কাল আমি-আপনি সবাই একই পরিণতির দিকে যেতে পারি।
যে আলো এই একাই একশো মানুষটা জ্বালিয়েছেন আসুন ওটাকে নীরবে ছড়িয়ে দিই ঘরে ঘরে। আসুন প্রশ্ন করার অধিকার দিই আগামী প্রজন্মকে। ওটাই হবে এই অক্ষয় মানুষটির জন্য শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধার্ঘ। অস্ত্রের বিরুদ্ধে, চাপাতির কোপের বিরুদ্ধে, মৌলবাদীদের হুঙ্কারের বিরুদ্ধে, মুক্তবুদ্ধির চর্চা চলবে। একজন অভিজিৎ রায়ের রক্তের স্রোত থেকে আরও দশজন উঠে দাঁড়াবে। কুপিয়ে মানুষ মারা গেলেও, তার মুক্তচিন্তার প্রভাবকে মেরে ফেলা যায় না। অভিজিৎ রায় তাঁর কাজের মাধ্যমেই বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে। নপুংসক জাতি যখন নিজেদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা করতে শেখে না, সেই জাতির দূর্যোগ অনিবার্য। কিন্তু তাই বলে হতাশায় কলম, কি-বোর্ড বন্ধ থাকবেনা। মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এই আন্দোলন চলবে। হত্যা-নির্যাতনের বিরুদ্ধে কলম চলবে, চলুক।
দেখতে চাই, এক অভিজিতের থেকে বাংলাদেশে জন্ম নিচ্ছে লক্ষ অভিজিৎ।
শুভ জন্মদিন অভিজিৎ রায়! আমরা জেগে আছি! কলম চলবেই!
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন