# শ্রেণীকক্ষে শিক্ষিকাকে গণধর্ষণ!
# কে এই ‘রামদা সুমন’?
# ভয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করেন না এলাকাবাসী!
বরগুনার বেতাগী উপজেলায় স্বামীকে বেঁধে রেখে শ্রেণীকক্ষে আটকে শিক্ষিকাকে গণধর্ষণের মামলার প্রধান আসামি সুমন বিশ্বাসকে লক্ষ্মীপুর থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এলাকায় সবাই যাকে চেনে কুখ্যাত সন্ত্রাসী ‘রামদা সুমন’ নামে।
শুক্রবার বিকালে বরগুনার পুলিশ সুপার বিজয় বসাক এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, সুমন বিশ্বাসকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার শ্বশুরবাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগতি থেকে বৃহস্পতিবার গ্রেফতারের পর ওই দিনই তাকে বরগুনায় নিয়ে আসা হয়।
পুলিশ ‘রামদা সুমনের’ স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ঘটনার দিন ধর্ষণের শিকার শিক্ষিকা ও তার স্বামী ভারতীয় নাগরিকের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া ২টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে। বেতাগী উপজেলার কদমতলা বাজারের জলিল মিঞার বাড়িতে পাওয়া যায় ওই ফোন দুটি। শুক্রবার ভোরে সেখানে অভিযান চালিয়ে মোবাইল দুটি উদ্ধার করে পুলিশ।
এ সময় আসামি সুমনও তাদের সঙ্গে ছিল। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জলিল ও তার ছেলেকে আটক করেছে। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, জলিলের ঘরকে টর্চারসেল হিসেবে ব্যবহার করত সুমন ও তার বাহিনী। মদ, গাঁজা জুয়ার আড্ডাসহ নানা অপকর্ম ও লোকজন ধরে এনে সেখানে আটকে রেখে মারধর করা হতো।
কে এই রামদা সুমন:
উপজেলা আওয়ামী লীগে কোনো পদ-পদবি না থাকলেও ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত সুমন। বেতাগীর হোসনাবাদ ইউনিয়নের বাসিন্দা সুমনের বাবা হিরন বিশ্বাস একজন কৃষক। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রায় না থাকা সুমন তার চাচাতো ভাই ইউপি মেম্বার মন্টু বিশ্বাসের ডান হাত। মন্টু বিশ্বাসেরও দলে কোনো পদ-পদবি নেই। তবে সবার কাছে তিনি আওয়ামী লীগের লোক হিসেবে পরিচিত।
মন্টু বিশ্বাসের খালাতো ভাই বাবুল আক্তার বেতাগী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি। এই বাবুল আক্তারের পরিচয়েই নিজেকে প্রভাবশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মন্টু বিশ্বাস। আর তার ডান হাত হিসেবে এলাকায় একটু একটু করে ‘কুখ্যাত সন্ত্রাসী’তে পরিণত হয়েছে সুমন। যদিও বর্তমানে মন্টু কিংবা তার সহযোগী সুমনকে কোনোভাবে ছাড় দিচ্ছেন না বাবুল। শিক্ষিকা গণধর্ষণের বিচার দাবিতে চলমান সব আন্দোলন কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। অপরাধীদের বিচার চাইছেন জোরেশোরে।
সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় প্রথম নিজের বাহিনী গড়ে তোলে সুমন। ১২/১৫ জনের ওই বাহিনী এলাকায় প্রায়ই মহড়া দিত রামদা নিয়ে। ভোটের দিন এই বাহিনী বিভিন্ন কেন্দ্রে সন্ত্রাসী মহড়া দিয়ে বিজয়ী হতে সহায়তা করে মন্টু বিশ্বাসকে। এরপর থেকেই এলাকায় সুমন বিশ্বাসের পরিচিতি দাঁড়ায় ‘রামদা সুমন’ নামে। নির্বাচনে জয়লাভের ভূমিকা রাখায় সুমনকে একটি মোটরসাইকেল কিনে দেন মন্টু বিশ্বাস। কাগজপত্রে মালিকানা না দিলেও মোটরসাইকেলটি সুমনই চালাত।
তার পেছনে ওই মোটরসাইকেলে চলাফেরা করতেন মন্টু। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক এলাকাবাসী যুগান্তরকে জানান, মন্টু বিশ্বাসের ছত্রছায়াতেই নিজেকে অপরাধ জগতের খলনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে রামদা সুমন। বেতাগী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি বাবুল আক্তার যুগান্তরকে বলেন, মন্টু বিশ্বাস কিংবা সুমন বিশ্বাসের অপরাধের দায়ভার আমরা নেব না। সুমন যা করেছে তার বিচার আর সবার মতো আমিও চাই।
রামদা সুমনের নানা অপকর্ম:
মাস দুয়েক আগে বেতাগীর জলিসা বাজারে আয়োজন করা হয় একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের। খেলা চলাকালে সামান্য বিষয় নিয়ে রামদা সুমনের সঙ্গে ঝগড়া হয় ইমন নামে এক কলেজছাত্রের। একপর্যায়ে দলবল নিয়ে ইমনকে বেদম মারধর করে সুমন। ছেলেকে মারধরের ঘটনা দেখে সহ্য করতে না পেরে ঘটনাস্থলেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান বাবা মোস্তফা জমাদ্দার।
এ ঘটনায় মামলা করতে গেলে ইমনকে প্রাণনাশের হুমকি দেয় সুমন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়ায় যে শেষ পর্যন্ত সুমনকে বাদ দিয়ে মামলা করে ইমন। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে ইমন যুগান্তরকে বলেন, ‘এমনিতেই বাবা হারিয়েছি। তার ওপর ছিল পরিবারের বাকি সবাইকে হত্যা করার হুমকি। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে সুমনকে বাদ দিয়ে ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করি।’
জানা গেছে, ১৭ আগস্ট শিক্ষিকা গণধর্ষণের ঘটনায় সুমনের সঙ্গে যে ৫ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে তারা সবাই-ই তার বাহিনীর সদস্য। ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে সঙ্গে থেকে সুমনের নানা অপকর্মে তারা সহযোগিতা করত। ধর্ষিতা শিক্ষিকার স্কুলের প্রধান শিক্ষক যুগান্তরকে বলেন, ‘মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাসহ সুমনের বেশকিছু কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করলে আমার ওপর সে ক্ষিপ্ত হয়। এসব ঘটনার জের ধরে একবার সে আমার ছেলেকে বেদম মারধরের পর চোখে মরিচের গুঁড়ো ঢেলে দেয়। এ ঘটনায় করা মামলা এখনও বিচারাধীন।’
নিজের বাহিনী আর ক্ষমতাসীন দলের একটি অংশের মদদে সুমন এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল যে গত জুন মাসের শেষের দিকে হোসনাবাদ ইউনিয়নে একটি সালিশি বৈঠকে ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাকুসুদুর রহমান ফোরকানকে সবার সামনে প্রাণনাশের হুমকি দেয়।
এ প্রসঙ্গে মাকুসুদুর রহমান ফোরকান যুগান্তরকে বলেন, মান-সম্মানের ভয়ে আমি এ বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীতে কোনো ব্যবস্থা নেইনি। কদমতলা বাজার এলাকার এক নারী অভিযোগ করে বলেন, ‘মাস চারেক আগে আমার কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণ করে রামদা সুমনের এক সহযোগী। এ ঘটনায় মামলা করতে চাইলে বাধা দেয় সুমন। বিষয়টি মীমাংসার কথা বলে আমাদের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা নেয় সুমন ও তার ভাই মন্টু মেম্বার। পরে ঘটনার কোনো বিচার তো হয়ইনি উপরন্তু আমাদের টাকা মেরে দেয় তারা দু’জন।’
বেতাগীর অনেকেই জানান, রামদা সুমন ও তার বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। ভয়ে কেউ মুখ খুলে প্রতিবাদ করার সাহস পেত না। প্রতিবাদ করতে গেলেই নেমে আসত নির্যাতন। থানা পুলিশে অভিযোগ করারও কোনো সুযোগ ছিল না। এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে বন্ধ পাওয়া যায় মন্টু বিশ্বাসের মোবাইল ফোন। ক্ষুদে বার্তা দিলেও কোনো যোগাযোগ করেননি তিনি। একটি সূত্র জানিয়েছে, মন্টু বিশ্বাস আত্মগোপন করেছেন।
আলোচিত ফাইল বাণিজ্য:
বেতাগী উপজেলায় একটি পরিচিত বাক্য হচ্ছে ‘ফাইল বাণিজ্য’। এ বাণিজ্যের মূলহোতা রামদা সুমন ও তার বাহিনী। জানা গেছে, এলাকায় কেউ বেড়াতে এলে, বিশেষ করে বাইরে থেকে আসা কিশোরী বা তরুণীরাই ছিল তাদের প্রধান টার্গেট। এরা যদি কখনও তাদের কোনো বন্ধু বা পুরুষ আত্মীয়স্বজন নিয়ে কোথাও বেড়াতে যেত তাহলেই তাদের টার্গেট করত সুমনের বাহিনী। তাদেরকে আটকে টাকা-মোবাইল আর স্বর্ণালঙ্কারসহ অন্যান্য মালামাল কেড়ে নিত।
বেতাগী উপজেলায় এমন অনেক ঘটনা থাকলেও লোকলজ্জা আর মানসম্মানের ভয়ে কেউ মুখ খোলেনি কখনও। যুগল ও নারী-পুরুষকে একসঙ্গে আটকে এভাবে টাকা মোবাইল আর গহনা-পত্র লুটে নেয়ার ঘটনাগুলোই বেতাগীতে ‘ফাইল করা’ নামে পরিচিত। শিক্ষিকা গণধর্ষণের ঘটনা নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড়ের পর কেউ কেউ নানা ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বেতাগী পৌর শহরের বাসিন্দা সরকারি চাকুরে একজন বলেন, ‘কিছুদিন আগে বরগুনা থেকে আমার এক আত্মীয় তার স্বামীকে নিয়ে বেড়াতে আসে। পথে তাদেরকে আটকে মারধর শ্লীলতাহানির ভয় দেখিয়ে টাকা, মোবাইল স্বর্ণালঙ্কার ছিনিয়ে নেয় সুমন ও তার বাহিনী।’
বেতাগীর একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক জানান, স্কুলে বা কলেজে আসা-যাওয়ার পথে ছাত্রীদের নানাভাবে উত্ত্যক্ত করত এই বাহিনী। তাদের ভয়ে অনেক ছাত্রীর স্কুল-কলেজে আসা বন্ধ হয়ে যায়। এসব ঘটনায় কখনও কোনো অভিযোগ করেছেন কিনা জানতে চাইলে তারা জানান, অভিযোগ করা মানেই জীবনের ঝুঁকি নেয়া। তাই ভয়ে কখনও কোনো অভিযোগ করেননি।
রামদা সুমন ও তার বাহিনী সম্পর্কে জানতে চাইলে বেতাগী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুন আর রশিদ বলেন, ‘বর্তমান ধর্ষণ মামলার বাইরে সুমনের নামে আরও একটি মামলা রয়েছে থানায়। এছাড়া তার বিরুদ্ধে আর কেউ কখনও কোনো অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতাম।’
পুলিশ সুপারের সংবাদ সম্মেলন:
শুক্রবার বিকালে সংবাদ সম্মেলনে বরগুনার পুলিশ সুপার বিজয় বসাক আরও জানান, পুলিশ হেডকোয়ার্টারের এলআইসি শাখার সহায়তায় পাওয়া তথ্যানুযায়ী বরগুনার সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. ওয়ারেসর নেতৃত্বে একটি দল রামগতি থেকে সুমনকে গ্রেফতার করে। পরে তার দেয়া তথ্যানুযায়ী বেতাগী থেকে উদ্ধার করা হয় ঘটনার দিন ছিনতাই হওয়া দুটি মোবাইল। এ সময় জলিল ও তার ছেলে রেজাউলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে আসা হয়।
তিনি বলেন, ‘আমরা সুমনকে আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ড চাইব। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাকিটা বলা যাবে।’ এ নিয়ে মামলার ৩ জন আসামি গ্রেফতার হল। বাকি ৩ জনকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইতিপূর্বে গ্রেফতার হওয়া রবিউল ও জুয়েলকে দু’দিনের রিমান্ডে দিয়েছেন আদালত। বাকি ৩ আসামিকেও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। আসামিদের পালাতে সহায়তা করার অভিযোগে ইতিমধ্যে আসামি রাসেলের বাবা আবদুল বারেক মিঞা ও আসামি সুমন গাজীর বাবা কুদ্দুস গাজীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া অপর আসামি সজলসহ তিনজনকে শিগগিরই গ্রেফতার করতে পারব আমরা।’
এদিকে ঘটনার পরপরই শিক্ষিকার স্বামী ভারতে চলে যাওয়ার পর থেকে কোনো যোগাযোগ করেননি স্ত্রীর সঙ্গে। বিষয়টি নিয়ে মুষড়ে পড়েছে শিক্ষিকার পরিবার। শিক্ষিকার বাড়িতে শুক্রবারও দেখা গেছে তার নিরাপত্তায় নিয়োজিত বেতাগী থানা পুলিশের একটি দল। তবে ঘটনার পূর্বাপর নিয়ে কোনো রকম কথা বলতে রাজি হননি ওই শিক্ষিকা।
তার ভাই বলেন, ‘আমরা আমাদের কথা বহু আগেই বলে দিয়েছি। আমার বোন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এটাই সত্যি। আমরা ধর্ষকদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। এ ঘটনায় আমার বোন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। তার সংসার টিকবে কিনা তা নিয়েও সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা এ ঘটনার বিচার চাই।’
পত্রিকায়>>> শ্রেণীকক্ষে শিক্ষিকাকে গণধর্ষণ: কে এই ‘রামদা সুমন’