দক্ষিণ এশিয়ার দুর্নীতি বসন্ত; এ এলাকার ‘সাব-অল্টার্ন’ মুভমেন্টেরই অংশ। ইউরোপের মতো শিক্ষা-ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে পুঁজিতে শোষিতের প্রবেশের অধিকার নিশ্চিত করার প্রয়োজন বোধ করেনি দক্ষিণ এশীয় উপনিবেশ-উত্তর শাসকেরা। শিক্ষা-ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করতে গেলেই; সাব-অল্টার্ন রাজনৈতিক দলগুলো একে ‘কুখ্যাত’ শিক্ষানীতি হিসেবে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার সাব-অল্টার্ন মুভমেন্ট; রবিনহুডের ডাকাতির সূত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নীতিনির্ধারণে এখন সাব-অল্টার্নদেরই জয়জয়াকার। অশিক্ষা-অযোগ্যতা-অসততাকে ‘সাব-অল্টার্ন’-এর প্রতিশোধের ‘তকমা’ দিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে রূপান্তর করা হয়েছে সাব-অল্টার্ন গভর্ন্যান্সে।
উল্লেখ্য যে দক্ষিণ এশিয়ায় ঔপনিবেশিক শাসনের বহু আগেই এক কদাকার কাস্ট সিস্টেম চালু করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় অন্তত চারটি অভিবাসনের ঢেউ-এ আফ্রিকা, পারস্য, মধ্য এশিয়া ও দূর প্রাচ্য থেকে নানা বর্ণের মানুষ এসে বসতি গড়ায়; ভূমিপুত্র বলতে বিশেষ কিছু নেই এখানে। এরমাঝে গাত্রবর্ণটিকে উচ্চ বর্ণ ও নিম্নবর্ণে মানুষকে ভাগ করার প্রধান সূচক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
গাত্রবর্ণ গৌর হলেই; শাসকের কেল্লার পুরোহিত-বিদূষক হিসেবে নিয়োগদান চলতে থাকে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার সাব-অল্টার্ন সৃষ্টির কারখানাটির উপনিবেশের সঙ্গে সম্পর্ক খুব কমই। কারণ বৃটিশদের দক্ষিণ এশিয়ায় এসে প্রভাব-প্রতিপত্তি স্থাপনে কোন বেগই পেতে হয়নি। শাসকের ‘সহমত ভাই’ হলেই ধনসম্পদ অর্জন করা যায়; শ্রেণী উত্থান ঘটানো যায়; এই বিশ্বাস পাকাপোক্ত ছিলো দক্ষিণ এশিয়ায়।
বৃটিশ হটানোর মাধ্যমে দেশীয় কিছু নব্য ব্যারিস্টারের গভর্নর বা প্রধানমন্ত্রী হবার শখ পূরণ হয়। কিন্তু গৌর গাত্র বর্ণের প্রতি দক্ষিণ এশীয় যে আগ্রহ তা পশ্চিমের হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদেরও ছাড়িয়ে যায়। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘কালো সে যতই কালো হোক; দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ’ লিখে হোয়াইট সুপ্রিমিজমের রোগ সারানোর চেষ্টা করলেও; তাতে কোন লাভ হয়না। বরং ‘ফেয়ার এন্ড লাভলি’ ক্রিমের গাত্রবর্ণ ফর্সা করার ব্যবসা প্রকল্পটি সবচেয়ে বেশী মুনাফার মুখ দেখে দক্ষিণ এশিয়ায়।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে সাব-অল্টার্নদের নিয়োগের মাধ্যমে; সাব-অল্টার্নদের ক্ষমতায়িত করলে; তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা নিও রুলিং এলিটের গর্ব বুকে ধারণ করে; রুদ্র ও কর্কশ হয়ে পড়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি।
সাব-অল্টার্নদের জন্য বিস্তর কাঁদাকাটি করলেও; তাদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য শিক্ষা-ব্যবস্থায় সমতা আনা কিংবা কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এসব কিছুই করেনা; দক্ষিণ এশীয় শাসকেরা। তারা বরং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেখিয়ে দেয়া পথে সম্পদ লুন্ঠন ও পাচারে ব্যস্ত থাকে। নিও রুলিং এলিট নিজেদের ছেলে-মেয়েকে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ায়; আর সাব-অল্টার্নদের ঠেলে দেয়, দুর্বল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্রমে ক্রমে ড্রপ আউট হতে ও রাজনৈতিক দলের চর দখলের লড়াই-এ ফুট সোলজার হতে।
দক্ষিণ এশিয়ায় সাব-অল্টার্নদের কিছু অংশকে জনপ্রতিনিধি বানিয়ে নিও রুলিং- এলিট ক্লাবে প্রবেশাধিকার দেয়া হয়। জীনগতভাবে কালো গাত্রবর্ণের লোকেরা সাদা গাত্রবর্ণের লোকেদের দ্বারা নির্যাতিত হবার স্মৃতি ধারণ করায়; কালো গাত্র বর্ণের লোক ক্ষমতা পেয়েই শুরু করে রিভার্স এপারথেইড। কালোরা সাদাদের হত্যা করতে থাকে।
সাব-অল্টার্নদের শিক্ষাদান ছাড়াই নিও রুলিং এলিট বানিয়ে দেয়ায়; তারা অশিক্ষাকে সাব-অল্টার্ন সেন্টিমেন্ট হিসেবে লালনের প্রয়াস পায়। কোন কাজ ঠিকমত না পারাই হয় আদরণীয়। নিও রুলিং এলিটের ছেলে-মেয়েরা সাব-অল্টার্ন নিয়ে একরকমের রোমান্টিসিজমে ভুগতে থাকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর গল্পের নায়িকা নৌকার মাঝির সঙ্গে যুগল জীবন যাপনে চলে যায়। ফেসবুকে এসেও সাব-অল্টার্ন রোমান্টিসিজমে আক্রান্ত নায়িকা বলে, আমি এলিট, কিন্তু সাব-অল্টার্নদের অত্যন্ত ভালোবাসি। এই যে আমি এলিট কিন্তু সাব-অল্টার্নকে ভালোবাসি; এটা হচ্ছে নিজের নতুন আভিজাত্য জানান দেয়া ও সাব অল্টার্নদের যে যে স্তরে আছে; সেইখানে রেখে দিয়ে; নিজের নতুন আভিজাত্য টিকিয়ে রাখার খলতা।
যারা ভারতে সর্বস্তরে হিন্দি ভাষা চালু, পাকিস্তানে সর্বস্তরে উর্দু ভাষা চালু ও বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর শ্লোগান দিয়েছে খুব করে; তারা নিজের ছেলেমেয়েদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়ে সাব-অল্টার্নদের সাব-অল্টার্ণ থাকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছে। জামায়াতে ইসলামির মওদুদী যেমন সাব-অল্টার্নদের মাদ্রাসায় পড়ার ফতোয়া দিয়ে নিজের ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়েছেন; গোলাম আজমও ঠিক সেটাই করেছেন।
ইউরোপে শিক্ষা-ব্যবস্থার সংস্কারের মাঝ দিয়ে সাব-অল্টার্ন ধারণাটিকেই ক্রমে ক্রমে বিলুপ্ত করা হয়েছে; অন্তত সমাজ মানসে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় সাব-অল্টার্ন ধারণাটিকে শোষণের ও সুপিরিয়রিটি চর্চার উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে টিকিয়ে রাখা হয়েছে।
আমার শৈশবে দেখা এক ভদ্রলোক চকিতে বিপ্লবী হয়ে পড়ে; বাসায় ‘সাব-অল্টার্ণ’ বিষয়ক বই-পুস্তক এনে বুক শেলফ ভরে ফেলে। অধিকারহীন মানুষের জন্য তার কান্নার কোন অন্ত ছিলো না। এইসব সাব-অল্টার্ন রোমান্টিসিজম জন্ম নিয়েছিলো; তার পুলিশ বাবার ঘুষের টাকায় হোন্ডা চালিয়ে; জিনস-টিশার্ট পরে ঘোরার আতিশয্যে। সাব-অল্টার্ন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকায়; কেউ প্রশ্ন করেনি ‘ব্যবসা-বানিজ্যের’ টেকাটুকা সে কোত্থেকে পেলো। লোকটি ব্যবসা বানিজ্য করে প্রকৃত পুঁজিবাদী হয়ে ওঠে; নিজের মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়ে পশ্চিমে পাঠিয়ে দেয়। আর নিজে খারাপ ছাত্র হওয়ায় ও ইংরেজি না জানায়, সারাক্ষণ বলতো, এইসব পড়ালেখার কোন দাম নাই; কী হবে ইংরেজি শিখে।
বাংলাদেশেই সাব-অল্টার্নদের দোহাই দিয়ে নিও এলিট হিসেবে আত্মপ্রকাশের যে রাজনীতি ও ধর্ম ব্যবসা; তার রীতিমত কুরুক্ষেত্র রচিত হয়েছে। কারো ওপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকমতো সে পালন করতে না পারলে; বা স্বপ্রণোদিত হয়ে কেউ কোন কাজে গিয়ে ব্যর্থ হলে; তখন সাব-অল্টার্ন রোমান্টিসিজম-এর ভাইয়া ও আপুরা চলে আসেন জাস্টিফিকেশান দিতে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘরে বাইরে উপন্যাসের স্বদেশী সন্দীপ আর বিমলাতে গিজগিজ করছে দক্ষিণ এশিয়ার সোশ্যাল মিডিয়া। দেশপ্রেমের মাধ্যমে স্বাস্থ্য অর্জনের জন্য পাবলিককে ‘স্বাধীনতা’, ‘ন্যায়বিচার’, অধিকারহীনের অধিকার; এইসব গালভরা বুলি দিয়ে সাব-অল্টার্নের সম্পদ লুন্ঠনই দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি।
‘সাব-অল্টার্ন’ শব্দটি চিন্তাবিদ আন্তনিও গ্রামসি যে লক্ষ্যে নিয়ে এসেছিলেন; তা ইউরোপের বাস্তবতায় কাজে লেগেছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় ‘সাব-অল্টার্ন’ শব্দটি শ্রেণী বৈষম্যকে রোমান্টিসিজম দিয়ে টিকিয়ে রাখার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। শিক্ষা বিস্তার না করে সামরিক-বেসামরিক আমলা পুষে স্বদেশী পরিচালিত উপনিবেশ টিকিয়ে রেখেছে থাগস অফ সাউথ এশিয়ানরা। অনাদরে অবজ্ঞায় কৃষক- সেলাইশ্রমিক-প্রবাসী শ্রমিক যোগান দেয় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি। আর সেই টাকা লুট করে ‘দেশপ্রেম’ ও ‘ধর্ম-প্রেম’-এর নির্লজ্জ লিপ সার্ভিসে টিকে আছে লুন্ঠক শাসকের দল। আর তাদের পিঠাপুলির আসরের বিদূষকদের কাজ, শিক্ষা বিস্তার-সাম্যভাবনাকে সমাজ মননে প্রোথিত হতে না দিয়ে; সাব-অল্টার্নের ধারণাটিকে দুই নয়নের জলে টিকিয়ে রাখা। নিও রুলিং এলিটের নিজ শ্রেণী উত্থান উপভোগের খেলাঘরের পুতুল যেন এই সাব-অল্টার্ন।