০
১৩৮৮ বার পঠিত
থাপ্পড়টা লেগেছে জায়গামতো। রবীন্দ্রভারতীতেই রবীন্দ্রনাথের বিকৃতি। কিন্তু কেনো এই বিকৃতি সে প্রশ্নটা না করে, যারা অভিযুক্ত তাদের জোর করে ক্ষমা চাওয়ানো হয়েছে। অথচ খোদ বসন্ত উৎসবের ধারণাটি কি শ্লীল এমন কথা বলেননি কেউ। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। প্রশ্নটা এখানেই। আপনি যখন একটা অংশকে অশ্লীল বলবেন, তখন পুরো অবয়বটার শ্লীলতাও প্রশ্নের মুখে পড়বে। বসন্ত উৎসবের নামে, রঙ খেলার নামে শারীরিক অশ্লীলতা করবেন অথচ মৌখিক কিংবা লিখিত কোনো অশ্লীলতার বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হবেন, এটা কেনো- এমন প্রশ্ন সঙ্গতই উঠবে।
হোলিতে কি হয়ে আসছে এতদিন। প্রতিবছরের হোলিতেই মেয়েরা নির্যাতিত হচ্ছে, অশ্লীলতার শিকার হচ্ছে। অবশ্য কেউ ইচ্ছাকৃত এমন অশ্লীলতার সাথে যোগ দিয়েছেন। দোলের নামে কোন দোল খেলা হচ্ছে তা সামাজিকমাধ্যমের অনেক দৃশ্যচিত্রই তার প্রমান। চলমান সেসব কান্ডে কারো কোনো প্রতিবাদ নেই। প্রতিবাদ হলো রবি বাবুর গানের বিকৃতিতে। হায়রে বিকৃতির সংজ্ঞা। চাড্ডি খুলে নাচবেন, অসুবিধা নেই, কিন্তু পৈতা খুললেই কেলো। অদ্ভুত এই অশ্লীলতার সংজ্ঞা।
পদাবলীতে অঙ্গের জন্যে অঙ্গ কাঁদাবেন। সুড়সুড়ি দিবেন অথচ যথন মেয়েরা সেই ভাষাকেই হালের ভাষাতে রূপান্তর করে গান করবে, তখন শুরু হবে ‘গেলো গেলো’। পদাবলীর ভাষাচিত্রগুলো কেউ কি সোজা ভাষায় ব্যাখ্যা করবেন। একবার বাংলার ক্লাশে ঢুকেছিলাম, পদাবলী বিষয়ে লেকচার শোনার জন্য। তাও আবার কুলীণ এক বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষক ভদ্রলোকের কি কসরত পদাবলীর বিষয়ে বলতে। পদাবলীতে কি বলা হয়েছে তা সরাসরি ভাষায় বর্ণনা করার চেষ্টায় ভদ্রলোক লাল হয়ে যাচ্ছিলেন। ঘোরানো-প্যাঁচানো ভাষাতে বর্ণনা করছিলেন চিত্রকল্পটি। হয়তো তার ব্যাখ্যা ছিলো অনেকটা এরকম, ‘ক্লাশে ছাত্রীরা রয়েছে তো, এখানে সব খোলাখুলি বর্ণনা করা যায়।’ আরে ভাই, যায় নাতো এমন বিষয় পড়ান কেনো? এই যে ‘কেনো’, এই প্রশ্নটা কি এতদিন কেউ করেছেন? করেননি। কেনো করেননি-রে ভাই। এটাই যদি না করতে পারবেন তবে ছাত্রীদের গান, আর বুকে পিঠে লেখা অশ্লীলতা নিয়ে এত আপত্তি কেনো। এতো আপনাদের জ্ঞানদাসের জ্ঞান, রবীন্দ্রনাথেরই প্রডাক্ট। পদাবলীর মাল।
ভারতে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ স্কুলের একাদশ শ্রেণির চার ছাত্রীর গান সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। ভাইরাল হবার পরেই সংস্কৃতি রক্ষার স্বঘোষিত সেবকরা, বলতে পারেন অনেকটা গোরক্ষকদের মতন হামলে পড়েছে। এক রব, গেলো গেলো। স্কুলটির প্রধান শিক্ষিকার মাথা হেট হয়ে যাচ্ছে এমনটাই জানিয়েছেন গণমাধ্যমের কাছে। ওই শিক্ষিকাকে রবীন্দ্রনাথের কিছু লেখার অংশ উঠিয়ে দিয়ে যদি প্রশ্ন করি রবি বাবু এখানে ঠিক কি বলতে চেয়েছেন, তা সরাসরি বলুন। নিশ্চিত বলতে গেলে তিনি আমতা আমতা করবেন। আপনি আমতা আমতা করতে পারেন, কিন্তু ছাত্রীরা করেনি, পার্থক্যটা এখানেই।
রবীন্দ্রভারতীর উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। তিনি লজ্জা পেয়েছেন, বসন্ত উৎসবের রঙ খেলায় অশ্লীল শব্দ লিখে কিছু শিক্ষার্থী সব মাটি করে দিয়েছেন, এমন বিবেচনায়। উপাচার্য বাবু, লজ্জার উৎসব করবেন, আবার তাতেই লজ্জা পাবেন তা কী করে হয়! রঙ খেলাটা কিরে ভাই। একদল তরুণ তরুণীদের রঙ লাগিয়ে দিচ্ছে। হাত চলে যাচ্ছে কখনো নিষিদ্ধ এলাকায়, যেটা কোনভাবেই শ্লীলতার সংজ্ঞার সাথে যায় না। সেখানে কোনো কথা নেই। অথচ বুকে-পিঠে লেখার জন্যই সবকিছু অশ্লীল হয়ে গেলো। কেউ যদি বলেন, এটা একধরণের প্রতিবাদ। অশ্লীলতাকে অশ্লীলতা দিয়েই ঠেকানোর প্রতিবাদ তবে কী বলবেন উপাচার্য বাবু। হায় উপাচার্য বাবু, আপনিতো ‘বাবু সোনা’ই রয়ে গেলেন।
ভারতীয় টিভি চ্যানেলে এক শিক্ষার্থীকে বলতে শুনলাম, যারা বুকে পিঠে লিখেছেন, তারা বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য নষ্ট করেছেন। আহারে ঐতিহ্য। যিনি বললেন, তার জামার উপরের অংশ এমন করে কাটা যে, তার ক্লিভেজ ছিলো স্পষ্ট। ওটা অশ্লীলতা ছিলো না, ছিলো সৌন্দর্য প্রদর্শন, প্রশ্ন করলে এমনটাই উত্তর পাবেন। সেখানে হাত দিয়ে রঙ লাগানো যাবে, অথচ কিছু লেখা যাবে না! সেলুকাস কইরে বাবা, কিছু বলে না কেন! করবেন যা, তা হবে অলিখিত। আশ্চর্য চিন্তা ও কর্ম এসব শ্লীলতাধারীদের। বন্ধ করতে চাইলে উৎস বন্ধ করতে হবে। পরকীয়ায় পাপ দেখবেন না, যেমন দেখতেন না স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। সেখানে পরকীয়া বিষয়টি বুকে পিঠে লিখে নিয়ে আসবেন তাতে দোষ হয়ে যাবে। বলবেন, ‘বোঝেন না কেনো দাদা, যা করবেন একটু আড়াল করে করবেন, চোখে না পড়লেই হলো।’ ওই ছেলেমেয়েগুলোও যদি তাই করতো। রঙের নামে একটু ‘রং’ করে যেতো, কিচ্ছু যায় আসতো না। লিখে নিয়ে এসেই যত ঝামেলা পাকিয়েছে। আর যারা গান গেয়েছে, সেই তরুণীরাও যদি আড়ালে আবডালে গলা না খুলে কাপড় খুলে দিতো তবে তারা হতো আরো আধুনিক, সংস্কারবিহীন। কিন্তু কাপড় না খুলে গলা খুলতে গিয়েই সব ঝামেলা বাধিয়েছে। এই শ্লীলতাধারীদের সংস্কৃতিতে আপনি আড়ালে কাপড় খুলতে পারবেন, প্রকাশ্যে গলা খুলতে পারবেন না। বলিহারি যাই, যুগ যুগ জিও সংস্কৃতিজীবী লেঙ্গট বাবারা।
‘প্রতি অঙ্গ কাঁদে তব প্রতি অঙ্গ-তরে। প্রাণের মিলন মাগে দেহের মিলন। হৃদয়ে আচ্ছন্ন দেহ হৃদয়ের ভরে মুরছি পড়িতে চায় তব দেহ-পরে।’ শ্লীলতার ধ্বজাধারীদের বলি, উদ্ধৃত অংশের ব্যাখ্যা দিনতো দাদা, খোলাখুলি ভাবে, হালের ভাষায়। বলুনতো দাদা এই লেখা কার? রোদ্দুর রায়ের নয়তো? আমারতো মনে হয় রোদ্দুর রায় টাইপের কারো। না হলে এমন লেখা! আরেকটা লাইন তুলে দিই, ‘তৃষিত পরান আজি কাঁদিছে কাতরে/ তোমারে সর্বাঙ্গ দিয়ে করিতে দর্শন।’ সর্বাঙ্গের মধ্যে কোনটা বাদ যায়গো দাদা? আপনি দর্শন করাবেন, চোখ বন্ধ করে দর্শন হয় কি দাদা? হয় না। ধ্বজাধারী রবীন্দ্রভারতী উপাচার্যকে বলি, সত্যিই হয় না।
সুতরাং এই যে, আজকের সংকট, তা আপনাদেরই তৈরি করা। যদি বলতে দিতেন রবি ঠাকুর যা লিখেছেন তা অশ্লীল, জ্ঞানদাস যা লিখেছে তাও শ্লীল নয়। তারপরেও এটা জীবনের অঙ্গ। আর সে জীবন ব্যক্তি জীবন, জনজীবন নয়। প্রকাশ্য আর আড়ালের পার্থক্য বোঝাতে যদি বলে দিতেন, বদ্ধ কামরায় যা করা যায় প্রকাশ্যে তা করা আধুনিকতা নয়, অশ্লীলতা। যদি বলতেন, চুমু খাওয়া তোমাদের ‘ব্যক্তি’ আবেগের ব্যাপার, তা ‘জন’তে পরিণত করো না, তাহলে আপনাদের নৈতিক জোর থাকতো এমনসব কর্মকান্ডকে প্রতিরোধ করার। সেই জোরটা নেই বলেই পদত্যাগ করতে হয়। পদত্যাগী এসব ভীরুরাই ভারতের সাংস্কৃতিক আচার্য, আর আমাদের দেশে এদের ধ্বজাধারীরা। বলিহারি-রে ভাই এবং সাথে দাদা।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন