১১৫৬ বার পঠিত
বিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের দীর্ঘ ইতিহাসের একেবারে শেষে এসে প্রস্তর যুগের শেষ দিকে সংখ্যা হিসেবে ‘এক’ এর যাত্রা শুরু হয়। ‘শেষ প্রস্তর যুগ’ শুরু হয় আনুমানিক ৫০,০০০ বছর আগে আর শেষ হয় ১০,০০০ বছর আগে, কৃষিভিত্তিক সভ্যতা শুরু হওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে। অতি সম্প্রতি কঙ্গোতে পাওয়া শেষ প্রস্তর যুগের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের নাম ‘ইসাঙ্গো হাড়’ (Ishango bone)। বর্তমানে বেলজিয়ামের যাদুঘরে সংরক্ষিত এ হাড়টি বেবুনের পায়ের বাইরের দিকে লম্বা হাড়। হাড়টির সাথে একটা কোয়ার্টজ পাথরের টুকরা আটকানো আছে, খুব সম্ভবতঃ হাড়ের গায়ে দাগ কাটানোর জন্য। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সম্ভবতঃ এ হাড়টিকে টালি করার কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল, কারণ হাড়ের গায়ে লম্বালম্বি বরাবর তিনটি স্তম্ভে দাগ কাটানো আছে, এর প্রত্যেকটি দাগ ‘এক’ সংখ্যা বুঝায়। হাড়ের এক পাশে ৬০ টি দাগ কাটা আছে, আরেক পাশেও ৬০ টি দাগ কাটা আছে এবং পেছনে গ্রুপ করে মোট ৪৮ টি দাগ কাটা আছে। বিজ্ঞানীদের মতে গণনা না করলে সমান সংখ্যার তালিকা বা গ্রুপ থাকত না। কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, দাগ কাটার কারণ তাতে হাড়টি ভাল করে ধরতে সুবিধা হবে, ব্যবহার উপযোগিতা এর মূল কারণ, এর সাথে গাণিতিক কোন সম্পর্ক নেই। ঘটনা যাই হোক না কেন, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ধরলে এসব হাড়ই মানুষের প্রাথমিক গননার প্রমান। যে স্থানে হাড়টি পাওয়া গেছে, গবেষণা করে দেখা গেছে সেটি প্রায় ২০০০০ বছরের পুরনো। প্রাণিবিজ্ঞানীরা আমাদের জানান অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণিরা তিন বা চার সংখ্যার উপরে বুঝতে পারে না, সেখানে মানুষ অনেক বেশি সংখ্যা বুঝতে শুরু করে, ইসাঙ্গো হাড় তাই মানুষের ইতিহাসে একটা মাইলফলক হয়ে আছে।
চিত্রঃ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ‘ইসাঙ্গো হাড়’
চিত্রঃ ইসাঙ্গো হাড়ের গায়ে দাগ কেটে গণনা
ইসাঙ্গো হাড়কে যদি মানুষের গননা কাজের জন্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে না মানা হয়, তাহলে ‘এক’ এর তথা সংখ্যার ইতিহাস জানতে আমাদের আরো কয়েক হাজার বছর অপেক্ষা করতে হবে। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ সালের দিকে সুমেরিয়াতে এসে হাড়ের বদলে একটা প্রতীক (টোকেন) ব্যবহার করতে দেখা যায় হয়। টোকেন ব্যবহার করার কারণে সুমেরিয়রা এমন কিছু করতে সমর্থ হয় যেটি পূর্বে আর কারো পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। যেমন, হাড়ের দাগ কাটা হলে সেটা গণনা করতে সুবিধা হয়, কিন্তু টোকেন বানানোর ফলে সংখ্যাকে আলাদা করা এবং আলাদা করে বহন করা সম্ভব হয়। যার ফলে গণিতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আবিষ্কার তথা পাটিগণিতের আবিষ্কার হয়।
কিন্তু কেন সুমেরিয়াতে পাটিগণিতের আবিষ্কার হয়? সেটা অন্য কোথাও হয় নি কেন?
দুনিয়ার অনেক আদিবাসী, যারা আমাদের নিকট প্রস্তর যুগের শেষ প্রতিনিধি, তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তাদের সংখ্যার ধারণা ‘এক এবং বহু’র ধারণাতে সীমাবদ্ধ। এ দুটি ধারণা দিয়ে তারা কোন সমস্যা ছাড়া হাজার হাজার বছর কাটিয়ে দিয়েছে। তাদের ভাষায় দেখা যায় ‘এক’ সংখ্যাটা আছে, কিন্তু এর বেশি বলতে গেলে তারা দাগ কেটে টালি করে বুঝায়। প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাস করার জন্য তাদের জীবনে এর চেয়ে বড় কোন সংখ্যার প্রয়োজন হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বলা যায়, ‘এক এবং বহু’, ‘One and Many’ এর সমস্যা আজো আমাদের ধর্ম এবং দর্শনের মৌলিক একটা বিভেদ। কেন কিছু মানুষ এক ঈশ্বরের উপাসনা করে, আবার কিছু মানুষ বহু ঈশ্বরের উপাসনা করে? মানুষের মনের গড়নেই এ প্রশ্নের জবাব আছে। মানুষ তার অভিজ্ঞতায় একই সাথে এক এবং বহুর ধারণা পায়। পণ্ডিত আলডাস হাক্সলির ভাষায়,
“Human mind is both diverse and simple, simultaneously many and one. We have an immediate perception of our own diversity, and of that of the outside world. And at the same time, we have immediate perceptions of our own oneness.”
মানুষের জন্ম, মৃত্যু এবং জীবনের যত সব অভিজ্ঞতা তাতে একের অনুভূতি প্রবল। সে একা জন্ম নেয়, মারা যায় একা, তার অভিজ্ঞতাও অনন্য, দুনিয়ার আর কারো তার মতো ঠিক একই অভিজ্ঞতা হয় না। চোখ বুঝলে মানুষ শুধু নিজের অস্তিত্ব টের পায়, সমগ্র বিশ্ব তার অস্তিত্বে বিলীণ হয়ে যায়, তার মধ্যে একটা একত্বের অনুভূতি হয়। আবার চোখ মেলে যখন দুনিয়াটা দেখে, ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তখন এর নানা বৈচিত্র্য দেখে তার মধ্যে বহুত্বের অনুভূতি হয়। একত্ববাদী ধর্ম এর সমাধান দেয় এই ভাবে, ‘Unity in Diversity, Diversity in Unity’। কিন্তু বহুত্ববাদীরা সাকার পূজারী তাই তারা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে বহুর উপাসনা করে। এই ‘এক আর বহু’র উপাসনা নিয়ে অনেকের মাঝে একটা ভুল ধারনা প্রচলিত আছে, সেটা হলো, মানুষ আগে বহু ঈশ্বরের উপাসনা করতো, সেখান থেকে বিবর্তিত হয়ে ধীরে ধীরে এক ঈশ্বরের ধারনা এসেছে। আসলে দুটোই সমান পুরনো, প্রাচীন সমাজে মানুষ একই সাথে একত্ববাদী এবং বহুত্ববাদী উভয় ধরনের উপাসকে বিভক্ত ছিল, দুটো ধারাই একসাথে এগিয়েছে।
যাই হোক আমরা একে’র ইতিহাসে ফেরত আসি। প্রশ্ন ছিল, কেন এত জায়গা থাকতে সুমেরিয়াতে এসে পাটিগনিতের আবিষ্কার হয়? এর অন্যতম কারন হলো, সুমেরিয়াতে শহুরে সভ্যতার কারনে একই জায়গায় অনেক মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করে যার ফলে তাদের মধ্যে হিসাব এবং বন্টন পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তাদের জন্য শহরের মোট জনসংখ্যার হিসাব রাখতে, গবাদি পশু, শস্যের পরিমাণ ইত্যাদি জানা খুবই জরূরি ছিল। এ কাজে মাটির তৈরি কোণাকৃতির টোকেন তাদের সম্পদের পরিমাণ, আয়-ব্যয়, লাভ-লোকসানের হিসেব রাখতে সাহায্য করে। আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, শহরের কর আদায়ের জন্যও এটি ব্যবহৃত হতো। কীলকের (ক্যুনিফর্ম) উপরে লেখার আবিষ্কারও হয় এই এলাকাতেই। মজার ব্যাপার হলো প্রথম লেখার বিষয়-বস্তু কোন কাব্য-সাহিত্য, রূপকথা বা প্যাঁচালী ছিল না, এর বিষয়বস্তু ছিল একেবারে বৈষয়িক লেনদেনের হিসাব। তাই বলা যায় সংখ্যা হলো পৃথিবীর আদিম লেখা, বিভিন্ন লেনদেনের হিসেবের রেকর্ড রাখতে গিয়ে লেখার উদ্ভব হয়। তখনকার দিনে অল্প কিছু সংখ্যক মানুষকে গণিত এবং সংখ্যার হিসাব রাখার কাজে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো, এবং তারা সমাজে খুবই সম্মানিত ছিল। মোট কথা সুমেরিয়ায় সংখ্যা হিসেবে ‘এক’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্যাদার আসন লাভ করে, শহুরে সভ্যতার গোড়াপত্তনে এর অবদান অনস্বীকার্য।
চিত্রঃ মিশরের পরিমাপের একক ‘কিউবিট’
শহুরে সভ্যতার পরে সাম্রাজ্যের হাতিয়ার হিসেবে ‘এক’ আবারো তার গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয় মিশরের ফেরাউনদের সময়ে। তাদের হিসেবে এক, দশ, শত, এমনকী মিলিয়ন পর্যন্ত সংখ্যা দেখা যায়। ফেরাউনদের সংখ্যার প্রতীক হিসেবে মিলিয়নের মত বড় সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। ফেরাউনদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো বিশাল বড় পিরামিড এবং প্রাসাদ নির্মাণ। এ নির্মাণ কাজের জন্য তারা পরিমাপের জন্য একক ব্যবহার করে এবং খুব কঠোরভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করে যাতে নির্মাণকাজে কোন ত্রুটি না হয় এবং সবাই একই একক ব্যবহার করে। এক সংখ্যাকে গণনার কাজ থেকে পরিমাপের এককে পরিণত করাটা মিশরিয়দের কৃতিত্ব, যেটা তাদের আগে কেউ করে নি। এর ফলে তারা ‘এক’কে সবকিছু পরিমাপের এককে পরিণত করে। তারা একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের কনুই থেকে হাতের আঙ্গুলের ডগা পর্যন্ত দৈর্ঘের সাথে অপর হাতের আঙ্গুলের প্রস্থ যোগ করে তাদের পরিমাপের একক তৈরি করে, যার নাম হলো ‘কিউবিট’। অফিসিয়াল কিউবিটকে খুব পাহারার মধ্যে রাখা হতো যার থেকে কপি বানিয়ে সেসকল কপি প্রতিদিন সকালে কর্মীদের দেয়া হতো। আধুনিক যুগে যেমন দৈর্ঘ্যের একক ‘মিটার’ সংরক্ষণ করা হয়, তেমনি তারাও তাদের পরিমাপের একক সংরক্ষণ করতো।
মিশরিয়রা ‘এক’ সংখ্যাকে পরিমাপ এবং শাসনের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু একের ইতিহাসের পরবর্তী পর্যায়ে গ্রিসে এসে ‘এক’ আরো মহিমা নিয়ে হাজির হয়। এক হয়ে পড়ে অন্যতম গ্রিকদেবতা। গ্রিক দার্শনিক পাইথাগোরাস ছিলেন ‘এক’ নিয়ে অবসেসড। তিনি প্রথম জোড় এবং বেজোড় ধারণার প্রচলন করেন, এবং সংখ্যাকে লিঙ্গ দান করেন, তার কাছে এক হলো পুরুষ আর দুই মানে নারী। কিছু পূর্ণসংখ্যা দিয়ে তৈরি জ্যামিতিক আকার তার কাছে খুবই আকর্ষণীয় ছিল, যেমন তিনটি সংখ্যা মিলে তৈরি হয় ত্রিভুজ, চারটি সংখ্যা মিলে হয় চতুর্ভুজ। এক, দুই, তিন আর চারের যোগফল দশ দিয়ে তৈরি হয় যাদুকরী ত্রিভুজ (ম্যাজিক ট্রায়াঙ্গল)।
গ্রিক দর্শনের আয়োনিয়ান ধারায় বস্তুজগতের ব্যাখ্যায় প্রাকৃতিক ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করে একটা মূলবস্তু খোঁজার চেষ্টা করা হয়, যার থেকে সব কিছু সৃষ্টি হয়েছে। একটা আদি বিন্দু নির্দেশ করা ছিল তাদের জ্ঞানচর্চার অন্যতম শর্ত। যেমন, গ্রিক দার্শনিক থ্যালিস ভাবতেন পানি দিয়ে জগতের সৃষ্টি, তার কাছে পানি ছিল মৌলিক কণা। সেরকম হেরাক্লিটাস ভাবতেন আগুন থেকে সব সৃষ্টি, আর এনাক্সিমেনেস বাতাসকে প্রাকৃতিক সৃষ্টির মূল উপাদান বলে মনে করত। অপরদিকে পাইথাগোরিয়ান স্কুল বিমূর্ত সংখ্যা এবং জ্যামিতি দিয়ে বস্তুজগতকে ব্যাখ্যা করেন। পাইথাগোরাসের মতে বস্তুনিচয় হল সংখ্যা (things are numbers)। তিনি এমনকী সঙ্গীতও সংখ্যা দিয়ে তৈরি বলে মনে করতেন।
১ বাদে অন্য পূর্ণসংখ্যাগুলো যেহেতু একের সমষ্টি, তাই পাইথাগোরাস মনে করতেন ‘এক’ দিয়ে বা ‘এক’ হতেই জগতের সৃষ্টি। একের জন্য এত বড় মর্যাদাকর অবস্থান এর আগে আর কখনো আসেনি। কিন্তু খুব শীঘ্রই পাইথাগোরাসের সমগ্র বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত নেমে আসে এবং খুবই বিয়োগান্তক ভাবে সেটা আসে ত্রিভুজ থেকে। যে ত্রিভুজ তাঁকে জগদ্বিখ্যাত করে সেই ত্রিভুজই তার জীবন ও দর্শনের গতিরোধ করে দাঁড়ায়। সবকিছুর মূলে যদি এক থাকে, তাহলে ত্রিভুজের মূলেও এক সংখ্যা থাকবে। কিন্তু সমদ্বিবাহু সমকোণী ত্রিভুজের ক্ষেত্রে পাইথাগোরাস প্রত্যেক বাহুকে একটি একক সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করতে চেষ্টা করতে ব্যর্থ হন। তার এক শিষ্য পাইথাগোরাসকে এ বিষয়টা অবগত করালে পাইথাগোরাসের সমর্থক গোষ্ঠী তাকে ডুবিয়ে মেরে ফেলে। হিপ্পসাস নামক পাইথাগোরাসের শিষ্য ‘স্কয়ার রুট ২’ আবিস্কার করেন। হিপ্পসাস পাইথাগোরাসের সদ্য আবিস্কৃত সমকোণী ত্রিভুজের সূত্র ব্যবহার করে, দুই বাহুর দৈর্ঘ্য ১ একক ধরে, অতিভুজ বের করতে গিয়ে একটা গোল বাধিয়ে ফেলেন। তিনি কিছুতেই অতিভুজ হিসাবে যে ‘স্কয়ার রুট ২’ পেয়েছেন তার মান আর হিসাব করতে পারছিলেন না। পরে বুঝলেন যে, এটা আর সব অন্য মুলদ সংখ্যার মত নয়, যাদের দুইটি পুর্ণ সংখ্যার ভাগফল আকারে লেখা সম্ভব। পরবর্তিতে আরো এরকম সংখ্যা আবিস্কৃত হয়। আর গণিতবিদেরা এদের নাম দেন অমুলদ সংখ্যা। অমূলদ সংখ্যার ধারণা পাইথাগোরাসের ‘এক’ উপাসনার সমাপ্তি ঘটায়।
চিত্রঃ সমদ্বিবাহু সমকোণী ত্রিভুজের সব বাহুকে ‘এক’ পূর্ণ সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা যায় না
একের ইতিহাসের এর পরের পর্যায়ে রূপান্তর ঘটে রোমে। পাইথাগোরাস এবং তার পূর্ববর্তী মানুষেরা এক সংখ্যাকে বিমূর্ত ভাবতে পারেনি, তারা সব সময় এক সংখ্যাটিকে কোন না কোন বাস্তব বিষয় বা পরিমাপের একক হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু পাইথাগোরাসের পরে যেসব গণিতবিদ এসেছেন তারা এক’কে এসব থেকে মুক্ত করেন। যার ফলে আধ্যাত্মিকতা থেকে একের বিচ্ছেদ ঘটে বিমূর্ত সংখ্যা ‘এক’ এর জন্ম হয়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন গণিতবিদ আর্কিমিডিস, তিনি সংখ্যা নিয়ে খেলতে পছন্দ করতেন। তাঁর সময়ে ‘এক’ সংখ্যাটি বিশ্বের মূল কেন্দ্রের ধারণা থেকে নেমে তাত্ত্বিক গণিতের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।
খ্রিস্টপূর্ব ২১২ সালে রোমানরা সিরাকিউস আক্রমণ করলে আর্কিমিডিসের সাথে প্রাচীন যুগের তাত্ত্বিক গণিতেরও সমাপ্তি ঘটে। রোমানরা গ্রিকদের মতো তাত্ত্বিক বিষয়ে আগ্রহী ছিল না, তারা ছিল ক্ষমতায় বিশ্বাসী, ফলে ‘এক’ হয়ে পড়ে রোমানদের দাস। তাত্ত্বিক বিষয় ছেড়ে ‘এক’ হয়ে পড়ে রোমান সেনাবাহিনীর একক। সৈন্যবাহিনীর প্রতি সেকশানে থাকত দশজন, এরকম দশটি সেকশান বা ১০০ জন্য সৈন্য মিলে হত সেঞ্চুরি। দুই ‘সেঞ্চুরি’ মিলে হত ‘ম্যানিপুলাস’। এমনকী সৈন্যবাহিনীর শাস্তির ক্ষেত্রেও সংখ্যা ব্যবহার করা হতো। কোন লিজিয়ন যদি যুদ্ধে পরাজিত হতো, তবে সম্পূর্ণ লিজিয়নকে ডেসিম্যাটেড (Decimated) করা হতো। অর্থাৎ ব্যক্তিগত মূল্যায়ন না করে প্রতি সেকশান (দশ জন) থেকে একজন সৈন্যকে শাস্তি হিসেবে মেরে ফেলা হতো। রোমান গণনা পদ্ধতিও এমন যে তা শুধু রেকর্ড রাখার জন্য সহায়ক ছিল কিন্তু তা দিয়ে গণিত চর্চা করা ছিল অসম্ভব, এজন্য প্রাচীন গ্রিসের মতো রোম থেকে কোন গণিতবিদের কথা জানা যায় না। পরবর্তী ৫০০ বছর রোমানদের ক্ষমতার বিস্তারের সাথে সাথে রোমান সংখ্যা পদ্ধতিও পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকী তাদের ক্ষমতা যখন স্তিমিত হয়ে পড়ে তখনও তাদের সংখ্যা পদ্ধতি বজায় থাকে।
রোমান সংখ্যা পদ্ধতির বিলোপ ঘটে আরবি সংখ্যা দিয়ে, যেটি আসলে ভারতীয় দশভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি। আরবদের হাত দিয়ে এটি ইউরোপে প্রবেশ করায় আধুনিককালে এটি আরবি সংখ্যা নামে পরিচিত। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সালে ভারতীয়রা এক থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যার জন্য একটা করে প্রতীক তৈরি করে। তারপর ৫০০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে শুন্যের আবিষ্কার দুনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে আমূল পরিবর্তন এনে দেয়। এ দশটি প্রতীক দিয়ে তারা অসংখ্য সংখ্যা তৈরি করতে সমর্থ হয় যেটা এর পূর্বে কারো পক্ষে সম্ভব হয় নি। ভারতের গোয়ালিয়রের মন্দিরের গায়ে আজ থেকে ১১০০ বছর আগের লেখা খোদাইতে শুন্যের প্রয়োগ দেখা যায়। মন্দিরের পূজার ফুল সরবরাহ করার জন্য ২৭০ হাত দৈর্ঘ আর ১৮৭ হাত প্রস্থের বাগান তৈরির কথা বলা আছে।
চিত্রঃ ইতালির বিখ্যাত গণিতবিদ ফিবোনাচ্চি
মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের হাতে বীজগণিত আবিষ্কারের সময় পর্যন্ত ইউরোপে রোমান সংখ্যার দাপট বজায় ছিল। ইতালির বিখ্যাত গণিতবিদ ফিবোনাচ্চি ১১৮০ সালের উত্তর আফ্রিকার আলজেরিয়ায় প্রথম ভারতীয় সংখ্যার ব্যবহার দেখতে পান। ১২০২ সালে ফিবোনাচ্চি সংখ্যা গণনা নিয়ে একটি বই লিখেন, সে বইয়ে তিনি ইউরোপিয়ানদের কাছে ভারতীয় সংখ্যা পদ্ধতির ব্যবহার তুলে ধরেন। তাঁর বই থেকে ব্যবসায়ীরা ভারতীয় সংখ্যা পদ্ধতির ব্যবহারোপযোগিতা বুঝতে পারেন, ফলে হিসাব বিজ্ঞান থেকে খুব দ্রুত রোমান সংখ্যা সরে যায় এবং আরবি সংখ্যা তার স্থান নিয়ে নেয়। ইউরোপে পুঁজিবাদের জন্মের সময়ে রোমান সংখ্যা পদ্ধতি যৌগিক সূদের হিসেব করার উপযোগি ছিল না, ভারতীয় সংখ্যা গৃহীত হবার পেছনে সেটাও একটা কারণ।
চিত্রঃ বাইনারি সংখ্যার প্রবর্তক দার্শনিক, বিজ্ঞানী লাইবনিজ
একের বিবর্তনের সর্বশেষ পর্যায় আসে সপ্তদশ শতকে, জার্মান গণিতবিদ লাইবনিজের মাধ্যমে, লাইবনিজ সংখ্যার গণনায় মানুষের ভুল এড়াতে কৃত্রিম গণনার মেশিন বানানোর চেষ্টা করেন। তাঁর মেশিনে কেবল ১ এবং শুন্য (০) এ দু‘টি সংখ্যা ব্যবহার করা হয়, যা বাইনারি সিস্টেম নামে পরিচিত। এতে শুধুমাত্র দুটি সংখ্যা থাকায় যান্ত্রিক গণনার জন্য এ পদ্ধতি খুবই উপযোগী। আজকের কম্পিউটার এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির সবকিছু এ বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে এক এবং শুন্য দিয়ে কেবল গণনা নয়, বলতে গেলে সবকিছুই করা সম্ভব। পাইথাগোরাস কিছুটা হলেও সত্য বলেছিলেন, থিংস আর রিয়েলি নাম্বারস। আজকের ডিজিটাল দুনিয়ায় যে কোন বিষয়কে সংখ্যায় (১, ০) পরিণত করা সম্ভব। পরিশেষে এক (১) এর ইতিহাস থেকে দেখা যায়, মানুষের বস্তুজগতকে বুঝার তাগিদ থেকে ‘এক’ সংখ্যার যাত্রা শুরু হয়, সে থেকে আজ অবধি ‘এক’ দাপটের সাথে তার আধিপত্য বজায় রেখেছে।
আরো জানতেঃ
ইউটিউব ভিডিও’র লিংক: সংখ্যা হিসেবে ‘এক’ এর ইতিহাস।
জুলাই ৪, ২০১৭; ৭:৩১ অপরাহ্ন
আপনার লেখা পড়ে গণিত বিষয়ে অনেককিছুই জানতে পারলাম। ধন্যবাদ জানবেন।
জুলাই ৪, ২০১৭; ১১:৪২ অপরাহ্ন
মন্তব্য করার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।