১
১৮৩২ বার পঠিত
ছাত্র ইউনিয়নের অনুষ্ঠানের রিহার্সেলে সঞ্জীব চৌধুরী, মানে আমাদের সঞ্জীবদার সঙ্গে প্রথম দেখা। আমাদের গান শেখাচ্ছিলেন শক্সকর সাঁওজাল। রিহার্সেল শেষে চারুকলার সামনে খুপরি ঘরের চায়ের দোকানে আড্ডা। তারপর আর থেমে থাকে নি সম্পর্কের চাকা। ‘সঞ্জীবদা’ থেকেও তিনি বন্ধুর চেয়েও বন্ধু, আপনের আপন হয়ে উঠেছিলেন। তাঁকে দেখলেই বলে উঠতাম, ‘এ আজব কোন জীব? সঞ্জীব সঞ্জীব!!’
সে সব আশির দশকের কথা। আমি তখন দেদারছে গান লিখছি বাংলাদেশের উঠতি প্রতিশ্রুতিশীল সব শিল্পীদের জন্য। সামিনা, কনকচাঁপা, তপন চৌধুরী, সবার জন্য। এসব গান আমাদের আধুনিক গানের প্রচলিত ধারার গান। সঞ্জীবদা বলতেন, ‘এই বেয়াদব ছেলে, তুমি সবার জন্য গান লেখো আমার জন্য লেখো না। আমার জন্য গান লেখো, আমি গাব।’
আমি বলতাম আপনি সিরিয়াসলি গান করেন আমি লিখবো। তখন সঞ্জীবদা ঘরোয়া আড্ডায়, বা খুপরি ঘরের চায়ের দোকানে বসে গুন গুন করে গাইতেন। শাহ আবদুল করিমের গান এত দরদ দিয়ে আমি কাউকেই গাইতে দেখিনি। সঞ্জীবদা মাঝে মাঝে আমাদের মিটফোর্ড ক্যাম্পাসে আসতেন। তখন রাতের বেলা নৌকা ভাড়া করে মুড়ি আর চানাচুর নিয়ে আমরা চারজন বুড়িগঙ্গায় ঘুরে বেড়াতাম। রাতের পুরনো ঢাকার যে অপার সৌন্দর্য তা বুড়িগঙ্গার নৌকা থেকে না দেখলে বোঝা যায় না। এটা আমার খুব প্রিয় একটি সময় কাটানো। এই সময় কাটানোতে শামিল হয়েছেন আরও অনেকে। অকালে ঝরে যাওয়া আরেক সঙ্গীত শিল্পী হ্যাপী আখন্দ। কিন্তু সঞ্জীবদার জন্য গান লেখা হলো না তখন।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি আমি উচ্চশিক্ষার জন্য চলে এলাম আমেরিকায়। পড়ালেখার চাপে বাংলাদেশের অনেক কিছুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হয় না তখন। বাংলাদেশে এরপর মিডিয়া বিপ্লব ঘটে গেলো। অনেকগুলো বেসরকারি টিভি চ্যানেল। সরকারি টিভির আমলাতান্ত্রিক নিগর থেকে মুক্তি পেলো নাটক, গান, সৃজনশীল অনেক কিছু। হঠাৎ একদিন একটি ভিডিওতে ‘ঈদের ঢোল’ অনুষ্ঠান দেখছি।
বাংলদেশের সাতটি প্রথম সারির ব্যান্ড মিলে একটি গান করেছে: দলছুট, রেনেসাঁ, সোলস, ফীডব্যাক ও অন্যান্য। সেখানে দলছুটের শিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী, মানে আমাদের সঞ্জীবদা। গানের কথা: ‘একটাই পৃথিবী আমাদের, আমাদের পৃথিবী সঙ্গীতে’।
একটাই পৃথিবী আমাদের
আমার একাধারে আনন্দ ও বিস্ময় জাগে। এই গানটি আমার লেখা, বেশ আগে লিখে সুরকার নকীব খানকে দিয়ে এসেছিলাম। এ সময়ের পটভূমির সঙ্গে মানানো একটি গান। সঞ্জীবদা গেয়েছেন আমার গান। সুদূর পরবাসে বসে ফেলে-আসা প্রিয় জগতের জন্য যে অপরিসীম কষ্ট তা কিছুটা ভুলে থাকি গানের বাণীর দর্শনে। আসলেও তো তাই, একটাই পৃথিবী আমাদের, আমাদের পৃথিবী সঙ্গীতে! আর বিনিসূতোর যোগসূত্র অনুভব করি সঞ্জীবদা এবং অন্যান্য প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গে।
এরপর একদিন আমার এক বন্ধু বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের কিছু গান রেকর্ড করে একটা সিডি পাঠালো সেই সেইন্ট লুইস থেকে। গানগুলো শুনতে শুনতে একটা গানের জায়গায় এসে থমকে যাই, এ কণ্ঠ আমার অতি চেনা। এ কথাও আমার চেনা:
আমি তোমাকেই বলে দেবো
কী যে একা দীর্ঘ রাত
আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে
https://www.youtube.com/watch?v=XOgZo66gKQA
সঞ্জীব দার গাওয়া গান। তাঁকে কখনও বলা হয়নি, বলা হলো না এটা আমার প্রিয় গানগুলোর একটি।
সঞ্জীবদার সঙ্গে আমার শেষ দেখা গতবার যখন বাংলাদেশে এলাম তখন। আমি যায়যায়দিন-এর সম্পাদক শফিক রেহমানের আমন্ত্রণে যায়যায়দিন কম্পপ্লেক্স দেখতে গিয়েছি। সেখানে প্রিয়ভাজন কবি, সাংবাদিক ব্রাত্য রাইসুর সঙ্গে দেখা। ব্রাত্য বললেন সঞ্জীবদাও এখানে। ওর কাছে থেকে ফোন নম্বর নিয়ে ফোন করি। মেসেস রাখি, ‘সঞ্জীবদা আমি ঢাকায়।’
পরদিন রাত বারোটায় আমার টেমপোরারি মোবাইলে সঞ্জীব দার ফোন, ‘সেজান, এক্ষুনি চলে আসো।’
‘কোথায়?’
‘সাকুরায়’।
ঢাকা আমার চেনা প্রিয় শহর হলেও কতকিছু বদলে গেছে। রিকশা চলে না কোনো কোনো রাস্তায়। তারপরও তক্ষুনি ছুটে যাই সাকুরায়। বুঝতে পারি আমার দেখা সঞ্জীবদাও অনেক বদলে গেছেন ঢাকা শহরের মতো। গান নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। পরিকল্পনা করি আমার বারোটা গান নিয়ে একটা সিডি করবো, সঞ্জীবদা গাইবেন। সিডির নাম হবে ‘যুগলবন্দী’। ছয়-সাতটা গান লেখা হয়ে গেছে, বাকিগুলো শেষ করলেই হাত দেবো এটার কাজে। সেদিন সাকুরার হইচইয়ের মধ্যেও খালি গলায় সুর ধরেন সঞ্জীবদা। আমি ভাবতে থাকি এই গান নিয়ে আলোচনা কালকে মনে রাখার মতো প্রকৃতস্থ আছেন কিনা। আমি রাগারাগি করি সঞ্জীবদার সঙ্গে। বলি, জীবনকে অপচয় করা অপরাধ, অন্তত আমাদের দেশের মানুষদের জন্য। তারপর ভাবি একথা কেন বলি? যিনি বলতে পারেন ‘আমি তোমাকেই বলে দেবো, কী যে একা দীর্ঘ রাত, আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে’ তিনি তো বিরান পথে একার হাঁটার মানুষ। সব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিরান পথে হেঁটে, জীবনের পাকে নেমে মুক্তো তুলে আনতে ক’জন পারে? আমাদের চারপাশের প্রতিষ্ঠালিপ্সু মিডিওকার মানুষদের তুলনায় তিনি অনেক আলাদা, অনেক অন্যরকম।
সঞ্জীবদার অসুস্থতা, এরপর মৃত্যুর খবর পাই। বিমূঢ় হয়ে বসে পড়ি। তাঁর গান কানে বাজে, আর আমি বিরান পথের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি, ঝাপসা চোখে বুকের হু হু কান্নার অবিশ্রান্ত ধারা। সঞ্জীবদা, তোমার জন্য গানগুলো লেখা হলো না, হলো না যুগলবন্দী। তবু এ আমি নিশ্চিত জানি, একটাই পৃথিবী আমাদের, আমাদের পৃথিবী সঙ্গীতে! সেই পৃথিবীতে তুমি বেঁচে থাকবে চিরকাল।
https://www.youtube.com/watch?v=2Rs4VPqYpIk
স্বপ্নবাজি
https://www.youtube.com/watch?v=Z-g7ijP_h5s
এই নষ্ট শহরে
[পুনঃপ্রকাশ]
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
জুন ১০, ২০২৩; ৭:৫৫ অপরাহ্ন
তবে এই হোক
তীরে জাগুক প্লাবন
দিন হোক লাবণ্য
হৃদয়ে শ্রাবণ….
তুমি কান্নার রঙ
তুমি জোছনার ছায়া….