<<< ১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন <<<
এটি এখন জানা গেছে যে, এ আদিম সমাজে শারীরিকভাবে অধিক শক্তিশালী পুরুষরা প্রায়শই নারীদের জোর করে, বলপূর্বক অপহরণ করে নিজের ঘরে নিয়ে তুলতো। অনিচ্ছুক রমণীকে বাগে আনতে গলায় হাতে পায়ে বাঁধন দেওয়া, আঘাত করে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া ইত্যাদির মত হিংস্র ও নির্মম পদ্ধতিও তারা অবলম্বন করতো। কয়েকশো বছরের এই তথাকথিত আচার-প্রক্রিয়ার ফলে যথাসম্ভব নারীর হাত পা গলার বন্ধন আর কপালের রক্তচিহ্ন তার বিশেষ পুরুষের অধীনস্থ হওয়ার সমার্থক হিসেবে পরিগণিত হয়ে যায়। পরবর্তীকালে এই অধীনস্থ হওয়া তথা বিশেষ এক পুরুষকে স্বামী বা প্রভু হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারটি তথাকথিত বিবাহ প্রথার জন্ম দেয়। কিন্তু এই বিবাহিত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে আদিম ওই চিহ্নাদি বেশ সম্পৃক্ত হয়ে মিশে থাকে। হাতে পায়ে গলার বন্ধন ধীরে ধীরে অলঙ্কারে পরিণত হয়। গলার হার, হাতে বা পায়ের বর্তুলাকার গয়নাগুলিকে অনায়াসেই এ আদিম বর্বর প্রথার প্রতীকী হিসেবে বোঝা যায়। একইভাবে মেরে ধরে রক্তপাত ঘটিয়ে নারীকে করায়ত্ত করার আদিম ক্রিয়াকাণ্ড রক্তবর্ণ সিঁদুরের জন্ম দেয়। প্রকৃত রক্ত না ঝরিয়েও তা একই অধীনতার প্রতীকী স্মৃতি বহন করে চলেছে।
কিন্তু এখন যাঁরা সিঁদুর পরেন তাঁদের মনে এ আদিমতার স্মৃতি নেই। সধবা থাকার আনন্দেই তাঁরা সিঁদুর পরেন। অভ্যস্ত দৃষ্টির সামনে তা প্রসাধনের কাজও করে। এই প্রসাধনিক সৌন্দর্য নিছক আপেক্ষিক ও মানসিক ব্যাপার। আমরা আমাদের চারপাশে এইভাবে আমাদের মা-স্ত্রী-বোনেদের দেখি বলেই তার এই গুরুত্ব। একসময় চীনদেশে যেমন খুব ছোট পা-ওয়ালা মেয়েদের সুন্দরী ও সৌভাগ্যবতী হিসেবে গণ্য করা হতো। তার জন্য ছোটবেলায় লোহার জুতো পরিয়ে পাকে বাড়তে না দেওয়ার নিষ্ঠুর প্রথাও সৃষ্টি হয়েছিল। কিছু আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে নারীদের লম্বা গলাকে সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। একারণে মেয়েদের গলায় একাধিক বালার মতো অলঙ্কার পড়িয়ে গলা লম্বা করার চেষ্টাও চলে। আমরা এখানে এমন লম্বা গলার বা ছোট পায়ের মেয়েকে দেখলে হয়তো কুৎসিতই বলবো। অন্তত একারণে সুন্দরী বলা হবে না। একইভাবে ‘পরণে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর’ পড়া আমাদের গৃহবধূদের দেখে চীন দেশের লোকরাও হয়তো আঁৎকে উঠবে; কিংবা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে।
বিবাহিত নারীদের সিঁদুর পরাকে অনেকেই আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ধর্মীয় পরিচয়ের অঙ্গীভূত হিসেবে গণ্য করেন। খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-আশাক, আচার-অনুষ্ঠান, গান-বাজনা, ইত্যাদি নানা কিছু নিয়ে বিশেষ জনগোষ্ঠীর যে তথাকথিত নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বেড়ে উঠে, তারই একটি ক্ষুদ্র অংশ এই সিঁদুর পরা। এই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ছবি চিরন্তন কিছু নয়। সময়ের সঙ্গে তা পাল্টায় এবং একসময় অপ্রাসঙ্গিক ক্ষতিকর হয়ে উঠলে তা সক্রিয়ভাবে পাল্টানো উচিত। সিঁদুর পরার ক্ষেত্রে ব্যাপারটিকে এভাবে পরিবর্তিত বা অবলুপ্ত করার প্রয়োজনীয়তা সার্বিকভাবে দেখা যায়নি। তাই তা লোকাচার বা লোক সংস্কৃতি, যেভাবেই হোক না কেন এখনো টিকে রয়েছে। এরমধ্যে নারী-পুরুষের বৈষম্য, পুরুষ আধিপত্যবাদ, শুধুমাত্র নারীকেই বিয়ের পর চিহ্নিত করার তথা পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করার মানসিকতা, আদিম বর্বর প্রথার ধারাবাহিকতা ইত্যাদি ছাপিয়ে প্রশ্নহীন প্রতিবাদহীন অভ্যাস কাজ করে চলেছে আপন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি সম্ভ্রমবোধ থেকে একটি আবেগও গড়ে উঠেছে যে আবেগ যুক্তিবুদ্ধির ধার ধারে না। এবং মানুষ শুধু যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক তথ্যাদির যান্ত্রিক ও নীরস বৈদগ্ধে বাঁচে না, তার মধ্যে যুক্তিহীন আবেগও থাকেই।
কিন্তু এর পাশাপাশি এমন একটা ধারণাও বেশ চালু আছে যে, সধবা নারীর সিঁদুর পরা হিন্দু নারীর লক্ষণ। এ ব্যাপারটি কিন্তু একেবারেই মিথ্যা। বেদ বা উপনিষদের মতো আদি সনাতনী-ধর্মসাহিত্যে সিঁদুর পরার কোন বিষয়ই নেই। যে গুপ্তযুগকে সনাতনধর্মের স্বর্ণযুগ হিসেবে অভিহিত করা হয় এবং যেসময় সনাতন ধর্মের বৈশিষ্ট্যগুলি বিধিবদ্ধ করা হয়, সে সময়ও এমন প্রথা ছিল না।
আসলে অনেক অনেক পরে, একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে রাঢ় অঞ্চলের দিকেই এ প্রথা লোকাচার হিসেবে প্রচলিত হয়। এই প্রচলনের পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন একাদশ শতাব্দীর সামবেদীয় পণ্ডিত ও রাঢ়ীয় সাবর্ণ গোত্রের শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মা ভবদেব ভট্ট এবং দ্বাদশ শতাব্দীর যজুবেদীয় ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পশুপতি। এঁরা বেদ, স্মৃতি বা পুরাণের কোন সমর্থন বা নির্দেশ অনুসারে এ কাজ করেন নি। তার কারণ এসবে সিঁদুর পরা সম্পর্কে এ ধরনের কোন নির্দেশই ছিল না। এঁরা‘শিষ্টসমাচারাৎ’-এর মাধ্যমে ভদ্রনারীর অনুসরণীয় প্রথা হিসেবে এর প্রচলন করেন। যথাসম্ভব ক্রমঅগ্রসরমান ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের থেকে হিন্দু নারীদের স্বাতন্ত্র্য ও ‘পবিত্রতা’ রক্ষা করতে (এ অঞ্চলে সাঁওতাল ইত্যাদি আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে আগে থেকেই বিয়ের সময় বরের হাতে বধূর কপালে সিঁদুর দেওয়ার কথা প্রচলিত ছিল। পরে তা সিঁথিতে উঠেছে এবং অন্যান্যদেরও তা প্রভাবিত করেছে)।
তবে সিঁদুর পরার সমর্থনে বৈদিক কিছু শ্লোকের উল্লেখ এঁরা বা অন্যান্য অনেকেই করে থাকেন। যেমন ভবদেব ভট্ট সামবেদের এই অংশটি উল্লেখ করেছিলেন ঘট স্থাপনার ও অধিবাসের সময় সিঁদুর দান প্রসঙ্গে-
ওঁ সিন্ধোরুচ্ছ্বাসে পতয়ন্তমুক্ষণম্
হিরণ্যপাবাঃ পশুমপ্ সুগভ্নতে।
এর প্রকৃত অর্থ- সিন্ধুনদের উচ্ছ্বাসের মত ঘৃতের ধারা যজ্ঞে পডুক।
ঋক্ ও যজুর্ব্বেদীয় প্রাসঙ্গিক শ্লোকটি হল –
ওঁ সিন্ধোরিব প্রাধ্বনে শূঘনাশো বাতপ্রমিয় পতয়ন্তি যহা।
ঘৃতস্যধারা অরুষো ন বাজী… ইত্যাদি।
এরও প্রকৃত অর্থ (যেমন সায়নাচার্য করেছেন) বেগবতী সিন্ধু নদী যেমন উঁচু থেকে প্রবল তরঙ্গে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার বেগ যেমন বায়ুর বেগকেও অতিক্রম করে অথবা রক্তবর্ণ অশ্ব যেমন কাঠের বেড়া ভেদ করে ছোটে, এ রকম মহাবেগে ঘৃতের ধারা (যজ্ঞের) আগুনের উপর পতিত হোক।
অর্থাৎ এগুলির সঙ্গে সিঁদুর-এর কোন সম্পর্ক নেই। আসলে ‘সিন্ধ’ শব্দের সঙ্গে অন্য শব্দের সন্ধিতে যে ‘সিন্ধোরুচ্ছ্বাসে’ বা ‘সিন্ধোরিব’ শব্দের সৃষ্টি হয়েছে, তার সঙ্গে ‘সিঁন্দুর’- এর ধ্বনি সাদৃশ্য দেখে এগুলিকে ‘সিঁদুর’-এর স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে হাজির করা হয়।
প্রকৃতপক্ষে ওই একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীর আগে এদেশের বিবাহিতা হিন্দু নারীরাও সিঁথিতে সিঁদুর পরতেন বলে কোন প্রমাণ নেই। প্রমাণ থাকা সম্ভবও নয়, কারণ এসময় মেয়েরা সিঁথিই কাটতো না। মেয়েদের চুল বাঁধা হতো পেছনের দিকে আঁচড়ে খোঁপা করে বা ঝুঁটি বেঁধে। সদ্য বিবাহিত নারীরাও ওইভাবেই চুল বাঁধতেন। তাই সিঁথিতে সিঁদুর পরার প্রশ্নই আসে না। বিবাহিত নারীর প্রথম গর্ভকালে একটি অনুষ্ঠান ছিল ‘সীমন্তোন্নয়ন’। তখনই কেবল ওই বধূর স্বামী তার চুলে সিঁথি কেটে দিতেন। সব মিলিয়ে এটি স্পষ্ট যে, বিবাহিতা নারীর সিঁথিতে সিঁদুর পরার সঙ্গে আমাদের এই অঞ্চলের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম ইত্যাদি সবগুলির সম্পর্কই অতি ক্ষীণ।
‘হিন্দুর সিন্দুর আসলে কতটা হিন্দুর, এবং আদৌ হিন্দুর কীনা’ – তা ভাবার বিষয়। কিন্তু তার সঙ্গে এক বিশেষ নারীকে বিশেষ পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত করা, অন্য পুরুষের যৌনাকাঙক্ষা বা লালসা থেকে নিজের এই সম্পত্তিটিকে মুক্ত রাখা ইত্যাদি মানসিকতার সম্পর্ক অতি দৃঢ়। অর্থাৎ মেয়েরা চেয়েছে বলে সিঁদুর পরা শুরু হয় নি, পুরুষরা চেয়েছে বলেই তা চালু হয়েছে। যা পরবর্তীতে মেয়েদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে।
তবে এ সিঁদুর শুধু সামাজিক অবমাননাই নয়, মেয়েদের শারীরিক ক্ষতিও করতে পারে। সিঁদুরে সাধারণত থাকে পারদঘটিত একটি পদার্থ (মারকিউরিক সালফাইড)। এটির প্রতি অ্যালার্জি হয়ে স্থানীয় চর্মরোগ, চুল উঠে যাওয়া ইত্যাদি ব্যাপার কোন কোন নারীর মধ্যে ঘটতে পারে এবং ঘটেও। এছাড়া ঘামের সঙ্গে মিশে এবং রান্নাঘরের ধোঁয়ার সংস্পর্শে এসেও এই রাসায়নিকটি ক্ষতিসাধন করতে পারে।
সিঁদুর পরার পেছনের সামাজিক ও ঐতিহাসিক এই সত্যকে উপলব্ধি করে যে নারী সুস্থ সুন্দর দাম্পত্য সম্পর্কের পাশাপাশি সিঁদুরকে বর্জন করেন তিনি অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এমন মুক্তমনা সচেতন মেয়েকে অভিনন্দন জানানোর চেয়ে আমাদের চারপাশের গড্ডালিকা স্রোতে ভেসে চলা মানুষ তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। সিঁদুর না পরা কোন বাঙালি নারী যখন ইউরোপ-আমেরিকায় যান, তখন তাঁকে এমন নোংরামির মুখোমুখি হতে হয়না। কিন্তু ভারতবর্ষের পরিবেশ-পরিস্থিতিতে একজন মুক্তমনা সিঁদুরহীন নারীকে প্রচণ্ড অপমানিত হতে হয়। ভারতবর্ষের পরিবেশে বিবাহিতা নারীর সিঁদুরবর্জন সাহসিকতার পরিচয় বটে। এই সাহস ও নানা অবাঞ্ছিত ঝামেলাকে মোকাবিলা করার সক্ষমতা সবার থাকবে তা আশা করা সম্ভব নয়। সিঁদুর বর্জন করে নিজেকে সবার থেকে আলাদা জাহির করা, বিতর্ক সৃষ্টি করা কিংবা আত্মপ্রচার করার মতো মানসিকতাও সবার থাকে না।
তাই আসল প্রয়োজন সিঁদুর ব্যবহারের অন্তর্নিহিত সত্যগুলিকে মানুষের সামনে বেশি বেশি করে তুলে ধরা। এর অর্থনৈতিক, অসার ও নারী-বিরোধী দিকগুলি সম্পর্কে ব্যাপক মানুষ সচেতন হলে সিঁদুর না-পরা নিয়ে মানুষের কুসংস্কারগুলিও আর থাকবে না। এবং সিঁদুর পরার ব্যাপারটিই তখন গুরুত্বহীন হয়ে উঠবে। পাশাপাশি আরও গুরুত্বপূর্ণ-এমন একটা সমাজের স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলা, যে সমাজে নারী-পুরুষ স্বাধীনভাবে তাদের নিজেদের জীবন গড়তে পারবেন। যে সমাজে নারী-পুরুষের পারস্পরিক প্রেম, যৌনতৃপ্তি ও সন্তানের সৃষ্টির পাশাপাশি দূর হবে একজনের ওপর আরেকজনের আধিপত্য করার প্রয়োজনীয়তা। তখন এভাবে নিজের সঙ্গিনীকে দাগা মারার ব্যাপারটিই ঘৃণ্য মানসিকতার পরিচয় বলে প্রতিষ্ঠিত হবে। নারীরাও অনুভব করতে পারবেন যে, শুধু ‘বিয়ে’ করার অপরাধে নিজের শরীরকে এভাবে চিহ্নিত করার মধ্যে চরম আত্মঅবমাননা ও দাসত্বের ব্যাপারটিই প্রধান।
তাই নারী-পুরুষের যৌথ উদ্যোগে গড়ে উঠুক সিঁদুর বর্জনের সামাজিক আন্দোলন, যা মুক্তচিন্তা, মানবিক মূল্যবোধ ও সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনেরই একটি অংশ।
কৃতজ্ঞতায়:
১. ডা: ভবানীপ্রসাদ সাহু, নারী: অস্তিত্ব ও সংস্কার
২. ডা: ভবানীপ্রসাদ সাহু, হিন্দু মৌলবাদ
৩. শিব নারায়ণ রায়, মূঢ়তা থেকে মানবতন্ত্রে
৫. বেদ
৬. শিবপুরান।
– শেষ –