০
২০৬১ বার পঠিত
২০৬১ বার পঠিত
অনলাইনে সমকামীদের বিয়ের অধিকার নিয়ে যে পরিমাণ সমালোচনা প্রত্যক্ষ করেছি এবং কিছু অপিনিয়ন লিডারেরা মূর্খের মতো এটাকে পুঁজিবাদের ফসল ইত্যাদি বলে যেভাবে প্রপাগাণ্ডা চালিয়েছে তা থেকে মনে হচ্ছে কতগুলো বিষয় না লিখলেই নয়।
আমি টানা ছয় বছর আমেরিকার দক্ষিণ এশীয় জাতীয় এইচআইভি-এইডস প্রতিরোধ কমিটি এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য হিসাবে কাজ করেছি। এই সূত্র ধরে প্রতি বছর লস এঞ্জেলেসে বাৎসরিক মিটিং করতে যেতে হতো। সেখানে বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, পাকিস্তানসহ সকল দক্ষিণএশীয় দেশগুলোর প্রতিনিধিরা এবং নানান সংগঠনের লোকজন থাকতেন। সেই মিটিং-এর একটি উদ্দেশ্যে থাকতো বিভিন্ন উচ্চ ঝুঁকির গ্রুপগুলোর সংস্কৃতিকে জানা। আমার দেখা সবচেয়ে বড় যে সমকামী গ্রুপটি, যাদের জন্যে লস এঞ্জেলেসের মতো জায়গায় বিরাট ক্লাব হাউস আছে, তারা হলেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মানুষেরা। এরা নিজেদের দেশে ধনী, এমনকী কেউ কেউ রয়্যাল পরিবারের সদস্য, কিন্তু দেশে থাকলে কেউ মেরে ফেলবে এই ভয়ে এরা আমেরিকায় চলে আসে। এদের না হয় বাবা-মা ধনী, আমেরিকায় আসার সামর্থ্য আছে, কিন্তু অনেক গরীব দেশের গরীব মানুষজন সামাজিকভাবে নিগৃহীত হওয়া ছাড়া আর কিছুই পায় না। এমনকী কোন কোন দেশে শুধু সমকামী হবার জন্যে মরতে হয়। আমি বহুবার বিচ্ছিন্নভাবে লিখেছি যে সমকামিতা অর্থই অবাধ যৌনতাকে সমর্থন তা ঠিক না। কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর বার বার দিতে হয়। এমন কি আমার ডাক্তার বন্ধুদের কেও দিতে হয়েছে বহুবার। আমি এখানে পয়েন্ট আকারে তুলে ধরি।
এক) সমকামিতা কি কোনো মানসিক বিকৃতি?
না। একেবারেই না। ১৯৯৩ সালের আগে মেডিক্যাল সায়েন্স-এ মনে করা হতো যে এটা মানসিক রোগ। কিন্তু বিস্তর গবেষণায় দেখা গেছে যে এটা কোন মানসিক রোগের শর্ত পূরণ করে না। যেমন, সমকামীরা অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতোই, সামাজিক বা প্রফেশনাল কাজে সমান পারদর্শী। বস্তুতপক্ষে, এদের মন মানসিকতা অনেক উদার, নরম, অন্যের প্রতি মায়ামমতায় ভরা। এ কারণেই, ১৯৯৩ সালে মনোরোগের টেক্সট বই থেকে রোগ সমকামিতাকে তুলে নেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, সারা পৃথিবীর সকল মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা মিলে এদের বিরুদ্ধে কোন বৈষম্য করাকে বেআইনি বা অন্যায় বলে মতামত দেন।
দুই) সমকামিতা কি প্রকৃতিবিরুদ্ধ? ছেলে এবং মেয়ের বিয়ে হয় শুধুই সন্তান উৎপাদনের জন্যে?
সন্তান জন্মানোই যদি বিয়ের উদ্দেশ্যে তাহলে প্রকৃতিগতভাবে যারা বন্ধ্যা তাদের কি বিয়ের অধিকার থাকবে না? সন্তান উৎপাদনের জন্যে কি একমাত্র যৌন সঙ্গম -ই প্রয়োজন? সেকথা না হয় বাদ-ই দিলাম। কেউ কেউ মূর্খের মতো সমকামিতাকে শুধু যৌনতার রূপ, পুঁজিবাদের ফসল যেখানে বাৎসল্য নেই আছে ভোগবাদ বলে চালিয়ে দিতে চান। এরা মূলত পুরো বিষয়টি সম্পর্কেই অজ্ঞ। একটি সন্তান উৎপাদনে অক্ষম যুগল যখন মিলিত হন তখন কী সেখানে কেবলই যৌনতা থাকে? ভোগবাদিতা থাকে? পৃথিবীতে যতো সমকামী যুগল তার চেয়ে অনেক বেশি বিষমকামী যুগলের কোন সন্তান নেই। তবে কী সেখানে কোন বাৎসল্য থাকে না? বিবর্তনের শরীরবিদ্যা না জানা থাকলেই এমন সরলীকরণ করা যায়।
তিন) সমকামিতা থাকলে জনসংখ্যা কমে যাবে এবং মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।
আমি পপুলেশন ডাইন্যামিক নামে একটি বিষয় পড়াই। সেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ, ডাব্লিং টাইম, রিপ্লেসমেন্ট ফার্টিলিটি সবকিছুই পড়াই। ইউরোপের জনসংখ্যা কম বা কমে যাচ্ছে যার কারণ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক। কতোভাগ মানুষ সেখানে সমকামিতার জন্যে জনসংখ্যা কমাচ্ছে? পৃথিবীর জনসংখ্যা এক মিলিয়ন থেকে ডাবল হতে সময় নিয়েছিল যা এখন চার থেকে আট বিলিয়ন হতে তার এক চতুর্থাংশ সময় নিচ্ছে। তাই জনসংখ্যা নিয়ে চিন্তিত হবার কিছু নাই। অন্যদিকে প্রকৃতিতে সাড়ে তিন হাজারেরও অধিক প্রজাতির মধ্যে সমকামিতা আছে কিন্তু তারা তো নিশ্চিহ্ন হচ্ছে না। কারণ, বিষমকামীরা তো থাকছেই।
চার) মানুষমাত্রেই কী ১০০% সমকামী অথবা ১০০ ভাগ বিষমকামী?
না। আধুনিক গবেষণায় দেখা যায় কোন মানুষই ১০০ ভাগ সমকামী বা ১০০% বিষমকামী না। বরং একটি মিশ্র রূপ। তবে সর্বশেষ গবেষণায় সমকামীদের মধ্যে বিশেষ জিনেটিক পাওয়া গেছে যা এক্স ক্রোমোজোম এবং ক্রোমোজোম ৮ এ, যা বিষমকামীদের থেকে আলাদা। এটা অনেক বড় বায়োলজিক্যাল প্রমাণ হতে পারে যে সমকামিতা মূলত জিনেটিক। তবে অন্যান্য জিনেটিক প্রিডিস্পোজিশন এর মতো এটাও সমাজ, সংস্কৃতি, ব্যক্তিগত চয়েস, পরিবেশ অনেককিছুই মিলিয়ে এই রূপটি একজনের জন্যে প্রধান হতে পারে। কিন্তু কাউকে ধরে বেঁধে জোর করে এই সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন বদলানো যায় না। অর্থাৎ একজন সমকামীকে ধরে বেঁধে বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে বিয়ে দিলেই ঠিক হয়ে যাবে এরকম ধারণাও ভ্রান্ত।
পাঁচ) সমকামীরা বিয়ে করলে পরিবার ধ্বংসের মুখে পড়ে যাবে।
এই কথাটা সর্বৈব মিথ্যা। কারণ, সমকামীদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ কম, গবেষণায় দেখা যায় এরা দত্তক নিয়ে সন্তানদের যে ভালবাসা দিয়ে গড়ে তুলেছে তা বিষমকামীদের তুলনায় অনেক বেশি মজবুত পরিবার তৈরি হয়।
ছয়) সমকামিতাকে উস্কে দিলে অনাচার বেড়ে যাবে।
সামাজিকক্ষেত্রে অনাচারীর সংখ্যা কী কম? ছেলে এবং মেয়ের বিয়ের মধ্যে কী অনাচার হয় না? বরং গবেষণা বলে সমকামী যুগলের অনেকবেশি বিশ্বস্ত থাকে নিজ নিজ পার্টনারের প্রতি। অন্যদিকে আরেকটা কথা, সমকামীরা প্রকৃতিগতভাবে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণবোধ করে না। এদের জোর করে বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে আরও বড় অনাচার করা হয়। কারণ তাতে দুটো জীবন নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া যা অনাচার তাকে সমর্থন না দিয়েই তো সামাজিক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
সাত) সমকামীদের সমর্থন করার অর্থ কী সমকামী হওয়া?
এটি একেবারেই ছেলে মানুষী অভিযোগ, অর্থাৎ সমকামীদের সমর্থন করার অর্থই হল নিজেরা সমকামী হওয়া। কেউ যদি ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তাহলে সে কী ধর্ষিতা হয়? কিংবা কেউ যদি বৃক্ষরোপণ নিয়ে আন্দোলন করে তাহলে নিজে বৃক্ষ হয়ে গেল? এইসব খেলো যুক্তি কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
আট) আমেরিকায় সমকামীদের বিয়ের অনুমতি দিলেই কী সবদেশে ঠিক হয়ে যাবে?
না। বরং আমেরিকা একটা খ্রিস্টানপ্রধান দেশ। তাই এখানেই দেরি হলো অনুমতি পেতে। আমেরিকার আগে আরও ২০ টি দেশ সমাকামীদের বিয়ের অনুমতি দিয়েছে। পাঁচটি দেশে লিমিটেড অনুমতি আছে। অস্ট্রেলিয়াও অনুমতি দেবার পথে। এই দেশগুলোর মধ্যে যেমন ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, সুইডেন আছে তেমনি ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনাও আছে। সুতরাং না আমেরিকা কোন মাঠকাঠি না, তবে একটা বড় বাটখারা।
নয়ঃ সমকামিতা ধর্মে গ্রহণ করতে না করা হয়েছে।
আমি জানি এই জায়গায় এসেই মানুষের জন্যে সবচেয়ে কঠিন হয়ে পড়ে সিদ্ধান্তগ্রহণ করতে। আমি কাউকে আহত না করে কয়েকটা কথা বলি। কোন ধর্মগ্রন্থ কিন্তু দাসপ্রথাকে নিষিদ্ধ করতে পারে নি। বাইবেলে দাসদের রীতিমতো কথা না শুনলে শাস্তির দেয়ার অনুমতি আছে। এমনকী ইসলামে দাসদেরকে মুক্তি করলে পূণ্য, দাসদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করার কথা বলা আছে। আবার দাসীদের সঙ্গে সহবাসেরও অনুমতি আছে (ক্ষেত্রভেদে) কিন্তু নিষিদ্ধ করা হয় নি। তাহলে কী আমরা দাসপ্রথার মতো অমানবিক প্রথায় ফিরে যাবো? যাবো না। ঘুষকে নিষিদ্ধ করা হলেও তা কি বন্ধ আছে? তাহলে ধর্মেরও ইন্টারপ্রিটেশন বদলাতে হতে পারে। কারণ ধর্ম-ই একমাত্র নৈতিকতার মাপকাঠি না।
সবশেষে বলবো, আমার দীর্ঘ গবেষণা, শিক্ষকতার জীবনে এমনকী বাংলাদেশের ধর্মময় জীবনেও অনেককে দেখেছি সামাজিকভাবে কতটা নিগৃহীত হতে। অথচ মানুষ হিসেবেও সমকামীরা অনেক উন্নত মনের। মানুষের প্রতি মমতা, ভালোবাসা নিয়ে দেখা শুরু করলে আমাদের এই বিশ্রী গালিগালাজ বন্ধ হতে বাধ্য। আমি কিছু বিশ্বাস করি বলেই আমি শ্রেষ্ঠ, আর অন্যেরা নিকৃষ্ট; এমন মনোভাব থেকেও মুক্তি পাওয়া দরকার। এজন্যেই বলা হয়, মানুষ মানুষের জন্যে।
(একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং লেখক হিসাবে আমি আমার মতামত দিলাম)
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন