০
২০৯২ বার পঠিত
এক.
আমাদের দেশ আবহমান কাল হতে সম্প্রীতির দেশ। আমরা যখন ছোট, তখন আমাদের বন্ধুদের অনেকেই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের, এখনো আছেন। এজন্যে বাড়িতে কখনো শুনতে হয়নি, ‘হিন্দু ছেলেদের সাথে মিশিস কেন’, এমন কোন প্রশ্ন। কখনো চিন্তাও করিনি আমার বন্ধু অন্য ধর্মের মানুষ। সম্পর্কের সাথে ধর্ম বিষয়ে কখনো মিলিয়ে দেখার পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু আশি’র দশকের শেষভাগে এসে ধর্মের সাথে সম্পর্কের সংঘাতের বিষয়টি মাথায় ঢুকলো। একদিন আমাদের ছোট্ট মফস্বল শহরে মাইকিং শুনলাম। বলা হচ্ছে, ‘সাম্প্রদায়িকতা’র কথা, বলা হচ্ছে ‘সংখ্যালঘু’দের নিরাপত্তার কথা। সে সময়ে ‘সাম্প্রদায়িক’ ও ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি একেবারেই অপরিচিত ছিল আমাদের কাছে। শুধু আমাদের কাছে নয়, শহরের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই এমন শব্দ ছিল নতুন। বড়রা যারা একটু বোঝেন তারা আশ্চর্য হলেন। ভাবলেন, আমাদের মধ্যে তো কোন ঝামেলা নেই তবে, নিরাপত্তার প্রশ্নটি আসছে কোথা থেকে!
প্রশ্নটা এখানেই, যখন নিরাপত্তা নিয়ে কোন ইস্যু নেই, তখন নিরাপত্তা নিয়ে কথা উঠলে তার মধ্যে কোন দুরভিসন্ধি না থেকে পারে না। আমাদের শহরে দুর্গাপূজা উদযাপিত হতো মহাসমারোহে। সারা শহর আলোতে আলোতে ভরে যেতো। মেলা হতো, নানা অনুষ্ঠান হতো। শত শত আনন্দোচ্ছল মানুষের সমাগম থাকতো মন্ডপগুলোতে। পূজার আগে কেনাকাটায় ঈদের মতই ভীড়বাট্টা লেগে থাকতো দোকানগুলোতে। কোথাও কোন সমস্যা চোখে পড়েনি সে সময়। সমস্যা হয়তো এখনো নেই। তবে এখন কোথায় যেনো একটা ছন্দপতন ঘটেছে। এই ছন্দপতনের কারণ হলো হলো সেই ‘পন্ডিত’রা, তাদের মনে করিয়ে দেয়া বিভাজন। জানিয়ে দেয়া, তোমরা ‘লঘু’, অন্যরা ‘গুরু’। ‘তোমরা- আমরা’র বিভাজনটা ধরিয়ে দেয়া এবং জাত চিনিয়ে দেয়ার যে অপচেষ্টা সে থেকেই শুরু ছন্দপতনের। যা মূলত চাপিয়ে দেয়া হয়েছে অনেকটা জোর করেই।
প্রসঙ্গত বলি, সারা বিশ্বে যদি এখন শান্তি কায়েম হয়। কোথাও যদি কোনো যুদ্ধ-সংঘাত না থাকে তাহলে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কী হবে? এই যে নিত্যনতুন অস্ত্র আবিষ্কার হচ্ছে মানুষ হত্যার জন্য, তার কী হবে? এত টাকার বিনিয়োগের কী হবে? লোভী ব্যবসায়ীদের কী হবে? এতসব প্রশ্নের উত্তর একটিই, যুদ্ধ-সংঘাত জিইয়ে রাখতে হবে। প্রয়োজনে গাঁটের টাকা খরচ করে যুদ্ধ জিইয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে তো ব্যবসা বন্ধ। পৃথিবীর সকল যুদ্ধ-সংঘাতের সৃষ্টির কারণ এটিই। আর ‘সাম্প্রদায়িকতা’র সৃষ্টি এই ব্যবসার জন্যই। ‘সাম্প্রদায়িকতা’ মানেই সংঘাত, আর সংঘাত মানেই বানিজ্য। আর লোভীদের জন্য যুদ্ধ-সংঘাত মানেই ‘বানিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’।
বিভেদ সৃষ্টির সকল প্রচেষ্টাই বানিজ্য। কর্পোরেট বিশ্ব সবখানেই লাভ খোঁজে। আর যুদ্ধ-সংঘাতে লাভ সবচেয়ে বেশি। এতে নানা দিকে লাভ। প্রশ্ন উঠতে পারে, শুধু কি সংঘাত ধর্মকে কেন্দ্র করেই? না, সংঘাতটাই এখানে বড় কথা। সেটা ধর্ম, বর্ণ না সম্প্রদায় অথবা গোষ্ঠীগত সেটা বড় কথা নয়। ইউরোপের ‘হোয়াইট সুপ্রেমিস্ট’দের সংঘাতের মূল বিষয় ধর্ম নয়, বর্ণ। তাদের ধারণায় সাদারাই শ্রেষ্ঠ কালো বা বাদামী বর্ণের মানুষদের চেয়ে। বর্ণবাদ তখা সংঘাতের প্রোজ্জ্বল উদাহরণ খোদ অ্যামেরিকা। গোষ্ঠীগত সংঘাতের বড় উদাহরণ রুয়ান্ডা। হুতু ও তুতসি’র গোষ্ঠীগত সংঘাতের কথা সবার জানা। সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল এই সংঘাতে। সুতরাং বিভাজন মানেই সংঘাত, আর সংঘাত মানেই ‘কর্পোরেট’ লোভীদের পোয়া-বারো।
দুই.
ধর্ম আর দর্শনের পার্থক্যটা করতে চান অনেক ‘পন্ডিত’। প্রতিটা ধর্মেরই নিজস্ব চিন্তা রয়েছে। আর চিন্তার প্রকাশই হলো দর্শন। সুতরাং ধর্মটা দর্শনের বাইরে নয়। এ বিষয়ে বিষদ কথা বলতে সময় ও জায়গা লাগবে। এর ব্যাখ্যা অল্প কথায় দেয়া খুব সহজ নয়। সুতরাং আপাতত এ বিষয়ে না যাই। তবে একজন ‘পন্ডিতে’র কথা বলি। যিনি আবার ‘মার্ক্সসিস্ট’। যিনি ধর্মকে মানেন পশ্চাৎপদতা হিসাবে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ইসলামের গোড়ামি নিয়ে কথা বলেন। কথিত মুক্তচিন্তায় মানুষকে আহ্বান জানান। বিপরীতে পূজার মধ্যে ধুতি-পাঞ্জাবি পরিধান করে মন্ডপে মন্ডপে ঘুরে বেড়ান। না, তার পোশাক, পূজামন্ডপে ঘুরে বেড়ানো বা দেবি প্রণামে কোন আপত্তি নেই। তিনি তার ধর্মের আচার-রীতি পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক এবং সঙ্গত।
কিন্তু এই তিনিই যখন ধর্মকে, বিশেষ করে অন্যদের ধর্মকে গোড়ামি বলেন, মধ্যযুগীয় কারবার মনে করেন, তখনই কথাটা উঠে। তখন স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে ইসলাম যদি মধ্যযুগীয় হয় তবে সনাতন ধর্মতো আদিযুগীয়। যে সময়ের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যে সময়ের ইতিহাস অনেকটাই ‘মিথ’ নির্ভর। এই যে, পার্থক্য খোঁজা, এই যে তুলনা, সে কিন্তু এমন ‘পন্ডিত’দের জন্যই। তিনি যদি ধর্মকে মুক্তচিন্তার বাধাই মানেন, তবে নিজ ধর্মওতো সেই বাধারই অংশ। পূজার আচরিত আচারকে এই ‘পন্ডিত’রা মানেন ‘কালচার’ হিসাবে। মানেন দোষ নেই। মানুষের জীবনের আশি ভাগই আসে ধর্ম থেকে, সে হিসাবে ধর্ম মানুষের যাপিত জীবনের বেশিরভাগ অংশ জুড়েই থাকে। এতে দোষের কিছু থাকতে পারে না। তবে দোষের প্রশ্ন তখনই উঠে, যখন অন্যের ‘কালচার’টাকে আপনি অস্বীকার করেন। অন্যের ‘কালচার’কে আপনি গোড়ামি বলেন।
যুদ্ধ ও সংঘাত প্রিয় ‘কর্পোরেট’রা এমনসব ‘পন্ডিত’দেরই ব্যবহার করেন তাদের ব্যবসার ‘অ্যাম্বাসেডর’ হিসাব। এরা এভাবেই বিভেদের কথা ছড়ায়, আর মানুষের মধ্যে পার্থক্য করার চিন্তাটা জাগিয়ে তুলে। ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ এই চিন্তার অনুসরণে ‘কর্পোরেট’রা তখন তাদের বানিজ্য প্রসারিত করে। অতএব সাম্প্রদায়িকতার সম্প্রসারণ বন্ধ করতে হলে, এমন ‘পন্ডিত’দের ব্যাপারে ভাবতে হবে। তুলনা ও বিভাজনের এমন ‘পান্ডিত্য’ বর্জন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, দুর্জন পন্ডিত হলেও বর্জনীয়।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন