০
১৩৬০ বার পঠিত
জানি, চারিদিকে নানা নিত্য-নতুন ইস্যু। রিফাতের পর মিন্নি, নতুন হলো ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার অভিযোগ এবং বন্যাতো রয়েছেই। তবে বন্যার চেয়ে মিডিয়া ব্যস্ত নতুন টপিক খুঁজতে। কোথায় যেন দেখলাম, বন্যায় কবরস্থ করার জায়গা নেই দেখে মৃতদেহ ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে, এমন খবর। গুরুত্বহীন, এক কোনায় পড়ে থাকা খবর।
এতসব ইস্যুর মাঝে অনেকেই ভুলে গেছেন, এমনকি গণমাধ্যমের কর্মীরাও। ইহসান ইবনে রেজা, ফাগুন রেজা বলেই যার পরিচিতি সে এমনি দিনে গত দু’মাস আগে ২১ মে খুন হয়েছিলেন। তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল জামালপুরে রেললাইনের পাশে। গত দু’মাসেও তার খুনের কোন সুরাহা হয়নি। কারা খুন করছিল, কেন খুন করা হলো, এর কোন কিছুই এখন পর্যন্ত উদঘাটিত হয়নি।
আমাদের গণমাধ্যমকর্মীদের অনেকের ভুলে যাবার ব্যাপারটি নিয়ে আপাতত কথা বলি। বলতে পারেন আত্মসমালোচনা। যে নিজের সমালোচনা করতে ভয় পায় বা করে না, সে অন্যের সমালোচনার অধিকারও রাখে না। আমরাই কি ফাগুন রেজাকে খুব মনে রেখেছি। তার কিছু সহকর্মী, গণমাধ্যমে তার কিছু সিনিয়র কলিগ বা বড়ভাই হয়তো তার ব্যবহারে, তার কাজে এখন পর্যন্ত তাকে মনে রেখেছেন।
বাবা হিসাবে আমার কিছু শুভাকাংখি আছেন দেশ-বিদেশে, তারা ফাগুনকে মনে রেখেছেন। তারা হয়তো লিখছেন, আরো লিখবেন। কিন্তু অন্যান্যরা। যারা বিভিন্ন গণমাধ্যমে আছেন, তাদের কি মনে আছে একজন তরুণ খবরের কর্মী প্রথমে নিখোঁজ ছিলেন পরে তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল। এ খবরটি নিয়ে এখন আর তেমন ফলোআপ নেই। স্বয়ং ফাগুন রেজা যে গণমাধ্যমে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে ফেরার পথে নিখোঁজ হন তিনি, অবাক হতে হয় সেই গণমাধ্যমটির কার্যক্রমে। অথচ তারা আরেকটু চেষ্টা করলেও হয়তো ফাগুন হত্যাকান্ডের তৎপরতায় আরেকটু চাপ সৃষ্টি হতো।
ফাগুনের জন্য জাতীয় প্রেসক্লাবের সমুখে তার সহকর্মীরা মানববন্ধন করেছিলেন। সেখানে আমিসহ তার স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদসহ অনেকেই। উপস্থিত ছিলেন দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিক, লেখক, সাহিত্যিকরা। দেশের প্রধানতম গণমাধ্যমগুলোসহ প্রায় সব গণমাধ্যমেই মানববন্ধনের খবরটি প্রকাশিত হলেও, গুটি কয়েক মাধ্যমের অনিহাও দৃষ্টি এড়ানোর মত ছিল না। নিজেদের কর্মীর একটি ব্যাপারে এমনি এক গণমাধ্যমের তোলপাড় কদিন আগে দেখেছি। অথচ সেই বিষয়টি কোন হত্যাকান্ড বা হত্যাকান্ড ঘটানোর মতন গুরুতর ছিল না। ছিল শুধুমাত্র ইগো’র ব্যাপার।
না, এসব আমি সেই ‘ইগো’টাকেও ছোট করে দেখানোর জন্য বলছি না। বলছি গণমাধ্যমকর্মীদের স্বার্থেই, তাদের ভবিষ্যত ভেবেই। হেলমেটধারীদের হাতে বেদম মার খেতে হয়েছে গণমাধ্যমকর্মীদের। ছবিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে দেখেছি চিকিৎসা নেয়া ফাগুনের কাছাকাছি বয়সের তরুণ গণমাধ্যমকর্মীদের অসহায় মুখ। এরপরেও আরো ঘটনা ঘটেছে, নির্যাতিত হয়েছেন গণমাধ্যমে কাজ করা তরুণরা।
প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে সেসব প্রতিষ্ঠানকে এবং তাদের কর্ণধারদের, কি করেছেন এসব তরুণ কর্মীদের নিরাপত্তায়। যেহেতু সামলে রাখতে বা উঠতে পারবেন না, তাহলে মাঠে পাঠান কেন তাদের! কি করেছেন তাদের জন্য, খুব বেশি হলে প্রেস ক্লাবের সামনে একটি মানববন্ধন। যাতে নিজেদের লোক ছাড়া অন্যদের ডাকলেও আসতে চায় না। কেন আসবে, আপনারা কি যান কারো ডাকে!
কখনো কি প্রশ্ন করেছেন নিজেকে, কেন এমন হয়। ভুলটা কোথায়। ভুলটা হলো আপনার আমার আত্মসমালোচনা না করাটা। নিজেদের স্বার্থ হাসিলে নিজেরা বিভক্ত থাকাটা। অন্যের ঘাড়ে পা রেখে দেয়াল টপকানোটা। তোষামোদি আর ‘বস’বাজি করাটা। আর এসব কারণেই নিজেদের উপর নিজেরাই বিশ্বাস হারিয়েছেন।
গণমাধ্যমে কাজ করছেন। কিন্তু কাজটাকে শুধু পেশা হিসাবেই নিয়েছেন, নেশা হিসাবে নয়। আর ভাব-ভঙ্গিতে প্রকাশ করছেন ফ্যাশন হিসাবে, প্যাশন হিসাবে নয়। যার ফলেই অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করার সাথেই সব শেষ। আর কোন খোঁজখবর রাখা নেই, প্রয়োজনও নেই। নিজের বিট সামলাতে পারলে সেটাই যথেষ্ট। বাড়তি যেটা করেন, তা হলো মিডিয়ার লোক হিসাবে নিজের ক্ষমতা যোগাযোগ দেখিয়ে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনকে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করার চেষ্টা। বলার চেষ্টা করেন, দেখেছো আমি কত বড় ‘ব’।
এসব কারণেই ফাগুনের বা তার কাছাকাছি বয়সের অনেকেই জানেন না, ফাগুন রেজা নামে তাদেরই এক সহকর্মী খুন হয়েছেন। এক সময় তারাও হতে পারেন। বাসে হতে পারেন, ট্রেন হতে পারেন, যেখানে সেখানে হতে পারেন। রাজনৈতিক গন্ডগোলে পড়ে নাই হয়ে যেতে পারেন কিংবা শিকার হতে পারেন গুমের। হতে পারেন নিজেই নিখোঁজ সংবাদ। কিছু দিন আগেইতো একজনের এমনটা হয়েছিল। যদিও পরে ফিরে এসেছিলেন তিনি। নিহত না হলেও আহত হতে পারেন এবং তা হতে পারেন যেকোন সময়েই। বাটে পড়লে, যার ‘বস’বাজি করেন দেখবেন, সেও চোখ উল্টে নিয়েছে। মানববন্ধনের সময় আপনার সহকর্মীরা ডাকলে তিনি অসুস্থ হয়ে ছুটি নেবেন। যে বন্ধু-বান্ধব আর স্বজনদের নিজের ক্ষমতা আর যোগাযোগ শো করার কোশেশ করেছিলেন, তারা তখন করুণা করবে।
অথচ ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন, ফাগুন রেজা ছিল এর উল্টো। তার সহকর্মীদের প্রতি সে ছিলো সহমর্মী এবং সত্যিকার অর্থেই সহযোগী। সম্পর্কের মর্যাদা সাথে দায়িত্বটা সে বুঝতো। সে যাদের সাথে কাজ করেছে তাদের কেউ যদি প্রশ্ন করেন, তবেই সত্যটা জানতে পারবেন। ফাগুন ছিল ইংরেজি বিভাগের সাব-এডিটর। যারা ইংরেজি নিয়ে অনেক সময় বড় কথা বলেন তাদেরও বলি, ফাগুনের সহকর্মীদের প্রশ্ন করলে বুঝতে পারবেন, ইংরেজিটা কি পরিমান অনায়াসলব্ধ ছিল তার কাছে। তার এক সহকর্মী মার খেয়েছিল নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে, দেখেছি কি পরিমান উৎকন্ঠিত, রাগান্বিত এবং প্রতিবাদী ছিল সে। সম্মানের সাথে বাঁচতে হলে প্রতিবাদটা করতে হবে। ফাগুন রেজা তাই শিখিয়ে রেখে গেছে।
আজ দু’মাসেও ফাগুন রেজা হত্যাকান্ডের তেমন কোন অগ্রগতি নেই। দেশের প্রধানতম গণমাধ্যমে এই হত্যাকান্ডের খবর হয়েছে, আলোচিত হয়েছে। কয়েকটা মাধ্যম বাদে দেশের প্রায় সবমাধ্যমেই আলোচিত হয়েছে হত্যাকান্ডটি। বিদেশি মাধ্যমেও হয়েছে। তারপরেও বিষয়টি খুব এগুচ্ছে না। আমি নিজে গণমাধ্যমকর্মী হিসাবে বুঝি, অনেক বিষয় থাকে জটিল। খুব সহজেই যার সমাধান হয় না। সময় লাগে। সেটা বুঝেই এখনো আশায় বুক বেঁধে আছি। দেখি বাবা হিসাবে ছেলের এবং গণমাধ্যমকর্মী হিসাবে আরেক গণমাধ্যমকর্মী হত্যার বিচার পাই কিনা।
না পেলেও হয়তো মেনে নেব, সাগর-রুনির ছেলে মেঘ যেমন মেনে নিয়েছে। এমন সময়ে হয়তো মেনে নেয়াটাই নিয়তি। তবে এটা নিশ্চিত মেনে নিলেও মনে নেব না। জানি, সময় একদিন আসবেই।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন