বারান্দায় বসে ছুটির দিন দুপুরে বদরুলের মাথায় ইতং বিতং নানা চিন্তা এসে ভর করে। সরকারি চাকরিতে দুই যুগ কেটে গেলো; এই তো দেখতে দেখতে রিটায়ারমেন্টের সময় এসে যাবে। তারপর কী হবে কী হবেরে আমার! মনের মধ্যে হাহাকার এসে ছুটির বিকেলটাকে লন্ডভন্ড করে দিয়ে চলে যায়। বউ-বাচ্চা যে যার ঘরে বসে স্মার্ট ফোনে মাতোয়ারা। আজকাল এমন হয়েছে; সে নিজে থেকে কোন কথা না বললে; গৃহময় নীরবতার নিঃশ্ছিদ্র চাদর বিছিয়ে দেয় কে যেন। বাধ্য হয়ে নিজেও স্মার্ট ফোন খুলে ফেসবুকের হোমপেজে দীর্ঘশ্বাসের স্পর্শ বুলাতে থাকে।
সেখানে চোখে পড়ে জাদুর মই বেয়ে “সফল যারা কেমন তারা”র মেলার ধাঁই ধাঁই করে ওপরে উঠে যাওয়ার গল্পগুলো। তার ব্যাচের যারা একটা অফিশিয়াল নোট লিখতে কলম ভেঙ্গে ফেলতো; তারাই এখন জাদুর মইয়ের স্তুতি করে কলাম লেখে। সার্ভিস রুলের গুল্লি মেরে তারা মইয়ের প্রশস্তি গায়; প্রমোশানের স্বস্তি পায়; মইয়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ পদায়ন চায়; সাফল্য খায়। আর বদরুলের জীবনময় রয়ে গেলো শুধু হায় হায়; “আমি না গেলাম যমুনার ঘাটে; না তুলিলাম জল; না হেরিলাম তারে সখি; না হইলাম চঞ্চল।”
সে সামনের ফুলের বাগানে মইয়ের স্বপ্ন কাঁধে দৌড়ে বেড়ানো এক মোটিভেশনাল স্পিকারকে দেখে। ভরসাদাদা স্পিকারটি তর্জনি উঁচিয়ে বলে, এই যে বদরুল স্যার; সারাক্ষণ নেগেটিভ এটিচ্যুড নিয়ে বসে থাকলে; পৃথিবীকে আপনি নেতিবাচক ‘অরা’ ছুঁড়ে দিলে; সেও আপনার দিকে নেতির ‘ফলাফল’ ছুঁড়ে দেবে। আপনি আজই একটি ইতিবাচক মইয়ের সন্ধান করুন। তারপর মই বেয়ে তরতর করে ওপরে উঠে যান।
ভরসা পেয়ে বদরুল ফেসবুকে মইয়ের প্রশস্তি লিখতেই; বারান্দায় একটি জাদুর মই নেমে আসে। মই বেয়ে উঠে গিয়ে দেখে এক রাজনৈতিক নেতা একটি সাপের সামনে বীণ বাজাচ্ছে। বদরুল ভয় পেয়ে গেলে; নেতা আশ্বস্ত করে; নাগ-নাগিনীর খেলাকে ভয় পেলে চলবে! ঐ যে দেখেন আরেকটা মই; আমাকে একটু প্রশস্তির ছক্কা মেরে তারপর ওটা দিয়ে উঠে যান আপনি।
সেই মই বেয়ে উঠতেই বদরুল দেখে এক ধর্মীয় অনুভূতির ম্যানেজার একটা সাপের সামনে বীণ বাজাচ্ছে। বদরুল ঘাবড়ে গেলে ম্যানেজার বলে, সামান্য সাপের খেলা দেখে ঘাবড়াচ্ছেন কেন; কিচ্ছু হবে না; ঐ দেখেন আরেকটা মই; আমাকে চারটা খুশী করে দিয়ে; ঐদিক দিয়ে উঠে যান। সেখানে উঠে বদরুল দেখে এক সাংবাদিক সাপের সামনে বীণ বাজাচ্ছে। সে হেসে বলে, এবার মই বেয়ে উঠেই দেখবেন; একটা সাপ; সেখানে বীণ বাজানোর কেউ নেই। আপনি এই বীণ বাজানোর গুরুত্বপূর্ণ কাজটি নিয়ে নিন। আমার পিঠটা তিনবার চাপড়ে দিয়েই উঠে পড়ুন শেষ মইয়ে।
মই বেয়ে উঠতেই হিস হিস করে একটা সাপ তেড়ে আসে। সাপটা বদরুলকে বলে, বোকা সোকা মানুষ আপনি; আপনি সাপলুডু খেলতে আসলেন কোন দুঃখে। একটু ওপাশটায় গিয়ে দেখেন; সাপের কামড় খেয়ে গড়িয়ে পড়ছে “সফল যারা কেমন তারা”র মেলার মইবাদীরা । এই সাপলুডু খেলার নিয়ম হচ্ছে; একবার নীচে গড়িয়ে পড়লে আর মই বেয়ে ওপরে ওঠা যায় না। আপনি বরং মই বেয়েই নেমে যান; প্রাণে বাঁচতে চানতো।
বদরুল মই বেয়ে নীচে নেমে দেখে আগের সাংবাদিকটি সেখানে নেই; নতুন আরেক সাংবাদিক এখন বীণ বাজাচ্ছে; সাপ নাচাচ্ছে। বদরুলকে দেখে সে বলে, আজব লোক তো আপনি; মই বেয়ে শুধু ওপরে উঠতে হয় এই খেলায়; আপনি নীচে নামছেন যে। নীচে গড়িয়ে পড়ার নিয়ম কেবল সাপের কামড় খেয়ে। সাপলুডুর আইন ভঙ্গ করছেন কেন!
বদরুল কথা না বাড়িয়ে মই বেয়ে নীচে নামতেই দেখে; আগের ধর্মীয় অনুভূতির ম্যানেজার সেখানে আর নেই; নতুন এক ম্যানেজার মনোযোগ দিয়ে বীণ বাজিয়ে সাপের নৃত্য উপভোগ করছে। বদরুলকে মই বেয়ে নামতে দেখে সে বিরক্ত হয়ে বলে, খেলার নিয়ম জানেন না; খেলতে আসছেন কেন বুঝি না! মৃত্যু একদিন হবেই; এতো মৃত্যু ভয় থাকলে জীবনে সফল হওয়া যায়না।
মই বেয়ে নীচে নামতেই দেখা যায় নতুন এক রাজনৈতিক নেতা নাগ-নাগিনীর খেলা দেখাচ্ছে। আগের নেতাকে সাপের কামড় খেয়ে গড়িয়ে নীচে পড়ে যেতে দেখা যায়। বদরুল ভয় পেয়ে দ্রুত মই বেয়ে নীচে নামতে থাকে। নীচে তাকিয়ে দেখে সেই মইবাদী মোটিভেশনাল স্পিকার তারস্বরে চেঁচাচ্ছে, এতো পজিটিভ থিংকিং করলাম; আর পৃথিবী আমাকে মইয়ের গোড়ায় ফেলে রাখলো। আপনি তাড়াতাড়ি নামেন; আমি এক্ষুণি মই বেয়ে উঠে যাবো; যেতে হবে বহুদূর।
কোত্থেকে যেন একটা সাপ এসে কামড় দেয় মোটিভেশনাল স্পিকারকে; আর হিস হিস করে বলে, আপনার কাছ থেকে একটু পজিটিভ ‘অরা’ নিতে ইচ্ছা করলো। নাগনাগিনীর খেলায় প্রমোশান পেয়ে আমাকেও যেতে হবে বহুদূর।
বদরুল মই বেয়ে দ্রুত নেমে বারান্দায় চলে যায়। মনে মনে বলে, এই বারান্দা-ইজমই শ্রেয়। চারপাশের বারান্দাবাদী লোকেরা হাত নাড়ে। একজন মিষ্টি হেসে বলে, মই বেয়ে ওপরে ওঠা তো দূরের কথা; এখন তো আমরা বারান্দা থেকেই নামি না; দেখলেন না ফুলের বাগানের সাপ এসে মোটিভেশনাল ভরসাদাদাকে কী আশীবিষেই না দংশিলো।