বিষ কী? প্রয়োজনের চেয়ে বেশি যে কোন কিছুই বিষ। হতে পারে তা ক্ষমতা, সম্পদ, ক্ষুধা, গোঁ, লোভ, অলসতা, ভালোবাসা, উচ্চাভিলাষ, ঘৃণা অথবা যে কোন কিছু– জালাল আদ-দীন মুহাম্মাদ রুমি
উইন্টার অফ ডিসকনটেন্টে অনেকটা গুহামানব হয়ে পড়ার পর থেকেই রুমি মাঝে মাঝে আসেন; উলটো দিকের সোফায় বসে মিট মিট করে হাসেন।
–বলতো বেদনা কী!
–এ সবকিছুই; এই যাপিত জীবন; বাবার মৃত্যু; করোনায় ফ্লাইট বন্ধ থাকায়; বাবাকে শেষবার দেখতে না পাওয়া।
রুমির এতে কোন প্রতিক্রিয়া হয়না; বরং বিড় বিড় করে বলেন, বুকের মাঝে বেদনার ক্ষত স্থান দিয়ে আলো প্রবেশ করে; বোধের আলোয় দেদীপ্যমান হই আমরা তখন।
রুমি ফিরে গেলে; জানালা দিয়ে গাছপালা ঘেরা খেলার মাঠের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছা করে। কোথাও কেউ নেই। এম্বুলেন্সের আর্তনাদ আর পুলিশের গাড়ির গোঙ্গানির শব্দ ছাড়া; আর কোথাও যেন কোন জনমানুষের চিহ্ন নেই।
মনে হচ্ছে যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। দখলদার করোনা সৈনিকদের মার্চপাস্টের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এবার জানালার দিকে তাকাতেই ভয় লাগে; মনে হয় যেন এক উদভ্রান্ত প্রকৃতির লোক প্রাচীরের ওপাশ থেকে ঠিক এই জানালার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। লোকটা আসলেই সেখানে দাঁড়িয়ে নাকি এ কেবল ভ্রান্ত অধ্যাস; তা বুঝতে বড্ড কষ্ট হয়। নিঃসঙ্গতায় বাস্তব আর কল্পনার পার্থক্য ঘুঁচে গিয়ে নানারকম ভীতি আর অমূলক আশংকা মনের মধ্যে বাসা বাঁধতে শুরু করে।
অনেকসময় পাশের বাসার শিশুদের কোলাহল শুনে মনে হয়; এই শিশুগুলো বুঝি সারাক্ষণ বড়দের নিয়ে উপহাস করছে। “ওহ এই সামান্য জিনিসটা বোঝো না” বলে, মায়ের মোবাইল ফোনে জুম এপস ডাউনলোড করে দিচ্ছে; যাতে বিশ্রামে হত মা ফোনে ম্যারাথন আড্ডা দিতে পারেন তার স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে।
করোনাকালে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং-এর কারণে; আগে যে মানুষকে এড়িয়ে চলতে ছলচাতুরী করতো অনেকে; এখনো তাকেই করুণ মিনতি মাখা কন্ঠে ফোন করে, একটু কথা বলার অবসর হবে ভাই?
–হবে না কেন; এখন তো অবসরই অবসরই।
কোন এক বিচিত্র কারণে স্কুল-কলেজের এই রিইউনিয়নের জুম বৈঠকে যোগ দিতে ইচ্ছা করে না। যে সুন্দর সময়ের স্মৃতি মনের মধ্যে জমা করা আছে; ওটা নাড়াচাড়া করাই শ্রেয়। বড় বা বুড়ো হবার পর; সেইসব বন্ধু যাদের সঙ্গে কৈশোরে-তারুণ্যে দেখা হয়েছিলো; তাদের সঙ্গে জুম চাষে দেখা হলে; ঐ সুন্দর কিশোর-তরুণ মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে যখন তাতে বার্ধক্যের জ্যামিতিক রেখা দেখা যায়; তখন নিজের বার্ধক্য আরো সুনিশ্চিত হয়।
অগত্যা পেটার ফ্র্যাংকোপ্যানের “দ্য সিল্ক রোড” বইখানি হাতে নিয়ে একটু পড়ার চেষ্টা করতেই মনোযোগকে এমনভাবে ধরে রাখার চেষ্টা করতে হচ্ছে যে, মনে হয়; আধলা একখানা ইট নিয়ে মাঠের বিভিন্ন জায়গায় গরু-ছাগলের খুঁটি পুঁতে দেয়া হচ্ছে; যাতে তারা নতুন নতুন জায়গায় ঘাস খেতে পারে। উইলিয়াম ড্যালরিম্পল এই বইটিকে ব্রিলিয়ান্ট এন্ড ফিয়ারলেস… আ হিস্ট্রি অন আ গ্রান্ড স্কেল বলে মন্তব্য করেছিলেন। পারস্য বন্দর যে ব্যবসা-বানিজ্যের হৃদয় বিন্দু ছিলো; রোমান নব্য এলিটদের পরিধেয় রেশমী কাপড় যে সেইকালে চীন থেকে আসতো; আজ চীন ব্যবসায়িক আধিপত্য বিস্তারের জন্য যে সিল্ক রোড করেছে; তা সেইকালেও ছিলো; কাজেই ভবিষ্যত হয়তোবা কোথাও কোথাও অতীতের পুনরাবৃত্তি। বিশ্ব ইতিহাসের প্রচলিত গ্রান্ড ন্যারেটিভকে চ্যালেঞ্জ করেছে এই ইতিহাস গ্রন্থটি। খুবই আগ্রহ উদ্দীপক এই গ্রন্থ; বারান্দায় রোদ্দুর; কিন্তু মনোযোগের দেখা নেই।
বরং জানালার ওপারে একটা এলিটফোর্সের গাড়িকে থামতে দেখে মনে হয়, ওরা বুঝি গ্রেফতার করতে এসেছে; সোশ্যাল মিডিয়ার কোন লেখাটা কার অনুভূতিতে লেগে যায় বলা মুশকিল। বিশেষ করে যাদের শরীরে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা-সম্পদ ও ইগোর বিষ; তাদের ভাবমূর্তির অনুভূতি খুব টনটনে হয়। ফলে তারা যে কোন কারো বিরুদ্ধে এলিট ফোর্সকে লেলিয়ে দিতে পারে। আগে যেমন জমিদারেরা ইচ্ছা হলেই সান্ত্রী পাঠিয়ে অবাধ্য প্রজাকে ধরে নিয়ে যেতো।
সাইবার আইন প্রচলনের পর থেকে সেটা ব্লাসফেমি আইনের মতো নটোরিয়াসলি ফেমাস হয়ে উঠেছে; কারো কথা আপনার পছন্দ হলোনা; অমনি তাকে উইচ বলে চিহ্নিত করে; পুলিশ লেলিয়ে দিন; হান্টিং করুন ক্ষমতার মৃগয়ায়। ভাবখানা এমন; এত্তো বড় সাহস; তুই চৌধুরী বংশের “চাষা ব্যাংক” নিয়া রসিকতা করছোস; চল তোরে জেলে ভইরা তিলে তিলে চোখের রস শুকাইয়া অন্ধ কইরা দিই; যাতে এই তল্লাটে কেউ আর চৌধুরির চাষা ব্যাংক চুষে খাওয়ার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি না করে। ফেসবুকে লগ ইন করে স্টেটাসে একটি শব্দ লেখারও সাহস চলে যায় পুরবাসীর। তারা বারান্দা থেকে আর নামে না।
এইসব ভয়ভীতি আর প্যারানয়ার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ যেন সোফার ঠিক যেইখানে রুমি এসে বসতেন; সেইখানে বসে বলেন, “কন্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে বাঁশী সংগীত হারা; অমাবস্যার কারা; লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপনের তলে।”
এইভাবে দিনের পর দিন ঘরের মধ্যে আটকে থেকে চেহারা গুহামানবদের মতো হয়ে যায়; অথবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্রে পিয়ানিস্টের যেমন লুকিয়ে লুকিয়ে ভয়ে ভয়ে কেটেছিলো; ঠিক তেমন এক অভিজ্ঞতা যেন এই করোনার ডেকে আনা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
ভয় কাটাতে ক্লিন সেভ করে নীল রং-এর একটা মাস্ক পরে পার্কে হাঁটতে যায়; উদভ্রান্তের মতো হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাওয়া এক লোক জিজ্ঞেস করে, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনটা কোথায় বলতে পারবেন; আমার খুব দেখা করা দরকার।
মনে হয় যেন গণতন্ত্রের কলিযুগে আছে লোকটা; আমি প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে যাবার পথটা বলে দিলেই; অমনি তাকে বাসভবনের গেট থেকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে যাবেন প্রধানমন্ত্রী। লোকটা কোন উত্তর না পেয়ে হন হন করে হেঁটে চলে যায়।
হেঁটে পার্ক থেকে বেরোনোর সময় দেখা যায়, এক লোক ব্রিটিশ আমলের মতো শর্টস আর হাফ হাতা শার্ট পরে গাড়ি থেকে নেমে টিকেট না কেটেই পার্কে প্রবেশ করলেন। দারোয়ান বললো, স্যার পুলিশ সুপার আপনারা সবাই সরে দাঁড়ান। এর পরপরই একজন মওলানা সাহেব প্রবেশ করলেন; একইভাবে; বিনা টিকেটে।
টিকেট কাউন্টারের লোকটাকে এদের দুজনের টিকেট না নেবার কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে, দুইজনই তো পুলিশ; একজন রাজনীতির পুলিশ আরেকজন ধর্মের পুলিশ তাই ভয়ে উনাদের টিকেটের কথাটা আর তুলিনা উনাদের সঙ্গে। মারধোর করছে না বা অভিসম্পাত দিয়ে ভস্ম করে দিচ্ছে না এইতো অনেক।
ফলের দোকানে ফল কিনতে গিয়ে এলিট ফোর্সের লোকেদের সঙ্গে দেখা। লোকজন মাস্ক পরছে কীনা; এটাই তাদের দেখার বিষয়; কিন্তু আশংকা জাগে চাষা চৌধুরী পাঠালো কীনা তাদের। ভেতরটা ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে যায়। ফল নিয়ে কোন মতে বাড়ি ফিরে; আবার যেন বাংকারে লুকানো জীবন।
এক বন্ধু ফোন করে; তার ফোন ধরতে ইচ্ছা করে না। হোয়াটস এপে কিংবা ফেসবুক ইনবক্সে কারো কুশলাদির উত্তর দিতে মাত্রাতিরিক্ত অলসতা আসে। প্রায়ই শ্বাস কষ্ট হয়; ঘাড় ব্যথা করে। করোনা এবং প্রেশারের মিশেল হতে পারে। কিন্তু ডাক্তার দেখে বলেছে, এটা পোস্ট করোনা সিনড্রোম; বিষণ্ণতার সওদাগর হয়ে উঠছে প্রতি চারজনে একজন। ট্রাই টু লুক এট দ্য ব্রাইট সাইড অফ লাইফ।
–আপনি কী জীবনের ব্রাইট সাইডের দেখা পেয়েছেন ডাক্তার সাহেব।
— লাইফের ব্রাইট সাইডের দেখা পেতে উইন্টার অফ ডিসকনটেন্ট থেকে সামার অফ সানশাইনের দিকে হেঁটে চলেছি। এই জার্নিটাই আসল। গন্তব্য প্রধান কিছু নয়। ভ্রমণটাকে উপভোগ করতে শিখুন। পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে মানুষের সামনে আর দুটো পথ থাকে, হয় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করা; কিংবা হেঁটে নেমে আসা। কাজেই চূড়া বিজয় নিয়ে এতো উচ্ছ্বসিত হবার কিছু নেই; তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা তো রীতিমতো অর্থহীন।