০
২৩১৩ বার পঠিত
ইমতিয়াজ মাহমুদ নামে একজন ভদ্রলোক। পেশায় আইনজীবী এবং সামাজিকমাধ্যমে সক্রিয় একজন মানুষ। রাজনীতিতে বাম ঘরানার। মনে করিয়ে দিলেন আনিসুজ্জামান সাহেবেরে একটি লেখার কথা। যা লিখা হয়েছিলো ১৯৯২-এ। যখন কেবলমাত্র স্বৈরাচার বিদায় নিয়েছে এবং ক্ষমতায় বসেছে জামান সাহেবদের অসম্ভব অপছন্দের একটি সরকার। এমন সরকার গঠন উনাদের ধারণাতীত ছিলো। তখনই আনিসুজ্জামান সাহেবরা ‘ঠাকুরঘরে কলা’ আবিষ্কার করলেন। অর্থাৎ ‘আমি কলা খাই না’র মতন ব্যাপার। হঠাৎ করেই আমাদের কানে বাজতে শুরু করলো সাম্প্রদায়িকতা শব্দটি। আমি এবং আমার এক প্রিয়বন্ধু একদিন মাইকিং শুনলাম ‘সাম্প্রদায়িকতা রুখতে হবে’ বলে। সেই সময়ের মফস্বল শহরে এমন শব্দটা ছিলো নেহাতই অপরিচিত। শোনা হয়নি এমন শব্দের উচ্চারণে আমরা দু’বন্ধুই কান খাঁড়া করলাম, ভাবনাটাকে প্রসারিত করলাম। কিন্তু না কোথাও সাম্প্রদায়িকতা খুঁজে পেলাম না। তবে ওই শব্দটি শোনার পর প্রথম অনুভব করলাম, আমার বন্ধুটি ধর্মে হিন্দু এবং আমি মুসলিম। সেই মাইকিং শোনার আগ পর্যন্ত আমাদের মাথায় ধর্ম ব্যাপারটিই কাজ করেনি। সেই মাইকিংটি ছিলো ‘পাগলাকে নাও ডোবানোর কথা মনে করিয়ে দেয়া’র মত।
সেই থেকে শুরু। চলছে আমাদের মেলবন্ধন ভেঙে ফেলার কাজ। যার কারণ শুধুমাত্র রাজনৈতিক। এখানে ধর্ম বলতে কিছু নেই। যেমন ভারতের এনআরসি, সিএএ প্রমান করে দিয়েছে এ শুধু হিন্দুত্ববাদের নামে ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশল। যে কৌশলে কোনো ধর্ম নেই, রয়েছে কূটবুদ্ধি আর বর্বরতা। গরু রক্ষার নামে মানুষ হত্যা কোনো ধর্ম হতে পারে না। আমাদের দেশেও ধর্মীয় উপাসনালয় ভেঙে কোনো ধর্ম উল্লসিত হতে পারে না। যে ধর্ম বিশ্বাস করে, যার যার ধর্ম তার তার। সেই ধর্মের কারণে অন্তত কারো উপাসনালয় বা ঘরবাড়িতে হামলা চলতে পারে না। এমনটা যারা বিশ্বাস করেন তারা হয় মতলববাজ নয় বোকা।
এরকম হামলা, ভাংচুরের প্রতিটার পেছনেই রয়েছে আলাদা কাহিনি। যেখানে ধর্ম নেই, রয়েছে দখলের জবরদস্তি। এমনকি কোনক্ষেত্রে সেটা নিজ গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মধ্যেও। রয়েছে রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের প্রকল্পও। যে প্রকল্পের ইনেভেস্টরদের রয়েছে ক্ষমতায় থাকা বা যাবার প্রয়োজনীয়তা। এসব আর এখন মানুষকে ভেঙে বলতে হয় না। মানুষ বোঝে। কিছু ক্ষেত্রে বোঝে না শুধু ভিনদেশিরা। তাদের এ না বোঝাও অনেক সময় ইচ্ছাকৃত।
প্রতিটি কাজের পেছনে একটি কারণ থাকে। সেই কারণটা লাভের চিন্তা থেকে উৎসারিত। সোজা ভাষায় ‘বেনিফেশিয়ারি’ হবার চিন্তা। অথচ সাম্প্রদায়িকতা থেকে লাভ হয় কার, ধর্মের না ধর্মপ্রাণদের? কারোরই না। উগ্র নির্বোধদের কারণে সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের অর্ধেকটাই বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছে। সমৃদ্ধ শহরগুলো বোমা আর গুলির স্প্লিন্টারে ক্ষত-বিক্ষত। বহুতল ভবনগুলো গুড়িয়ে গেছে। সমৃদ্ধ জনপদ পরিণত হয়েছে ভিখারির শহরে। আর এর ‘বেনিফেশিয়ারি’ কারা সেটাতো সবাই জানে। সুতরাং এটা নিয়ে আলোচনারও বেশি কিছু বাকি নেই। তারপরও যারা অহেতুক তত্ত্বকথা শোনাতে চায়, তারা স্রেফ মতলববাজ, চাটার দল। খুঁদকুড়ো খেয়ে বেঁচে-বর্তে থাকে যারা।
‘সেকুলার’ শব্দটিকে যারা ধর্মনিরপক্ষের তকমা দিয়েছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন তর্জমাটি শুদ্ধ কিনা। কিন্তু সেকুলারিজমের মূলকথা হলো ধর্মের বিরোধীতা নয়, ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থানে না যাওয়া। যার যার ধর্ম বা বিশ্বাস তার তার, যাতে অন্যের সাথে কনফ্লিক্ট না হয়। এমনকি যারা ধর্মে বিশ্বাস করেন না, তারাও যেনো সংঘাতে না জড়ান। এই হলো সেকুলারিজমের মূল ধারণা বা চিন্তা। তবে এই চিন্তাকেও বিভক্ত করা হয়-হয়েছে এবং যার পেছনের কারণ হলো মতলববাজি। সংঘাত জিইয়ে রাখা।
নারীবাদের উদাহরণটা এখানে টানি। নারীবাদ মানে হলো, নারীদের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা। তাদের মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা। অথচ মতলববাজরা নারীবাদকে পুরুষের প্রতিপক্ষ হিসাবে হাজির করেছে। এদের কাছে নারীবাদ হলো পুরুষের বিরোধীতা করা। যেমন ধর্মনিরপেক্ষদের কাছে ধর্মের বিরোধীতা। কথিত নারীবাদীদের মূল এজেন্ডা হলো পুরুষকে হেয় করা, অপদস্ত করার চেষ্টা। পুরুষও যে কখনো কখনো মানুষ হয় না, এমন ধারণাও তাদের নেই। থাকলেও এড়িয়ে যায়, উপেক্ষা করে এবং তা অবশ্যই ইচ্ছাকৃত।
তারা নারীকে মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত না করে পুরুষের জায়গায় প্রতিস্থাপনের এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে। একই ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীরা ধর্মের জায়গায় ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতিস্থাপনের চেষ্টায় রত। প্রতিস্থাপনের এমন চেষ্টাটাই সাংঘর্ষিক। আপনি যখন কাউকে উচ্ছেদ করতে যাবেন, সেতো বাধা দেবেই। সেক্ষেত্রে সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্যতার ফল। সুতরাং সংঘাতের জায়গাটি ধর্ম নয় বরং তা উচ্ছেদের প্রচেষ্টা। তেমনি কথিত নারীবাদ যা মূলত পুরুষদের বিরোধীতা এবং জবরদস্তিতে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা।
‘সুখে থাকতে ভূতে কিলায়’ প্রবাদটি আমাদের দেশে এমনি এমনি প্রচলিত হয়নি। ভূতের কিল না খেলে আমাদের ভালো লাগে না। শরীর ম্যাজম্যাজ করে। তাই আমাদের ভূত আমদানি করতে হয়। কখনো কথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র নামে আবার কখনো ‘নারীবাদে’র নামে। ভূতের কিল খেয়ে আমরা হজম করি। আর ‘বেনিফেশিয়ারি’রা সুযোগ পায়। খুঁদকুড়ো খেয়ে বাহকরা বেঁচে থাকে। তবে ‘বেনিফেশিয়ারি’দের চেয়ে এইসব বাহকরাও কম ক্ষতিকর নয়। যেহেতু তারা জেনেশুনে বহন করেন। আর সে কারণেই ভূত ডেকে আনার এসব ভূতুড়েদের সম্পর্কে আমাদের সাবধান থাকাটা বড় দরকারি।
পুনশ্চ : এখনো সাম্প্রদায়িকতার কথা বলা হয়। আনিসুজ্জামানের লেখাটি বর্তমানের অমোঘ বাস্তবতা বলেও মানেন অনেকে। তাদের শুরু থেকে আজকের মানা’র এই ধারাবাহিকতা বিশ্লেষণ করতে গেলে অসংখ্য স্ববিরোধীতার সম্মুখিন হতে হয়। হওয়াটাই স্বাভাবিক, প্রতিটি বিরোধ সৃষ্টির প্রচেষ্টায় স্ববিরোধীতা প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন