২
৯২০ বার পঠিত
নবীন শিক্ষার্থীদের সাম্প্রদায়িক ও কূপমন্ডুক হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্ট নাগরিকরা।
গত মঙ্গলবার কামাল লোহানী, আহমেদ রফিক, যতীন সরকার, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীসহ ৮৫ বিশিষ্ট নাগরিক যৌথ বিবৃতিতে এ আহ্বান জানান। পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যমূলক ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে তারা বিবৃতিটি দেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, সঠিক শিক্ষা কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে একটি জাতির অগ্রযাত্রার গতিপথ নির্মিত হয়। শিশু শিক্ষার্থীদের মেধা, মনন, ব্যক্তিত্ব ও চেতনা গড়ে তোলায় শৈশবের শিক্ষার প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় জাতিসত্তার শিক্ষাসাধন ও বিশ্বদরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের ১৫ (ক) অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা বিধানের মাধ্যমে শিক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। ১৭ (ক) অনুচ্ছেদে একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সব শিক্ষার্থীকে বৈজ্ঞানিক ও বাধ্যতামহৃলক শিক্ষা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলনই নেই। ইংরেজি নতুন বছরের প্রথম দিনেই বিনামূল্যে সব শিক্ষার্থীর হাতে পাঠ্যবই পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের সফলতা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু পাঠ্যবইগুলোর মান নিয়ে বিগত কয়েক বছর ধরেই প্রশ্ন উঠছে। ২০১৭ সালের পাঠ্যবইগুলোয় ছাপার ভুল, বানান, তথ্য, ইতিহাসের নির্লজ্জ বিকৃতি নিয়ে বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
এতে বলা হয়, প্রাথমিকভাবে ঘটনাগুলোকে দায়িত্বে অবহেলা হিসেবে চালানোর চেষ্টা হলেও, ধীরে ধীরে এসব বিকৃতির পেছনের ঘটনা বের হয়ে এসেছে। পশ্চাৎপদ ও মৌলবাদের তোষণনীতির কারণেই পাঠ্যপুস্তকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে। এর পেছনে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে ভয়ানক বিস্তার রয়েছে, তা কয়েক বছর ধরেই স্পষ্ট। এ বছরের পাঠ্যপুস্তক সেই সাম্প্রদায়িক অপরাজনীতির সঙ্গে সরকারের আপসরফারই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, পাঠ্যপুস্তকগুলোয় যে ভুল ও তথ্য-ইতিহাস বিকৃতির ছড়াছড়ি, তা তিন ধরনের। এক. বানান ও তথ্যগত বিকৃতি। দুই. বাক্য গঠনে ভুল। তিন. মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির অনুপ্রবেশ ঘটানো। এক ও দুই নম্বর ভুলগুলো সঠিক পরিকল্পনা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে হচ্ছে। কিন্তু তৃতীয় ভুলটি পরিকল্পিত; যারা করছেন, তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের জন্য করেছেন।
এতে বলা হয়, আমাদের পাঠ্যপুস্তকে বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির ঘটনা ঘটেছে। হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে পাঠ্যপুস্তককে বেছে নেওয়া হয়েছে। ফলে চলতি বছরের পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতা ও একক ধর্মের যে বিস্তার ঘটানো হয়েছে, তার পেছনেও রাজনীতি আছে। একাত্তরের পরাজিত সাম্প্রদায়িক শক্তি আজ শাসকশ্রেণির রাজনৈতিক মেরুদণ্ডহীনতার সুযোগে বিষবৃক্ষে রূপান্তরিত হয়েছে। ভুল আর বিকৃত তথ্যে ভরা সাম্প্রদায়িক পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের জন্য সরকারকে হেফাজতে ইসলাম বা চরমোনাইয়ের পীর যখন ধন্যবাদ জানান, তখন স্পষ্ট হয়- কতটা দিকচিহ্নহীন রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনীতির দরকষাকষিতে জাতির ভবিষ্যৎদের চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। শিশুদের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিষ; রাষ্ট্রের প্রতিটি পর্যায়ে তার বিস্তার ঘটানো হচ্ছে।
বিশিষ্টজনরা আরও বলেন, হাজার বছরের আবহমান অসাম্প্রদায়িক আর সৌহার্দ্যরে সংস্কৃতিকে পাঠ্যপুস্তক থেকে তুলে দেওয়া হচ্ছে। সৃষ্টি করা হচ্ছে জাতিগত, ধর্মীয় আর নারী-পুরুষের ভেদ-বৈষম্য। এ চক্রান্ত পরিকল্পিত, কেননা বাঙালির সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের পূর্বশর্তই হলো গুণগত ও সঠিক শিক্ষা। শিক্ষা হলো সাংস্কৃতিক পুঁজি। যে ‘উন্নয়ন’-এর কথা বলে সরকার তার সামগ্রিক আপস আর মৌলবাদের তোষণনীতিকে বৈধ করার অপচেষ্টা করছে, তা কেবলই অবকাঠামোগত। কিন্তু শিশুর মননে যে সংস্কৃতির আলো পৌঁছানো প্রয়োজন, তাতে বাধা সৃষ্টি করছে সরকার। কোমলমতি শিশুদের নৈতিক বোধের স্ফূরণ না ঘটিয়ে তৈরি করা হচ্ছে বিভেদ আর সাম্প্রদায়িকতা। জঙ্গিবাদের যে ভয়াল রূপ আমরা দেখছি, তা কেবল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে নির্মহৃল করা সম্ভব নয়। জঙ্গিবাদ দমনের জন্য প্রয়োজন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন।
তারা বলেন, মৌলবাদের কাছে সরকার কতটা পরাজিত তার বড় প্রমাণ- পাঠ্যপুস্তক থেকে শিশুদের সৃজন ও মনন বিকাশের উপযোগী রচনা বাদ দেওয়া। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালন শাহ, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, এস ওয়াজেদ আলী, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখের রচনা যে হীন চক্রান্তে বাদ দেওয়া হয়েছে, সেই চক্রান্তেরই ভয়ানক রূপ হয়ে উঠবে জঙ্গিবাদ আর মৌলবাদ।
বিশিষ্টজনরা তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, লেখকদের লেখা-কবিতার লাইন পরিবর্তন করার দুঃসাহসও দেখিয়েছে কর্তৃপক্ষ। পাঠ্যপুস্তকে নির্লজ্জ দলীয়করণ করা হয়েছে, দলীয় প্রধানের তোষামোদী করে বিজ্ঞাপনও প্রচার করা হয়েছে। তারা ভুলে ভরা পাঠ্যপুস্তক প্রত্যাহারের জোর দাবি জানান। এ ছাড়া তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি দোষীদের শাস্তির দাবি করেন।
বিবৃতি দেওয়া অন্যরা হলেন- ড. হায়াৎ মামুদ, সৈয়দ হাসান ইমাম, হাসান আজিজুল হক, সনৎ কুমার সাহা, ড. অজয় রায়, ড. সফিউদ্দিন আহমদ, সাইদুর রহমান বয়াতী, কাজী মদিনা, আবুল মোমেন, রামেন্দু মজুমদার, শিল্পী আনোয়ার হোসেন, নিখিল সেন, দ্বিজেন শর্মা, বেগম মুশতারী শফি, বীরেন্দ্রনাথ রায়, অধ্যাপক আবুল মনসুর, ডা. রশিদ ই মাহবুব, লায়লা হাসান, মামুনুর রশিদ, মানবেন্দ্র বটব্যাল, মাহফুজা খানম, অধ্যাপক ড. রফিকুল আলম, ড. ইনামুল হক, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, কবি আসাদ চৌধুরী, অধ্যাপক শফি আহমেদ, অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম, অধ্যাপক বদিউর রহমান, কাজী মোহাম্মদ শীশ, ম হামিদ, লাকী ইনাম, এ এন রাশেদা, অধ্যাপক মতলুব আলী, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, শংকর শাওজাল, ভাস্কর রাশা, রফিউর রাব্বি, শিক্ষাবিদ রাবেয়া খাতুন, সঞ্জীব দ্রং প্রমুখ।
সূত্র: দৈনিক সমকাল
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
জানুয়ারি ১১, ২০১৭; ৭:৪০ অপরাহ্ন
প্রয়োজন প্রতিরোধ।
জানুয়ারি ১৪, ২০১৭; ৩:৪৭ পূর্বাহ্ন
আহ্বান করে সাড়াশব্দ কিছু জুটল কি?