০
১২৪৫ বার পঠিত
বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা এবং সাহিত্যিক মনি হায়দার সামাজিকমাধ্যমে জেলাগুলোর সাহিত্য চর্চা বিষয়ে ক্ষোভ কিংবা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ‘জেলার সাহিত্যর কর্ণধার জেলা প্রশাসকরা’ অনেকটা এমন বলে তাকে সাহিত্যের দুরবস্থা বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি। মনি হায়দারকে বন্ধুজন জানি, তার এই ক্ষোভ বা শঙ্কার বিষয়টি অমূলক নয়। জেলায় জেলায় সাহিত্য সম্মেলন হয়েছে কদিন আগে। এসব সম্মেলনের আয়োজক ছিলো জেলা প্রশাসন। মনি ভাইয়ের ভাষায় বলতে গেলে, জেলার সাহিত্যের কথিত কর্ণধার জেলা প্রশাসকগণই।
আমলারা যখন শিল্প-সাহিত্যের কর্ণধার হয়, তখন মনি হায়দারের ভাষ্যটা অনেকাংশেই সঠিক হয়ে দাঁড়ায়। ব্যতিক্রমও আছে। কবি কামাল চৌধুরী, আমলা হিসেবে যিনি কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী নামে পরিচিত। আমার অত্যন্ত প্রিয়জন। কিন্তু পরিচিতির মূলটা তার কবি হিসেবে। আজ থেকে প্রায় দুই দশক আগে তাকে বলেছিলাম, হয়তো একদিন প্রশাসনের সর্বোচ্চ জায়গায় যাবেন, কিন্তু তাতে কিচ্ছু আসবে যাবে না। আপনি মানুষের কাছে আদৃত হবেন কবি কামাল চৌধুরী হিসেবে। অনেক আমলা এসেছেন, গিয়েছেন মানুষ তাদের মনে রাখেনি। তাদের মনে রাখার মতন আলাদা কিছু ছিলো না।
কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন। বর্তমানে তার পদমর্যাদা অতিরিক্ত সচিবের। কিন্তু জাকির হোসেনকে মানুষ চেনেন নজরুল গবেষক হিসেবে। যেখানেই নজরুল বিষয়ক বক্তৃতা সেখানেই ডাক পড়ে জাকির হোসেনের। মানুষ মুগ্ধ হয়ে শোনে তার কথা। জাকির হোসেন হয়তো সচিব হবেন, কিন্তু তার প্রকৃত পরিচিতি থেকে যাবে কবি নজরুলকে ঘিরেই। তিনি সময়ের সাথে আলোচিত হবেন একজন নজরুল গবেষক হিসেবে।
আলম ভাই, ছড়াকার আলম তালুকদারকে মহামারী করোনা কেড়ে নিয়েছে। তিনি একসময় জাতীয় গ্রন্থাগারের মহাপরিচালক ছিলেন। খুব চমৎকার মানুষ এবং তার সাথে আমার সম্পর্কটিও ছিলো দারুণ। এত রসিক মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। তার সরকারি পদ-পদবি এমনকি সরকারের খাতার নামটিও অনেকে জানেন না। কিন্তু পাঠকদের হৃদয়ে আছেন তিনি ছড়াকার আলম তালুকদার হিসেবে এবং সেই বসবাস ভালোবাসার সাথে। সুতরাং মনে রাখতে ও থাকতে হলে সৃষ্টিশীল হতে হয়, আলাদা কিছু থাকতে হয়।
মনি হায়দারের ক্ষোভের কথায় আসি। জেলা প্রশাসকদের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করে লাভ কী? প্রশাসন তো একটা যন্ত্র, হুকুম পালনের জায়গা। যা হুকুম হয় তা পালন করতে হবে। যারা হুকুম দেন তারা কি ভেবে দেখেছেন জেলা প্রশাসকরা সাহিত্যের ব্যাপারে কতটা ওয়াকিবহাল? ভাবেননি। আমার জেলাতেও সাহিত্য সম্মেলন হয়েছে। সেখানেও সাহিত্যজনদের একটা তালিকা রয়েছে, যে তালিকায় সম্ভবত আমার নাম নেই। না, এতে আমার কোনো ক্ষোভ নেই। জেলা প্রশাসকের প্রতিও আমার কোনো ক্ষুব্ধতা নেই। কারণ তিনি সাহিত্যজন নন; নন বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার সাথে জড়িতও। তার কাজ প্রশাসন চালানো এবং প্রশাসন মূলত যন্ত্র। সেই যন্ত্রের একটা অংশ তিনি। তার নিজস্ব কোনো চিন্তা নেই, থাকলেও তার প্রকাশ বা প্রয়োগ করার উপায় নেই। ক্ষোভটা সে কারণেই নেই।
অবলম্বন প্রয়োজন হয় কাদের, এমন প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় প্রতিবন্ধীদের। সুতরাং যারা বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করেন, তাদের কি অবলম্বনের খুব বেশি প্রয়োজন? সাহিত্যিক জাকির তালুকদার, বাংলাদেশের সাহিত্যজগতের অন্যতম একজন। রাজশাহীর চিহ্নমেলায় তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। অথচ সেই চিহ্নমেলায় এক সময় তিনি পুরস্কৃত হয়েছিলেন, এবার তাকে ডাকাও হয়নি। তাতে কি জাকির তালুকদারের সাহিত্য চর্চা থেমে যাবে? যাবে না তো। কিন্তু যারা ভাবেন আমন্ত্রণ না পেলে, তালিকাভুক্ত না হলে সাহিত্য চর্চা আটকে যাবে, সত্যিকার অর্থে নিজের কৃতকর্মের উপর তাদের বিশ্বাস নেই। অবশ্য নিজ কাজ তাকে চিহ্নিত করবে, এমন বিশ্বাস অনেকেরই নেই।
জেলার কথা বাদ। প্রতিষ্ঠিত অনেকেরই পদক বা পুরস্কারের আশায় যে আকুলতা দেখি, তাতে বিশ্বাসহীনতার বিষয়টিই প্রমাণিত হয়। যেন আমন্ত্রণ, তালিকা, পুরস্কার আর পদকই সব! অথচ কারো কাছে তো রান্নার চুলা আর পদক সমার্থক হয়ে ওঠে। সুতরাং সমস্যা সবখানেই। আর সাহিত্যের দুরবস্থা এসব কারনেই। সময়টাই ভালো যাচ্ছে না, সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হয়, ‘সকলই গরল ভেল’।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন