সাহিত্য অকাদেমির ‘হরিচরণ-পূজা’ (সিমপোজিয়াম) বিষয়ে ‘বঙ্গযান’ উত্থাপিত এক ডজন প্রশ্নমালা এবং শ্রীরবি চক্রবর্ত্তী-কৃত ‘গুরুবন্দনা‘
প্রশ্ন-১
‘বড় শত্রুকে উঁচু পিঁড়ি’ দিয়ে বা পূজা করে মেরে ফেলার মহান ঐতিহ্যশালী এই দেশে গান্ধীর গলায় মালা দিয়ে পূজা করা ও গান্ধীনীতি অমান্য করা, কিংবা রবীন্দ্রনাথের গলায় মালা দিয়ে পূজা করে তাঁর শিক্ষানীতি অমান্য করা’ এ’সব তো চলছিলই; পাশাপাশি এবার কি তবে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পূজা করে তাঁর শব্দার্থনীতিকে সমূলে ধ্বংস করার উদ্যোগ নেওয়া হল? তাঁর সার্দ্ধ জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সিমপোজিয়াম ইত্যাদির নামে হরিচরণ-পূজার প্রচলন কি সেই জন্যেই?
প্রশ্ন-২
১৯৩৯ সাল থেকে ১৪ বছর ধরে ১০৫ খণ্ডে সম্পূর্ণ স্বোপার্জ্জিত অর্থে স্বল্পসঙ্খ্যয় যে ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ‘-এর আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল সেই ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’কে কেন্দ্র করে স্রষ্টা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার সৃষ্টি নিয়ে যারা ইতোমধ্যেই গবেষণা করেছেন এবং গবেষণালব্ধ ফল পুস্তকাকারে জনারণ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং যার গ্রহণযোগ্যতা, পঠন-পাঠন ও চর্চ্চা বাংলা তথা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা আপামর বাঙালীর কাছে ক্রমেই পৌঁছে যাচ্ছে, সেই গবেষক মনীষী শ্রীরবি চক্রবর্ত্তী এবং শ্রীকলিম খান কি এই সিম্পোজিয়ামে আমন্ত্রিত হয়েছেন? না হলে কেন হন নি?!!!
প্রশ্ন-৩
শ্রীরবি চক্রবর্ত্তী এবং শ্রী কলিম খানের যৌথ গবেষণা ছাড়া অন্য কেউ কি আজ পর্য্যন্ত স্রষ্টা হরিচরণ [রাজা মিত্র নির্ম্মিত চলচ্চিত্র ‘একটি জীবন‘ ব্যতিরেকে) এবং তাঁর সৃষ্টি ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ‘-এর উপরে কোনো গবেষণাপ্রসূত সন্দর্ভ বা নিবন্ধ বা পুস্তক স্বকীয় বা সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছে কি? কেন হরিচরণের কোষগ্রন্থটি পড়ব কিংবা পড়ব না, তাঁর বিশেষত্ব ঠিক কোথায়, তা নিয়ে উপরোক্ত চিন্তকদ্বয় ছাড়া আর কেউ কোন প্রতিবেদন পেশ করেছেন কি?
প্রশ্ন-৪
কী কারণে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় তাঁর ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ লিখতে গিয়ে নিম্নলিখিত এই ‘দুষ্কর্ম্ম’(?)-গুলি করেছেন?
(১) একটি শব্দের অর্থ দিতে গিয়ে তিনি একাধিক, বহু ও অসংখ্য অর্থ দিয়ে গেছেন কেন?
(২) কখনও কখনও এক বা একাধিক বাক্যের সাহায্যে শব্দের অর্থ দিয়ে গেছেন কেন?
(৩) শব্দের এমন অর্থ দিয়ে গেছেন কেন যা অবাস্তব, অসম্ভব, বা অবিশ্বাস্য? [যেমন – লিঙ্গ = যাহার দ্বারা জ্ঞান সাধিত হয়; অশ্বত্থ = অশ্বেরা থাকে যাহাতে; অক্ষ = যাহার দ্বারা দেবন হয়; … এ’রকম অজস্র ]।
(৪) দেড়শো বছর পূর্ত্তির নামে অনেক কিছুই তো হল, কিন্তু রবি চক্রবর্ত্তী ও কলিম খান ছাড়া আর কেউ কি উপরোক্ত প্রশ্নগুলির অর্থ কখনও খুঁজেছেন, কোত্থাও? না, পাশ্চাত্যের প্রতীকী একরৈখিক লোগোসেণ্ট্রিক ভাষাতত্ত্বে বিশ্বাসী তথাকথিত ‘আলোকপ্রাপ্ত’ ‘অন্ধ’ তৎকালীন বাংলাভাষা ও শিক্ষাজগতের কাণ্ডারিরা হরিচরণের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ‘-এর তাৎপর্য্য, বৈশিষ্ট্য ও অনন্যতাকে অনুভব করতে হয় পুরোপুরি অক্ষম ছিলেন, নয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভারতের ঐতিহ্যমণ্ডিত ভাষাতত্ত্বকে ঔপনিবেশিক প্রভুদের স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন এবং বাংলাভাষাকে তার বর্ত্তমান নৈরাজ্যিক, বিশৃঙ্খল, মুমূর্ষুরূপে নামিয়ে এনে অধঃপতনের চূড়ান্ত পথে ঠেলে দিয়েছেন।
প্রশ্ন-৫
বাংলাভাষার শব্দের বহুরৈখিক অর্থ-বৈশিষ্ট্য (এক শব্দের বিশ-ত্রিশ-চল্লিশ কিংবা অসংখ্য অর্থ হয় এমন অজস্র শব্দের ভাণ্ডার) এবং তার ক্রিয়াভিত্তিকতাই যে বাংলা শব্দার্থতত্ত্বের অনন্যতা বা ‘ইউনিকনেস’ যা শ্রুতকীর্ত্তি হরিচরণ ‘বঙ্গীয়-শব্দকোষ‘-এ তুলে ধরেছেন সেই অনন্যতা ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ‘-এর পরে আর কোন অভিধানে [ খান-চক্রবর্ত্তী প্রণীত ব্যতিক্রমী ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ ও ‘সরল শব্দার্থকোষ‘ ছাড়া ] অর্থাৎ অন্য কোথাও অনুসৃত হল না কেন?
প্রশ্ন-৬
১৯৩৯ সালেই যে ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ পূর্ণাঙ্গরূপে প্রকাশিত হতে পারত, কিন্তু পারেনি, যার বহু কারণের সঙ্গে সকলেই পরিচিত; যেমন – রবীন্দ্রনাথের অশক্ত ভগ্নস্বাস্থ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বিশ্বভারতী ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক অস্বচ্ছলতা/অক্ষমতা ইত্যাদি কারণ – এবং এ’সবই বোধগম্য। কিন্তু ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৯ পর্য্যন্ত হরিচরণের জীবদ্দশার শেষ ১২ বছরেও ‘সাহিত্য অকাদেমি’ বা অন্য কোন একাডেমী, কিংবা রাজ্য-সরকার কিংবা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কেউই ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ প্রকাশ করতে পারলেন না কেন?!!! সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় [যিনি ভারতের একাডেমিক বিশ্বের অবিসম্বাদিত নেতা, প্রধানমন্ত্রী থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সকলের কাছেই সম্মানিত ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব]-এর মত এমন ক্ষমতাবান আচার্য্যের উপস্থিতি ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও একটি ঐতিহাসিক কোষগ্রন্থ আলোর মুখ দেখল না, সমগ্র বাঙ্গালীসমাজকে বঞ্চিত করে রাখা হল এমন একটি উচ্চস্তরের কোষগ্রন্থের ঐশ্বর্য্য থেকে? কিন্তু কেন? কেন এই উপেক্ষা ও অবহেলার শিকার হতে হ’ল হরিচরণকে ও তার অমর সৃষ্টি ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’কে? কোনো সদুত্তর আছে কি? তাহলে আজ কোন অর্ঘ্যের ডালি নিয়ে হরিচরণ-পূজার এই আয়োজন?
প্রশ্ন-৭
হরিচরণের জন্মশতবার্ষিকীতে রাজ্য সরকারের অর্থানুকূল্যে কোষগ্রন্থটি দুইখণ্ডে সুলভমূল্যে প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও কোনো বিদ্যালয়ে, মহাবিদ্যালয়ে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ কে অবশ্যপাঠ্য অভিধান করা হয়নি। শুধু তাই নয়, এমনকী রেফারেন্স্ অভিধান হিসাবেও তাকে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢু্কতে দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের জন্য এক যুগ সময়কাল অপেক্ষাই বা করতে হল কেন?
প্রশ্ন-৮
কেন সমস্ত অধ্যাপক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ক্রমাগত শিক্ষক, ছাত্র ও অভিভাবক-সমাজকে এই কথাই বুঝিয়েছিলেন যে ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এর মত অভিধানগ্রন্থ শিক্ষকরা শেখাতে পারবেন না এবং ছাত্রসমাজও এই অভিধান বুঝবে না এবং এক শব্দের একাধিক মানে শিখলে জটিলতা বাড়বে। আর এভাবেই তারা বাংলার শিক্ষক সমাজ এবং ছাত্রসমাজের মননশীলতার অমর্য্যাদা ও অপমান করার এই দুঃসাহস দেখিয়ছিলেন, – সেকি এই জন্যই যে তারা নিজেরাই হরিচরণের শব্দকোষ আত্মস্থ করতে পারেন নি? শুধু কি তাই, ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’-কে ‘রেফারেন্স বুক’ হিসাবেও দেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশের অনুমোদন পর্য্যন্ত তারা দেননি, এমনকী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান সেই কাজ করার আবেদন জানালেও তা অনুমোদিত হয়নি – কিন্তু, কেন?
প্রশ্ন-৯
‘সাহিত্য অকাদেমি‘ কি কলিম খান রচিত ২০০২ সালে প্রকাশিত ‘পরমাভাষার বোধন-উদ্বোধন‘ কিংবা রবি চক্রবর্ত্তী ও কলিম খান প্রণীত কোষগ্রন্থগুলি যথা – (১) ২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’-এর ১ম খণ্ড কিংবা (২) ২০১১ সালে প্রকাশিত ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’-এর ২য় খণ্ড, কিংবা (৩) ২০১৩ সালে প্রকাশিত ‘সরল শব্দার্থকোষ’ এই তিনটি অভিধানের কোনো সংবাদই পাননি বা রাখেননি কিংবা কোনো খবরই তাদের কানে কেউ পৌঁছে দেননি? কিনে পড়েছেন কি না জানি না কিন্তু লেখকদের পরিচিতদের কাছ থেকে হাতে হাতে দাম দিয়ে বা না দিয়ে নিয়েছেন, রবি চক্রবর্তীর বাড়ী গিয়ে তাঁর হাত থেকে নিয়েছেন – এমন প্রমাণ তো আছেই।
প্রশ্ন-১০
না কি ‘সাহিত্য অকাদেমি‘সহ শিক্ষাজগতের সমস্ত নিয়ামক সংস্থার ক্ষমতাসীন শীর্ষস্থানীয় কিছু রক্ষণশীল ব্যক্তিত্বের ব্যক্তিগত বাধাদানের কারণে ‘সাহিত্য অকাদেমি’র মত সংস্থাকেও উপযুক্ত গবেষণাকর্ম্মের প্রতি উৎসাহ, সমর্থন কিংবা স্বীকৃতির মত জরুরী কাজের প্রতি অবহেলা ও উপেক্ষাকে মেনে নেওয়া ভিন্ন কিছু করার উপায় থাকে না?
প্রশ্ন-১১
২৬শে জুলাইয়ের আমন্ত্রিত বক্তা ও গবেষকদের মধ্যেও কেউ কেউ আছেন যাঁরা খান-চক্রবর্ত্তীর সমস্ত গ্রন্থ ও তাঁদের অর্জ্জনের সঙ্গে সম্যকরূপে পরিচিত। এবং তাঁরা খান-চক্রবর্ত্তীর গ্রন্থ ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগ্রহ করেছেন, পঠন-পাঠন করেছেন, উচ্ছ্বসিত ও সশ্রদ্ধ প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন। একজন আছেন যিনি অভিধান-বিশেষজ্ঞ রূপে একাধিক পরস্পরবিরোধী অভিধান-সমিতির সদস্য হিসাবে যেখানে যেমন যজমানি পেয়েছেন তেমন প্রতিদানে কোথাও ‘কোষ’ লেখায় এবং কোথাও ‘কোশ’ লেখায় সম্মতি দিয়েছেন। তিনি ২০০২-এর ‘পরমাভাষার বোধন-উদ্বোধন’ গ্রন্থের রিভিউ করেছিলেন উচ্ছ্বসিত আবেগে এবং সপ্রশংস হয়ে, যে রিভিউ বেরিয়েছিল ‘একক-মাত্রা’ পত্রিকায়। আবার সেই তিনিই আজকাল পত্রিকায় খান-চক্রবর্ত্তী প্রণীত পুস্তিকা ‘বাংলাবানান বাংলাভাষা‘র বানান-নীতির তীব্র সমালোচনাও করেছিলেন। সেই তিনিই আবার ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’-এর রিভিউ করেছিলেন দায়সারা ভাবে, কিছু মুদ্রণজনিত প্রমাদের উল্লেখ ছাড়া আর উল্লেখযোগ্য কিছুই তাঁর চোখে পড়েনি বা বলতে চাননি?
মনে হয় – ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ হরিচরণের থেকে ভাষাতত্ত্বের কোন মুকুটমণি তত্ত্বটিকে সংগ্রহ করে, তাকে একালিকরণ করেছেন এবং তাকে বিশ্বের ভাষাতত্ত্ব-চর্চ্চার শিখরে প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেকথা তিনি বুঝতেই পারেননি। সেই তত্ত্বই যে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক-শব্দার্থবিধি নামে বেদ-পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারতাদির প্রকৃত অর্থ উদ্ধার করে মানবজাতির সকল অতীত রহস্য উন্মোচন (decipher) করে দেবে, সেসব কথা তিনি বুঝবেন, সে আশাও আমরা করিনি। আমাদের প্রশ্ন: এত কিছুর পরেও ‘সাহিত্য অকাদেমি’ কি জানতেন না এইসব গবেষণামূলক কোষগ্রন্থের খবরাখবর? না কি তারা জেগে ঘুমোচ্ছেন?
প্রশ্ন-১২
তা হলে কি এটা ধরে নেওয়া যায় যে সুনীতিকুমার কিংবা তাঁর উত্তরসুরিরা হরিচরণের উদ্দেশ্যে যে প্রশস্তি গেয়েছেন (শুধু তাঁর নিষ্টা, শ্রম আর শব্দকোষের কলেবরের আয়তন বিষয়ক বক্তব্যকে কেন্দ্র করেই) তা অন্ত:সারশূন্যই ছিল, অথবা অনন্যোপায় হয়ে ফাঁকা প্রশস্তি গাইতে বাধ্য হয়েছিলেন যেহেতু এই শব্দকোষ রচনার নির্দ্দেশ দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং যার পিছনে সমর্থন ছিল শান্তিনিকেতনের সঙ্গে যুক্ত প্রাচ্যের ভাষাতত্ত্বের প্রতি বিশ্বস্ত ও অনুগত শীর্ষস্থানীয় জ্ঞানব্রতিগণের? আর একে আমরা যদি বলি হরিচরণ-পূজার ছলে হরিচরণের শব্দকোষ-এর অন্তর্নিহিত বাংলাভাষার স্বভাব-সঙ্গত অনন্য নীতিগুলিকে অস্বীকার করার অপচেষ্টা মাত্র, তাহলে কি ভুল বলা হবে?
অথ উপসংহার –
খান-চক্রবর্তীর গবেষণালব্ধ গ্রন্থগুলি পাঠ করলে এক এক করে এই সব রহস্যই জানা যায়: বাস্তবে হরিচরণ ছিলেন ব্রাত্য। তাঁর রচিত ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অনুসরণের ক্ষেত্রে নানা আপত্তি তুলতেন শিক্ষাজগৎ ও অ্যাকাডেমীর শীর্ষস্থানীয় মাতব্বরেরা। বিশেষত এই জন্য যে, ইংরেজী ভাষার শব্দেরা যেখানে যাচ্ছেতাই (arbitrary) শব্দার্থনীতি অনুসরণ করে থাকে এবং সাধারণভাবে একার্থবাচক হয়, সেখানে বাংলাভাষার শব্দেরা সুবিন্যস্ত ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক (action based phoneme-centric) শব্দার্থনীতি অনুসরণ করে এবং সাধারণভাবে বহু-অর্থবাচক হয়; এবং হরিচরণ বাংলা শব্দের সেই নিজস্ব উত্তরাধিকারকে ত্যাগ না করেই তাঁর ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ সঙ্কলন করেছেন। ইংরেজীর ও ইংরেজী-প্রভাবিত ‘আলোকপ্রাপ্ত’ ( অন্ধত্বপ্রাপ্ত ) ইণ্ডিয়ানদের চোখে এ তো অমার্জ্জনীয় অপরাধ! তাঁরা যেখানে ‘স্বদেশের ঠাকুর ফেলে বিদেশের কুকুর পূজা’কেই তাঁদের ধর্ম্ম বলে ঘোষণা করে রেখেছেন, সেখানে হরিচরণ তো অধর্ম্মাচারী। ঠিক কি না?
অতএব, হরিচরণকে বাদ দাও, তা রবীন্দ্রনাথ তাঁর জন্য যতই ওকালতি করে থাকুন না কেন! অ্যাকাডেমীর শীর্ষে বসে থাকা ‘আলোকপ্রাপ্ত’ ‘অন্ধ’ ইণ্ডিয়ান পণ্ডিতেরা কী পরিমাণ রবীন্দ্রবিরোধী, রবীন্দ্রনাথের ‘শিক্ষা’ গ্রন্থটি পড়লেই সেকথা টের পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের পূজা করে যেমন রবীন্দ্রনাথের শিক্ষানীতিকে গুমখুন করা হয়েছে, এক্ষেত্রেও কি তেমনি হরিচরণের পূজা শুরু করে তাঁর (বা প্রাচ্যের) শব্দার্থনীতিকে খুন করে লোপাট করা হবে? তা নইলে অ্যাকাডেমীর শীর্ষে বসা বর্ত্তমান অ্যাকাডেমি-শিয়ানদের একটা ক্ষুদ্র অংশ এতকাল পরে হঠাৎ হরিচরণ-পূজা শুরু করেছেন কেন?
তা সে যাই হোক, যে দুজন মানুষ হরিচরণের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এর আত্মাটিকে দেখতে পেয়ে, চিনতে পেরে প্রায় চল্লিশ বছর ধরে হরিচরণের দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরে এগিয়ে দুইখানি শব্দার্থকোষ সহ অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছেন, দেখা যাচ্ছে, সেই রবি চক্রবর্ত্তী ও কলিম খানকে আজকের অ্যাকাডেমিশিয়ানরা জানেন না, বা জেনেও জানেন না! যাঁরা হরিচরণের শব্দকোষের আত্মাটিকে আদৌ চেনেন না, কেউ কেউ তার দেহটিকে মাত্র একটু আধটু চেনেন, সেই অ্যাকাডেমিশিয়ানরা এতকাল পরে হরিচরণের পূজা শুরু করেছেন! আর, সে কাজটি তাঁরা কী উদ্দেশে শুরু করেছেন, ভবিষ্যৎই তার সব রহস্য উন্মোচন করে দেবে।
সবশেষে রবি চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের ‘গুরুবন্দনা’ নামের একটি প্রবন্ধ পুন:প্রকাশ করে আজ বক্তব্য শেষ করব। প্রবন্ধটি তিনি লিখেছিলেন ২০০৭ সালের শেষ দিকে এবং ২০০৮ সালের বইমেলায় ‘রোয়াক’ পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়। তার মানে, মহাত্মা হরিচরণের পথ ধরে ক্রমশ এগিয়ে তাঁর ও কলিম খান-এর ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ তখনও লেখা চলছে। … ২০১২ সালে তাঁর ‘দিগন্তের টানে: “The Lure of the Horizon” গ্রন্থে ঐ ‘গুরুবন্দনা’ প্রবন্ধটি সঙ্কলিত হয়।
‘গুরুবন্দনা’
– রবি চক্রবর্ত্তী
‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অভিধানটি যে শ্রুতকীর্ত্তি হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বহু বছরের সাধনার ফসল, এটি আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু গ্রন্থটির গুরুত্ব ঠিক কতটা, সে বিষয়ে আমাদের অধিকাংশের কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। অনেকে এমন পর্য্যন্ত ভাবেন যে, বইটিতে পাণ্ডিত্য ও পরিশ্রমের নিদর্শন থাকতে পারে, কিন্তু বইটির প্রকৃত জায়গা হল মিউজিয়াম, কেননা বাস্তব জীবনে বইটি বিশেষ কাজের নয়।
অবশ্যই অভিধানটি আজকের শিক্ষা-পরিমণ্ডলে স্কুলছাত্রদের নিত্য ব্যবহারের উপযুক্ত নয়। তাছাড়া, অভিধান তো শুধু ছাত্রদের জন্য তৈরি হয় না। একবার ভাবুন না, অতীতকালের অভিধান-প্রণেতারা কী করতেন? শব্দভাণ্ডার নিয়ে তাঁদের যা কিছু ভাবনা, চিন্তা ও গবেষণা, অভিধানের মাধ্যমে তা তাঁরা হাজির করে দিতেন জ্ঞানী ও পণ্ডিতদের সামনে। ঘরে ঘরে প্রতি ছাত্রের কাছে অভিধান থাকবে, এমন ভাবনা নেহাতই গত দেড়-দুশো বছরের। ছাপাখানার বিপুল উন্নতির ফলে গ্রন্থপ্রস্তুতির ব্যয় কমে যায়; এবং তার ফলে এটি সম্ভব হয়েছিল এবং বলতে গেলে তখন থেকেই দুই জাতের অভিধান তৈরি হয়ে আসছে। একরকমের অভিধান তৈরি হচ্ছে তরুণ বিদ্যার্থীর জন্য, এবং আর এক রকম অভিধান তৈরি হচ্ছে শিক্ষক-অধ্যাপক -গবেষক-লেখক প্রমুখ গুণিজনের জন্য। বর্ত্তমানে অভিধানকুলের এই দুটি মূল ভাগ। এর পর হয়েছে বিষয় ও চাহিদার মাত্রা অনুযায়ী আরও অনেক রকম ভাগ। এক ইংরেজী ভাষার জন্যই Oxford University Press কত রকমের অভিধানের যোগান দিয়ে যাচ্ছে: জামার পকেটে ঢুকিয়ে রাখার মতো মিনি সাইজের অভিধান থেকে শুরু করে বড় তাক ভরে শোভা পাওয়ার মতো ঢাউস সাইজের বিশ-পঁচিশ খণ্ডের অভিধান পর্য্যন্ত।
দুঃখ লেগেছিল ‘দেশ’ পত্রিকায় একসময়ে প্রকাশিত জনৈক বাংলা শিক্ষকের চিঠি পড়ে। চিঠিতে তিনি ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ সম্পর্কে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করেছিলেন। উনি নিজে হয়তো মনে করেন, ছাত্রজীবনের লক্ষ্য পরীক্ষা উৎরানো, আর ছাত্রকে পরীক্ষা উৎরে দেওয়ার মতো বিদ্যে থাকাই শিক্ষকের পক্ষে যথেষ্ট। এবং সেক্ষেত্রে ওনার মনে হতেই পারে ‘সংসদ বাঙ্গালা অভিধান’-এর মতো গ্রন্থই কাজের অভিধান। তার ওপর ওনার এমন ধারণা থাকতে পারে, সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলার সম্পর্কটা ভুলে যেতে পারলেই বাংলা ভাষা ঠিক ‘বাংলা’ হয়ে উঠবে। সে অবস্থায় ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ ওনার কাছে বর্জ্জনীয় মনে না হয়ে পারে না। কিন্তু ঘটনাচক্রে বাংলা শব্দভাণ্ডারের মূল অংশটাই এসেছে সংস্কৃত বা প্রাকৃত থেকে। আর শব্দের উৎপত্তি দেখাতে হরিচরণ কুল বিচার করেননি। সংস্কৃত, আরবী, ফার্সী, ইংরেজী – যেখান থেকেই শব্দটি এস থাকুক না কেন, হরিচরণ তা সমান স্বচ্ছতার সঙ্গে দেখিয়ে গেছেন।
বাইরের দিক থেকে দেখলে, ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য কোথায়? অন্য সব অভিধানকার শব্দের জন্মকথা বা ব্যুৎপত্তি সংক্ষেপে সারেন, যেন একটা ritual পালন করছেন এমন দায়সারা ভাবে। এমনকী তাঁরা অনেকসময় সেই ব্যুৎপত্তি দেখানো প্রয়োজনও মনে করেন না। হরিচরণ সেখানে শব্দের সম্ভাব্য সকল রকমের উৎপত্তি যত্নের সঙ্গে দেখান। শব্দটির অর্থ দেখানোর ক্ষেত্রেও অন্য অভিধানকাররা কার্পণ্য করেন। আধুনিক কালে যে যে অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এবং হচ্ছে, সেগুলো দেখানোই তাঁরা তাঁদের কর্ত্তব্য বলে মনে করেন। প্রাচীন বাংলা বা মধ্যকালীন বাংলায় শব্দটির কী রকমের প্রয়োগ হত, সেটি দেখানোর চেষ্টা তাঁরা করেন না। হরিচরণ কিন্তু শব্দটি আজ পর্য্যন্ত যত বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার হয়েছে, তা দেখানোর চেষ্টা করেন। শুধু তাই নয়, অন্যান্য ভাষায় শব্দটির যত জ্ঞাতি-শব্দ তাঁর চোখে পড়েছে, সেই সব শব্দের উল্লেখ করেছেন তাঁর অভিধানে। এছাড়া যেখানে যতটা পেরেছেন, স্বর বা ব্যঞ্জন নির্ব্বিশেষে, প্রতিটি বর্ণের নিজস্ব অর্থ দেওয়ার চেষ্টা তিনি করেছেন।
তবে হরিচরণের দেওয়া ব্যাখ্যানের প্রধান গুরুত্ব বিশেষ এক জায়গায়। আলোচ্য শব্দটি কোন্ ধাতু বা ক্রিয়াবাচক মূল থেকে এসেছে তা দেখানোর চেষ্টা তিনি সব সময় করেছেন। শুধু তাই নয়, শব্দটি যে যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, সেই অর্থগুলিকে তিনি মেলানোর চেষ্টা করেছেন তাঁর দেখানো ব্যুৎপত্তির সঙ্গে। প্রতিটি শব্দ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন, যাস্ক-এর এই তত্ত্ব তাঁর কাছে কেতাবি তত্ত্ব মাত্র নয়, তা একটি প্রাণবন্ত সত্য। অন্যান্য অভিধানকার সম্বন্ধে একথা বলা চলে না।
হরিচরণের অভিধানের তাৎপর্য্য দূরপ্রসারী। তবে সেই আলোচনার আগে অল্প কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এর সার্থকতা বোঝানোর চেষ্টা করব। অগুণতি উদাহরণ দেওয়া যায়। তবে, আলোচনা সহজ করার জন্য, বেছে নিচ্ছি, বেশী নয়, মাত্র চার-পাঁচটি শব্দ – ‘পদ’, ‘পাত্র’, ‘লিঙ্গ’, ‘সিদ্ধ’।
সংসদের অভিধানে ‘পদ’ শব্দটর মানে দেওয়া আছে – চরণ (= leg / foot), কার্য্যের ভার বা অধিকার (= post / position), কবিতা, কবিতার পঙক্তি, বিভক্তিযুক্ত শব্দ, বিভিন্ন প্রকার বস্তু ইত্যাদি। কিন্তু ‘পদ’ শব্দটির এত ভিন্ন রকমের মানে হল কী করে? এ-প্রশ্ন যদি কোনো জিজ্ঞাসু ছাত্র তোলে, তবে শিক্ষকমশাই কী উত্তর দেবেন, তার কোনো হদিশ সংসদ অভিধান দেয়নি; এমনকী ‘পদ’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি পর্য্যন্ত দেখায়নি। ঢাকার বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ও এ-বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত বা হদিশ দেয়নি। কিন্তু হরিচরণ দিয়েছেন। ‘পদ’ শব্দের পাশে হরিচরণ প্রথম অর্থ দিয়েছেন ‘গমনসাধন’, এবং ‘পদ’ শব্দের ঠিক আগে ‘পদ’ ধাতু এনেছেন এবং তার মানে দিয়েছেন একেবারে প্রথমেই : ‘গতি, প্রাপ্তি’। এবার একটু আলো পাওয়া গেল না কি? leg, foot–এর সাহায্যে কোথাও যেতে পারি এবং কিছু করতে পারি, post, position-এর সাহায্যে বেতন, সম্মান ইত্যাদি পাই, কবিতা বা কবিতার পঙক্তির সাহায্যে কাব্যরস পেয়ে যাই, বিভক্তিযুক্ত শব্দের সাহায্যে একটা বিশেষ অর্থ বা মানে পাই, এমনকী রান্নার পদের সাহায্যে পাই ভোজনের রস বা তৃপ্তি। এই সব কিছু বোঝানোর ক্ষমতা আছে ‘পদ’ শব্দটির। কারণ ‘পদ্’ এই ক্রিয়াবাচক শব্দের ভিত্তিতেই দাঁড়িয়ে আছে এতগুলি মানে।
‘পাত্র’ শব্দটির ক্ষেত্রেও সংসদ অভিধান ব্যুৎপত্তি দিচ্ছে না এবং নানারকমের মানের পিছনে কোনো যুক্তি দিচ্ছে না। অন্যান্য অভিধানের মতো সংসদ অভিধান ‘পাত্র’ শব্দটির মানে দিচ্ছে পান বা ভোজনের পাত্র, মন্ত্রী, উপদেষ্টা, যোগ্য ব্যক্তি, নাটকের চরিত্র, বিবাহের বর ইত্যাদি। এত ভিন্ন রকমের মানের কারণ কী? কোনো অভিধান কোনো দিশা দেখাচ্ছে না; ব্যতিক্রম শুধু ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’। হরিচরণ ‘পাত্র’ শব্দটির প্রথম অর্থ দেন ‘আধেয়রক্ষক’। পেয় বা ভোজ্য বস্তু, কাজকর্ম্মের দায়িত্ব, নাটকে উপস্থাপিত ভাব ও রস, স্নেহ, শ্রদ্ধা প্রভৃতি ভাব, বিবাহযোগ্যা কন্যা – সব কিছুই রক্ষা করবার ও পালন করার যোগ্য অর্থাৎ ‘আধেয়’। অতএব যার দ্বারা সেই রক্ষণ ও পালন ক্রিয়াটি সম্পন্ন হচ্ছে সেই তো পাত্র – সে বাটি, মন্ত্রী, নাটকের চরিত্র, কন্যার বর, যাই হোক না। হরিচরণের পৃথকভাবে দেওয়া ‘প’ শব্দের অর্থ হল পান / পালন। তার সঙ্গে মেলালে ‘পাত্র’ শব্দের এত রকমের মানে মেনে নিতে অসুবিধে হয় না।
আর ‘লিঙ্গ’ ও ‘সিদ্ধ’ শব্দের বেলায় ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ‘-এর সার্থকতা চোখে পড়ার মতো। সংসদ অভিধান ‘লিঙ্গ’ শব্দের প্রথম মানেই দিচ্ছে ‘পুং জননেন্দ্রিয়’। তারপর বলছে, ‘শিবমূর্ত্তিবিশেষ’। তারপর ‘পুংস্ত্ব, স্ত্রীত্ব’। তারপর ‘শব্দের পুং-স্ত্রী-ক্লীবভেদ’। কিন্তু ‘লিঙ্গ’ বললে যদি মুখ্যত penis বোঝায়, তবে ‘স্ত্রীলিঙ্গ’ বা বিশেষ করে ‘ক্লীবলিঙ্গ’ শব্দদুটি কী করে দাঁড়ায়? আবার, ভারতীয় চিন্তায় কল্পিত মানুষের সূক্ষ্মশরীর, যেখানে দেহ থাকার প্রশ্ন নেই, তাকে কেন ‘লিঙ্গশরীর’ বলা হবে? হরিচরণ কিন্তু ‘লিঙ্গ’ শব্দের প্রথম মানেই দিয়েছেন ‘জ্ঞানসাধন’। তারপর দিচ্ছেন ‘চিহ্ন, লক্ষণ’। শব্দের পঞ্চম মানে হিসেবে তিনি দিচ্ছেন ‘পুংচিহ্ন, স্ত্রীচিহ্ন’। হরিচরণের দেওয়া এই ‘জ্ঞানসাধন’ সংজ্ঞা থেকে অনেকটা বুঝতে পারি, মধ্যযুগের ইংরেজিতে know কথাটি কেন প্রায়ই মৈথুন অর্থে ব্যবহৃত হত। মজার কথা এই যে, পাশ্চাত্যের ভাষাতত্ত্ব ‘know’ শব্দের এই অর্থ হওয়ার পিছনে কোনো কারণই দেখাতে পারে না। কিন্তু আমাদের ভাষাতত্ত্ব এ বিষয়ে সুস্পষ্ট হদিশ দেয়। আর হরিচরণ হলেন সেই ভাষাতত্ত্বের প্রতিনিধি।
‘সিদ্ধ’ শব্দের বেলায় সংসদ অভিধান প্রথম যে দু-তিনটি মানে দিয়েছে তারা এককথায় ইংরেজী boil শব্দের নানা বাংলা প্রতিশব্দ, আর তারপর যে তিন-চারটি মানে দিয়েছে তারা এককথায় succeed / success-এর বাংলা। প্রশ্ন উঠছেই, boiling-এর সঙ্গে success-এর কী সম্পর্ক? কোনো ইঙ্গিত নেই। ‘সিদ্ধপুরুষ’, ‘অষ্টসিদ্ধি’ – এসব শব্দ কি উড়ে এসে জুড়ে বসেছে? হরিচরণ কিন্তু ‘সিদ্ধ’ শব্দের ব্যাখ্যায় boiling-কে কোনো গুরুত্বই দেননি। শব্দটির তেরো নম্বর মানেতে তিনি boiling-কে এনেছেন। ‘সিদ্ধ’ শব্দের প্রথম মানেই হরিচরণ দিয়েছেন ‘নিষ্পন্ন, নিবৃত্ত’, এবং ক্রমে ‘সিদ্ধ’ তথা ‘সিদ্ধি’ শব্দের নানা ব্যবহার দেখিয়েছেন। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অভিধানে আগাগোড়া এই চেষ্টা হয়েছে যাতে শব্দের সঙ্গে অর্থের প্রকৃত সম্পর্কটা মানুষের বোধগম্য হয়।
তাঁর দেওয়া অগণিত তথ্য ও উদ্ধৃতি কত কী কাজে লাগতে পারে, তা জানা হরিচরণের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু সত্যান্বেষণের কাজে তিনি নিজেকে নিঃশেষে নিবেদন করেছিলেন। তাই বোধ করি প্রকৃতিও তাঁকে পুরস্কার দিয়েছিল। বারে বারে সেই সব তথ্য ও তত্ত্ব তাঁর চেতনার ছাঁকনিতে আটকে যেত, যেগুলি পরে আলোকবর্ত্তিকার কাজ করবে। কী বিশাল তফাৎ সমাজসত্য ও ভাষাসত্যের স্বঘোষিত অভিভাবকদের থেকে! সত্যের আহ্বান পেয়েও তাঁরা সাড়া দেন না। প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেয়, তাঁদের চেতনায় নিজে থেকে সত্য উদ্ভাসিত হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি বন্ধ করে দিয়ে!
প্রকৃত অর্থেই ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অভিধানের সার্থকতা বহুমুখী। যেমন দেখছি know ক্রিয়াটির বেলায়, তেমন দেখব আরও বহু শব্দের ক্ষেত্রে। তাঁদের নিজেদের ভাষা ঐতিহ্য নিয়ে পশ্চিমের ভাষাতাত্ত্বিকরা আঁধারে পথ হাতড়াচ্ছেন, কিন্তু সেখানে জোরালো আলো ফেলছে ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’। এবং তার ফলে সভ্যতার ইতিহাসের পুনর্লিখন পর্য্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ইংরেজীর and যে জার্ম্মান-এর und–এর জ্ঞাতি, এ কথা পশ্চিমী ভাষাবিদরা সবাই জানেন। কিন্তু এরা কোন ভাষা থেকে এল, এবং কেনই-বা তাদের এমন মানে হল? পশ্চিমী ভাষাতত্ত্ব আজও তা জানে না। সেকালের বাংলাভাষিরা তা জানতেন বলেই হরিচরণ ‘অণ্ড’ শব্দের প্রথম অর্থই দিতে পেরেছেন ‘যাহা দ্বারা অবয়ব সংযোগ প্রাপ্ত হয়’। ‘অণ্ড’কে and–এর জ্ঞাতিশব্দ বলে ভাবতে পারলে, যেটা মোটেই কঠিন নয়, একই সঙ্গে আলো পড়ে যায় ইংরেজীর and, জার্ম্মান-এর und, হিন্দীর ‘আণ্ডা’, আর গ্রীক ভাষার Andro (= male) শব্দের ওপর।
আবার ash (গাছ) ও ass শব্দ কোথা থেকে এল, কীভাবে তৈরি হল, কোনো ব্যাখ্যা নেই পশ্চিমী ভাষাতত্ত্বে। কিন্তু হরিচরণের দেওয়া ‘অশ্’, ‘অশ্ব’ ও ‘অশ্বত্থ’ শব্দের ব্যাখ্যায় আছে রহস্যের সমাধান। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অশ্-এর দ্বিতীয় মানে দিচ্ছে ‘ব্যাপ্তি’ আর (অন্তঃস্থ) ব-এর মানে বলছে ‘বহন’ বা বাসস্থান। তাহলে মানুষ যার সাহায্যে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ব্যাপ্ত হতে পারত, স্বাভাবিকভাবেই তার নাম দেবে ass বা ‘অশ্ব’ (horse)। ভাষা থেকে প্রমাণ পেয়ে যাচ্ছি যে, অশ্ব (horse)-কে আয়ত্তে আনার আগে ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর মানুষেরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আবার, পরিচালনা-কেন্দ্রের ইচ্ছা বা নীতি যে মানুষদের সাহায্যে সমাজে ছড়িয়ে পড়বে বা ব্যাপ্ত রূপ পাবে, তারাও তো অশ্ব পদবাচ্য। যে সমাজব্যবস্থায় অশ্বরা সক্রিয়, সে ব্যবস্থা তাহলে অশ্বত্থ! হরিচরণ বিনা কুণ্ঠায় ‘অশ্বত্থ’ শব্দের ব্যাখ্যা দিয়েছেন ‘অশ্বরা এখানে থাকে’ (‘অশ্বা: তিষ্ঠন্তি অস্মিন্’)। তত্ত্বটা এই যে, অশ্বত্থ-সমাজব্যবস্থা হল প্রাচীন অশ্বমেধ-এর কালের ব্যবস্থা। সেই ব্যবস্থা বটবৃক্ষ সূচিত বেনিয়া (banian) আধিপত্যের সমাজ থেকে প্রাচীনতর ও মহত্তর ব্যবস্থা; আমাদের দেশে অশ্বত্থগাছ কেন বটগাছের চেয়েও বেশী পবিত্র, ওদের দেশেও Ash গাছ কেন পৌরাণিক মহত্ত্ব পাচ্ছে এবং কেন ওরা বলে The horse is a noble animal – বোধ হয় একসঙ্গে সব কিছুর ব্যাখ্যা পাওয়া গেল।
বাংলা চর্চ্চার চৌহদ্দির মধ্যে শব্দার্থতত্ত্বের আজ যে নবজন্ম হয়ে চলেছে মুখ্যত কলিম খান এবং কিছুটা আমার কাজের মধ্য দিয়ে, সে কাজের সূচনা হরিচরণের অভিধান থেকে। উত্তরসূরী হওয়ার সৌভাগ্যে, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের জোরে, এবং প্রতি বর্ণের বিশেষ অর্থবহতায় স্থিরনিশ্চয় হওয়ায় হরিচরণ থেকে এগিয়ে যাওয়ার এবং বহু ক্ষেত্রে তাঁর থেকে ভিন্নতায় যাওয়ারও সাহস আমরা করেছি। কিন্তু মানুষের পরমাভাষার আবাহনমন্ত্র আমাদের জীবনে যে স্পন্দিত হয়ে চলেছে, সে সৌভাগ্যে আমাদের অধিকারই হয় না যদি-না হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মহান সাধনাকে আগেই বন্দনা জানাই।