১
১৪৯০ বার পঠিত
মানুষ কেন লেখে?
মানুষই একমাত্র প্রাণী যে লেখালেখি করে। আর কোন প্রাণীর মধ্যে লেখালেখির উদাহরণ নেই। মানুষ লেখে কারণ সে বিমূর্ততা ভালোবাসে। আর কোন প্রাণী এই বিমূর্ততাকে অনুভব করে না। সবাই মূর্ত (Real) জগতকেই বুঝতে পারে। তাকে কেন্দ্র করেই তার সমস্ত কর্মকাণ্ডকে আবর্তিত করে। যেমন একটা বানরকে কলা দেখালেই কেবল সে সেটা পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হবে। কিন্তু তাকে কলার স্বপ্ন দেখিয়ে কাজ আদায় করা যাবেনা।
মানুষ যা চর্ম চক্ষে দেখতে পায়না, এমনকী যার অস্তিত্ব সম্পর্কেও কোন ধারণা নেই তাকেও সে অনুভবে হাজির নাজির বলে জানে। মানুষ অনেক সম্ভাবনাকে স্বপ্নে দেখতে পায়। অসম্ভবকেও দেখতে পায়। সেই স্বপ্নের জন্য এমনকী সে জীবনও দিতে পারে।
এই দেখা ও অদেখার মাঝামাঝি বিমূর্ত জগতকে শব্দ দিয়ে মূর্ত করে তোলাটাই লেখকের কাজ। এ ক্ষেত্রে লেখক একজন নির্মাণ শ্রমিক।
লেখালেখির কাজটার জাগতিক বা বৈষয়িক মূল্য তেমন নেই। যেহেতু তা বিমূর্ত। কিছুটা এন্টারটেইনমেন্ট আছে ফলে কখনো কখনো তা বিনোদনের বাজারমূল্যে বিক্রি হয়। কিন্তু সেটা না থাকলে লেখালেখি আসলে লালনের ভাষায় ‘বাতাসে গেরো দেওয়ার মত কাজ‘। এ যেন শূন্যের ওপর পোচতা করে ঘর বাধা। এই কাজটা ঘোর লাগা মানুষের কাছে বড়ই মূল্যবান। লেখালেখি মূলত একটি ঘোরের জগত।
লেখককে নির্লিপ্ত হতে হয়। সামাজিক মানুষ হয়েও লেখক হবেন সমাজের বাইরের একজন বিচ্ছিন্ন মানুষ। মহাকাশচারীরা যেমন মহাশূন্য থেকে পৃথিবীকে দেখলে বুঝতে পারেন পৃথিবী গোল তেমনি লেখককেও জীবনকে দেখতে হয় জীবনের বাইরে থেকে নির্লিপ্ত দর্শকের মত করে। বাঘের খাঁচায় ঢুকে বাঘের বর্ণনা লিখতে হয়না। খাঁচার বাইরে নিরাপদ দূরত্বে থেকেই তাকে দেখতে হয়।
২)
লেখালেখি একধরনের খেলা। শিল্প-সংষ্কৃতিও একধরনের খেলা। এক মানুষ আরেক মানুষে রূপান্তরিত হবার খেলা। মুখোশের খেলা। আবেগ ও অনুভব নিয়ে ভোজবাজির খেলা। মানুষই কেবল এই খেলা খেলতে পারে। এ তার কিছুটা জিনগত (জেনেটিক)। কিছুটা ভূতগত। মানে আছরজনিত (instinctual)। যা পরিবেশ থেকেও আসে। আর প্রস্তুতিও লাগে। অনেক অনেক ভাল লাইন পড়লেই কেবল একটা ভাল লাইন লেখা যায়। তাই লেখালেখি এক ধরনের এডাপ্টেশনও বটে। অন্যের ভাবনাসূত্রের সাথে নিজের ভাবনা জুড়ে দিয়েই নতুন লেখা তৈরি হয়।
লেখা একধরনের যুদ্ধও বটে। নিজের সাথে যুদ্ধ, জীবনের সাথে যুদ্ধ, জীবিকার সাথে যুদ্ধ, সমাজের সাথে যুদ্ধ। বিতর্ক লেখকের অনিবার্য নিয়তি। সামাজিক ব্যর্থতাও একটা চ্যালেঞ্জ। সাহিত্যে শহীদ হবার ঝুঁকিও আছে। সবার কপালে অমরত্ব জোটেনা।
৩)
একটু ভিন্ন প্রসংগে যাই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী বয়ানটি হলো ‘আনা ফ্রাংকের ডায়েরি‘। আনাফ্রাংক কোন যোদ্ধা ছিলেন না। তিনি ভুক্তভোগী পলায়নপর একজন কিশোরী। তিনি যুদ্ধকে দেখেছেন একজন বিপর্যস্ত মানুষের চোখ দিয়ে। যুদ্ধের অপারেশনাল ন্যারেটিভ নিয়ে হয়ত অনেক বই লেখা হয়েছে কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আনা ফ্রাংকের ডায়েরি হয়ে উঠেছে বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দলিল।
একটি যুদ্ধের বহুমাত্রিক দিক থাকে। রাইফেল বন্দুক মর্টার মেশিনগানের বাইরেও এর অসংখ্য গল্প থাকে। থাকে বলেই কোন রকম বন্দুক ধারণ না করেও, একজন পাকিস্তানি আর্মিকে হত্যা না করেই একজন ধর্ষিত, নির্যাতিত নারী হয়ে ওঠেন বীরাঙ্গনা। যেখানে তার জরায়ুই হয়ে উঠেছে একটা যুদ্ধের ময়দান সেখানে তার বন্দুক হাতে সম্মুখ যুদ্ধের প্রসংগটি অবান্তর।
জনযুদ্ধের বহুমাত্রিক দিক থাকে। জীবন ভয়ে পলায়নপর একজন ভীতু তরুণও যুদ্ধের একটি অংশ। একজন কবি পাকিস্তান সরকারের সরকারি পত্রিকায় কাজ করছেন। কিন্তু তার কাছ থেকেই আবার যুদ্ধের জন্য সঞ্জীবনী কবিতা লিখবার আব্দার নিয়ে আসছেন একজন গেরিলা যোদ্ধা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শাহাদত চৌধুরি যোগাযোগ করছেন শামসুর রাহমানের কাছে। পলায়নপর কবি কবিতা লিখলেন ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা‘। সেই কবিতা পাকিস্তানীদের হাতে পড়লে কবি ও গেরিলা উভয়ের জন্যই খারাপী ছিল। তবু মন মানেনা কবির। কবি লিখেন। কিন্তু বন্দুক হাতে যুদ্ধ করতে পারেননা। সাহস হয়না।
একজন গেরিলার জননী সরকারি রেডিওতে চাকরি করেন কিন্তু লিখে যান কষ্টের রোজ নামচা। নিজে গাড়ি চালিয়ে ছেলেকে নামিয়ে দেন যুদ্ধের রাহায়। ছেলের নিষেধ আছে বলে পেছন ফিরে থাকেন। একনজর দেখার সাধ হয় কলিজার টুকরাকে। কিন্তু যুদ্ধের শপথ অন্য জিনিস। সেই জননীর রোজ নামচা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বয়ান। তিনি সেদিনই শহীদানা বরণ করেছেন যেদিন পুত্রকে একনজর পেছন ফিরে দেখার তৌফিক হয়নি তার। এই জননী একজন লেখক। পুরো ডায়েরিতে তিনি উপস্থিত থেকেই অনুপস্থিত। যেন একজন নির্লিপ্ত মহাকাশচারী। ওপর থেকে দেখছেন আশ্চর্য ঘটনাবলী।
বয়োসন্ধি পেরুনো দুই তরুণ পিতাকে হারিয়ে বিহবল, দিশেহারা। বিধবা মা, তরুণী বোনকে নিয়ে পথে পথে, নদীতে নদীতে ঘুরছে আশ্রয়ের আশায়। এটাও জনযুদ্ধের একটা দিক। একদল ভীতু, মৃত্যুর হাত থেকে পালিয়ে বেড়ানো তরুণ হতবিহবল হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কিন্তু আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছে না। এই আশ্রয়হীনতা যুদ্ধের নির্মম সত্য। প্রিয়তম পিতাকে হারানো পুত্র, সম্ভ্রম হারানো নারী, প্রাণ হারানো যোদ্ধা কার চেয়ে কার ত্যাগ বেশি কে বলতে পারে?
এই ভীরু তরুণও লেখেন। যুদ্ধের বয়ান লেখেন। মমতা দিয়ে লেখেন সেই জনযুদ্ধের গল্প। তার নির্লিপ্তি তাকে পর্যবেক্ষকের জায়গায় স্থাপন করে। লিখতে সাহায্য করে। এই লেখকও আনা ফ্রাংকের মতো বেদনা ছড়িয়ে দেন। কখনো তা ক্রোধে রূপান্তর হয়। কিন্তু যাপিতজীবনে তিনি নির্লিপ্ত। ক্রুদ্ধ মানুষ লেখক হয় না। হলেও ছোট লেখক হয়। এদের লেখা কম মানুষই পড়ে।
৪)
একজন রাজনীতির কবি যুদ্ধে উপস্থিত থাকেননা। মিছিলেও থাকেন না। কিন্তু মিছিলের ওপারে তিনি থাকেন। যুদ্ধের জমিনে তার কাজ নেই। তার কাজ মানুষের মগজে, হৃদয়ে।
একজন মুজিব সম্মুখ যুদ্ধ করেন না। কিন্তু তিনি বিমূর্ত স্বপ্ন হয়ে থাকেন যোদ্ধার মস্তিষ্কে। শুধু পার্থক্য এই কবি লেখ্য ভাষার মোহন খেলা জানেন না। তিনি জানেন উচ্চারিত শব্দ আর উত্থিত তর্জনীর আগুন খেলা। কেন তিনি যুদ্ধ করেন নি এই প্রশ্ন বানরের সামনে কলা দেখানোর মতো রিয়ালিজমের ফেরকা।
একমাত্র মানুষই দৃশ্যমান জগতের বাইরের জগতটাকেও দেখতে পায়। তবে দেখতে জানতে হয়। একটু প্রস্তুতি লাগে এই যা।
নোট:
প্রথম ও দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ চিন্তাসূত্র ২৩/১২/২০১৭ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখক শাহাদুজ্জামানের সাহিত্য আড্ডা থেকে পাওয়া। চিন্তার জগতে আমি তার একজন সামান্য সাগরেদ বলে মনে করি। সমকালে একমাত্র তার প্রতিভাকেই ঈর্ষা করি।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
ডিসেম্বর ২৯, ২০১৭; ৩:৫৮ অপরাহ্ন
লিখতে বসলেই সবচেয়ে সাহসী মনে হয় নিজেকে।
আপনার লেখাটি চিন্তার প্রসার ঘটালো।