বাঁধভাঙ্গা প্লাবনের মত ভেসে থাকে জ্যোৎস্নার আলো। সেইসাথে হু হু করে বাতাস বয়ে যাচ্ছে কোথাও কোন অজানায়। গুঁড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর সব নৈঃশব্দ্য। এমনি কোন এক ঐশ্বরিক রাতেই হয়তো গৌতম বুদ্ধ নির্বাণ লাভ করেছিল। কিন্তু সব পূর্ণিমা রাতই যে এতোটা নিস্তরঙ্গ হবে তাও তো নয়। এই ভীষণ আলোকিত রাতেও তাই আমাদের গল্পের নায়িকা বিপাশার মন খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। বিক্ষিপ্ত বললে কম বলা হয়। ও আজ লজ্জা আর হতাশার শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। অন্তত ওর আচরণ তো তাই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সন্ধ্যার পর থেকেই ছাঁদের এক কোণে হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে। এখন বাজে রাত ১১টা।
পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাসিক এসেছে আজ ওর সাথে কিছু বিষয়ে কথা বলার জন্য। ইদানিং কর্মক্ষেত্রে ওর ব্যস্ততা খুব বেড়েছে। সেইসাথে কেমন যেন একটু অবসাদও পেয়ে বসেছে বোধহয়। ওর বর্তমান পোস্টিং প্লেস রাঙামাটি। প্রায় তিন বছর হতে চলল এখানে আছে। বিসিএস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে প্রথম জয়েন করেছিল কুমিল্লায়। এরপর রাঙামাটি। যে কোনদিন হয়তো চলে যেতে হবে অন্য কোনো জায়গায়। এখানে জীবন খুব একাকী, নিস্তরঙ্গ। দিনদিন যেন একঘেয়ে হয়ে উঠছে সবকিছু।
দুদিন হলো ও ছুটিতে বাসায় এসেছে। এসেছে বললে ভুল বলা হবে। বরং তলব করে আনা হয়েছে। ছেলের বিয়ে না দিতে পারলে মা’র যে নাওয়া খাওয়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সেটা বুঝতে পেরেই এক সপ্তাহের ছুটিতে ঢাকায় এসেছে সে। অনেকদিন বিপার সাথে দেখা হয়না। সন্ধ্যার পরপরই ওর বাসায় এসে জানতে পারে, ও ছাঁদে আছে। আজ বৌদ্ধ পূর্ণিমা। বিপা জ্যোৎস্না দেখছে ভেবে রাসিকও উঠে আসে ছাঁদে। কিন্তু এখানে এসে এমন অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হবে কে জানতো? রাসিক বুঝতে পারেনা ওর আসলে এমন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত। বুঝতে পারেনা বিপাশা এক নাগাড়ে আর কতোক্ষণ ধরে কাঁদবে? সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয়েছে আর এখন পর্যন্ত থামার কোন লক্ষণ নেই। এখন অবশ্য শুধু ফোঁপানির শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছেনা। ভীষণ বিরক্তিকর ব্যাপার তো! গত কয়েক ঘণ্টা ধরে কতোভাবেই না ও বিপাশাকে বুঝিয়ে চলেছে কিন্তু কাজ হচ্ছে বলে তো মনে হচ্ছে না।
আই হেভ বিন চিটেড! আই হেভ বিন চিটেড বাই হিম!
ফোঁপানির বিচিত্র শব্দধ্বনির ভিতর থেকে এই একটি কথাই শুধু বোঝা যাচ্ছে। ‘আই হেভ বিন চিটেড বাই হিম’। আর কাঁহাতক সহ্য হয় এসব চাইল্ডিস আচরণ। বিপাশার মুখ শক্ত করে ধরে ওর দিকে ঘোরায় রাসিক।
এই তাকাতো আমার দিকে। সত্যি করে আমাকে একটা কথা বল তো? তুই কী সত্যি বিশ্বাস করিস বাবু ভাই তোর প্রেমে পড়েছিল? আর তোকে ডিচ করে রোমানা আপুকে বিয়ে করছে? বিপাশা নিরুত্তর থাকে।
তোর সাথে উনার কী কোন কমিটমেন্ট ছিল? আমাকে বল তো?
বিপাশা বিস্মিত হয়! অবাক হয়ে রাসিকের দিকে তাকিয়ে থাকে ও। এসব তুই কী বলছিস এতদিন পর?
ঠিকই বলছি। আমি কেন আমার মত ‘কথাকাকলি’র সবাই জানতো বাবু ভাইয়ের সাথে রোমানা আপুর সম্পর্কের কথা। কেন তুই জানতিস না? বাবু ভাই কী তোকে কোনদিন বলেছিল যে উনি তোকে ভালোবাসে? এসব অলীক কল্পনা বুনা কবে থেকে শুরু করলি বল তো?
কথাকাকলী আবৃতি সঙ্ঘে বিপা একসময় আবৃত্তি শিখতো। ওখানে একজন সিনিয়র ভাই ছিলেন বাবু ভাই। বিপার সাথে ডুয়েট আবৃত্তি করতো। রোমানা নামের অন্য একজন সিনিয়র আপার সাথে বাবু ভাইয়ের সম্পর্কের কথা বিপা একসময় বলেছিল রাসিককে। আজ তাই রাসিক সেটাই মনে করিয়ে দিচ্ছে বিপাকে। বিপা যে বাবু ভাইয়ের প্রেমে পড়েছিল বা ওদের দুজনের মধ্যে কোন কখনো সম্পর্ক হয়েছিল কীনা সেটা অবশ্য রাসিক জানে না। তবে বিপার আজকের এমন বিচিত্র ব্যবহার দেখে রাসিক একইসাথে বিরক্ত ও উত্তেজিতবোধ করে। ওর কথায় অসন্তোষ প্রকাশ পায়।
রাসিকের এমন উদ্ভট ব্যবহার বিপাশা আগে কখন দেখেনি। লাজুক-শান্ত আর ভদ্র ছেলে হিসেবেই ও সবার কাছে পরিচিত। ওদের বন্ধুত্ব অনেক দিনের। একই স্কুলে পড়েছে ওরা ছোটবেলা থেকে। বিপাশার বাসায় ওর যাওয়া আসা শুরু হয় ক্লাস এইটে পড়ার সময় থেকে। বন্ধুত্বটাও গাঢ় হয়েছে তখন থেকেই।
চার মেয়ের পর একমাত্র ছেলে রাসিক। সবার ছোট ছেলে তাই যত্নের একটু আধিখ্যেতা আছে বৈকী। সারাক্ষণ কারো না কারো নজরদারিতে থাকতে হয় ওকে। বন্ধুর সংখ্যাই তো ওর হাতে গোনা। আর বান্ধবী তো কোন অলীক বস্তু বৈ কিছু নয়। শুধু বিপা ছাড়া। ওর সাথেই রাসিকের যা বন্ধুত্ব। এতটুকুই।
বিপাশার মা খালেদা ম্যাডাম ওদের স্কুলের সিনিয়র সেকশনের বায়োলজির টিচার। রাসিক উনার কাছে ব্যাচে পড়ার জন্য বাসায় আসে। বিপা খুব কাছ থেকে ওকে দেখার সুযোগ পায়। পড়া শেষ হয়ে গেলেও মাঝেমাঝে রাসিক বিপার সাথে ক্লাসের অনেক ব্যাপার নিয়ে গল্প করে। নানা বিষয়ে নিজেদের মধ্যে খোঁচাখুঁচি আর হাসি ঠাট্টায় মেতে ওঠে। দুজনার বন্ধুত্ব বেশ জমে ওঠে এভাবে। ক্লাসে সবসময় প্রথম বা দ্বিতীয় পজিশন থাকে রাসিকের। আর ভদ্র ছেলেটার চেহারাটাও খুব মিষ্টি। যে কোন মেয়েই হয়তো এমন ছেলের প্রেমে পড়তে চাইবে। বিপাশারও ওকে ভীষণ ভালো লাগে। ক্রমশ ভালোলাগা বাড়তেই থাকে। আর এটাও ও বুঝতে পারে যে সে ছেলেটার প্রেমে পড়েছে। কিন্তু বলার সাহস বা সুযোগ সহসা আসে না।
সরকারি কর্মকর্তার একমাত্র ছেলে বলে কথা। তার ওপর আবার মা হচ্ছেন মহা জাঁদরেল গৃহিণী। যার কথাই সংসারের শেষ কথা। ছেলের তদারকি করাকেই তিনি জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। মার চোখকে ফাঁকি দেওয়া ছেলের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার বলা চলে। ফলে বিপাশার খুব একটা সুবিধা হয় বলে মনে হয় না।
এসএসসিতে স্টার মার্ক্স পায় রাসিক। ভর্তি হয় ঢাকা কলেজে। বিপাশা ইডেনে। কলেজে উঠে রাসিকের বিপাশার বাসায় আসা স্বভাবতই কমে যায়। এখন তো আর খালেদা ম্যাডামের কাছে পড়া হয়না।
এদিকে বিপাশার পাশের বাসায় থাকে স্বপ্না নামের অপরূপা এক স্কুল ছাত্রী। ওদের দুই ক্লাস জুনিয়র। অর্থাৎ এখন ক্লাস নাইনে উঠেছে। আর রাসিক -বিপা পড়ছে কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে। রাসিক স্বপ্নাকে বেশ কয়েকবার বিপাশার বাসায় দেখেছে পড়ার সময়। মেয়েটিকে দেখলেই কেমন যেন ঘোর লাগে ওর মনে। নির্জনে বসে গল্প করতে ইচ্ছে করে। হাত ধরে কোন বাগানে হাঁটতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু এসব কথা কী করে স্বপ্নাকে বলা যায়? বিপাশা রাশিকের খুব ভালো বন্ধু যদিও কিন্তু ওর কাছেও কথাটা বলতে সঙ্কোচ হয় খুব। স্বপ্নাও কিন্তু রাসিককে খুব পছন্দ করে কিন্তু ছেলেটা এতো শান্ত আর ভদ্র যে কথা বলার মতো সাহস হয় না। এভাবেই এক ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী এগিয়ে যেতে দেখি আমরা। বুঝতে পারিনা কী করে এর সমাধান হবে।
স্বপ্না, বিপা আর রাসিক একই পাড়ায় থাকে। এতো বছরেও কী ওদের মধ্যে কখনো কোথাও দেখা সাক্ষাৎ হয়না? দেখা হয়। হয়তো রাসিক হেঁটে যাচ্ছে কোথাও আর স্বপ্না কলেজ থেকে এসেছে। বাস থেকে নেমেই একটা রিক্সা নিয়ে বাসায় আসছে। পথে দেখা হয় দুজনের। চোখে চোখ পড়ে। হয়তো একটু হাসে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে। ব্যাস এটুকুই। আবার হয়তো কখনো মার্কেটে দেখা হয়ে যায়। রাসিক হয়তো কোন বন্ধুর সাথে অথবা হয়তো একাই কোন চায়ের দোকানে চা খাচ্ছে আর স্বপ্না পাশের মার্কেটে গেছে কোনকিছু কেনাকাটা করতে। দেখা হয়ে যায়। হয়তো বা জানতে চায় কেমন আছো? বা স্বপ্না জানতে চায় আপনি কেমন আছেন। ভালো আছি। ব্যাস এটুকুই।
রাসিক আর বিপাশা কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ভার্সিটিতে পড়ছে এখন। আর স্বপ্না কলেজে। বিপা গান শেখা, আবৃতি করা নিয়ে খুব ব্যস্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী ও। রাসিক ক্যামেস্ট্রির। দেখা-সাক্ষাৎ তেমন হয়না বললেই চলে। কালেভদ্রে বাসে দেখা হয়ে গেলে জমিয়ে আড্ডা দিতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু সময় সুযোগ বেশি হয়না। কখনো কখনো রাসিক স্বপ্নার কথা জানতে চায়। এরইমধ্যে একদিন সাহস করে বিপাকেও জানিয়ে ফেলে যে ও স্বপ্নাকে পছন্দ করে। কিন্তু বিপা যে ব্যাপারটা ঠিক কীভাবে নেয় তা বোঝা যায় না। মনে হলো প্রথমে খুব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করে নি ওর ভালবাসার মানুষই ওকে অন্য কাউকে পছন্দ করার কথা বলবে। আর চাইবে ও যেন সাহায্য করে ওদের যোগাযোগের ব্যাপারে। ভাবেনি ওকেই অনুরোধ করবে স্বপ্নার সাথে দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য।
যাহোক, ও কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। বুঝতে পারে এসময় মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। নইলে এতদিনের সাধনা ওলটপালট হয়ে যেতে পারে। সেটা তো ও কীছুতেই হতে দেবে না। বিপার দুবছর বয়সে ওর বাবা-মার মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। ওকে একা হাতে ওর মা বড় করেছেন। অনেক অযাচিত পরিস্থিতি সামাল দিয়েই এতদূর আসতে হয়েছে ওকে। তাই এটা খুব ভালো করেই বোঝে যে কোন পরিস্থিতিতে কার সাথে কী ব্যবহার করতে হয়।সংসারে নানারকম মানুষ থাকে। কীভাবে পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে নিয়ে আসতে হয় সেটা ওর চেয়ে ভালো কয়জন জানে? রাসিকের সাথে ওর পরবর্তী ব্যবহার কী হবে আর কী করে ওকে হাতের মুঠোয় বাঁধবে সেটা মনে মনে হিসেব কষে ফেলে এরইমধ্যে। ওকে ভরসা দিয়ে বলে , আছি তোর পাশে। জানাবো । স্বপ্নার সাথে কথা বলে নেই ।
কয়েকদিন পর নিজে থেকেই রাসিকের সাথে দেখা করে ও। জানায় স্বপ্নার সাথে কথা বলেছে। স্বপ্না রাজি হয়নি রাসিকের সাথে কোন সম্পর্কের ব্যাপারে। রাসিক ব্যাপারটাকে ঠিক মেনে নিতে পারেনা। ওর মনে পড়ে মেয়েটির চোখে ওর জন্য প্রশ্রয় দেখেছিল ও। তাই একবার অন্তত ওর সাথে দেখা করতে চায় বলে জানায়। বিপাশা বলে ও স্বপ্নাকে বলেছিল সে কথা কিন্তু স্বপ্না দেখা করতে চায় না । বোঝা যাচ্ছে বিপাশা কিছুতেই রাসিক আর স্বপ্নার মাঝে কোন সম্পর্ক হোক সেটা সহ্য করবে না।
স্বপ্না আর বিপাশা খুব ভালো বন্ধু । এদিকে স্বপ্নাও কয়েকদিন ওকে বলেছে রাসিককে ওর খুব পছন্দ। বিপাশা যেন রাসিককে ব্যাপারটা জানায়। কিন্তু বিপাশা ঘুণাক্ষরেও ওকে কিছু বুঝতে দেয়না। বরং রাসিকের অন্য কোথাও সম্পর্ক আছে সেকথাই স্বপ্নাকে জানায়। স্বপ্নার আগ্রহ কিছুতেই কমেনা দেখে ও একদিন আসল কথাটা ওকে বলে বসে। বিপাশা জানায় যে আসলে ওর সাথেই রাসিকের প্রেম আছে। যদিও ওরা ব্যাপারটা কাউকে জানাতে চায় না এখন। কারণ রাসিকের মা সম্পর্কটা মানতে চাইছে না। স্বপ্না যেহেতু ওর প্রিয় বান্ধবী তাই ওকে না বলে থাকতে পারলো না।
ব্যাপারটা শুনে স্বপ্না খুব লজ্জিত হয়। বিপাশা ওকে একথা এতদিন জানায়নি বলে অভিমান হয় ওর । বিপাশাও স্বপ্নাকে সরি বলে আপাতত ব্যাপারটা মিটিয়ে নেয়।
এদিকে সময় গড়িয়ে চলে। স্বপ্না কলেজ পেরিয়ে ইউনিভার্সিটিতে যাতায়াত শুরু করেছে, এখন ওরও জীবনে নানা রঙের ছটা এসে লাগছে। নতুন জায়গা, নতুন বন্ধু, নতুন ব্যস্ততা তাকে মুখর করে রাখে। অতীত স্মৃতি ঘোলাটে হয়ে গেছে কবেই। ইংরেজি সাহিত্যে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অনার্স শেষ করতে না করতেই চারদিক থেকে বিয়ের প্রপোজাল আসতে থাকে। মাস্টার্সের ক্লাস চলতে চলতেই অস্ট্রেলিয়ার এক ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের সাথে এনগেজমেন্ট হয়ে যায়। এদিকে রাসিক কিন্তু কিছুতেই স্বপ্নাকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারছে না। কিন্তু কিছু তো করার নেই। এদিকে স্বপ্নার বিয়ে ঠিক হয়েছে সেকথাও ওকে জানিয়েছে বিপা। অস্থির হয়ে রাসিক ছুটে আসে ঢাকায়, কিন্তু ততোদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এতোদিনে সে একটি মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে বিপা রাসিককে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় যে ও ঠিকই বলেছিল স্বপ্না সম্পর্কে। এই চ্যাপ্টার ক্লোজ হয়ে যায়।
স্বপ্না স্বামী-সন্তান নিয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে সুখেই আছে। অথবা সত্যি খুব সুখে আছে কীনা আমরা জানতে পারি না। সেটা জানা খুব দরকারও নেই। কিন্তু রাসিক! ও এখনো ভাবে স্বপ্নার মতো কাউকে পেলেই শুধু সে শুরু করবে একটা নতুন জীবন।
মা-বোনদের চাপে পড়ে কিছু মেয়ে দেখা হয়। কিন্তু এমন অসভ্যপন্থায় বিয়ে করার করার কথা ও ভাবতে পারেনা। একটা মেয়েকে চেনেনা জানেনা, হুট করে বিয়ে করে বসবে সেটা ও ভাবতেই পারে না। এভাবে বারবার বিয়ে ভেঙে যেতে থাকে।
এমনই এক বিষণ্ণ অগোছালো সময়ে কোনো একদিন বিকেলে রাসিক বিপার বাসায় আসে। নীল রঙের টাঙ্গাইলের শাড়িতে বিপাকে একদম অন্যরকম লাগে সেদিন রাসিকের। হাঁটু অব্দি খোলা দীঘল কালো চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে আছে। তেমন সাজগোজ করে নি বিপা। হালকা একটু লিপস্টিক আর চোখে কাজল পরেছে মাত্র! আর এতেই ওকে একদম মায়াবী এক নারীতে পরিণত করেছে। বিপা ছোটবেলা থেকেই গান শেখে আর সেদিন রাসিককে ও বেশকিছু পুরানোদিনের গান শোনায়। রাসিকের রবীন্দ্র সঙ্গীত পছন্দ তাই কিছু রবীন্দ্র সঙ্গীতও গায়। অনেকদিন পর রাসিক এসেছে সেই অজুহাতে বিপার মা নানাপদের রান্না করে ওকে রাতের খাবার খাইয়ে দেয়। রাসিকের এই প্রথমবার মনে হয় আচ্ছা বিপাও তো বেশ ভালোই। ওকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেলে কেমন হয়? এতোদিন কেন ওর কথা একটুও মনে হয় নি ভেবে অবাক হয় নিজে নিজে। ও তো এখনো বিয়ে করেনি। কেন করেনি তা অবশ্য জানা হয় না রাসিকের। আচ্ছা বিপাকে কী জিগ্যেস করবে যে ওকে ওর পছন্দ কীনা? কিন্তু কীভাবে বলবে ব্যাপারটা ভাবে। রাসিকের চিন্তায় ছেঁদ পড়ে যখন বিপা ওর ভাবনার কথা জানতে চায়। রাসিক বলে পরে বলবে কী ভাবছিল।
যাওয়ার সময় বিপা ওকে আবারো আসতে বলে। বলে ওর সাথে খুব জরুরী একটা ব্যাপার নিয়ে আলাপ করবে। কবে আসবে জানতে চেলে বলে পরশু বৌদ্ধপূর্ণিমা। সেদিন সন্ধ্যায় আসিস।
আজ বৌদ্ধপূর্ণিমা। আকাশ বাতাস একাকার হয়ে যাচ্ছে আলোর নিষাদে। শূন্যদিগন্তে ঝুলে আছে সাদা থালার মতো বিশাল এক চাঁদ। নীলবেগুনী রশ্মির সুতোয় জোনাকের আলো গেঁথে গেঁথে যেন আলোর এই দীর্ঘরাত নির্ঘুম চোখে তাকিয়ে আছে প্রেমিকের দিকে। বিপা কিছু যেন বলতে চেয়েছে ওকে। ও যাই বলুক না কেন আজ রাসিক মন দিয়ে শুনবে ওর কথা, আর ওর দীর্ঘ চুলে মুখ গুজে আশ্রয় চাইবে ওর কাছে। আজ যেন ওর চোখে নির্বাণ হয়েছে নেশার ঘোর। কিছুতেই আর বাঁধ মানছে না কোনকিছু।
এদিকে বিপাশা অবিরাম কেঁদে চলেছে। আর রাসিক ক্লান্ত আর বিপর্যস্ত হচ্ছে। রাসিকের সব সংযম ভেঙে চুরমার হয়। কী ভেবে আসলো ও বিপার কাছে আর এসব এখন কী দেখতে হচ্ছে ওকে। কেন এমন করছে বিপা? আর এসব কী সব বাজে বকে চলেছে। বাবু ভাই? মাই ফুট! এটা একটা অবাস্তব কল্পনা মাত্র। বিপার জন্য মায়া হয় ওর। কী করবে এখন রাসিক?
এমনই এক অস্থির মুহূর্তে ও বিপাকে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নেয়। আদরে আদরে ভুলিয়ে দিতে চায় বিপার সব দুঃখ। শোন লক্ষ্মীমেয়ে। এমন করিস না সোনা। তুই না একটা ম্যাচিওরড মেয়ে। কেন এমন করছিস বল? তোর যদি মনে হয় বাবুভাই তোকে ডিচ করেছে তাহলে তো তুই বেঁচে গেছিস। শোন তুই এক কাজ কর, তুই না হয় আমাকেই বিয়ে করে ফেল। সব ভুলে যা অতীতে কী হয়েছে।
বিপা তো অনন্তকাল অপেক্ষা করেছিল একথা শুনবে বলে।
আর ইউ সিরিয়াস?
ইয়েস অফকোর্স। তোর কী মনে হয় এই অবস্থায় আমি তোর সাথে ফান করছি?
নাহ! সেটা না। কিন্তু??
আচ্ছা আমাকে আজকের দিনটা সময় দে। আমাকে একটু ভাবতে দে।
না কোন ভাবাভাবির কিছু নেই। ইয়েস ওর নট সেটা তোকে এখনি জানিয়ে দিতে হবে। আর তুই কখনওই আমাকে না করতে পারবি না। আমি জানি।
বিপা কাঁদতে কাঁদতে রাসিককে জড়িয়ে ধরে। ওর ফোঁপানোর মাত্রা আগের চেয়ে আরও বাড়ে বৈ কমেনা।
ওকে! ইয়েস ইয়েস। এখনি চল তাহলে আমরা আজকেই বিয়ে করে ফেলি। চল। দুজন হো হো করে হেসে ওঠে।
নাটকের দৃশ্য এখন একদম বদলে গেছে। একটু আগের সব কুয়াশার ঘনঘটা কেটে গিয়ে ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে গেছে চারপাশ। কেউ আর কাঁদছে না। কারো মনে বিন্দুমাত্র দ্বিধাও নেই কোথাও। পৃথিবীর সুন্দরতম অথচ প্রাচীনতম এক দৃশ্য ফুটে ওঠে আমাদের চোখের সামনে। আমরা দেখতে পাই সেই কোন প্রাচীনকাল থেকে একটি সফল প্রেমিকযুগল হাত ধরাধরি করে সিঁড়ি বেয়ে ছাদ থেকে নিচে নেমে আসছে। ওদের চোখে ফুটে আছে অজস্র নয়নতারা ফুল।