১
১৭৮১ বার পঠিত
গত শুক্রবার বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের ২১ সদস্যের কমিটি এই প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে। আগামী ২ থেকে ১২ জুলাই পোল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় সংস্থাটির বার্ষিক সাধারণ সভায় এই প্রস্তাব বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করা হবে। সংস্থাটি বলছে,
সুন্দরবন রক্ষায় বাংলাদেশকে করা তাদের ১০টি সুপারিশের মধ্যে ৮টিই বাস্তবায়িত হয়নি। সরকার কেবল সুন্দরবনের পাশে ওরিয়ন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অনুমোদন দেয়নি এবং রামপাল প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় বাতিল করা হয়েছে বলে ইউনেস্কোকে জানিয়েছে।
গত শুক্রবার ইউনেসকোর ওয়েবসাইটে ৯৯টি বিশ্ব ঐতিহ্যবিষয়ক ১৯৯ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে সুন্দরবন নিয়ে তাদের অবস্থান ও সুপারিশ সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে সংস্থাটি পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (EIA) ছাড়া সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া পশুর নদ খনন না করা, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল বন্ধ করা, সুন্দরবন ঘিরে নির্মিত শিল্পকারখানা ও নির্মাণাধীন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সেখানে কী ক্ষতি হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষক দল গঠন করতে বলেছে। তাদের দিয়ে সুন্দরবনে এর প্রভাব নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বলেছে।
ইতোপূর্বে রামপাল প্রকল্প বাতিলের জন্য ইউনেসকো ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৬ সালে তিন দফায় সরকারকে সুপারিশ করেছিল। সর্বশেষ গতবছর মার্চে সংস্থাটির একটি পর্যবেক্ষক দল সুন্দরবন সফর করে এই প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি হবে বলে মত দেয়।
অপরদিকে জ্বালানি,খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন,
“সুন্দরবন রক্ষার দায়িত্ব পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের। আমরা পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে এবং বেশ কিছু শর্ত পালন সাপেক্ষে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের অনুমতি পেয়েছি। সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্য থাকবে কী থাকবে না, তা ওই মন্ত্রণালয় দেখবে।”
ইউনেসকোর এই কঠোর অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহীর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল প্যারিসে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে যাচ্ছে। আগামী সোমবার সরকারি এ প্রতিনিধিদলটির সঙ্গে ইউনেসকোর কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। মূলত সুন্দরবনের নাম যাতে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ না যায়, সে জন্যই তারা ইউনেস্কোর কাছে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরবে বলে জানা গেছে।
এদিকে রামপাল প্রকল্পের বিষয়ে এখনো পরিবেশগত ছাড়পত্র দেয়নি পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন একটি দৈনিকের প্রশ্নের জবাবে জানান,
“আমরা বেশ কিছু শর্তে রামপাল প্রকল্পকে অবস্থানগত ছাড়পত্র ও পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (EIA) অনুমোদন দিয়েছি।”
ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে,
“রামপাল প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনের অসাধারণ প্রাকৃতিক সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। এই আশঙ্কার পক্ষে বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরার পরও সরকার প্রকল্পটি বাতিল করেনি। ২০১৪ সালে সুন্দরবনের তেলবাহী ট্যাংকারডুবির পর আরও তিনটি কয়লা ও সিমেন্টবাহী জাহাজডুবি হয়েছে। এসব দুর্ঘটনার কারণে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হয়েছে কী না, তার কোনো প্রভাব সমীক্ষা করেনি সরকার।”
ইউনেস্কোর সুপারিশ সম্পর্কে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব আনু মুহাম্মদ বলেন,
“রামপাল প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি বিষয়ে প্রথমে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা মতামত তুলে ধরেছিলেন। তারপর বিশ্ববাসী ওই বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে একমত হয়ে মতামত দিয়েছেন। ইউনেস্কো এখন যে কথাগুলো বলছে, তা সুন্দরবন রক্ষায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের মতামতকে প্রতিনিধিত্ব করছে। একটি মাত্র প্রকল্প নিয়ে সরকারের একগুঁয়েমির কারণে সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান হারাতে চলেছে। এটা বাংলাদেশের জন্য একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় তৈরি করবে। সরকারই অসামান্য এই বন ধ্বংস করতে যাচ্ছে।”
সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সুলতানা কামাল বলেন,
“রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি বিষয়ে ইতিমধ্যে বিশ্বমানের আটটি গবেষণা প্রতিবেদন সবার উদ্দেশে তুলে ধরেছি। তারপরও রামপাল প্রকল্প নিয়ে সরকার যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে এই বন চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান অটুট থাকুক। এখনো সময় আছে, সরকার এই প্রকল্প থেকে সরে আসুক।”
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
মে ২১, ২০১৭; ৬:৪৮ পূর্বাহ্ন
প্রাসঙ্গিক রিপোর্ট-১
অব্যবহৃত কয়লা রামপালে জোগান দিতে চায় ভারত
ভারতে উৎপাদিত সব কয়লাই অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে নিম্নমানের। এসব কয়লা পোড়ালে দূষণের ঝুঁকিও তাই বেশি। এ বিবেচনায় ভারতেরই কয়লাভিত্তিক অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র চলছে আমদানি করা কয়লায়। এতে অব্যবহৃত থাকছে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ কয়লা, যা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে জোগান দিতে চায় তারা।
বাংলাদেশে কয়লা রফতানির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে গত বছর একটি প্রতিনিধি দল পাঠায় কোল ইন্ডিয়া। প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড জানিয়েছে, কোল ইন্ডিয়ার অধীনে সবচেয়ে বড় কয়লা খনি মহানদী কোলফিল্ডস লিমিটেড (এমসিএল) থেকে উত্তোলিত কয়লা ওড়িশার পারাদ্বীপ বন্দর থেকে বাংলাদেশে পাঠানো যাবে। পরবর্তীতে তা নৌ বা রেলপথে সরাসরি বিদ্যুৎকেন্দ্রে পৌঁছানো সম্ভব হবে।
যদিও রামপালের জন্য ভারত থেকে কয়লা আমদানির সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ভারতের প্রতিনিধি দল আমাদের কাছে এসেছিল। তবে আমরা কয়লা আমদানির উৎস নির্দিষ্ট করে ফেলেছি। যত দূর সম্ভব অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া অথবা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কয়লা আনা হবে।
তবে ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশনের (এনটিপিসি) মাধ্যমে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লার জোগান দিতে পারে ভারত। কারণ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫০ শতাংশের অংশীদার সে দেশের এনটিপিসি। বাকি ৫০ শতাংশের মালিক পিডিবি।
যৌথ মালিকানার বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডে (বিআইএফপিসিএল) অর্থায়ন করছে ভারতের এক্সিম ব্যাংক। নির্মাণ ঠিকাদার হিসেবেও থাকছে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যালস (বিএইচইএল)। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জ্বালানির উৎস হিসেবেও তাই ভারতই অগ্রাধিকার পাবে বলে আশাবাদী কোল ইন্ডিয়ার এক কর্মকর্তা। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, আশা করছি, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা জোগান দেয়ার প্রাথমিক কাজ এ বছরই শেষ হবে।
ভারতের কয়লা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর ৫৫ কোটি টনের বেশি কয়লা উত্তোলন করছে কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটির উত্তোলিত এ কয়লা ব্যবহারোপযোগী করার ক্ষমতা বছরে ৩ কোটি ৭০ লাখ টন। বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অন্যান্য কাজে ব্যবহারের পর এখনো ৬ কোটি ৯০ লাখ টন কয়লা অব্যবহূত রয়েছে কোল ইন্ডিয়ার। নিম্নমানের হওয়ায় এ কয়লা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ভারতের কয়লা ও বিদ্যুত্মন্ত্রী পীযূষ গয়াল। সম্প্রতি সে দেশের গণমাধ্যমে দেয়া এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, আমরা কয়লা রফতানির কথা ভাবছি। তবে রফতানির ক্ষেত্রে ভারতের কয়লার মানের বিষয়টিও ভাবতে হবে। কারণ ভারতের কয়লার দূষণ সবচেয়ে বেশি।
কয়লায় অ্যাশের পরিমাণ যত বেশি হবে, তা পোড়ানোর ফলে পরিবেশদূষণ তত বেশি হবে। বাংলাদেশের খনিতে প্রাপ্ত কয়লায় অ্যাশের পরিমাণ ১৫ শতাংশের নিচে। তবে ভারতের কয়লায় তা ১৫ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত। এ ধরনের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার করলে জ্বালানি হিসেবে এর পরিমাণ বেশি প্রয়োজন হয়। আর বেশি কয়লা পোড়ানোর কারণে ছাই নির্গমনের পরিমাণও হবে বেশি।
সুন্দরবনের রামপালে কয়লাভিত্তিক ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বর ও দ্বিতীয় ইউনিটটি ২০২০ সালের ডিসেম্বরে চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে বিআইএফপিসিএলের। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে রামপালের গৌরম্ভার কৈকরদশকাঠি ও সাতমারী মৌজায় ১ হাজার ৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জ্বালানি হিসেবে কয়লা প্রয়োজন হবে প্রতিদিন প্রায় ১৩ হাজার টন। এ প্রকল্পে জোগানের মধ্য দিয়ে কয়লা রফতানি শুরু করতে চায় ভারত।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে অত্যাধুনিক আল্ট্রাসুপার থার্মাল প্রযুক্তি ব্যবহূত হবে। তাই কালো ধোঁয়া বা ছাই উদিগরণের আশঙ্কা নেই। সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করেও ইআইএ প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতিদিন ৪৫ টন নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ও ১৪২ টন সালফার ডাই-অক্সাইড নির্গমন হবে। বছরে ৯ লাখ ৪০ হাজার টন ছাই নির্গমন হবে, যার ৮০ শতাশই শুকনো ফ্লাই অ্যাশ আর ২০ শতাংশ বটম অ্যাশ।
উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ২৫০ মেগাওয়াটের। ২০৩০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুত্ উৎপাদনক্ষমতার ৫০ শতাংশই কয়লাভিত্তিক করার পরিকল্পনা রয়েছে। বিদ্যুত্ খাতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, সে নাগাদ দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা দাঁড়াবে ৪০ হাজার মেগাওয়াটে।
সূত্র: বণিক বার্তায় প্রকাশিত ইয়ামিন সাজিদ-এর রিপোর্ট।