১৯৪৭ সালের প্রথম দিকটা; র্যাডক্লিফ সাহেব পেন্সিল দিয়ে আমাদের ‘ঠিকানা’ নির্ধারণ করছেন। নতুন আঁকা মানচিত্র নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা পরিস্থিতি। দাদা কংগ্রেসের ব্যবসায়ী পৃষ্ঠপোষক; তার ব্যবসার সীমান্ত ছিলো না; পদ্মার ওপারে সাহেবনগর-বহরমপুর আর এপারে রাজশাহী-চারঘাট জুড়ে তার ব্যবসা-বানিজ্য। ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে ভারত ভেঙ্গে গেলে; মুসলমানেরা আর ভারত অংশে থাকতে পারবে কীনা ঠিক নেই। দাদা তাই জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে ছেলে-মেয়েদের পাঠিয়ে দিলেন সম্ভাব্য পাকিস্তান অংশে তার চারঘাটের বাড়িতে।
১৪ অগাস্ট ভোরে ভারত বিভাজিত হবার কালরাতে তিনদিনের অসুস্থতায় দাদী মারা গেলে; নৌকা করে পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে একটি কিশোর ছুটে যায় সাহেবনগরে। কুষ্টিয়ার করমদী থেকে ছুটে আসেন দাদির স্বজনেরা। ভারতের স্বাধীনতার দিনে একটি কিশোর ছেলে তার মাকে হারিয়ে কোণার ঘরে শোক আর আশ্রয়ের বড় জানালার ঘরে চলে যায়; যে জানালা দিয়ে দেখা যায় আমের বাগান; বাগানের মাঝ দিয়ে হেঁটে বেরুলে বনভূমি-শস্যক্ষেত্র-সামান্য লোকালয়ের চিহ্ন।
আব্বা তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চোখ বুঁজে ঐ সাহেবনগরের বড় জানালার সবুজ আভা ছড়ানো কক্ষ; সেই যে আনন্দ-বেদনার স্মৃতিঘর সেখানে গিয়ে তবে ঘুমিয়ে পড়তেন। বলতেন, এই ঘরটা আমার ম্যাজিকঘর। সেখানে গেলে ঘুম আসতে বাধ্য। দেশবিভাগের যন্ত্রণা নিয়ে; কলকাতায় ফেলে আসা বন্ধু অমিয় কিংবা প্রতীকহীন কোন নিঃসঙ্গতায়; স্মৃতি এসে পেছনে টেনে নিয়ে যেতে চাইলেই; আব্বা সেই মন খারাপের খপ্পরে পা না দিয়ে চলে যেতেন ‘সাহেবনগরের বারান্দার কোণার’ ঘুমঘরে।
দাদা তার মাতৃভূমি ছেড়ে কোথাও যাবেন না; কেন যাবেন; ভারত তার দেশ; এখানে তার সারাজীবনের স্বপ্ন-শ্রম-ঘাম মিশে আছে; পূর্বপুরুষের কবরের চিহ্নগুলো এই ভারত মাতার বুকে পরম মায়ায় ঘুমিয়ে আছে। এই শৈশব-কৈশোরের মায়াজড়ানো সাহেবনগর; ব্যবসা আর আড্ডার বহরমপুর, ফিল্ম দেখতে যাওয়া কিংবা কংগ্রেসের এমপি বদরুদ্দোজার বাসায় এক রাতের আতিথ্য গ্রহণ; সেখানে একটি কক্ষ তালাবদ্ধ থাকে নতুন ফিল্ম রিলিজ হলে; এতো উষ্ণ বন্ধুত্ব এতো দিলীপ-কুমার-সায়রা বানু-মধুবালা-বৈজয়িন্তী মালা; কিংবা অশোক-কুমার, উত্তম কুমার-সুচিত্রা-সুপ্রিয়ার প্রেমময় কলকাতা। দাদা অখণ্ড ভারতের আদর্শে চলেছেন সারাজীবন; ফলে সে আদর্শ থেকে টলে যাবার মতো আবেগী হতে পারেননি।
ফলে তার ছেলে ১৯৬৪ সালের কলকাতা দাঙ্গার রাতে কারমাইকেল হোস্টেলের ছাদে রুদ্ধশ্বাস মৃত্যুর প্রস্তুতির শোকে ভারত মাতাকে নিয়ে সমস্ত স্বপ্ন ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যাবার খবর নিয়ে প্রাণ নিয়ে সাহেবনগর পৌঁছালে; দাদা একটা কঠোর সিদ্ধান্ত নেন। ছেলের মাস্টার্স শেষ হয়েছে; তাকে লন্ডনে আইনশাস্ত্র পড়াতে পাঠানোর পরিকল্পনা করেছেন। কিন্তু ছেলে দর্শন পড়াতে চায় শৈশবের বিনোদ বিহারী স্যারের মতো; কিংবা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিখিল সেনের মতো করে । দাদা পূর্বপাকিস্তানের কলেজগুলো অসংখ্য শিক্ষক চেয়ে দেয়া বিজ্ঞাপন দেখান আব্বাকে।
ভোর বেলা ছেলেকে ধর্মীয় ‘সংখ্যালঘু’-র বন্দীত্ব থেকে মুক্তি দিতে পদ্মানদীতে নৌকায় ভাসিয়ে দেন; মনদেবতাকে বিসর্জনের অশ্রুতে, তিনি শেষ বার বলেন, তোকে নিয়তির কোলে ঠেলে দিলাম আহসান। পূর্বপাকিস্তানের নিয়তি যাত্রায় দেশ নিয়ে স্বপ্নভাঙ্গার দিনগুলিতে উনি ফরিদপুরের ভাঙ্গা’র শ্রী কৃষ্ণ কলেজে পড়াতে শুরু করেন। দাদা এক্সচেঞ্জ করে বেশ কিছু জমি পাঠান রাজশাহীর আড়ানীতে বড়াল নদীর তীরে; তার কয়েকজন সংখ্যালঘু কৃষক সন্তান; যারা শৈশব থেকে তার স্নেহে লালিত হয়েছে; তারা পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধীনতার স্বাদ নিতে চাইলে তাদের পাঠান সে কৃষি জমিতে ফসল ফলিয়ে বাঁচতে; তাদেরকেও নিয়তির হাতে সঁপে দেন। আব্বার জমিজমায় কোন আগ্রহ কখনোই ছিলো না; তবু সামান্য ব্যবস্থাপনা করতে আড়ানীতে যেতে হতো। সেটা ভাঙ্গা থেকে দূরে পড়ে যায়। এর মাঝে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি; সে সময়ের ঈশ্বরদী জিন্নাহ কলেজের অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক সমাজি; আব্বার ব্যাপারে শুনে তাকে ঈশ্বরদী কলেজে দর্শন পড়াতে আমন্ত্রণ জানান। ঈশ্বরদী উত্তরবঙ্গের প্রবেশ পথ; আড়ানির দূরত্ব একঘন্টা; ফলে এর চেয়ে স্যুটেবল অফার তো হয় না।
এর মাঝে পাকিস্তান সরকার নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ডোমিসাইল সার্টিফিকেট দেয়। একটা লোক একশো বিঘা জমির সমপরিমাণ অর্থ পূর্ব পাকিস্তানে ইনভেস্ট করেছে; তাকে নাগরিকত্ব না দেবার যে বা-আইনি কাজ পাকিস্তান সরকার করেছে; এটা নির্বুদ্ধিতাপ্রসূত; তা বলাই বাহুল্য। সেই ঘটনা থেকে পাকিস্তান সরকারকে তার নির্বুদ্ধিতার কথা বলার একটা সাধ আমার গড়ে উঠেছিলো। সে সাধ পূর্ণ হয়েছে।
আব্বার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক নিখিল সেন তার ছাত্রের ব্যাপারে একটা চিঠি লিখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক জিসি দেবকে। কিন্তু সে সময় অসহযোগ আন্দোলন চলছে; মুক্তিযুদ্ধের দামামা বাজছে; তাই পরিস্থিতি শান্ত হলে আব্বাকে নিয়ে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন বলেছিলেন। পাকিস্তানের দখলদার বাহিনী অপারেশান সার্চলাইটের রাতেই জিসি দেবকে হত্যা করে। এই দেবতুল্য নিষ্পাপ মানুষটিকে হত্যা করার নিষ্ঠুরতা; ভাবা যায় কী আদিম ছিলো সেই হামলাকারীরা!
আব্বা অবশ্য এরই মাঝে ঈশ্বরদী কলেজে পড়ানোর আনন্দ পেয়ে গেছেন। ললিত কলা একাডেমিতে প্রায় বন্ধুর বয়েসি ছাত্রদের সঙ্গে টুকটাক থিয়েটার চর্চা করতেন। আর বৈবাহিক সূত্রে স্ত্রীর আত্মীয়-স্বজন অসংখ্য যে শহরে; সেখানে দাওয়াত আর স্নেহের তোড়ে জীবনের আনন্দযজ্ঞ শুরু হয়।
আব্বা এ-পলিটিক্যাল লোক; কিন্তু ছাত্রদের অসহযোগ আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ সব কিছুতেই অনুপ্রাণিত করতেন। উনি তার ছাত্র মোতালেবের নামটি প্রায়ই বলতেন; প্রিয় ছাত্র তার; যে প্রথম দিনের প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা মোতালেব তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে আমাদের কলেজ পাড়ার বাসায় রাতে অপারেশানে যাবার আগে খাবার সময় আব্বাকে অনুরোধ করেন আম্মা আর তার কোলের আমাকে নিয়ে গ্রামের ভিতরে পালিয়ে যেতে। কারণ হাতের কাছে পেলে; দখলদার পাকিস্তানি সেনারা ক্ষতি করবে।
আম্মার এক মামা পরদিন ভোরে রিক্সা করে তার বাড়িতে নিয়ে যান; সেটাও নিরাপদ নয় ভেবে আব্বা-আম্মা আমাকে নিয়ে আড়ানির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পথে আব্বার ছাত্রদের বাড়ি থাকায় একটু যাত্রাবিরতির সুযোগ ছিলো। এরপর আড়ানি-মালঞ্চি এসব জায়গাও নিরাপদ নয় ভেবে ভারতে পালিয়ে যাই আমরা। আব্বার সেটা মাতৃভূমি; সুতরাং দুজন সহকর্মীর পরিবারকেও যুক্ত করেন শরণার্থী সফরে। দাদার বাড়ি আর তার অদূরে দাদার একটা কুঠি বাড়ি মিলিয়ে পুরোটাই তখন শরণার্থী শিবির। আড়ানি থেকে আসা আম্মার ক্লাসমেট মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল, এলাকার বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা আজাদের সঙ্গে দেখা হলে আব্বা-আম্মা গিয়ে শরণার্থী শিবিরে কিছুটা স্বেচ্ছাসেবা দেন। যুদ্ধের সময়টাতে সবাই সবাইকে সাহায্য করতে সক্রিয় ছিলো; সে ছিলো এক মায়ার ঐক্যের কাল।
আর স্বদেশে ফেরা যাবে কীনা এই দুঃশ্চিন্তায় জীবনের উইন্টার অফ ডিসকনটেন্ট এলে; আব্বা আমাদের নিয়ে কলকাতায় নিয়ে যান। আব্বা তার প্রাণের শহর; যে শহরের অলিগলি চেনা; যেখানে সুচিত্রা মিত্রের সংগীত সন্ধ্যা থেকে সত্যজিতের পথের পাঁচালির প্রথম শো; কফি হাউজ থেকে প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ তার যৌবনের আনন্দযজ্ঞের সোনালি স্মৃতিতে; তা আম্মাকে ঘুরে দেখান। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে গিয়ে আমি আম্মার আঙ্গুল ছেড়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে দৌড়ে পালিয়েছিলাম। সেই থেকে ভিক্টোরিয়ার পিছে দৌড়ে বেড়াচ্ছি যেনো আজো। একজন নিরাপত্তারক্ষী সস্নেহে খুঁজে আমাকে উদ্ধার করে দিয়ে যান। বয়সের কারণে আম্মা তার ফেভারিট চড়টি আমার জন্য জমা রেখেছিলেন আগামীর বাংলাদেশ কালের জন্য।
যুদ্ধ শেষ হবার আগেই দেশে ফিরি আমরা; চারিদিকে যখন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে; পোড়া মাটি নীতিতে যুদ্ধে পরাজয়ের আগে বাংলাদেশকে গ্রাউন্ড জিরোতে পৌঁছে দিয়ে গেছে শত্রু সেনারা। আড়ানিতে আমার নানার বাড়িতে আগুন দিয়েছে; তার গুদামের পণ্য প্রায় পুড়ে গেছে; কিছু পণ্য মিলিটারী ট্রাকে করে তুলে নিয়ে গেছে নানাকে গ্রাউন্ড জিরোতে পৌঁছে দিতে। এরমাঝে খবর আসে সরদহ পুলিশ একাডেমির পাশে থানা[পাড়ায় আম্মার চাচাসহ তার চাচাত ভাই-দুলাভাই মিলিয়ে একটা পরিবারের পাঁচজনকে হত্যা করেছে পাকিস্তান আর্মি। আম্মার চাচাত ভাই শিবলী ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। সেই অপরাধে একটি পরিবারকে পুরুষ-শূন্য করে ফেলা হয়েছে প্রায়; এথনিক ক্লিনসিং যেরকম নরোভোজি হয় আর কী।
দেশ স্বাধীন হলে ট্রেনে করে ফেরার পথে ট্রেন উপচে পড়া ঘরে ফেরা মানুষ; ট্রেনের জানালা দিয়ে ডেকে আব্বার বন্ধু সে সময়ের ঈশ্বরদীর এমপি মহিউদ্দীন চাচা আমাদের ট্রেনের কামরায় তুলে নেন। ঈশ্বরদীতে ফিরে আম্মা দেখেন, তার বাড়ি লুট হয়ে গেছে; প্রথম দফা লুট করেছে বিহারিরা; দ্বিতীয় দফা লুট করেছে বাঙ্গালিরা। সুতরাং আসন্ন ‘চোরের খনি’র ইঙ্গিতও এই বাড়িলুটে ছিলো। কিন্তু জিরো থেকে সংসার শুরু করার এই ট্রমা আম্মার মাঝে এমন ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে যে; আজো তাকে ঈশ্বরদির বাড়ি থেকে নড়ানো কঠিন। যুদ্ধ কত বিচিত্র কষ্ট গেঁথে দেয় মানুষের মনে।
যুদ্ধের পর আমার আম্মার ছোট চাচার শ্বশুর কূলের আত্মীয় ত্রাণ মন্ত্রী হেনা সাহেবের কাছে, যুদ্ধে বাড়িঘর লুট হয়ে যাবার ব্যাপারটা জানিয়ে প্রাধিকার হিসেবে ক্ষতিপূরণ নেয়ার প্রস্তাব আসে। যেহেতু এদেশের দরিদ্র মানুষের প্রথম অধিকার এই ক্ষতিপূরণ পাবার; আমার আব্বা-আম্মা ক্ষতিপূরণ নেবার কথা ভাবতেই পারেননি।
বঙ্গবন্ধুর সরকার আব্বাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়ায় আর নতুন স্বাধীন দেশে অনেক চাকরিতে শূন্যপদ সৃষ্টি হওয়ায় আবার ছোট নানা তাঁর আত্মীয় হেনা সাহেবের সঙ্গে এপয়েনমেন্ট করে তাকে নিতে আসেন। আব্বা ভদ্রভাবে ব্যাপারটা এড়িয়ে যান। আম্মার অবাক লাগে আব্বার এই উন্নয়নে নিঃস্পৃহতা আর বিপুল আনন্দে ছাত্র-পড়ানোর কাজে লেগে পড়ার নেশা দেখে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফেরা ছাত্রদের বাসায়ও পড়াতেন আব্বা। কারণ তাদের তখন অতিরিক্ত দেশপ্রেম; এতে শিক্ষাপ্রেমে ঘাটতির আশংকা তো থাকেই। বিপ্লবীদের পড়িয়ে অন্তত ব্যাচেলর ডিগ্রিটা করিয়ে দিলে; তারপর যা খুশি করুক তারা; এরকম একটা জেদ আব্বার সবসময়ই ছিলো। এইকারণে রাজনৈতিক দল করা ছেলেদের বাসায় পড়িয়ে পড়া মেক-আপ করে দিতেন তাদের দুর্বলতা। একটি ছাত্রও ফেইল করবে না; এরকম একটা চ্যালেঞ্জ আব্বা নিজের কাছেই নিতেন। আর ছাত্রদের স্পোর্টস, থিয়েটার এগুলো চর্চায় সাহায্য করতেন। কলেজ সংসদ নির্বাচনে তিনি থাকতেন নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন হিসেবে; আর এরপর নির্বাচিত আমোদ-প্রমোদ সম্পাদকের উপদেষ্টা হিসেবে।
এসব লোকের চ্যালেঞ্জের জগতটা বিচিত্র; দাদা মৃত্যুর আগে শেষ বার দেখা করতে এসে আব্বাকে বললেন, বাড়ি তো নয় এ যে কবুতরের ঘর! আব্বা পরদিন থেকে লেগে গেলেন বাড়ি বানাতে; আম্মা বাধ্য হয়ে সহযোগিতা করলেন এই শ্রমসাধ্য কাজে। দাদা আমাকে বলেছিলেন, তোমার প্রোগ্রেস রিপোর্টে সবই ঠিক আছে; অংকে একশো পাওনি কেন; রেস্টলেস হয়ে একটা অংক ভুল করলে কী চলে! আমি তো অবাক; টোটাল মার্কস দেখলে আর ক্লাসে পজিশন দেখলেই বোঝা যায়; একটা অংক ভুল হওয়াতে আমার বিন্দুমাত্র ক্ষতি হয়নি। দাদা অনিচ্ছা সত্বেও হেসে ফেললেন।
আব্বার শিক্ষকতার সাধ পূর্ণ করেছে বাংলাদেশ। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ, সিলেট এমসি কলেজ আর রংপুর কারমাইকেল কলেজে প্রাণভরে পড়িয়ে অবসরে যান। আমি তো ভেবেছিলাম; দর্শনের লোক; ক্লাস নিতে না পেরে অস্থির হয়ে পড়বেন। সে ধারণা খুবই ভুল ছিলো। এতোদিন দর্শনের শিক্ষক হিসেবে মুসলিম দর্শন নিয়ে পড়লেও; এবার নামাজের প্রতিটি সুরার বাংলা অর্থ জেনে প্রথমে আরবিতে এরপর বাংলায় বলে নামাজ পড়ার মাঝেই অর্থ খুঁজে পেলেন তিনি। বুঝে বুঝে প্রার্থনার মাঝে আনন্দ পেলেন। আমাকে একদিন বললেন, তোমার দাদা তো নামাজ টামাজ বিশেষ পড়েননি; আমি একটু মেক-আপ করি সেটা।
আব্বা টকশো দেখতেন; বাহাজ তার ভালোই লাগতো। ইউটিউবে এস কে সিনহা কেস স্টাডি করে বললেন, এই ভদ্রলোক পাকিস্তানের মতো জুডিশিয়াল ক্যু করতে যাচ্ছিলেন হয়তো; তবে তাকে সরিয়ে দেবার পদ্ধতিটা খুব আদিম হয়েছে। আরেকটু ভদ্রভাবে নেগোসিয়েশান করতে হয় এসব ক্ষেত্রে। আমি তো এস কে সিনহা’র প্রতি অন্যায় হয়েছে; এরকম অভিমত পোষণ করতাম। আব্বার সঙ্গে ভিন্নমত নিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নিয়মিত অনুশীলন আমার।
শৈশবে পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে মারপিটের অভিযোগ আসতে থাকায়; আব্বা আমাকে ডেকে বক্তৃতা-বিতর্ক চর্চায় নিযুক্ত করেন। বললেন, ডায়ালগ ইজ দ্য বেসিস অফ সিভিলাইজেশান।
আব্বা মাঝে মাঝে বলতেন, তোমার পেশাটাই তো বলার-লেখার; ফলে চুপ করে থাকার তো অবকাশ নেই। এদেশে শান্তিতে বাস করতে গেলে চুপ করে থাকতে হয়। তোমাকে এতো পড়ালেখা না করিয়ে একটা ওষুধের দোকান করে দিলে আজ একসঙ্গে থাকতে পারতাম। সেজীবনও আমাকে টানে; আবার তুমি বিশ্বনাগরিক হও; সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রমের আনন্দ পাও সে ইচ্ছাটাও খুব প্রকট। এরকম চিন্তার দোলাচলে আমি সাহেবনগরের সেই বড় জানালার ঘরে গিয়ে ঘুমাই।
শেষবার কথা হলো যখন; তখন বললেন, জীবনব্যাপী দেখলাম ধর্মের ভিত্তিতেই শুধু সংখ্যালঘু হয়না মানুষ; চিন্তার জগতেও সংখ্যালঘু হয়। ফলে আমার জীবন ভারতেও যা হতো; বাংলাদেশেও তাই। তাই বলে বেদনা-বিলাসও আমার ধাঁচে নেই; মুড ইজ দ্য কিং। কলকাতার টিভিতে একটা ধারাবাহিক নাটকের সময় হয়ে এলো। ভালো থেকো। কক্ষণো পেছনে তাকিয়ে হেঁটোনা; পথ চলতে হয় সামনে তাকিয়ে।
২০২০ সালের ২১ মার্চ উনি হাসতে হাসতে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন; সেই বড় জানালার ঘুম ঘরে; যার বাইরে সবুজ শস্যক্ষেত্র; আমবাগান অথবা নদী কিংবা সামান্য লোকালয়ের চিহ্ন।
(আব্বা তার ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে প্রায়ই শিক্ষা সফরে বেরিয়ে পড়তেন। তারই একটিতে কোন এক প্রত্ন নিদর্শন উঠোনে)