১
১৮১৪ বার পঠিত
প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২৫ মার্চ ১৯৮০ সালে। ওইদিন কাউখালী থানার সেনাকর্মকর্তা কলমপতি ইউনিয়নভুক্ত নোয়াপাড়া বৌদ্ধ মন্দিরটির আসন্ন কিছু উৎসব উপলক্ষে মেরামতের বিষয়টি আলোচনার জন্য স্থানীয় জুম্ম গ্রামবাসীদের সমবেত হওয়ার নির্দেশ দেন। যখন গ্রামবাসীরা সমবেত হোন, তখন সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য সমবেত গ্রামবাসীর ওপর অতর্কিতভাবে গুলিবর্ষণ করে। এতে আনুমানিক ৩০০ পাহাড়ি জুম্ম নিহত হয় এবং আরো অনেকেই আহত হয়। এরপর সেনাবাহিনীর সদস্য এবং নতুন বসতিকারী সেটেলার বাঙালিরা একযোগে কলমপতি ইউনিয়নের ২০টি গ্রামের ওপর আক্রমণ চালায়, বাড়িঘর লুণ্ঠন করে জ্বালিয়ে দেয় এবং ইউনিয়নের ৯টি বৌদ্ধ মন্দির ধ্বংস করে। ২০ জন বৌদ্ধ ভিক্ষুকে কুপিয়ে হত্যা ও মারধর করা হয়। তাছাড়া ৩০ জন জুম্ম নারীকে অপহরণ করে ধর্ষণ করা হয়।
এরপর ১৯৮১ সালের ২৫ জুন মাটিরাঙ্গা ও বেলছড়ি এলাকার জুম্ম গ্রামগুলিতে যথাক্রমে আক্রমণ চালানো হয় এবং নির্বিচারে জুম্ম পাহাড়িদের হত্যা করা হয়। শতশত বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং লুণ্ঠন করা হয়। এতে কয়েকশত জুম্ম পাহাড়ি নিহত ও আহত হয়। ওই ঘটনার পর রামগড়, মাটিরাঙ্গা এবং তার আশপাশের গ্রামগুলি হতে ২০ হাজার জুম্ম পাহাড়ি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এরপর গণহত্যা ঘটে ১৯৮৪ সালের ৩১ মে হতে ৭ জুন পর্যন্ত ভূষণছড়া এবং ছোট হরিণা মৌজায়। নতুন বসতিকারী সেটেলার বাঙালিরা জুম্ম পাহাড়িদের পাকা ধান কেটে দিলে জুম্ম পাহাড়িরা তাদের বাধা দেয়ার করার চেষ্টা করে। ওই প্রতিক্রিয়ার ফলে সেনাবাহিনী, বিডিআর এবং সেটেলার বাঙালিরা একযোগে জুম্ম পাহাড়িদের গ্রামগুলোতে ব্যাপক নৃশংস আক্রমণ চালায়। ওই আক্রমণে ৬২ জন জুম্ম পাহাড়ি নিহত এবং ১৩ জন আহত হয়। তাছাড়া ৭ জন জুম্ম পাহাড়ি নারীকে ধর্ষণ করা হয় এবং গ্রামগুলি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। ফলে ৪৫৩০ জন জুম্ম পাহাড়ি পার্শ্ববর্তী ভারতের মিজোরাম রাজ্যে মানবেতর জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। কয়েকমাস পর মিজোরাম সরকার তাদের জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিলে তারা আবারো সেনাবাহিনী এবং সেটেলার বাঙালি কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হোন।
এরকম আরও গণহত্যা ঘটে ১৯৮৬ সালের ১ মে তারিখে পানছড়ি এবং মাটিরাঙ্গা এলাকায়। ১৮ মে তারিখে রামবাবু ডেবা গ্রামে এবং একই সালে ১৯ ডিসেম্বর চংড়াছড়ি এবং মেরুং মৌজায়। ওইসব সংগঠিত ঘটনায় ২৩৮ জন জুম্ম নিহত হয় এবং ৪৮০ জনের বেশি আহত হয় এবং নিখোঁজ হোন ২০৯ জন। ধারনামতে তারাও নিহত হয়েছেন। কারণ পরবর্তীকালে তাদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। তাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু।
১৯৮৮ সালের ৮-১০ আগস্ট সেনাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালিরা একসঙ্গে যুগপৎ আক্রমণ চালায় হিরাচর, সারবোতুলী, খাগড়াছড়ি এবং পাবলাখালী গ্রামে। গ্রামগুলো ছিল পাশাপাশি। এই ঘটনাতেও শতাধিক জুম্ম নিহত হয় এবং আহত হয়। অনেকেই পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এরপর ১৯৮৯ সালের ৪মে তারিখে আরও একটি বড়ধরনের গণহত্যা ঘটে। ওইদিন কে বা কারা লুংগুদু উপজেলার চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ সরকারকে হত্যা করে চলে যায়। জুম্মদের মনে আক্রমণের আশঙ্কার জন্ম হলে এলাকার পূর্ব উপজেলা চেয়ারম্যান অনিল চাকমার বাড়িতে আশ্রয় নেয় জুম্মরা। কারণ দীর্ঘদিন অনিল চাকমা লুংগুদু উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাকালে এলাকার পাহাড়ি এবং বাঙালি সবাই তাকে সম্মান করত। কিন্তু সেদিন নতুন বসতিকারী সেটেলার বাঙালি ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা একযোগে অনিল চাকমার বাড়িসহ আশপাশের জুম্ম গ্রামগুলোর ঘড় বাড়িতে আক্রমণ করে অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেয় ও লুট করে। এমনকী তারা জুম্মদের নির্বিচারে হত্যা করে।
অনিল চাকমার স্ত্রীসহ সেদিন প্রায় ১০০ জন জুম্মকে হত্যা করে গ্রামপ্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য এবং সেটেলার বাঙালিরা। উল্লেখ্য গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকলেই ছিল বাঙালি এবং সরকারই তাদের অস্ত্র সরবরাহ করে। সে অস্ত্র দিয়ে সেদিন তারা জুম্মদের আক্রমণ করে, হত্যা করে। নিহতের পাশাপাশি এতে অনেক জুম্ম আহত হয়।এরপর আরো একটি গণহত্যা ঘটে ১৯৯৩ সালের ১৭ নভেম্বর নানিয়াচড় বাজারে। সেদিন ছিল হাটবাজার, শত শত জুম্ম বাজারে এসেছিল। সেদিন সকালে সেনাবাহিনীর সদস্যদের লঞ্চঘাটে একটি যাত্রিছাউনি দখলের বিরুদ্ধে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ একটি মিছিল বের করে। সেই প্রতিক্রিয়ায় সেনাসদস্য এবং নতুন বসতি স্থাপনকারীরা বাজারে উপস্থিত জুম্ম জনগণসহ মিছিলকারী ছাত্রদের ওপর অতর্কিত আক্রমন চালায়। সেই আক্রমণে ২৯ জন পাহাড়ি নিহত, ১৬২ জন আহত এবং ৭৩ জন নিখোঁজ হয়।
এর পূর্বে ১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল আরও একটি গণহত্যা ঘটে পানছড়ি থানার লোগাং গুচ্ছ গ্রামে। সেদিন সকালে নতুন বসতিকারীগণ উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচার করে যে গুচ্ছগ্রামে জুম্মগণ একজন বাঙালি রাখাল বালককে হত্যা করেছে। সেই প্রতিক্রিয়ায় দুপুরবেলা নতুন বসতিকারী এবং নিরাপত্তা বাহিনী একযোগে গুচ্ছগ্রামে আক্রমণ করে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং পাহাড়ী জুম্মদের আক্রমণ ও হত্যা করতে থাকে। এই ঘটনায় কমপক্ষে ৩০০ জন নারী পুরুষ ও শিশু নিহত হয় এবং আরো অনেকে আহত হয়। আনুমানিক ৭০০ ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। ঘটনার সংবাদ দেশে-বিদেশে বিস্তর প্রচার লাভ করে। কারণ ঘটনার দু’একদিন আগে একটি মানবাধিকার গ্রুপ বিজু উৎসব উপলক্ষে খাগড়াছড়ি গিয়েছিল এবং তাদের খাগড়াছড়ি থাকার সময়েই ঘটনাটি ঘটে। কিন্তু সেনাবাহিনী মানবাধিকার গ্রুপটিকে ঘটনাস্থলে যেতে দেয় নি।এমনকী সেনাবাহিনী তৎকালীন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সমীরন দেওয়ানকেও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে দেয় নি।
এরকম ছোটবড় অনেক ঘটনা রঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় ১৯৭৬ সাল হতে, বিশেষ করে জেনারেল এরশাদের আমলে ঘটেছিল। এসব ঘটনায় শত শত জুম্ম পাহাড়ি নারী-পুরুষ-শিশু নিহত, আহত ও নিখোঁজ হয়। তাছাড়া হাজার-হাজার জুম্ম বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল।
এসব ঘটনা কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া কোনোরূপ তদন্ত হয়নি এবং মূলধারারার কোনো সংবাদপত্রেও প্রকাশ পায় নি। কেবল লোগাং গণহত্যাকাণ্ড এবং নানিয়াচর হত্যাকাণ্ড একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি দ্বারা তদন্ত করা হয়েছিল। যদ্সিও এর কোনো রিপোর্ট অদ্যাবধি প্রকাশিত হয় নি। তাছাড়া এসব ঘনার সাথে জড়িত কোন অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে অথবা বিচারের সম্মূখীন হতে হয়েছে এমনটাও কখনো শোনা যায় নি।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
জানুয়ারি ৫, ২০২০; ৯:৩১ অপরাহ্ন
১. উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাবাহিনী ও বাঙ্গালী হত্যার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
১৯৭৭ সাল থেকে শান্তিচুক্তির আগ মূহূর্ত পর্যন্ত এই তথ্য পরিসংখ্যান। পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২০ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরে আসেনি। অশান্তি বিড়ম্বনায় আজও পার্বত্য বাসীকে তাড়িয়ে বেড়ায়। প্রশাসন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশাজীবীর মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী কর্তৃক হামলা, মামলা, খুন, গুম, অপহরণ, হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি ও সেনা হত্যার সংক্ষিপ্ত তালিকা-
৬ মে ১৯৭৭ : সাঙ্গু নদীতে কর্তব্যরত অবস্থায় আবদুল কাদিরসহ পাঁচ সেনাসদস্যকে হত্যা।
২৫ অক্টোবর ১৯৭৭ : বান্দরবানে নিহত হন নায়েক আবদুল গণি মিয়া, নায়েক আবদুস সাত্তার, নায়েক আরিফ, সিপাহী লুৎফর রহমান, সিপাহী আলী হোসেন এবং সিপাহী আবদুল খালেক মুন্সি।
২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ : সাঙ্গু নদীতে অ্যামবুশ, এক সেনাসদস্যকে হত্যা এবং প্রচুর গোলাবারুদ লুট।
৫ জুলাই ১৯৭৯ : কাপ্তাই নতুন বাজার থেকে ২ জন আনসার সদস্যকে অপহরণ করে হত্যা।
১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৯ : দীঘিনালায় নায়েক এসএম রুহুল আমিনকে হত্যা।
১৪ অক্টোবর ১৯৭৯ : খাগড়াছড়িতে পাঁচ সেনাসদস্যকে হত্যা।
১৯ ডিসেম্বর ১৯৭৯, লংগদু : একই রাতে একযোগে কয়েকটি গ্রামে হামলা, ২০ বাঙ্গালীকে হত্যা, আহত ৪০, ১০৪টি বাড়ি অগ্নিদগ্ধ।
২৩ জানুয়ারি ১৯৮০ : খাগড়াছড়িতে তিন সেনাসদস্য খুন, আহত ৫।
২১ এপ্রিল ১৯৮০ : ফালাউংপাড়া নামের একটি স্থানে অ্যামবুশ করে ১১ রাইফেল ব্যাটালিয়নের ২০ জন জওয়ানকে হত্যা, প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র লুট।
১ মার্চ ১৯৮০ : ঘন্টিছড়া নামের একটি স্থানে অ্যামবুশ করে হত্যা করা হয় মেজর মহসিন আলমসহ ২২ জন সেনাসদস্যকে।
২৫ মার্চ ১৯৮০, কাউখালী : বাঙালি বসতিতে হামলা, নিহত ২৯, আহত ১১ জন।
১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮০, কাউখালী, বেতছড়ি ও কচুখালী : আকস্মিক আক্রমণে ৬ বাঙালি খুন, আহত ২৫ জন।
২৯ এপ্রিল ১৯৮৪ : খাগড়াছড়ি মাটিরাঙ্গায় বাঙালি বসতিতে গণহত্যা। হতাহতের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায়নি।
৩০ ও ৩১ মে ১৯৮৪, ভূষণছড়া ও বরকল : দিবাগত রাতে বাঙালি বসতিতে হামলা, ৮৮ জনকে গুলি করে হত্যা, আহত ৩৩ এবং ১৮ জন অপহৃত। আগুনে পুড়ে ছাই ২৬৪টি বাড়ি।
১৯ জুলাই ১৯৮৬ : খাগড়াছড়িতে এক সেনাসদস্য নিহত, আহত ৭।
২২ জুলাই ১৯৮৬, দীঘিনালা : সশস্ত্র হামলায় ২৪ বাঙালি খুন, ৩২ জনকে অপহরণ।
৭ আগস্ট ১৯৮৬ : ২ জন আনসার সদস্যকে অপহরণ করে হত্যা।
২১ জুন ১৯৮৭ : নাড়াইছড়ির অদূরে অ্যামবুশ, সেনাসদস্য আবদুর রাজ্জাক, ইসমাঈল হোসেন ও মোহনলালকে হত্যা।
২৪ নভেম্বর ১৯৮৭ : শিলছড়িতে দুই সেনাসদস্যকে গুলি করে হত্যা।
১৮ এপ্রিল ১৯৮৯, বাশখালী : পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে ১৫ জনের মৃত্যু।
২৭ জানুয়ারি ১৯৮৯ : বন কর্মকর্তা আবুল হোসেন, বজল আহমদ ও মাহবুবুল আলমকে অপহরণ করে হত্যা।
৪ মে ১৯৮৯, লংগদু : আকস্মিক আক্রমণে ১৫ বাঙালির মৃত্যু।
১৬ এপ্রিল ১৯৯০, নাইক্ষ্যংছড়ি ও বলিপাড়া : ১৯ বাঙালিকে গুলি করে হত্যা। এ বছরই থানচিতে ১১ জন সেনা জওয়ানকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়।
১০ জানুয়ারি ১৯৯২, খিরাম : খিরাম বন কার্যালয়ে আক্রমণ, ৬ কর্মচারীকে হত্যা।
২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২, লংগদু : চলন্ত লঞ্চে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ১৭ বাঙালিকে হত্যা।
২৯ জুন ১৯৯২ : মহালছড়ি-রাঙ্গামাটি সড়কে পাহারা চৌকির ওপর হামলা, দুজন সেনা সদস্য নিহত।
১৪ জুন ১৯৯৫ : শান্তিবাহিনীর ২০ সদস্যের একটি গ্রুপের হাতে ব্যাংক লুট। গার্ডকে হত্যা এবং দুই ব্যাংক কর্মচারীকে অপহরণ।
৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬, পাকুয়াখালী (রাঙামাটি) : নৃশংস হামলা চালিয়ে ৩৫ জন বাঙালী কাঠুরিয়াকে হত্যা।
এরপরও হত্যা চলেছিল অবলীলায়। সেনাবাহিনী আছে বলেই পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রনে।
দীর্ঘ ৩ যুগের কাছাকাছি সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করে আসছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। যখন সেনাবাহিনী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করে ঠিক সেই সময় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলে। একের পর এক মিথ্যা অভিযোগ রটিয়ে সেনাবাহিনীকে তাদের কার্যক্রম থেকে দুরে রাখে। সন্ত্রাসীদের সাপোর্ট করে দেশের একটি সুশীল নামধারী জ্ঞানপাপী মহল। যাদের পরোক্ষ সহযোগিতায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একের পর মিথ্যাচার করে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করতে বরাবরই বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী সমূহ তৎপর রয়েছে। সরকারে রীতিনীতি ও একটি পক্ষকে সন্তুষ্ট করার কারণে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। যতদিন রাষ্ট্রের রীতিনীতি পরিবর্তন হবেনা ততদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী ও বাঙ্গালী হত্যাযজ্ঞ সহজে বন্ধ হবে না।
২. ঠিক বত্রিশ বছর আগের এই দিনের নির্মম-নৃশংস ঘটনা। রাতের আধাঁরে চার ঘন্টার ব্যবধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি স্থানে পরিকল্পিতভাবে নিরীহ বাঙ্গালিদের উপর একযোগে হামলা চালিয়ে যে গণহত্যার রেকর্ড করা হয়েছিল সেদিন,তা আজও ঢুকরে কাঁদায়। সেদিন উপজাতীয় সন্ত্রাসী সংগঠন “শান্তিবাহিনী” পার্বত্য চট্টগ্রামের অগণিত হত্যাকান্ডের বিভৎস নারকীয় রোমহর্ষক ঘটনাটি ঘটায় খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার পানছড়ি,দিঘীনালা ও মাটিরাঙ্গায়। শান্তিবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত ১৯৮৬ সালের ২৯ এপ্রিলের এই তিনটি গণহত্যা বাংলাদেশের ইতিহাসে- পানছড়ি গণহত্যা, দিঘীনালা গণহত্যা ও মাটিরাঙা গণহত্যা হিসেবেই যুগের পর যুগ পরিচিতি পেয়ে চলেছে। সেদিন দিবাগত রাত আনুমানিক ৯টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত একযোগে চালানো হয় পানছড়ি – দিঘীনালা – মাটিরাঙার শিহরণ জাগানো গণহত্যা। তিনটি গণহত্যার শিকার হন ২৪৪০ নিরীহ বাঙ্গালি।তাদের পরিবার আজও বিচার পায়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়,যুগের পর যুগ “শান্তিবাহিনী”র অসংখ্য বর্বরোচিত, নারকীয় ও পৈশাচিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে পার্বত্য অঞ্চলের বাঙালিরা। কিন্তু কোন এক অলৌকিক কারণে বাঙালিদের উপর সন্ত্রাসীদের চালানো এসব নির্যাতনের চিত্র প্রচার মাধ্যমে তেমন স্থান পায়নি। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নির্যাতনকারী উপজাতিরা নিজেদের নৃশংসতার স্বরূপকে ঢেকে তিলকে তাল বানিয়ে দেশে-বিদেশে নিজেদের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে যে পার্বত্য চট্টগ্রামে তারা অত্যাচারিত। কতিপয় উপজাতি সাইবার এক্টিভিস্ট এবং তথাকথিত সুশীল সমাজ কর্তৃক অর্থের বিনিময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের উপর সন্তু লারমার শান্তিবাহিনী দ্বারা সংঘটিত এসব গণহত্যার সম্পর্কে বিদেশী ও দেশের মানুষকে ভুল বোঝানো হয়। এতে করে সর্বমহলে ধারণা জন্মেছে যে, পার্বত্যাঞ্চলের আসলে উপজাতিরাই নির্যাতনের শিকার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামে বেশিরভাগ গণহত্যা শান্তিবাহিনী দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু এই তথ্য এখন বিচ্ছিন্নতাবাদী শান্তিবাহিনীর দালালদের কর্তৃক লুকানো হচ্ছে। এই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দেশে-বিদেশে সর্বত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করে। স্বাভাবিকভাবে মানুষ সংখ্যালঘুদের কথা বিশ্বাস করে এবং ভাবে যে সংখ্যাগুরুরা তাদের নির্যাতন করছে। কিন্তু বাস্তবতা হল, পার্বত্য চট্রগ্রামের ক্ষেত্রে এখানকার বাঙালিরাই উপজাতি সন্ত্রাসীদের দ্বারা নির্যাতিত এবং অত্যাচারিত।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিুচুক্তি করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) তথা শান্তিবাহিনীর সদস্যদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলেও আজও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি আসেনি, বন্ধ হয়নি হত্যাকান্ড।
কাগজে-কলমে শান্তিবাহিনী না থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংগঠনগুলোর দৌরাত্ম্য কমেনি, বরং তাদের হাতে বাঙালিরা যেমন হত্যার শিকার হচ্ছে, তেমনি নিহত হচ্ছে উপজাতি জনগোষ্ঠীগুলোর মানুষজনও। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির অন্বেষায় সরকার শান্তিচুক্তি করলেও সন্তু লারমার শান্তিবাহিনীর বিকল্প জেএসএস(সন্তু), জেএসএস(সংস্কার), ইউপিডিএফ(প্রসীত) এবং ইউপিডিএফ(গণতান্ত্রিক) নামক চারটি সন্ত্রাসী বাহিনী গঠিত হয়েছে। এই চার সংগঠন এখন পাহাড়ের সকল জনগোষ্ঠীকে কোণঠাসা করে রেখেছে। তারা পাহাড়ের সাধারণ মানুষের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। কখন কার উপর তারা যমদূতের মতো আবির্ভূত হয় তা নিয়ে শঙ্কিত থাকে পাহাড়ের মানুষ।
শান্তিচুক্তির পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনী কর্তৃক অসংখ্য গণহত্যা চালানো হয়। তাদের এইসব গণহত্যার শিকার পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালি ও উপজাতি জনগোষ্ঠীর মানুষগুলো। এমনকি শান্তিবাহিনীর বর্বর হত্যাকান্ড থেকে রেহায় পায়নি পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরাও।
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত অসংখ্য হত্যাকান্ডের মধ্যে অন্যতম হল ১৯৮৬ সালের ২৯ এপ্রিলে সংঘটিত তিন তিনটি গণহত্যা। এগুলো হলো- পানছড়ি গণহত্যা, দিঘীনালা গণহত্যা ও মাটিরাঙা গণহত্যা। সেদিন দিবাগত রাত আনুমানিক ৯টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত একযোগে চালানো হয় পানছড়ি গণহত্যা, দিঘীনালা গণহত্যা ও মাটিরাঙা গণহত্যা। এদিনে খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার লোগাং, চেঙ্গী, পানছড়ি, লতিবান, উল্টাছড়ি এই ৫টি ইউনিয়নের ২৪৫টি গ্রামের প্রত্যেকটি বাঙালি গ্রামে; দীঘিনালা উপজেলার মেরুং, বোয়ালখালী, কবাখালী, দিঘীনালা, বাবুছড়া এই ৫টি ইউনিয়নের ২৪৫টি গ্রামের প্রত্যেকটি বাঙালি গ্রামে এবং মাটিরাংগা উপজেলার তাইন্দং, তবলছড়ি, বর্ণাল, বেলছড়ি, আমতলি, গোমতি, মাটিরাংগা, গুইমারা এই ৮টি ইউনিয়নের ৩২৫টি গ্রামের প্রত্যেকটি বাঙালি গ্রামে অগ্নিসংযোগসহ লুটতরাজ, হত্যা, বাঙালি নারীদের গণধর্ষণ ও পরে হত্যা করে নারকীয়তা সৃষ্টি করেছিলো সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এর সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা। মাত্র কয়েক ঘন্টা সময়ের মধ্যে তারা পানছড়ি এলাকায় ৮৫৩ জন, দিঘীনালা এলাকায় ৮৯৮ জন এবং মাটিরাঙ্গা এলাকায় ৬৮৯ জন নিরস্ত্র নিরীহ বাঙালি নারী, শিশু, আবাল-বৃদ্ধ বনিতাকে হত্যা করে। হাত-পা বেঁধে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে, দা-দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে, জবাই করে, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নানা ভাবে কষ্ট দিয়ে হত্যা করেছিল এই অসহায় বাঙালি মানুষগুলোকে। প্রতিটি লাশকেই বিকৃত করে সেদিন চরম অমানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল তারা।
ওই ঘটনায় পানছড়ি এলাকায় আহত হয় ৫০০ জনের অধিক বাঙালি। ৬২৪০টি বাঙালিদের বাড়ি লুটতরাজ করে সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে দেয় উপজাতি সন্ত্রাসীরা। দিঘীনালা এলাকায় আহত হয় ১২০০ জনের অধিক বাঙালি। ৭৩০৪টি বাড়ি লুটতরাজ করে সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে দেয় উপজাতি সন্ত্রাসীরা। মাটিরাঙ্গা এলাকায় আহত হয় ৮০০ জনের অধিক বাঙালি। ৯০৪৮টি বাড়ি উপজাতি সন্ত্রাসীদের কর্তৃক লুটতরাজ করে সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে দেয়া হয়।
তিনটি ঘটনাতে অপহরণ ও গুমের শিকার হয় কয়েক হাজার বাঙালি। সেদিন কতিপয় বাঙালি প্রাণে বেঁচে গেলেও এই ঘটনায় গৃহহীন হয়ে পড়ে হাজার হাজার বাঙালি পরিবার। ঘটনাটি স্বচক্ষে দেখা এবং বেঁচে যাওয়া কিছু কিছু সাক্ষী আজো আছে। কিন্তু ঘটনার বীভৎসতার কথা মনে পড়লে আজও তাদের চোখে মুখে আতঙ্ক ফুটে ওঠে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের এই ভয়াবহ গণহত্যা ও বাঙালি নিধনের কথা আজ ইতিহাসের অতলান্তে, স্মৃতির ধুলার পুরো আস্তরে ঢাকা পড়ে অনেকটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। তবে তাদের প্রাণ ও রক্তের বিনিময়ে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে আজো পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অখন্ড ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে টিকে আছে বাংলাদেশের মানচিত্রে।