বাংলা ছোটগল্প সেই আশ্চর্য রত্নভাণ্ডার, ঊনিশ শতকের নব্বইয়ের দশকে যার সন্ধান আমাদের দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর থেকে প্রতিনিয়ত এই আবিস্কার প্রক্রিয়া চলছেই। বাংলা কথাসাহিত্যের রত্নখচিত এই অঙ্গনে কতজনের কত সৃজন-সাধনায়, ধারাবাহিক চর্চায় সৃজিত বাংলা গল্পভূমি আজ যে পাঠমনস্কতা দাবি করে সে অবদান সর্বতোভাবে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রপরবর্তী ছােট গল্পকারকথাকার সকলেরই। তাই যে কোন একজন লেখকের ছোটগল্প আলোচনার ক্ষেত্রে সমগ্র বাংলা গল্পজগতের প্রসঙ্গ এসে পড়বেই। বাংলা ছোটগল্প নদীর স্রোতের মতো। সেই চলমান ধারায় বিকশিত হয়েই এক একজন স্রষ্টা স্রোতপথকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। ভাষা নির্মাণশৈলীর পরীক্ষানিরীক্ষায় কখনও বা বাঁক নিয়েছেন, কিন্তু আসল ধারাস্রোতে ভাটা পড়েনি কখনও। শুধু পরিমাণে পরিসরে নয়, বৈচিত্র্যে গভীরতায় সর্বদা ব্যাপ্ত যে-সৃষ্টি, মাঝেমধ্যেই স্বকীয়তায় অনন্য হয়ে উঠেছেন তার স্রষ্টা লেখকজন। সৃষ্টি-প্রক্রিয়া নির্মাণশৈলী আঙ্গিকে যিনি কখনওবা হয়ে ওঠেন নির্মাণশিল্পী। গঠনবিন্যাস পদ্ধতির সঙ্গে মিলেমিশে যায় নির্মাণ বা সৃষ্টি। “কী গাঁথলেন সেটি যেমন দর্শনীয় হয়ে ওঠে, কেমন করে গাঁথছেন সেই অভাবিত সৌন্দর্যেও মগ্ন হতে হয়।” বাংলা ছোটগল্পে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ হলেন এমনই স্থপতি, যাঁর স্থাপত্যকর্ম যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনই স্থাপন প্রক্রিয়াটিও উপভোগ্য, দাবি করে মনোযোগ। কোনও একটিকে বাদ দিলে ঠিক আস্বাদ মেলে না। তাই ওয়ালীউল্লাহ্-র গল্পের পুনঃকথন সম্ভব হয় না। সংক্ষিপ্তভাবে বলা যায় না, প্রতিটি শব্দ পড়তে হয়। গল্পের ভেতরের মূল অংশকে তেমন করে আলাদা করা যায় না। আবার নির্মাণভঙ্গিমাটিকে আলাদাভাবে দেখতে চাইলেও গল্পের প্রাণটি নষ্ট হয়। ওয়ালীউল্লাহ্-র গল্প মানে তাই আগাগোড়া পাঠ এবং সচেতন পাঠ।
মাত্র পঞ্চাশ বছরের জীবন (১৯২২-১৯৭১)। প্রায় তিন দশকের (চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট) লেখালেখি। গল্প দিয়ে শুরু করলেও পরে লিখেছেন উপন্যাস, নাটক। সাহিত্যজীবনের প্রথম দেড় দশকই মূলত তাঁর গল্প লেখার কাল। পরে ক্রমে মগ্ন হয়েছেন উপন্যাসে। শেষ আবিষ্কৃত গল্পর হিসেবে সব মিলিয়ে ৫৩টি গল্প লিখেছেন। জীবনের প্রথম গ্রন্থটিই গল্পগ্রন্থ ‘নয়নচারা’। প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সালে (ভুল না হয়ে থাকলে ৪৪শেও হতে পারে)পূর্বাশা প্রকাশনী থেকে। আর লেখকের দ্বিতীয় ও শেষ গল্পগ্রন্থ “দুই তীর ও অন্যান্য গল্প” প্রকাশিত হয় দু’দশক পরে ১৯৬৫ সালে। দুটি গল্পগ্রন্থে সংকলিত গল্পের সংখ্যা ৮ ও ৯ মিলিয়ে মোট ১৭। বাদবাকি সব গল্পই অগ্রস্থিত থেকে যায় দীর্ঘকাল। ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ গ্রন্থাবলী। পূর্ববর্তী ১৭টি গল্প ছাড়াও এ গ্রন্থাবলীতে আরও ৩২টি গল্প সংকলিত হয়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত আরও ৪টি গল্প পরে পাওয়া যায়। সবমিলিয়ে ‘গল্পসমগ্র আপাতত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-র গল্পের এক পূর্ণাঙ্গ সংকলন বলা যায়।’ ওয়ালীউল্লাহ্-র প্রথম গল্প ‘নয়নচারা’ প্রকাশিত হয় পূর্বাশা পত্রিকায়। সে-সময় (১৯৪৩-৪৫) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পঞ্চাশের মন্বন্তরের কালো ছায়া সারা বাংলা জুড়ে। যুদ্ধ অনাহার ও মৃত্যুর পটভূমিকায় ‘নয়নচারা’ ছাড়াও তিনি পরপর লিখেছেন ‘মৃত্যু-যাত্ৰা’, ‘রক্ত’। সমকালীন পটভূমিতে তরুণ ওয়ালীউল্লাহ্-র অন্তর্গত রক্তক্ষরণই অনুভবে দরদে প্রকাশিত হয়েছে। যুদ্ধ-মন্বন্তর শুধু যে খিদে বাড়িয়ে দেয় তা নয়, লুটেপুটে নেয় আবাল্য স্নেহের কৈশোর ভূমিটুকুও। ভিটেছাড়া ঘরছাড়া মানুষের বুকের ভেতরের সবটুকু ‘জমিন’ কেড়ে নিয়ে তাকে ছিবড়ে হাভাতে ভিখিরি করে তোলে। আর কিছু নয়, চেয়েচিন্তে যে কোনওভাবে উদরপূর্তিই যার একমাত্র চাহিদা বলে সাধারণের বিশ্বাস, সেখানে ওয়ালীউল্লাহ্ শুরু করেন এভাবে;
“ঘনায়মান কালো রাতে জনশূন্য প্রশস্ত রাস্তাটাকে ময়ুরাক্ষী নদী বলে কল্পনা করতে বেশ লাগে।”
খিদে নয়, খিদের তাড়নে হা-অন্ন মানুষটির অন্তর্দেশ জুড়ে হারানো মাটি হারানো জীবনের হাহাকার। । এও এক খিদে, যার তৃপ্তি নেই দু’মুঠো ভাতে। ফ্যানভাতের সন্ধানী মানুষটির সতৃষ্ণ আকাঙক্ষা আসলে সেই মাটি এবং মা-টি। ময়ূরাক্ষী নদীকে ছুঁয়ে যে গ্রাম ‘নয়নচারা’, মাটিলগ্ন যে জীবন, পায়ে পায়ে তারই নিরন্তর অনুসন্ধান। খিদে নয়, তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় স্মৃতি। “সুড়ঙ্গের মতো গলা বেয়ে তীক্ষ তীব্র আর্তনাদের পর আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে লাগল, আর সে থরথর করে কাঁপতে লাগল আপাদমস্তক।” অবশেষে “কে একটা মেয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল, এসে অতি আস্তে-আস্তে অতি শান্ত গলায় শুধু বলল: নাও।” ভাত পেল সে। “ত্ৰস্ত ভঙ্গিতে ময়লা কাপড়ের প্রান্ত মেলে ধরে সে ভাতটুকু নিলে, নিয়ে মুখ তুলে কয়েক মুহূর্ত নিম্পলক চােখে চেয়ে রইলো মেয়েটির পানে।” চেনা যেন বহুকালের চেনা এই মুখ। নয়নচারা গ্রামে ভাতের থালা সাজিয়ে অপেক্ষা করে যে জন, এ তো সেই মুখ। চকিতে কি ভেসে ওঠে মা-র ভাত বেড়ে দেওয়ার চিরকালীন অমৃত বৈভবাদৃশ্য? রান্নাঘর আসনপিড়ি আস্ত সেই উঠোন? আচলে ভাতটুকু নিয়ে মাটি-সন্ধানী সে সন্তান কাঙ্গালের আকুতিতে বলে ওঠে : “নয়নচারা গায়ে কী মায়ের বাড়ি?”
খিদের মুখে দাঁড়িয়ে শুধু ভাত নয়, মনের ভেতর জুড়ে অন্য এক অনুসন্ধান-প্রক্রিয়া নিয়ত ক্রিয়াশীল। ‘নয়নচারা’য় যে সূচনা পরবর্তী তিন দশকের লেখালেখিতে সেই অনর্গল খোঁড়াখুড়ি। বহির্বাস্তব পরিবেশ পরিস্থিতি সময়ের সঙ্গে পা ফেলে ওয়ালীউল্লাহ্ আসলে খনন করে চলেন মানবমন মানবভূমি। বহির্বাস্তবকে ছাপিয়ে যায় মনোবাস্তব। ওয়ালীউল্লাহ্ তাই অন্য রকমের লেখক।
ওয়ালীউল্লাহ্ যখন কলম ধরেন, বলা ভালো-বাধ্য হন, তখন বাংলা গল্প অতিক্রম করেছে প্ৰায় পাঁচ দশকের পথ। ভাব-ভাষা ও নির্মাণশৈলীতে ক্রমশ ফুটে উঠছে তার বৈচিত্র্য। ততদিনে কল্লোল যুগের লেখকজনেরা তাঁদের কথা-বৈচিত্র্যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। কলম ধরেছেন ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। দ্রুত বদল ঘটে চলেছে গল্পের চেহারায় আঙ্গিকে অন্তর্লীন বয়নকৌশলে, এবং অবশ্যই বিষয়ে ও ভাবে-ভাষায়। গল্প-বৈচিত্র্য সম্পর্কে জগদীশ গুপ্ত ভারি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন:
“…উন্মুখ প্রবৃত্তি লইয়াই এবং মনোভাবের বিশ্লেষণ করিয়াই এখন গল্প লেখা চলিত হইয়াছে। কাজেই মানুষের বিভিন্ন প্রবৃত্তির সঙ্গে যার যত পরিচয়, বা সে বিষয়ে যার যত অন্তর্দৃষ্টি তার গল্প তত বিচিত্র হইবে।”
[‘কালি-কলম’-এর সম্পাদক মুরলীধর বসুকে লেখা চিঠি ১৬.৯.১৯২৭, জগদীশ গুপ্ত রচনাবলী ১ম খণ্ড, ২৭ সংখ্যক চিঠি।]
সমাজচেতনা ও অন্তশ্চেতনার মিশেলে বাংলা গল্পভুবনের রূপমাধুর্য প্রকৃত অর্থেই বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠতে থাকে। জগদীশ গুপ্ত, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় এবং তিন বন্দ্যোপাধ্যায় বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর ও মানিকের কলমে ক্রমাগত এই বৈচিত্র্য প্রকাশিত হতে থাকে। বাংলা ছোটগল্পে উঠে আসতে থাকে সাধারণ প্রান্তিক মানুষ ও তার মানসভূমি। এই অনুসন্ধানেই একে একে নিয়োজিত হলেন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, বিমল কর, সমরেশ বসু, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সন্তোষকুমার ঘোষ এবং আরও অনেকের সঙ্গে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। ‘নয়নচার’ গল্পবয়নে যে-সূচনা, তাতে জগদীশ ও মানিকের ধারা-প্রভাব কিছুটা স্পষ্ট হলেও অল্প কয়েকটি রচনাতেই নিজস্ব স্বতন্ত্রতার প্রমাণ রাখলেন ওয়ালীউল্লাহ্। “সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সর্বসময়ের এক শ্রেষ্ঠ বাঙালি লেখক- গল্পকার ঔপন্যাসিক ও নাট্যরচয়িতা। এর মধ্যে তাঁর গল্পকার ও ঔপন্যাসিক পরিচয় বিশেষ মহত্ত্ব ও স্বাতন্ত্র্যে চিহ্নিত..।” ওয়ালীউল্লাহ্ তো গল্প-লেখক নন, গল্পনির্মাতা। স্থাপত্য নির্মাণের পরও যেমন ধারাবাহিক ঘষামাজ চলতেই থাকে, তেমনই আপন সৃষ্টির প্রতি দরদ লক্ষ করি এই লেখকের মধ্যেও । গল্প তো নয়, যেন আত্মজ। প্রকাশের পরও চলতে থাকে অদলবদল পুনর্লিখন। একটি লেখা নিয়ে কত অতৃপ্তি। লেখার প্রতি কতখানি ভালোবাসা, নিয়ত পূর্ণাঙ্গভাবে ধরবার চেষ্টা। লেখার প্রতি এই দরদ ও নিষ্ঠাই লেখক ওয়ালীউল্লাহ্র প্রাণবস্তু। লেখক নিজেই তাঁর গল্পের পাঠক, নির্মম বিচারক।
‘নয়নচারা’ প্রকাশের কয়েক বছর পর মোটামুটি ১৯৪৯ সাল থেকেই গল্প রচনায় লেখকের মনোযোগ কমে আসে। লেখক মন দাবী করে আরও পরিসর ও ব্যাপ্তি। মনোযোগী হয়ে ওঠেন উপন্যাসে ও নাটকে। ফলত প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশের প্রায় দু-দশক পরে সংকলিত হয় দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘দুই তীর ও অন্যান্য গল্প‘ (১৯৬৫)। এ গ্রন্থের ভূমিকাতেই প্রকাশিত হয় নিজস্ব গল্প নিয়ে লেখকের অতৃপ্তি ও পরিচর্যার দৃষ্টিভঙ্গি:
“পূর্ব-প্রকাশিত গল্পগুলি এ সঙ্কলনের জন্য ঘষামাজা করেছি, নাম বদলেছি, স্থানে স্থানে লেখকের অধিকার সূত্রে বেশ অদল-বদলও করেছি।”
দু-দশক আগে প্রকাশিত গল্প সংকলিত করবার আগে আগাগোড়া পরিমার্জন, নাম বদল (যেমন দুই তীর গল্পের পূর্বনাম ছিল ‘কালো বোরখা’) করার মতো ধৈর্য শ্রম তো খুব একটা চােখে পড়ে না। ওয়ালীউল্লাহ্-র মতো গল্প-নির্মাতারাই পারেন। ওয়ালীউল্লাহর অধিকাংশে গল্পেই লেখকের উপস্থিতি লক্ষণীয়। কারণ গল্পের চরিত্র গল্পের কাহিনির চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে গল্পের নির্মাণশৈলী। শব্দবন্ধে কীভাবে বুনে চলেছেন গল্পের অবয়ব, তা অনেক বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করে। গল্পকথক থেকে গল্প-নির্মাতা হয়ে ওঠা ওয়ালীউল্লাহ্-র একটি বড় বৈশিষ্ট্য। সমকালীন অন্যান্য লেখকদের মতো এই লেখককেও ব্যতিব্যস্ত রেখেছিল সমকাল ও বাস্তব অভিঘাত। এই বহির্বাস্তবকে ওয়ালীউল্লাহ্ ধরতে চেয়েছেন মনোবাস্তবের প্রেক্ষিতে। তাই তাঁর গল্প-শরীরে বাত্মায় হয়ে উঠেছে অন্য মাত্রার ব্যঞ্জনা। ‘নয়নচারা’য় মাটি সন্ধানী আমুর শেষ উচ্চারণ: “নয়নচারা গাঁয়ে কি মা’র বাড়ি?” খিদের সমস্ত চাহিদা আকাঙক্ষা গ্লানিকে ছাপিয়ে এ অনুসন্ধান স্পষ্ট করে তোলে এক গ্রাম উঠোনের মনোভূমি। ‘জাহাজি’ গল্পে তো সমুদ্রযাত্রা জাহাজ পরিবার ছেড়ে বাড়ি চলে যাওয়ার ছাড়পত্র পেয়ে যায় ছাত্তার। করিম সারেঙও ভাবে “এবার শেষ হবে তার সামুদ্রিক জীবন, এবার এ-অশান্ত জীবন থেকে সে মুক্তি পাবে।” জাহাজ বন্দরে পৌছবার পর করিম সারেঙ ছাত্তারের হাতে ধরিয়ে দেয় ঘরে ফেরার অসম্ভব আকুতিভরা ছাড়পত্র ‘তুই বারিৎ যা গই, আর ন আইছ্’, আর বদলে নেয় নিজের সিদ্ধান্ত ‘আবার সে জাহাজে চুক্তি নেবে, এবং যদি পারে আমৃত্যু সমুদ্রের বুকেই বাস করবে।’ ছাত্তারদের ঘর আছে আত্মীয়পরিজন আছে সবাই আছে। কিন্তু করিম সারেংদের জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার মত কোনও ‘ঘর’ নেই। জাহাজ-ই তাদের ঘরবাড়ি, তারা যে জাহাজি’। ওয়ালীউল্লাহকে শ্রদ্ধা জানিয়ে শওকত ওসমান বলেছিলেন,
“ওয়ালীউল্লাহর নিসর্গবন্দনা কিন্তু উপন্যাসের পটভূমি রচনার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত নয়। বরং তা উপন্যাসের অলংকারবিশেষ। কথকতার বিবৃতি না দিয়ে যেন পাঠকের দৃষ্টি কিছুক্ষণের জন্য অন্য দিকে ফিরিয়ে রাখা। কিন্তু প্ৰায় একই ধরনের বিষয়বস্তু-উপন্যাসে নয়, গল্পে নিসর্গ কথকতার মেটিভ বা উদ্দেশ্যের সঙ্গে বিধৃত।”
[সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্: শওকত ওসমান। দেশ, ১৫ জানুয়ারি ১৯৭২]
শুধু উপন্যাসে নয়, ওয়ালীউল্লাহ্র গল্পে নিসর্গ এসেছে চরিত্র হিসেবেই। ‘পরাজয়’ গল্পে নিসর্গ যেন সহযোগী পার্শ্বচরিত্র। গল্প-নির্মাতা হিসেবে লেখকের এও এক নির্মাণকৌশল। ‘পরাজয়’- পাঠে বিভূতিভূষণকে কি মনে পড়ে পাঠকের? অনেকটা একই আঙ্গিকে ভিন্নতর বোধে মাত্রায় রচিত হয় ‘মৃত্যু-যাত্রা’ গল্পটি। একক কোনও নায়ক নয়, পঞ্চাশের মন্বন্তরই এ গল্পের নায়ক। আরও নির্দিষ্টি করে বলতে হয়, মন্বন্তরের পীড়নে পিষ্ট একটি মৃতদেহকে ঘিরে আবর্তিত এ গল্প। একটি শবদেহ, তা যেন নিম্প্রাণ অমানবীয় বস্তু নয়, হয়ে উঠেছে। মানবিক চরিত্র। “ওপারে বড় গাঁ, চাল পাওয়া যাবি নেশ্চয়।” এই আশায় মেয়েপুরুষের দল সঙ্গী বৃদ্ধের মৃতদেহের বাধা অতিক্রম করে চলে যায়। “এবং প্রান্তরের ধারে বৃহৎ বৃক্ষের তলে তার গুড়িতে ঠেস দিয়ে বুড়োর মৃতদেহ বসে রইল অনন্ত তমিস্রার দার্শনিকের মত।” আশ্চর্য বিস্ময়ে স্তব্ধ হতে হয় পাঠককে। এভাবেই একের পর এক তুলনাহীন স্বতন্ত্র নির্মাণ। একটি তুলসীগাছের কাহিনী, খুনি, দুই তীর, নিস্ফল জীবন, নিস্ফল যাত্রা, মালেকা, খণ্ড চাঁদের বক্রতায়, সেই পৃথিবী, পাগড়ি, কেরায়া, সতীন প্রতিটি গল্পকেই ওয়ালীউল্লাহ্ স্থিতধী স্থপতির মতো ভারি মমতায়, কিন্তু কখনও কখনও নৈর্ব্যক্তিক নিষ্ঠুরতায় গড়ে তুলেছেন। আর এই নির্মাণক্রিয়ায় বড় রকমের প্রাধান্য পেয়েছে মননচর্চা। ‘অবসর কাব্য’ এমনই এক গল্প যেখানে মধ্যবিত্ত চরিত্রের ভাবনা-বেদনার নাটকীয় উপস্থাপনা। মনের গহিনে যে জটিল আবর্ত, চোরাগলি তার সন্ধানে মগ্ন লেখক। পড়তে পড়তে মনে হতে পারে সাধারণ মধ্যবিত্ত মননে এত জটিলতা থাকে? থাকতে পারে? জটিলতা খোঁজার এক ধরনের বিলাসিতা নয় তো? কিন্তু মনের গভীরতর অন্বেষণে এমন আরও জটিল জটিলতর ভাঁজখাঁজের খোঁজ পাওয়া স্বাভাবিক। বরং মনে হয় সময়ের নিরিখে ওয়ালীউল্লাহ্ অনেক বেশি নিবিষ্ট মনের জটিলতা বিশ্লেষণে। এও তাঁর আর এক বৈশিষ্ট্য। যেমন ‘স্তন’ গল্পটি। এ তো পুরোপুরি মনোবিকলনধর্ম গল্প। একটি শিশুর জন্ম দিয়ে এক মা-র মৃত্যু। অন্য এক মা মাজেদার ষষ্ঠ সন্তান জন্মের পরই চলে গিয়েছে কোল খালি করে। মা মরা সন্তানটিকে দুধ দেবার জন্য মাজেদা কে নিয়োগ করা হয়েছে। সন্তানহারা মাজেদা প্রাথমিক দ্বিধা কাটিয়ে মাতৃহীন দুধের শিশুকে কোলে তুলে নেয়, স্তন গুজে দেয় শিশুর মুখে। কিন্তু দুধ নেই যে বুকে। মাজেদার মনে হয় “স্ফীত স্তনে দুধ জমে গেছে বলেই কিছু নিঃসৃত হচ্ছে না।” মাজেদা ভাবতে থাকে “এ কি সম্ভব যে, যে-দুধ তার সন্তানের জন্য এসেছিল, তার সন্তানটি আর নেই বলে সেদুধ এমনভাবে জমে গেছে?” এই মানসিক খোঁড়াখুড়ি চলতেই থাকে। শেষ পর্যন্ত তার মনে হয় “কুচাগ্রে কী যেন আটকে আছে বলে দুধটা সরছে না।” আর সে দেরি করে না। সরু দীর্ঘ একটি মাথার কাঁটা নিয়ে পরপর দুটি স্তনের বোঁটায় তীক্ষভাবে বসিয়ে দেয়। “তার স্তন থেকে দুধ ঝরে, অশান্তভাবে দুধ ঝরে। তবে সে-দুধের বর্ণ সাদা নয়, লাল।”
এমনই আরও অনেক গল্প, যার নির্মাণকৌশল গল্পশরীর সচকিত করে, বিস্মিত করে। ‘না কান্দে বুবু’র প্রতি অনুচ্ছেদের নির্মাণপর্বে আশ্চর্য কারুকাজ। মনে হয়, এও সম্ভব! কখনও অনামা চরিত্রের সংলাপ, কখনও বর্ণনা। মাঝেমধ্যে একই কথার পুনরাবৃত্তি, কিন্তু একঘেয়েমির প্রশ্নই আসে না। বরং এমত বর্ণনায় মেলে রূপকথা-স্বাদ। ওয়ালীউল্লাহ্-র নির্মাণকলার অন্যতম উপাদান তাঁর ভাষাবিলয়। জাদুকলমের অসাধারণ চারুতাগুণে ভাষা পায় অলঙ্কারের সৌকর্য। ‘নয়নচারা’ গল্পে “আমুর চোখে পরাজয় ঘুম হয়ে নাবল।” কিংবা ‘কেরায়া’ গল্পে “কানা বেড়ালের মতো নিঃশব্দে সতর্ক পদক্ষেপে অবশেষে ভোর আসে।” ‘অবসর কাব্য’-এ “পৃথিবীময় মখমলের মতো রাত্রি এসেছে নিঃশব্দে।” ‘স্বপ্নের অধ্যায়’ এ “মাস্টারনিটির সঙ্গে তার ভাব হল, পাখির পালকের মত উষ্ণ নরম ভাব।” তেমনই ‘নানির বাড়ির কেল্লা’-য় “খানিকটা উজানে নদীটি হঠাৎ কেচ্ছার মতো রহস্যময় হয়ে গেছে।” জীবনানন্দ বলতেন “উপমাই কবিতা”। ওয়ালীউল্লাহ্-র গল্পশরীরের স্থানে স্থানে আশ্চৰ্য সব উপমায় মনের মধ্যে চারিয়ে যেতে থাকে কবিতা-অনুভব। উপমার পাশাপাশি ওয়ালীউল্লাহ্র গল্পের আর এক সম্পদ পূর্ববঙ্গের বৈচিত্র্যময় উপভাষা। অধিকাংশ গল্পেই তো প্রান্তিক জীবনের জীবনচিত্রণ, যে জীবন পল্পবিত ঢাকা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, যশোর, খুলনার গ্রামমাটিতে। এইসব এলাকার স্থানিক উপভাষা উচ্চারিত হয় গল্প-চরিত্রের ঠোঁটে ঠোঁটে। গল্পের পৃষ্ঠা থেকে চরিত্রগুলি যেন উঠে দাঁড়ায়। ভারি সবল, মুখোমুখি তাদের অবস্থান। এই বাস্তবতা যতটা না বাইরের, তার চেয়ে অনেক বেশি অন্দরের অন্তরের। চরিত্রর অন্তর্গত যে মানুষ তারই উন্মোচনে ওয়ালীউল্লাহ্-র স্বকীয়তা। এতটাই আন্তরিক গভীর উপস্থাপনা যাতে গল্পভূমির মানসজনে আবিষ্ট হয়ে ওঠেন পাঠক। গল্প-ভুবনের মানুষের সঙ্গে এভাবে একাত্ম হয়ে নিজেকে দেখার সুযোগ তো মেলে না সহজে। বাংলা ছোটগল্পের বহতা স্রোতের যে অভিমুখটির সন্ধান পেতে কিছুটা অসুবিধে হত, উপস্থিতি অনুভূত হত জগদীশ-মানিক-জ্যোতিরিন্দ্রের সৃজনে, কিন্তু ঘনিষ্ঠভাবে ছোঁয়া যেত না তাকে, ওয়ালীউল্লাহ্-র ‘গল্পসমগ্র’ একালের পাঠককে এনে দিল সেই আস্বাদঅহঙ্কার।
বইটির একটি অনলাইন সংস্করণ পাওয়া যাচ্ছে এখানে।
আগস্ট ১৭, ২০১৭; ১০:৩৩ পূর্বাহ্ন
বইয়ের লিংকের জন্য ধন্যবাদ। ওয়ালীউল্লাহ’র গল্প পড়া হয়নি, আপনার রিভ্যু পড়ে পড়ার ইচ্ছা জাগল।