০
১০৭৯ বার পঠিত
স্টিফেন হকিং চলে গেলেন। তিনি ছিলেন আমাদের সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় বিজ্ঞানী। জন-সাধারণের মধ্যে বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে তার অবদান অসামান্য। আইনস্টাইন নন, হকিং এর লেখা জনপ্রিয় বই ‘এ ব্রিফ হিস্টরি অফ টাইম’ পড়েই আমরা আমপাঠক প্রথমবারের মতো সময় সম্পর্কে সচেতন হই। বলতে গেলে ওই বই পড়ার পর সময় সম্পর্কে আমাদের ধারনা আমূল পাল্টে যায়। হকিং ছিলেন যুক্তরাজ্যের ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের লুকেসিয়ান অধ্যাপক। সাধারণ পাঠকদের জন্য তাঁর লেখা জনপ্রিয় বইয়ের মধ্যে ‘দ্য ইউনিভার্স ইন এ নাটশেল’, ‘ব্ল্যাক হোলস এন্ড বেবি ইউনিভার্স’ উল্লেখযোগ্য।
১৯৬৩ সালে মাত্র একুশ বছর বয়সে মটর নিউরন ডিজিজে আক্রান্ত হলে ডাক্তাররা নিদান হাঁকেন, আর মাত্র দু’বছর আয়ু আছে। কিন্তু এতে দমে যাবার পাত্র নন হকিং, অসুখ নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি শেষ করেন। তারপরে নিজেকে জ্যোতির্বিদ্যার গবেষণায় উৎসর্গ করেন। ব্ল্যাক হোল এবং জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে তার মৌলিক গবেষণা থাকলেও হকিং পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার পাননি। এর পেছনেও মজার একটা গল্প চালু আছে। নোবেল পুরষ্কারের প্রবক্তা আলফ্রেড নোবেলের স্ত্রী কোন এক জ্যোতির্বিদের সাথে পালিয়ে গেলে তিনি বলে যান, কখনো যেন কোন জ্যোতির্বিদকে নোবেল পুরষ্কার না দেয়া হয়। কাহিনী কতটুকু সত্য তা বলা মুশকিল, কিন্তু দেখা গেছে জ্যোতির্বিদ্যার গবেষকেরা নোবেল পুরষ্কার পান না।
সাধারণ মানুষের চিন্তায় সময় সরলরৈখিক, ক্রমাগত সামনের দিকে ধেয়ে চলছে। আমাদের জগতটা যেন একটা সময়ের তীর। অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে তার ছুটে চলা। কিন্তু আসলে কী তাই? সময় কী সরলরৈখিক? সময়ের কী শুরু বা শেষ আছে? থাকলে কোথায়?
সময় কী? আমাদের সবার সময়ের ধারনা আছে, সময়ের বৈশিষ্ট্যসূচক ঘটনাবলীকে আমরা বুঝতে পারি, এমনকী আমরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ের মধ্যে পার্থক্যও করতে পারতে পারি। কিন্তু সময় কী জিনিশ এটা আমরা সম্পূর্ণ সঠিকভাবে বলতে পারি না। সময় এত দ্রুত পালায় যে ‘বর্তমান‘ সময়ে আমাদের দাঁড়ানোর কোন সুযোগ নেই, বর্তমানকে ধরতে না ধরতেই সে অতীত হয়ে যায়। আবার আমাদের অভিজ্ঞতায়, সময় কখনও খুবই ধীর, অপেক্ষার সময় যেমন সহজে কাটতে চায় না। আবার কখনও খুবই দ্রুতগতির, যেমন আনন্দের সময় খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। সময় এবং সময়ের চেতনা যতোটা সহজ মনে হয়, আসলে ততোটা সহজ নয়। বিখ্যাত দার্শনিক সাধু অগাস্টিনের ভাষায়,
“What is time then? If nobody asks me, I know; but if I wish to explain it plainly I know not.”
– St. Augustine
সময় বিশ্বজনীন একটা ধারনা, শুন্য, বস্তু এবং রূপের (space, matter, form) ধারনার মত জগতকে বুঝার জন্য সময় আমাদের অন্যতম হাতিয়ার। জগত থেকে আমরা একে আলাদা করতে পারি না। দুনিয়াতে এসেই আমরা সময় সচেতন হই, আমাদের বোধ-বুদ্ধির সাথে সময়ের ধারনা জড়িত। আমাদের মনে সময় একটা সরলরেখার মত, অতীতে শুরু হয়ে বর্তমান পেরিয়ে ভবিষ্যতের দিকে ছুটে যাচ্ছে।
আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা আমাদের জীবন থেকে প্রাকৃতিক ছন্দময় চক্রকে সরিয়ে হাতে ঘড়ি পরিয়ে ছেড়েছে। এখন আমাদের জীবন ঘড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে আবর্তিত হয়। আমাদের প্রগ্রেস বা উন্নয়নের ধারণাও এ সরলরৈখিক ঘড়ির সাথে সম্পর্কিত। মনে হচ্ছে আমরা যেন কোথাও যাচ্ছি, অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে ক্রমাগত ছুটে চলছি। সময় আমাদের জীবনকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যে আমাদের ঘড়ির কাঁটা ধরে চলতে হয়। একটু এদিক থেকে ওদিক হলে চরম অনিষ্ট ঘটে যেতে পারে।
বিজ্ঞানের মতে কাল বা সময়ের কোন স্বাধীন অস্তিত্ব নেই, এটি সবসময় কোন স্থানের সাথে সম্পৃক্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘ট্যাঁক ঘড়ি’ আছে কিন্তু কোন ‘একঘড়ি’ নেই, অর্থাৎ সার্বজনীন কোন সময় বলতে কিছু নেই, কিন্তু কেউ যখন ট্যাঁক ঘড়িতে সেটা পরিমাপ করে তখন সময় আছে। সময় পরিমাপের জন্য আমাদের যে কোন ধরনের পরিবর্তনকে পরিমাপের প্রয়োজন পড়ে। এর জন্য কমপক্ষে দুটি পরিমাপ এবং একটা রেফারেন্স দরকার। বর্তমান বিজ্ঞানে ধারনা করা হয় বিগ ব্যাং এর কারণে বিশ্বজগতের সৃষ্টি হয়ে আমরা একটা ক্রম সম্প্রসারিত বিশ্বে আছি। স্টিফেন হকিং আরেক বিজ্ঞানী রজার পেনরোজের সাথে গবেষণা করে দেখান যে, আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে স্থান-কাল এর একটা শুরু আছে এবং সেটা হলো বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ থেকে সময়ের শুরু এবং এর শেষ হয় ব্ল্যাক হোলে গিয়ে। এর ফলে সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের সাথে কোয়ান্টাম তত্ত্বের ঐক্য ঘটানোর প্রয়োজন পড়ে। সেটা করতে গিয়ে হকিং দেখতে পান যে ব্ল্যাক হোল কেবল যে সবকিছু শুষে নিবে তা নয়, তারা কিছু বিকিরণও করবে যেটা ‘হকিং রেডিয়েশান’ নামে পরিচিত।
বিগ ব্যাং থেকে সময় শুরু হয়ে আজকে প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর পার হয়ে গেছে, আমরা ক্রমাগত সময় পার করে ‘সামনের দিকে’ যাচ্ছি। কিন্তু বিগ ব্যাং এর আগে কী ছিল? এমন কী হতে পারে বিগ ব্যাং নিজেই আরেকটা চক্রের সমাপ্তি?
আমাদের বিশ্বজগতে যদি একটা ক্রিটিক্যাল পরিমাণ বস্তু না থাকে তাহলে মহাবিশ্ব অসীম সময় পর্যন্ত প্রসারিত হতে থাকবে। আরেকটা হতে পারে বিশ্বজগত হয়ত এক সময় স্লো ডাউন করবে, সম্প্রসারণ থামবে এমনকী সংকুচিত হতে শুরু করবে। বিশ্বজগতে যদি আমাদের জানার চেয়ে বেশি ম্যাটার থাকে তাহলে মহাকর্ষ একে ধরে রাখবে এবং সম্প্রসারণের পরে সংকোচন ঘটবে, এবং ভারতীয় ধারনামত এ চক্র চলতে থাকবে, ‘Cosmos without end’। যদি সেরকম হয় তাহলে আরেক জনপ্রিয় বিজ্ঞানী কার্ল সাগানের মতে,
“The Big Bang is not the creation of the Cosmos but merely the end of the previous cycle, the destruction of the last incarnation of the Cosmos.”
– Carl Sagan
দার্শনিক আলোচনায় সময় বলে কিছু নেই, সময় সবসময় ‘বর্তমান’, ‘মুশফিকুল সময়’। স্টিফেন হকিং আমাদের সাধারণ, বৈজ্ঞানিক সময় সম্পর্কে ধারনা দেয়ার চেষ্টা করেন। তার লেখা থেকেই আমরা জানতে পাই স্থান-কাল একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত, তাদের পৃথক করা যায় না। আমাদের বর্তমান বিশ্বের সময় শুরু বিগ ব্যাং থেকে এবং ক্রমসম্প্রসারিত বিশ্বে এ সময় ছুটে চলেছে, এর সমাপ্তি হবে আরেকটা সংকোচনের মাধ্যমে, অথবা আমাদের মহাবিশ্ব ক্রমাগত সম্প্রসারিত হতে থাকবে। স্টিফেন হকিং আমাদের সময়ে জনসাধারণের মাঝে মৌলিক বিজ্ঞান চর্চা এবং বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছিলেন। তার লেখার কারণে আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্তায় ‘কৃষ্ণগহ্বর’ একটা প্রচলিত শব্দ। তবে গোঁড়া ধার্মিক যেমন মনে করেন তার ধর্মটাই সেরা, তাতেই একমাত্র সত্য আছে। তেমনি হকিংও মনে করতেন পদার্থবিদ্যার জ্ঞান সেরা, বিশেষ করে দর্শন শাস্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর বিষোদগার মেনে নেয়া যায় না। এরকম দু’একটা জ্ঞানতাত্ত্বিক বালখিল্যতা ছাড়া হকিং এর কর্মজীবন ছিল উজ্জ্বল। অসুস্থ শরীর নিয়েও তাঁর জীবন যুদ্ধবিরোধী সমাবেশে অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে নানা অ্যাক্টিভিজমে পূর্ণ ছিল। সবশেষে মহাকাশ গবেষণা এবং এলিয়েন নিয়ে অতিরিক্ত আগ্রহ দেখানো নিয়েও তার সাবধানবাণী আমাদের স্মরণ রাখতে হবে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন