সমীকরণে আগুন ফোঁকে কীসে?
যে ছেলেটা কলেজে পড়ার সময় ভালবাসত বেপরোয়াভাবে নৌকো বাইতে, এবং তা করতে গিয়ে প্রায়শই নৌকোটির বারোটা বাজিয়ে বিস্তর বদনাম কিনত, সে বা অন্য কেউই বোধহয় কখনও ভাবেনি যে, তার জীবনের শেষ দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে সে শুধু নিশ্চুপে বসে মহাবিশ্বের সাথে কথা বলবে মনে মনে। ছেলেটা মানে স্টিফেন উইলিয়াম হকিং, অসাড় দেহ আর অসীম মেধা নিয়ে মহাবিশ্বের দুর্বোধ্যতার সাথে সাপলুডো খেলে যাওয়া সেই অবিশ্বাস্য বিজ্ঞানী। গণিত দিয়ে বিশ্বকে বাঁধতে চাওয়াটা তাঁর বরাবরেরই, কিন্তু ক্রমেই শুকিয়ে এসেছে স্নায়ু আর পেশি, শিকেয় উঠেছে নিজের হাতে অঙ্ক কষা। গবেষণাপত্র লেখা বা টাইপ করা হয়ে উঠেছে উত্তরোত্তর অসম্ভব। হুইলচেয়ারে কোনওদিনই উঠতে চায়নি সে, হাতের ওপর ভর দিয়ে তাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে যেতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছে জীবনসঙ্গিনী জেন-এর। মানে ওভাবে যতদিন পারা যায় আর কী!
সেই তেইশ বছর বয়েসেই তো ডাক্তারেরা বলে দিয়েছিলেন, দুরারোগ্য ‘মোটর নিউরোন ডিজিস’-এ আক্রান্ত হয়েছেন তিনি, বাঁচবেন আর মেরেকেটে বছর দুয়েক। পরের যেটুকু বাঁচা, সবটাই তাই ফাউ। রোগাক্রান্ত হওয়ার পরপরই শরীর নাড়ানো আর কথা বলার ক্ষমতা সীমিত হয়ে এল। ধরে ধরে হাঁটাতে হত, ঘড়ঘড়ে স্বরে কথা যা বেরোতো তা খুব কাছের লোকজন ছাড়া অন্যের পক্ষে বোঝা কঠিন হচ্ছিল। তাও, তবু তো ছিল কিছু।
কিন্তু, উনিশশো পঁচাশি সালে প্রবল নিউমোনিয়া-সংক্রমণ থেকে বাঁচতে অপারেশন হল শ্বাসনালীতে, তারপর শুধুই নিস্তব্ধতা। বিভিন্ন উচ্চ-প্রযুক্তির গবেষণা সংস্থা এগিয়ে এল বিজ্ঞানীকে কথা বলাতে। মোটরচালিত হুইলচেয়ারে পাকাপাকিভাবে আসীন হলেন তিনি, যার সাথে লাগানো আছে কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত ‘ভয়েস সিন্থেসাইজার’ বা কথকযন্ত্র। একটিমাত্র আঙুল তিনি নাড়াতে পারেন, আর তা দিয়েই সুইচ টিপে টিপে রচনা করেন বাক্য, রচনা সম্পুর্ণ হলে যন্ত্র তা উচ্চারণ করে দেয়। তারপর একদিন এল সেই দিন, যখন ওই একটিমাত্র আঙুলও আর চলে না। তখন চশমার ডাঁটিতে বসল সরু কাঠির মত যন্ত্র, যা তাঁর গালের ওপরে ফেলতে থাকে অবলোহিত রশ্মি। গালটা তিনি এখনও একটু নাড়াতে পারেন। তাঁর সামনে টাঙিয়ে রাখা কম্পিউটরের পর্দায় ভেসে ওঠে সম্ভাব্য নানা শব্দ। পছন্দের শব্দটি দেখলেই তিনি গাল নাড়িয়ে দেন, আর সেটা করলেই অবলোহিত-সংকেত গিয়ে পৌঁছোয় কম্পিউটারে, যন্ত্র বুঝে নেয় তাঁর পছন্দের শব্দটি। এভাবে অতি ধীরে ধীরে শব্দ সাজিয়ে সাজিয়ে গোটা বাক্য তৈরি হলেই কথকযন্ত্র তা উচ্চারণ করে দেয় মার্কিন ভঙ্গিমায়, যদিও তিনি মার্কিনী নন, ব্রিটিশ। ডাক্তারি ভবিষ্যদ্বাণীকে নস্যাৎ করে পাওয়া আধ শতাব্দীর ‘ফাউ’ জীবনকালে তিনি হুইলচেয়ারে বসে নিশ্চুপে ধ্যান করেন সসীম কিন্তু কিনারহীন ঈশ্বরবর্জিত ব্রহ্মাণ্ডের, চোখ বুজলেই দেখতে পান অকল্পনীয় অনীহার সাথে উবে যেতে থাকা কৃষ্ণগহ্বরদের। স্থান-কাল-বস্তুর অন্তর্নিহিত জ্যামিতি জীবিত হয়ে ওঠে তাঁর নিঃশব্দ কল্পনার সাহচর্যে। অসাড় দেহকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে প্রকাশিত হতে থাকে অমোঘ সব গবেষণাপত্র আর গ্রন্থাবলী। শুধু সতীর্থ বিজ্ঞানীদের জন্য নয়, সাধারণ অনুসন্ধিৎসুদের জন্যও।
হকিং-এর পূর্বসূরী, আধুনিক পদার্থবিদ্যার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গ্যালিলিও বলতেন, গণিত হল প্রকৃতির নিজস্ব ভাষা। তাই, প্রকৃতির চালচলন সবচেয়ে ভাল প্রকাশ করতে পারে গণিতই। অন্য সব বিজ্ঞানের থেকে এ কথাকে সবচেয়ে বেশি মান্য করেছে পদার্থবিজ্ঞান। নিউটন-ম্যাক্সওয়েল-আইনস্টাইন-বোর-হাইজেনবার্গ-ডিরাক হয়ে ভাইনবার্গ-পেনরোজ-হকিং পর্যন্ত সে ট্রাডিশন সমানেই চলেছে। তবে, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় শুধু ছাড়পত্র পায় সেটুকুই, যা নাকি অভিজ্ঞতা অথবা গণিতের দ্বারা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত। অথচ মহৎ বিজ্ঞানী সবসময় শুধু তাতেই সন্তুষ্ট হন না, যা প্রমাণিত তা নিয়েও তিনি তুলতে চান কূট প্রশ্ন। সে প্রশ্ন হয়ত তাঁকে সাময়িকভাবে টেনে নিয়ে যায় দর্শনের আঙিনায়, প্ররোচিত করে প্রতিষ্ঠিত ধ্যানধারণার ভিত্তিগুলোকে আবার খুঁটিয়ে দেখতে, আরেকবার যাচাই করে নিতে। আপাতভাবে বিজ্ঞান-বহির্ভূত প্রশ্ন এভাবেই ঢুকে পড়ে বিজ্ঞানের কেন্দ্রে, তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় অজানার দিকে। ঠিক তেমনই কিছু প্রশ্ন তুলেছিলেন হকিং-ও। তাঁর কোটি কপি বিক্রি হওয়া বই ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’-এ মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ঐতিহাসিক অগ্রগতির উত্তেজক বর্ণনা দেবার পর বইয়ের শেষ অধ্যায়ে তিনি জিজ্ঞেস করেন, ধরা যাক মহাবিশ্বের সমস্ত কিছু তথ্যকে ধারণ করতে পারে এমন এক সর্বব্যাপী গাণিতিক তত্ত্ব শেষ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হল। কিন্তু, গাণিতিক তত্ত্ব তো নিছকই এক বর্ণনামূলক হাতিয়ার, সে কি নিজেই নিজের অস্তিত্বের ব্যাখ্যা হতে পারে? ওইসব গাণিতিক নিয়ম মানবার জন্য একটি আস্ত ব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব আদৌ থাকবে কেন, সে প্রশ্নের উত্তর কী ওতে থাকবে? গণিতের বায়বীয় ফর্মুলাগুলো কীভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে?
“What is it that breathes fire into the equations”
সমীকরণে আগুন ফোঁকে কীসে? প্রথম দর্শনে মনে হয়, হকিং বুঝি বিজ্ঞানের অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতার দিকে ইঙ্গিত করে কোনও এক মিস্টিক বা ঐশ্বরিক অবস্থান নিতে চাইছেন। এমনকী, ওই বইয়েই তাঁর বিখ্যাত ঘোষণা – সে তত্ত্ব তাঁকে সন্ধান দেবে ঈশ্বরের মনের (‘দ্য মাইন্ড অফ গড’) – এ সন্দেহকে আরও দৃঢ় করে তুলতে পারে। এ ইঙ্গিত নিয়ে সে সময় হইচই-ও হয়েছিল খুব, যা হয়তো বইটির বিক্রি বাড়াবার কাজে প্রভূত সাহায্যও করে থাকতে পারে। কিন্তু, বইটির প্রথম সংস্করণের মুখবন্ধে আরেক স্বনামধন্য বিজ্ঞানী কার্ল স্যাগান জল ঢেলে দিয়েছিলেন সে সম্ভাবনায়। অননুকরণীয় ভঙ্গিতে তিনি বলেছিলেন,
“এ বই ঈশ্বর সম্পর্কে … কিংবা হয়তো ঈশ্বরের অনস্তিত্ব সম্পর্কে”।
কেন অনস্তিত্ব সম্পর্কে, সেটা বুঝতে গেলে বইটা খুঁটিয়ে পড়তে হবে, জানতে হবে হকিং-এর কাজের মর্মবস্তু। আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব দিয়ে মহাবিশ্বের যে সমস্ত গাণিতিক সমীকরণ বানিয়েছিলেন, সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গিয়েছিল, তা থেকে এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে – মহাবিশ্বের শুরুতে থাকবে স্থান-কাল-বস্তুর এমন এক অসীম ঘনত্বসম্পন্ন বিন্দু যেখানে বিজ্ঞানের নিয়ম-কানুন কাজ করবে না, ফলে বিশ্বসৃষ্টির প্রক্রিয়া পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক যুক্তির আওতায় থাকবে না (যে বিন্দুকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় বলা হয় ‘সিঙ্গুলারিটি’)। কাজেই, বিশ্বসৃষ্টিতে ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ দাবি করার অল্প একটু জায়গা ঈশ্বরবিশ্বাসীর জন্য ফাঁকা পড়ে থাকবে। হকিং তাঁর প্রথমদিকের গবেষণায় সেরকম দেখতে পেলেও পরে রজার পেনরোজের সঙ্গে যৌথ গবেষণায় দেখান, মহাবিশ্ব সৃষ্টির একেবারে গোড়ায় অতিসূক্ষ্ম আয়তনের কারণে শুধু সাধারণ আপেক্ষিকতা নয়, কোয়ান্টাম তত্ত্বের নিয়মকানুনও একইসঙ্গে সক্রিয় হয়ে উঠবে, এবং সেটা হিসেবে ধরলে আর ‘সিঙ্গুলারিটি’ র উদ্ভব ঘটার কথা নয়। অর্থাৎ, সেক্ষেত্রে বিশ্বসৃষ্টির গোড়ায় আর কোনও অযৌক্তিকতা থাকছে না, এবং ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপের জন্যও আর কোনও জায়গা ফাঁকা পড়ে থাকছে না। ফলে ঈশ্বর হয়ে পড়ছেন সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু তাহলে, হকিং ওই বইয়ে ওভাবে ‘মাইন্ড অফ গড’ জেনে ফেলার কথা তুললেন কেন? নিছকই বইয়ের বিক্রি বাড়ানোর জন্যে? সুখের বিষয়, এখন আর আমাদের সে নিয়ে আকাশপাতাল ভাবার দরকার নেই, কারণ জীবনের সায়াহ্ণে এসে এক সাক্ষাৎকারে তিনি সে প্রশ্নের পরিষ্কার জবাব দিয়ে গেছেন। ২০১৪ সালে ‘এল মুন্দো’ পত্রিকাকে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারে তিনি যা বলেন তার বাংলা তর্জমা এরকম হবে,
“ঈশ্বরের মন জেনে ফেলার কথা বলে আমি যা বোঝাতে চেয়েছিলাম তা এই যে, ঈশ্বর যদি থাকতেন, তো তিনি যা যা জানতে পারতেন আমরা তার সবই জানতে পারব [ওই তত্ত্ব আবিষ্কার করলে]। তবে, ঈশ্বর তো নেই। আমি একজন নাস্তিক।”
বলা বাহুল্য, এর মধ্যে অজ্ঞতাগর্বী ভক্তির বিন্দুমাত্র প্রকাশ নেই, আছে শুধু এক আপাদমস্তক বিজ্ঞানীর বৌদ্ধিক ঔদ্ধত্য ও আশাবাদ।
অবশ্য, আরও কঠিন প্রশ্ন থেকে যায় এর পরেও। বোধবুদ্ধি-অতিক্রমী কোনও মিস্টিক বা ঐশ্বরিক ইঙ্গিত যদি তিনি না-ই করে থাকেন, তবে তাঁর ওই অদ্ভুত প্রশ্নটির অর্থ কী?
“What is it that breathes fire into the equations”
সমীকরণে আগুন ফোঁকে কীসে?
এ প্রশ্নের নিরীশ্বরবাদী অর্থ তবে কী হতে পারে? একটু তলিয়ে ভাবলে বোঝা যাবে, অর্থ অবশ্যই হতে পারে, এবং হয়ত শুধু নিরীশ্বরবাদী অর্থই হতে পারে। আসলে, আমাদের জানাচেনা বিজ্ঞানে আমরা বর্ণনা দেবার চেষ্টা করি প্রকৃতির নানা জটিল ও বিচিত্র চালচলনের, তারমধ্যে খোঁজার চেষ্টা করি নানা নকশা আর নিয়মিতি, সেটা পাওয়া গেলে তাকে বলি ‘জগতের নিয়ম’ বা ‘বস্তুর ধর্ম’। আর ওইভাবে বর্ণনাটা একবার ঠিকঠাক দেওয়া গেলে আসে ব্যাখ্যার প্রশ্ন, ‘কেন ওইরকম চালচলন’ সেই প্রশ্ন।
কীভাবে হবে সে ব্যাখ্যা? কেন, এক ধর্মের ব্যাখ্যা হবে আগে থেকে জানা আরেক ধর্ম দিয়ে, ওটা হলে এটা না হয়েই পারেনা এই রকম যুক্তিতর্ক দিয়ে। যেমন, গ্রহ-নক্ষত্র কীভাবে চলাফেরা করে সে ব্যাপারে হাজার হাজার বছরের পর্যবেক্ষণ থেকে নানা সংশোধনের মধ্যে দিয়ে খাড়া হল উপবৃত্তাকার জ্যামিতির তত্ত্ব, আর সে গতিপথ কেন উপবৃত্তাকারই হতে হবে তার ব্যাখ্যা হল বস্তুর মাধ্যাকর্ষণ ধর্ম দিয়ে। অবশ্য, যে ধর্মকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে তারচেয়ে, অন্য যে ধর্মটি দিয়ে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে তাকে, বেশি গভীর ও মৌলিক হতে হবে। যেমন, মাধ্যাকর্ষণ ধর্মটি গ্রহের উপবৃত্তাকার গতিপথের ধর্মের চেয়ে বেশি মৌলিক। ঠিক সেইরকম, সমাজজীবনে আমাদের আচরণকে আমরা ব্যাখ্যা করি ব্যক্তির মনস্তত্ত্ব দিয়ে, ব্যক্তি-মনকে ব্যাখ্যা করি স্নায়ুবিজ্ঞান দিয়ে, স্নায়ু-প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা করি কোষতত্ত্ব দিয়ে, কোষের ক্রিয়াকলাপের ব্যাখ্যা দিই রসায়ন দিয়ে, রসায়নের ব্যাখ্যা দিই আণবিক পদার্থবিদ্যা দিয়ে, আর আণবিক পদার্থবিদ্যার ব্যাখ্যা দিই আরও ছোট মাপের পদার্থকণার কোয়ান্টাম ধর্ম দিয়ে। প্রত্যেকটিই তার আগেরটির উপাদানস্বরূপ, এবং সেইহেতু তার চেয়ে বেশি মৌলিক। এইভাবে বস্তুর নিম্নতর সংগঠনের ধর্ম দিয়ে উচ্চতর সংগঠনের ধর্মের ব্যাখ্যা দেওয়ার পদ্ধতিকে বলে ‘রিডাকশনিজ্ম্’, বাংলায় হয়তো চলতে পারে ‘পর্যবসনবাদ’, অর্থাৎ এক ধর্মকে আরেক ধর্মে ‘রিডিউস’ বা পর্যবসিত করার রীতিনীতি। এ পদ্ধতির সাফল্য বিরাট, যদিও সে সাফল্যের সীমা নিয়ে জোরালো সব কূটপ্রশ্নও আছে, এবং এখানে সেসব প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আমাদের বরং এখুনি যেতে হবে অন্য আরেক কূট প্রশ্নে। বস্তুধর্মের ব্যাখ্যা দিতে দিতে যতই গভীরে যাই না কেন, শেষতম (বা গভীরতম বা মৌলিকতম ইত্যাদি) যে ধর্মে গিয়ে ঠেক খেতে হবে সেও তো নিছক একটা ধর্মই, কোনও একটা গাণিতিক সূত্রেই তার প্রকাশ। কিন্তু, যেমনটি গণিতজ্ঞ ইউজিন হ্বিগনার তার ‘দি আনরিজনেব্ল্ এফেক্টিভনেস অফ ম্যাথমেটিক্স’ প্রবন্ধে এক অদ্ভুত হতাশামাখা কৌতুহলের সাথে লক্ষ করেছেন, গণিত জিনিসটি বিজ্ঞানে বড্ডই কাজে লাগে বটে, কিন্তু আসলে তার সাথে পদার্থের কোনও অনিবার্য সম্পর্ক নেই, অন্তত এখনও পর্যন্ত তেমন কিছু জানা যায়নি।
বস্তুর অস্তিত্ব কোথায় সেটা আমরা আঙুল (বা যন্ত্র) দিয়ে দেখাতে পারি, কিন্তু সংখ্যা বা যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ কোথায় রয়েছে সেটা ওভাবে দেখানো যায় না। একটি ল্যাংড়া আম বা একটি লোককে দেখানো যায়, ‘এক’ সংখ্যাটিকে নয়। যে ‘পাই’ সংখ্যাটি আসে বৃত্তের পরিধি মাপতে, সে-ই আবার গণিতের অমোঘ আভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ায় চলে আসে কোয়ান্টামতত্ত্ব আর জনসংখ্যাতত্ত্বের মত সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন বিভিন্ন ক্ষেত্রেও, কেন কীভাবে আসে তার বাস্তব তাৎপর্য সবসময় বোঝা যায় না।
ফলত যেটা দাঁড়ায় তার মোদ্দা কথাটা এই যে, বিজ্ঞানের কার্যকারণ-অনুসন্ধান শেষকালে গিয়ে ঠেক খায় বস্তুর মৌলিকতম ধর্মে, যাকে গণিত দিয়ে শুধু বর্ণনাই করা যায়, তার অস্তিত্বের ব্যাখ্যা করা যায়না। যস্যার্থ, মহাবিশ্বের সব জানা কথাকে ধারণ করতে পারে এরকম একটিমাত্র চূড়ান্ত গাণিতিক সূত্র যদি পাওয়াও যায় (বহু-আকাঙ্খিত সেই ‘থিওরি অফ এভরিথিং’), তো সেটা কিন্তু তখনও স্রেফ এ জগতের বর্ণনা হয়েই থাকবে, নিজেই নিজের অস্তিত্বের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবে না।
আর তখনই হকিং তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবেন, ওই সূত্র মেনে চলার জন্য আদৌ একটা আস্ত মহাবিশ্ব থাকবে কেন হে? অস্তিত্বের ঝঞ্ঝাটটুকু সে নিতে যাবে কেন? ধারণার জগতে বাস করা গাণিতিক সংখ্যা আর প্রক্রিয়াগুলো বাস্তব জগতের মধ্যে মূর্ত আর জীবন্ত হয়ে ওঠে কীভাবে –
“What is it that breathes fire into the equations”
সমীকরণে আগুন ফোঁকে কীসে? হকিং দুঃখ করেছিলেন, এসব নিয়ে তো বিজ্ঞানীদের চেয়েও বেশি ভাবার কথা দার্শনিকদের, কিন্তু তাঁরা কেউই যে আধুনিক বিজ্ঞান বোঝেন না! অ্যারিস্টটল আর কান্টের মত ক্লাসিক দার্শনিকেরা নিজেদের সমসাময়িক বিজ্ঞানটা ভাল করে পড়তেন ও বুঝতেন। কিন্তু আজকের বিজ্ঞান হয়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর গণিতনির্ভর, তাই দার্শনিকরা তা বুঝতে পারছেন না, এবং হ্বিটগেনস্টাইনের মতো দার্শনিক ঘোষণা করে দিচ্ছেন, দার্শনিকদের কাজ নাকী শুধুই ভাষার বিশ্লেষণ!
এক অর্থে হকিং-এর এ জিজ্ঞাসা হল আইনস্টাইনের সেই বিখ্যাত প্রশ্নের যৌক্তিক সম্প্রসারণ মাত্র, যে প্রশ্ন তিনি করেছিলেন তাঁর সহকারী আর্নস্ট স্ত্রস’কে –
“আমি দেখতে চাই যে ঈশ্বর ইচ্ছে করলে এ জগতকে অন্যভাবে বানাতে পারতেন কীনা” ।
বিশ্বাসীজন ভেবে দেখলে হতাশ হবেন, এর ভেতরে যতই ঐশ্বরিক ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে বলে মনে হোক, আসলে তা স্রেফ মরীচিকা। ব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্বের কারণ হিসেবে যদি ঈশ্বরকে মেনে নেওয়া হয় তাতে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না, কারণ তখন ঠিক ওই একইভাবে ঈশ্বরের কারণ নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। আর ঈশ্বরকে স্বয়ম্ভূ ঘোষণা করে যদি এ প্রশ্নকে ধামাচাপা দেওয়া হয় তো তার ফল হবে বিপজ্জনক। কারণ, স্বয়ম্ভূ-ই যদি ঘোষণা করতে হয় তো সরাসরি ব্রহ্মাণ্ডকেই তা ঘোষণা করা উচিত, ঈশ্বর ভদ্রলোককে আবার মাঝখান থেকে ডেকে আনা কেন? কিন্তু তবে, এর নিরীশ্বরবাদী সমাধানটিই বা কী? সত্যি বলতে কী, সেটা এখনও কেউই জানেন না। হকিং প্রশ্ন করেছেন,
“Is the unified theory so compelling that it brings about its own existence?”
অর্থাৎ, ইউনিফায়েড থিওরিকে যদি নিজের অস্তিত্ব নিজেই জাহির করতে হয়, তো তাকে যথেষ্ট ‘কম্পেলিং’ হতে হবে। ‘কম্পেলিং’ বলতে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন তিনি? অনিবার্য? অমোঘ? সে তত্ত্বের মধ্যেকার এমন কোনও গুণ, যার ফলে বোঝা যাবে যে অস্তিত্ব থাকতেই হত, এবং তাকে যেমনটি দেখছি ঠিক তেমনটিই হতে হতো, তা না হয়েই পারতো না? কিন্তু, বিমূর্ত বায়বীয় গাণিতিক সূত্রাবলীতে কীভাবে সঞ্চারিত হবে সে গুণ? ভবিষ্যতে কোনওদিন কী একবিন্দুতে এসে মিলবে সংখ্যা ও বস্তুর অস্তিত্ব? আবিষ্কৃত হবে কী এমন কোনও স্বয়ংসত্তাবান গাণিতিক রাশি বা প্রক্রিয়া, যা নাকী ধারণ করতে পারে অস্তিত্ব ও বিকাশের মৌলিকতম টানাপোড়েনগুলো, এবং সেইহেতু পরিষ্কার বোঝা যায় যে তারা কেন বিজ্ঞানে ‘কাজে লাগে’? কীভাবেই বা আবিষ্কার হবে সে স্বয়ংসত্তাবান গণিত? কোনও প্রতিভাবান পদার্থবিদ কী অস্তিত্ব-রহস্যের সমাধান করার জন্য নিজেই নিজের নতুন গণিত সৃষ্টি করে নেবেন, যেমন নিউটন সৃষ্টি করেছিলেন ক্যালকুলাস, বা পল ডির্যাক বানিয়ে নিয়েছিলেন ‘ডেল্টা ফাংশন’? অথবা, কেজোমিকে ঘৃণা করা কোনও এক অপাপবিদ্ধ গণিত-শিল্পী স্রেফ নিজের খেয়ালে বানিয়ে তুলবেন সে গণিত, যাতে কোনও অপেক্ষমাণ প্রকৃতিবিজ্ঞানী তা লুফে নিতে পারেন, যেমনটি আইনস্টাইন লুফে নিয়েছিলেন রীমানের জ্যামিতি?
সুকুমার রায় তাঁর অননুকরণীয় অমোঘ সহজতায় উচ্চারণ করেছিলেন,
“বলছিলাম কি, বস্তুপিণ্ড সূক্ষ্ম হতে স্থূলেতে, অর্থাৎ কিনা লাগছে ঠেলা পঞ্চভূতের মূলেতে”।
স্থান-কাল-বস্তুর শেষ সত্যের খোঁজে কোনও এক অতিবৃহৎ বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রের স্তরে গিয়ে কি ঠেলা লাগবে পঞ্চভূতের মূলেতে? সে প্রশ্নের ব্যাটন আইনস্টাইনের হাত থেকে নিয়ে অশক্ত শরীরে তীব্র মানসিক শক্তি সঞ্চার করে আধ শতাব্দী ধরে প্রাণপণ ছুটেছেন হকিং। গত চোদ্দই মার্চ তিনি তা ছেড়ে গেলেন, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য।
তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদ করেছেন, ইরাক আগ্রাসনের নিন্দা করেছেন, ইজরায়েলে অনুষ্ঠিতব্য হাই-প্রোফাইল বিজ্ঞানী-সম্মেলন বয়কট করেছেন, পরমাণু বোমার বিরোধিতা করেছেন, স্টেম সেল গবেষণা ও সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়েছেন। বরাবর ছিলেন লেবার পার্টির সমর্থক, ঘৃণা করতেন রক্ষণশীলদের। মোটরচালিত হুইলচেয়ার নিয়ে কেরামতি দেখানোর উছিলায় ইচ্ছে করে চাকা দিয়ে মাড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রিন্স চার্লসের পা। প্রকাশ্যে আফশোসও করেছেন, মার্গারেট থ্যাচারকে ওইভাবে মাড়িয়ে দেবার সুযোগ পাননি বলে। অসুস্থ, নিশ্চল, অথচ প্রচণ্ডভাবে জিজীবিষু সেলিব্রিটি স্বামীর সেবা করতে করতে তাঁর জীবনসঙ্গিনী জেন একসময় নিজেকে তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর বলে ভাবতে থাকেন, মুক্তি খোঁজেন এক সঙ্গীতজ্ঞের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নির্মাণে। হকিং তা অনুমোদন করেন, এবং বলেন, আমাকেও ভালবেসো কিন্তু। তবু শেষে ছিন্ন হয় সম্পর্ক, পাকাপাকিভাবেই ডিভোর্স হয়ে যায়। হকিং বিয়ে করেন তাঁর নার্স এলেইন মেসন-কে। কানাঘুষো শোনা যায় শারীরিক নির্যাতনের। হকিং-য়ের কখনও কব্জিতে চিড়, কখনও হাত ভাঙা, ঠোঁট ফাটা, গালে কাটা দাগ। পুলিশের কানে যেতে শুরু হয় তদন্ত, কিন্তু হকিং সমস্ত অভিযোগ বাতিল করেন, বলেন, ওর ভালবাসাতেই তো বেঁচে আছি। চোদ্দই মার্চ এক শোকবার্তায় তাঁর পুত্র-কন্যারা জানান, তাঁদের আদরের বাবা একদা বলেছিলেন, সে ব্রহ্মাণ্ড কীসের ব্রহ্মাণ্ড, যে ব্রহ্মাণ্ডে আমার ভালবাসার লোকের ঘর নেই!
মানুষের জীবনের সমীকরণে আগুন ফোঁকে কীসে? সেও বুঝি সেই আজও-অধরা স্বয়ংসত্তাবান গণিত!