০
৮০৯ বার পঠিত
ফেসবুক নিউজফিডে সেদিন সামনে এলো বন্ধু অপর্ণা খানের পোস্ট৷ তাঁর বড় ভাবি অসুস্থ, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। তাড়াতাড়িতে কেবল লাইক দিয়েই চলে গিয়েছিলাম। পরে তাঁকে ফোন করে যখন সবটা জানলাম আক্ষরিক অর্থে ভয়ে যেন জমে গেলাম৷
অপর্ণার বড় ভাবি রানু, ঝকঝকে উজ্জ্বল গৃহিণী। হঠাৎই টের পেলেন তাঁর বাম স্তনে একটা চাকা মতোন৷ তড়িঘড়ি ডাক্তার দেখিয়ে জানলেন স্তন ক্যান্সার। তখনই থার্ড স্টেজ। অপারেশন হলো , বাদ গেলো একটা স্তন। এরপরে কেমো চললো। বেশ ভালো ছিলেন কিন্তু কিছুদিন পরে আবারো গলার কাছ থেকে ত্বক লালচে হয়ে গেলো। এখন একেবারেই বিছানায়, নিজের কাজও করতে অক্ষম। তাঁর নিজের সাজানো সংসারে নিজের শরীরটাই যেন বড় অচেনা এখন তার।
একা কেবল রানু নন, বিশ্বে প্রত্যেক বছর আট জন নারী আক্রান্ত হচ্ছেন এই মরণব্যাধিতে আর প্রতি ছত্রিশজনে একজন মারা যান গড়ে প্রতি বছর।
দেশে প্রতি ১ লক্ষ জন মহিলার মাঝে ২১.৪ জন মহিলা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। সংখ্যাটা নেহাত কম মনে হলে, আরেকটু বোধগম্য করে দিচ্ছি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি, এবং তার মধ্যে অর্ধেকই মহিলা। অর্থাৎ, প্রায় সাড়ে ৮ কোটি। সে হিসেবে প্রায় ১৮ হাজারের বেশী নারী প্রতি বছর নতুন করে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। বর্তমানে বাংলাদেশে নারীদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পরিসংখ্যানে স্তন ক্যান্সারের শতাংশ ২৬%, অপরদিকে জরায়ুর ক্যান্সারের শতাংশ হলো ২১%। অথচ, সামাজিক এক অদ্ভুত ট্যাবুর কারণে আমাদের সমাজে এই মারাত্মক রোগসমূহ নিয়ে কোনো কথা নেই, নেই কোনো প্রতিরোধের ব্যবস্থা। যেনো স্তন নিয়ে, জরায়ু নিয়ে কথা বললেই সম্মান শেষ হয়ে যায়। যেনো সমস্ত শরীরের শুধু স্তন আর জরায়ুতেই জমা আছে সব সম্মান! জরায়ু ক্যান্সারের ভয়াল থাবা থেকে নারীদের বাঁচাতে উদ্ভাবিত হয়েছে টীকা৷ পনেরো থেকে পঁয়তাল্লিশ বছরের নারীরা টীকা নিয়ে নিজেদের সুরক্ষিত করতে পারেন। স্তন ক্যানসার হলে চীকিৎসা আছে আর বাঁচার হারও যথেষ্ট। আক্রান্ত রোগী নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে চিকিৎসা নিয়ে পাঁচ থেকে দশ বছর পর্যন্ত সুস্থ জীবন লাভ করেন।
স্তন ক্যান্সার মানে হলো স্তন কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। যা বহু কারণেই ঘটতে পারে। এর মধ্যে ভুল সাইজের ব্রা পরা একটি। আমরা বহুজনেই জানি না আমাদের সঠিক কাপ সাইজ৷ জানি না সঠিন মাপ। স্তনের কাপ সঠিক কাপ সাইজ থেকে ঢিলা ব্রা পরলে টিস্যু সাপোর্ট পায় না আবার টাইট পরলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্তন গ্রন্থির পাশে অবস্থিত লসিকা গ্রন্থি, বাড়ে ক্যানসারের ঝুঁকি।
সবসময় ব্রা পরে থাকলে ঘাম জমে, কেবল দুর্গন্ধ না এতেও ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। সঠিক ব্রা ব্যবহার যেমন স্তনকে সুডৌল দেখায় তেমনি ভুল ব্রা বাড়াচ্ছে ঝুঁকি৷ এসব জরুরি কথা মাথায় রেখে তেরো অক্টোবর পালিত হয় নো ব্রা ডে৷ জানা জরুরি যে রাতে ঘুমাবার সময় কোনো অবস্থাতেই ব্রা বা টাইট কোনো পোশাক পরা যাবে না৷ স্তন ক্যানসার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করাই নো ব্রা ডের উদ্দেশ্য, এটা ফাজলামি করার কোনো বিষয় না। তবে জানা কথা যেসব পুরুষ নারীর স্তন শব্দটির প্রতি সংবেদনশীল, শব্দটি উচ্চারিত হলেই তাড়না প্রবল হয় তারা এরকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকেও হালকা করতে পিছপা হন না। তারা বোঝে না স্তন শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্ল্যান্ড বা গ্রন্থি সেক্স অর্গান না৷
যাহোক এখন প্রশ্ন হচ্ছে স্তন ক্যান্সার থেকে কি আমরা বাঁচতে পারি? পারি, আর সেই চেষ্টার জন্য রয়েছে কিছু ধাপ। আমি খুব করে চাইবো, আমাদের মায়েরা, আমাদের মেয়েরা প্রত্যেকে নিয়ম মেনে এই ধাপগুলো পালন করবেন। বিশ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে মাসিকের দিনগুলোতে নিজে নিজের স্তন পরীক্ষা করবেন৷ স্নানের সময় খেয়াল করবেন স্তনে কোনো অস্বাভাবিক আকৃতির ঢেলা হাতে লাগে কীনা৷ স্তনের আকারে কোনো পরিবর্তন আছে কীনা বা স্তনবৃন্তে কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কীনা৷ ত্রিশ বছরের মধ্যে প্রথম সন্তানের জন্ম দেয়া জরুরি। অবিবাহিত ও সন্তানহীনা নারীরা ন্তন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকিতে আছেন।
দেখা গেছে দেরী করে সন্তানের জন্মও স্তনক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
মেনোপজের পরে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে৷
আবার সেইসব মেয়ে যারা দেরীতে বাচ্চার জন্ম দিয়েছেন বা বাচ্চাকে স্তন্য পান করান নি তাদের ঝুঁকি বেশী।
যেসব মেয়েদের পরিবারে স্তন ক্যান্সারের ইতিহাস আছে তারাও ঝুঁকিতে আছেন।
খেয়াল করুন যেসব নারীর দেরী করে পিরিয়ড শুরু হচ্ছে আর তাড়াতাড়ি মেনোপজ, তারা সতর্ক হোন। আবার যাদের পঞ্চাশের পরেও মাসিক চালু তারা সতর্ক হোন। দেখা যায় যাদের দেরী করে মেনোপজ হচ্ছে তাদের আরো বহু রোগের মতো স্তন ক্যান্সারের জন্য সতর্কতা বেশি দরকার।
তাই সেল্ফ ব্রেস্ট এগজামিনের মাধ্যমে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখলে তখনি ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে৷ যদিও সবক্ষেত্রেই টিউমার মানেই তা যে বিনাইন তা যেমন না আবার ম্যালিগন্যান্টও না৷ ম্যামোগ্রাফি করানো হলেই স্পষ্ট বোঝা সম্ভব টিউমারের প্রকৃতি কেমন! তাই পঞ্চাশ বছর বয়স থেকে সত্তুরের নারীদের প্রতি তিনমাস অন্তর ম্যামোগ্রাফি করানো জরুরি। অক্টোবর স্তন ক্যান্সারের জন্য সচেতনতার মাস৷ আসুন আমরা নিজেরা সচেতন হই, পরিবার ও নিজের বন্ধুদেরও সচেতন করি।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন