আমার এক অতি প্রিয় বন্ধু ছিলো সাকির। এক সময় ওর বাসায় খুব যেতাম। ওদের বাসার গেটের ভিতর একটা আধা পাগলা টাইপ কুকুর ছিলো। আমার ব্যাপক Cynophobia আছে। আমি কুকুর ভয় পাই। যখনই ওদের বাসায় যেতাম সঙ্গে কাউকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করতাম। বন্ধ গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে প্রায়শই আমাকে সাকির সাকির বলে চিৎকার করে ডাকতে ওদের গলির অনেকেই দেখেছে। কতবার আমি কোনও বুড়া মহিলা বা ছোট্ট বাচ্চার পিছনে পিছনে বুকের ভিতরে ধরাস ধরাস হৃদপিণ্ডের শব্দ নিয়ে ওদের বাসায় উঠেছি। কখনো কখনো সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকলে দেখতাম কুকুরটা সিঁড়ির উপর বসে আছে। আমার শরীর সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে শক্ত হয়ে যেতো। গলা শুকিয়ে যেতো। সাকির সঙ্গে থাকলে আমি সাকিরের হাত চেপে ধরতাম। সাকির হাসতে হাসতে বলতো- আরে কিচ্ছু করবো না। তুই আয়। কুকুরটা কোনও কোনও দিন শান্ত থাকতো, আবার কোনোদিন পিছন দিক থেকে প্রচণ্ড ঘেউ ঘেউ করে উঠতো। আমার তখন প্রতিবারেই ব্লাডারের উপর বেশ একটা এক্সট্রা চাপ অনুভব হতো।
ওদের বাসার দোতলার সিঁড়িতে দরজার পাশের দেয়ালে একটা অনেক বড় ছবি বাঁধাই করে টানানো ছিলো। যতবার ওই ছবিটার দিকে তাকাতাম, আমার মনটা কুকুরের প্রতি ভয় ভুলিয়ে দিয়ে প্রবল বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হতো। এমন কী কুকুরটা এসে তখন যদি আমার হাফ প্যান্টের কিনারে ওর শরীর ঘষতো তাও ওকে নিরীহ লাগতো। ওদের বাসার সেই ছবিটা ছিলো সাদাকালো। চুনা রঙের কিছু নারী-পুরুষ যেনো সিমেন্ট হয়ে আছে। তাদের জমে যাওয়া শক্ত দেহের চোখ উপড়ানো, মাথার খুলি ভাঙ্গা, কারো আবার চোখ, দুই হাত পিছনে বাঁধা। বড় বড় চারকোনা ইটের সাথে একটা ইটের ভাটার ভাঙ্গা দেয়ালের পাশে অল্প পানিতে এরা সবাই জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। সেই সাদা কালো ছবিটার উপরে লাল টকটকে অক্ষরে লেখা ছিলো-
‘তোমাদের যা বলার ছিলো, বলেছে কি তা বাংলাদেশ?’
আজ সাকিরের সাথে আর বহুদিন যোগাযোগ নেই, সেই কুকুরটাও নেই। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই- সেই বন্ধুত্ব, প্রিয় মানুষ বা ভয় কিছুই আর ফিরে ফিরে আসে না। কিন্তু এই প্রশ্নটি আমার কাছে বারবার বারবার ফিরে আসে। ‘তোমাদের যা বলার ছিলো, বলেছে কী তা বাংলাদেশ?’ হয়তো বা ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া অথবা দুঃখ-কষ্টের চেয়েও কিছু মানুষকে বৃহৎ বেদনাবোধ অনেক বেশি উদ্বেলিত করে কিংবা গভীরে নাড়া দেয়। যতবার আমি ওই লাইনটি পড়তাম ততবার আমার নিজেকেই বাংলাদেশ মনে হতো। মাথা নত হয়ে যেতো। বুকের ভিতরে কোথাও একটা অনুশোচনার মনস্তাপের চিনচিনে ব্যথা অনুভব করতাম। নিজেকে অপরাধী মনে হতো ওই ছবিটার সামনে।
আচ্ছা, বাংলার সূর্যসন্তান যত বুদ্ধিজীবীরা ১৯৭১ সালের ১৪-ই ডিসেম্বর নিহত হয়েছিলেন, কেন হয়েছিলেন? কেন তাঁরা আর বাড়ি ফিরে এলেন না? হ্যাঁ, উত্তরটা হয়তো আমরা সবাই কম বেশি জানি। তাঁরা ছিলেন সমাজের আত্মা; মুক্তবুদ্ধির, মুক্তচিন্তার মানুষ। তাঁরা রেডিক্যাল অর্থোডক্স পাকিস্তানী সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য হুমকি স্বরূপ ছিলেন। যদি এই শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক, শিল্পী, লেখক, কবি, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ারদের’কে শেষ করে ফেলা যায়, তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশের সামাজিক জীবনে একটি অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি হবে। যেই শূন্যতা আজো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। একজন জহির রায়হান, একজন শহিদুল্লাহ কায়সার, একজন আলতাফ মাহমুদ কি প্রতি দশকে জন্মান? এমন আরো কত অসংখ্য নাম। আহা রে! আমার ঘরে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’ আছে। আমি সেই বইয়ের পাতা উল্টাই, ছবিগুলো, নামগুলো, পরিচয়গুলো দেখি;- আর ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। হায়! এ আমরা কাদের’কে হারিয়েছি!
পাকিস্তান সঠিক কাজটি করেছিলো। তারা বুঝতে পেরেছিলো যদি বাংলাদেশ স্বাধীন হয় এবং এমন সব বুদ্ধিজীবীরা এই দেশের নেতৃত্ব দেন, তাহলে বাংলাদেশ অনেক দূরে যাবে। বাংলাদেশ’কে পাকিস্তানিরা কখনোই পুরোপুরি ছেড়ে দেবে এই চিন্তা তারা করেনি। তাই বুদ্ধিজীবীদের নাম ধরে ধরে হত্যার নীল নকশা বাস্তবায়ন করেছিলো। কারণ পাকিস্তান জানতো তারা আবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঠিকই ফিরে আসবে। এবং পাকিস্তানিরা পুরোপুরি এতে সফল। সেটা বর্তমান বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা দেখলেই বোঝা যায়। আমাদের এই দেশের সর্বত্র আজ পাকিস্তানী মূল্যবোধের চর্চা চলে। আমরা দেহে হয়তো স্বাধীন হয়েছি কিন্তু আমাদের চেতনায়, আমাদের মূল্যবোধে, আমাদের আত্মায় এখনো সেই পূর্ব-পাকিস্তানিই রয়ে গেছি।
যে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরা শাড়ি পড়ে, মাথায় তেল দিয়ে বেণী করে, খোপা করে, পথে নামতে পেরেছিলো। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে ট্রেনিং করেছে, মার্চ করেছে রাজপথে শাড়ি পড়ে। আজ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা পাকিস্তানিদের মতো হিজাব পড়ে। আজ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাবের ছড়াছড়ি। কোথাও কোথাও হিজাব আজ বাধ্যতামূলক। যে ৭২ এর সংবিধানের একটি মূলনীতি ছিলো ধর্মনিরপেক্ষতা, আজ সেই সংবিধানে বিসমিল্লাহ্, আজ সেই দেশ চলে মদিনা সনদে। আমি জিজ্ঞেস করি- মদিনা সনদে ইহুদী, প্যাগান, খৃষ্টানরা কী মুসলমানদের সমান মর্যাদা পেতো? সবার জন্য আইন, ট্যাক্স কী সমান ছিলো? শেখ মুজিবুর রহমান যখন দিল্লীতে ভাষণ দেন ইন্দিরা গান্ধীর সামনে, সেখানে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সেক্যুলারিজমের সাথে একমত পোষণ করে বক্তব্য দিতে গিয়ে কি ভেবেছিলেন এই দেশ একসময় মদিনা সনদে চলবে?
এই দেশে এখনো পাকিস্তানের চাঁদ তারা পতাকা ওড়ে। অথচ মাদ্রাসায় এই দেশের লাল সবুজ পতাকা ওড়ানো হয় না। জাতীয় সঙ্গীত হারাম এমন বয়ান কানে আসে। এখন ডাক্তাররা সবচেয়ে বেশি আল্লা বিল্লা করেন। শিক্ষকরা দাড়ি রেখে মোছ ফেলে দিয়ে জঙ্গি হয়ে যান। বাংলাদেশের ছাত্ররা মাশাল্লাহ আই.এস.আই.এস এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে পাকিস্তানের মতো জঙ্গি হামলা শুরু করেছে। পাকিস্তান যেদিকে গিয়েছে আমরাও সেদিকে গিয়েছি। এখন আমরা পাকিস্তানীদের মতো বিদেশেও জঙ্গি রপ্তানি করি। ঠিক যেভাবে ১৯৭১ সালে বিধর্মীদের নিধন করা হয়েছে ইসলামের নামে। ঠিক এখনো এই দেশে হিন্দুদের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে মন্দির, মূর্তি ভেঙে পাকিস্তানীদের মতো ইসলাম কায়েম করে চলছি। যেসব মুক্তচিন্তার মানুষদের নাম লিখে সিরিয়াল করে ১৯৭১ সালে হত্যা করা হয়েছে। এখনো ঠিক তেমনি কেউ নাস্তিক, ব্লগার, লেখক, মুক্তচিন্তার চর্চা করলে তাদেরকে নাম লিস্ট করে হত্যা করা হচ্ছে। পাকিস্তানের ব্লাসফেমির মতো আমরা এখন তৈরি করেছি ৫৭ ধারা।
আসলে এই বুদ্ধিজীবী হত্যা কোনও ব্যক্তি হত্যা না। এটা একটি আদর্শ’কে হত্যা করা। যে আদর্শ মানুষকে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায় আলোর দিকে, সেই আদর্শকে হত্যা করা। আজ আমাদের দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অন্ধকার। হ্যাঁ, উন্নতি কি হয়নি? অবশ্যই হয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নতি হয়েছে। সেতো স্বাভাবিক গতি। আমাদের গ্রামে যে লোক একসময় রাস্তার পাশে বসে ডিম বিক্রি করতো তারও উন্নতি হয়েছে। সে তিনতলা বাড়ি করেছে। ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছে। আমাদের মহানগরে ভিক্ষুকরাও উন্নতি করেছে, শুনতে পাই অনেক ভিক্ষুকের দুইটা তিনটা বাড়িও আছে। সরকারী দলের নেতারাও উন্নতি করেছে। চা সিগারেটের বাকীর টাকা দিতে না পারা ছেলেটাও আজ গাড়ি চালায়। উন্নতি হবে না কেন? হয়েছে। কিন্তু এটাই যে একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের উন্নতির সূচক না, সেটা বোঝার মতো উন্নতি এই দেশের কারো তেমন হয়নি।
আমরা সহিষ্ণু সমাজ গড়তে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের দেশের প্রতিটি শাখায় নিখাদ ঘৃণার চর্চা হয়। আমরা আজ পাকিস্তানের মতো মোল্লা শ্রেণীর হাতে জিম্মি একটা জাতি হয়েছি। আজ মোল্লারা বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রের সব বিষয়ে ফতোয়া দেয়। এবং সরকার ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে তাদের সাথে আপোষ করেন। একজন জঙ্গি যে তার আদর্শিক জায়গা থেকে মানুষকে হত্যা করতে চায়, তাকেও এই সরকার শাস্তি না দিয়ে অর্থ দিয়ে এই সমাজে পুনর্বাসন করতে চায়। অথচ যারা বই পড়ুয়া, লেখক, কোনও প্রথাগত ধর্ম মানেন না, নাস্তিক, দেশ প্রেমিক, যারা দেশের ঐতিহ্যকে লালন করেন, দেশকে ভালোবাসেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যাদের মৌলিক আদর্শ, সেই তাঁদেরকে এই দেশ থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে যেতে হয়। তাঁদেরকে হত্যা করা হয়। সরকারের কোনও সমবেদনা এই নাগরিকদের প্রতি নেই। তাহলে, জিয়া কী দোষটা করেছিলো জামাতকে, গোলাম আজম’দেরকে পুনর্বাসিত করে? অথচ তারা কি বদলেছিলো? সেই মাশুল কিন্তু স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে আজো টানতে হচ্ছে।
যারা এই ভাষাকে ভালোবাসেন, চর্চা করেন, তাঁরা যেনো এই দেশের সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন, আর যারা বাংলা ভাষাকে হিন্দুয়ানী ভাষা বলে, আরবি ভাষায় তাদের সন্তানের নাম রাখেন তারা এই দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। এই দেশে আজ শেখ মুজিবরের মতো একজন মহান নেতার আদর্শকে ধারণ করা মানুষের চাইতে শফি হুজুরের আদর্শকে ধারণ করা মানুষের সংখ্যা বেশি। আওয়ামীলীগেই বেশি। তাই বলি, ১৯৭১ বুদ্ধিজীবী হত্যার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সফল। আজ নারীরা মাঠে কাজ করলে ফসল নষ্ট হবে এই ফতোয়াও শুনতে হয়। এইসব সামাজিক কোন উন্নতির সূচক? মুক্তিযুদ্ধ কোন আদর্শে তবে সংঘটিত হয়েছিলো? পাকিস্তানীরা ঠিকই আমাদের আদর্শ’কে হত্যা করতে সফল হয়েছে। আমরা ওদের সাথে যুদ্ধে জিতেছি হয়তো কিন্তু আদর্শে হেরে গিয়েছি।
নিয়াজির সেই কুখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ে- “বাঙালির রক্তে পাঞ্জাবীর রক্ত মিশিয়ে তাদের জাত উন্নত করে দাও।”
অনলাইনে এই চিঠিটি পড়েছিলাম।
নিচে একটু উদ্ধৃতি দেই-
“প্রিয় বন্ধু ইকরাম (সেনা অফিসার ইকরাম),
…..বাঙালি বাঘিনীদের পোষ মানাতে হবে, যেন তাদের মাধ্যমে সন্তান উৎপাদনের মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত (বিশুদ্ধ) প্রজন্মের জন্ম হবে, যারা প্রকৃত মুসলমান ও পাকিস্তানি হবে।…..
-মেজর আফজাল খান সাকিব”
পাকিস্তানি বিগ্রেডিয়ার জেনারেল সিদ্দিকী তার ‘ইস্ট পাকিস্তানঃ দ্য এন্ড গেইম’ বইতে লে. জেনারেল নিয়াজীর একটি উক্তি উল্লেখ করেছেন,
“আপনি এরূপ আশা করতে পারেন না যে, সৈন্যরা থাকবে, যুদ্ধ করবে এবং মৃত্যুবরণ করবে পূর্ব-পাকিস্তানে আর যৌন চাহিদা নিবারণ করতে যাবে ঝিলামে।”
পাকিস্তানি সেই জেনারেল আর অফিসাররাই কী আজ তবে সফল হলো? এই বাংলাদেশের জননীরা কী তাঁদের গর্ভে পাকিস্তানিই জন্ম দিচ্ছেন?
বুদ্ধিজীবীদেরকে যখন হত্যার লিস্ট করা হয়, তখন তাঁদেরকে নাস্তিক, কাফের বলেই লিস্ট করা হয়েছিলো। আল শামস, আল বদর বাহিনীকে বুঝানো হয়েছিলো এরা ইসলামের শত্রু, এইসব নাস্তিক, কাফেরদের কারণে পূর্ব-পাকিস্তান ভারতের হিন্দুদের গোলাম হয়ে যাচ্ছে। এদের কতল করা ফরজ। আজও সেই বোধ বদলেছে কী? আজ স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও সেই ১৯৭১ সালের মতো বুদ্ধিজীবীদের বদলে ব্লগারদের হত্যার লিস্ট হয়। মুক্তি চিন্তার মানুষ তখনো এই দেশে নিরাপদ ছিলো না, আজো নেই। পাকিস্তানের আইএসআই এর ছায়া রয়েছে এই দেশেও। যারাই বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে চায়, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এখনো নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে, যারা ১৯৭১ সালের বুদ্ধিজীবীদের মতো একটি সেক্যুলার বাংলাদেশের কথা বলে, তারা আজো সেই পাকিস্তানের আল শামস, আলবদর, রাজাকার বাহিনীর ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ মানুষের কাছে মৃত্যুর হুমকি পায়।
আজ এই সরকার সেই বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ হত্যাকারীদের সমস্ত স্বপ্নই বাস্তবায়ন করে চলেছে। আমি ভাবতে পারি না, যখন বিএনপি বা জামাত আবার ক্ষমতায় আসবে তখন দেশের কী হাল হবে? প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে নাকি একবার দপ করে জ্বলে ওঠে। আমরা যারা স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করি, সেই স্বাধীনতার চেতনার শেষ ভরসা আওয়ামীলীগ কী সেটা বুঝতে পারছে না? তারা তাদের সরকারের আমলে এই দেশটাকে সেই পাকিস্তান আমলের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সেই একই ভাবে বুদ্ধিজীবীদের মতো মুক্তচিন্তার লেখকদেরকে নাস্তিক, কাফের বলে হত্যা করা হচ্ছে। বুদ্ধিজীবী’তো কোনও ব্যক্তিকে বোঝায় না। বোঝায় একটি যোগ্যতাকে, একটি উচ্চতাকে, একটি বোধ বা জ্ঞানের ধারক’কে। যে ‘জ্ঞান’ অন্ধকার সমাজে বারবার তাঁর মশালের আলো জ্বেলে পথ দেখানোর চেষ্টা করে।
আজ এই বুদ্ধিজীবী দিবসে যত সূর্য সন্তানেরা শহীদ হয়েছিলো। তাঁদের প্রতি যদি আমাদের মনে সত্যিই কোনও কৃতজ্ঞতা বা ভালোবাসা থাকে, তবে সেটার প্রকাশ হওয়া উচিত তাদের আদর্শকে পূণঃপ্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমেই। শুধুই তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে এই ঋণ শোধ হয় না। যে আদর্শের জন্য তারা নিহত হয়েছিলেন, সেই আদর্শকে নিজে ধারণ করা এবং পাকিস্তানী ভূতে আর প্রেতাত্মায় ধরা এই বাংলার সমাজে সেই আদর্শের আলো পূনঃপ্রতিষ্ঠা করা চেষ্টাই সেই ঋণ থেকে দায়মুক্তির একমাত্র পথ হতে পারে।
আমার যখন খুব মন খারাপ হয় তখন আমি বধ্যভূমিতে যাই। আমার বাবা যখন মারা গেলেন, আমি তাঁকে কবর দিয়ে সবে মাত্র ঢাকায় এসেছি। পিতা হারানোর শোক, পাশাপাশি আমি সংসার চালানোর চিন্তায় তখন হতবিহবল। খুব সামান্য বেতনে চাকুরী করি। সেইসময় দুইজন বন্ধুকে নিয়ে আমার মনেপড়ে আমি রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে গিয়ে বসে ছিলাম। ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্টের চেয়েও যেনো এই বধ্যভূমির মাটিতে, ঘাসে মিশে থাকা আমার অনেক পিতা-মাতার মৃত্যু বেদনা আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। বারবার আমার চোখ ভিজে উঠছিলো সেইসব মানুষের দীর্ঘ নিঃশ্বাসে। আমি মৃত্যুকে বরং মেনে নিতে পারি, কিন্তু আমি হত্যাকে মেনে নিতে পারি না। ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্টে অতবার আমার চোখ ভিজে ওঠেনি, যতবার না আমি বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে আমার চোখ ভিজিয়েছি, দেশাত্মবোধক গান শুনে হাপুস নয়নে কেঁদেছি।
মোহিনী চৌধুরীর লেখা একটি গান আমার অসম্ভব প্রিয়। গানটি গাইতে নিলেই গলা ধরে আসে, বুক ভার ভার লাগে, চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। হে পাঠক, যদি আমার লেখাটা এই পর্যন্ত পড়ে থাকেন। তাহলে একটা অনুরোধ- আজ এই গানটি একবার শুনুন না হয়। আমার সকল প্রিয় জিনিস সবার সাথে ভাগ করে নিতে বড় ইচ্ছে করে।
মুক্তির মন্দির সোপানতলে
কত প্রাণ হলো বলিদান,
লেখা আছে অশ্রুজলে।
কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা,
বন্দীশালার ওই শিকল ভাঙ্গা
তাঁরা কি ফিরিবে আজ সুপ্রভাতে
যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে।
যাঁরা স্বর্গগত তাঁরা এখনও জানেন
স্বর্গের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি
এসো স্বদেশ ব্রতের মহা দীক্ষা লভি
সেই মৃত্যুঞ্জয়ীদের চরণ চুমি।
যাঁরা জীর্ণ জাতির বুকে জাগালো আশা,
মৌল মলিন মুখে জোগালো ভাষা
আজি রক্ত কমলে গাঁথা মাল্যখানি
বিজয় লক্ষ্মী দেবে তাঁদেরই গলে।
ডিসেম্বর ১৬, ২০১৭; ৫:৫৭ পূর্বাহ্ন
যে যায় লংকায়, সে হয় রাবণ।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পূর্বে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং যা যা এজেন্ডা ছিল তার বিপরীত কাজ করছে। স্বাদীনতা বিরোধী জামাতে ইসলামের এজেন্ডা বাস্তবায়নেই আওয়ামী লীগ সক্রিয়। অবস্থাদৃষ্টে যা মনে হয় আওয়ামী লীগ থাকতে আর জামাতে ইসলামির কোনো প্রয়োজন নাই।
ডিসেম্বর ১৬, ২০১৭; ৯:০৩ পূর্বাহ্ন
ভালো লিখেছেন। অনেক ধন্যবাদ।