০
১৫৯৫ বার পঠিত
বাবা দিবসে এক কন্যার আকুতি দেখেছি পিতার চিকিৎসার জন্য। পরদিন জানলাম সেই পিতা নেই। কন্যার আকুতির পরিসমাপ্তি ঘটেছে নিদারুণ কষ্টে। যে কষ্ট অপার্থিব। দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলছেন, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ফৌজদারি অপরাধের সামিল। অর্থাৎ এটা এক ধরণের হত্যাকান্ড। বিচারও ফৌজদারি ধারায়। অথচ এসবের বিচার কী হচ্ছে কিংবা এই অবহেলাজনিত মৃত্যুর ন্যূনতম কোনো জবাবদিহিতা রয়েছে কিনা সেটা আলোচনার আগে কয়েকটা খবরের শিরোনাম দেখে নিই।
জার্মান খবর সংস্থা ‘ডয়চে ভেলে’র শিরোনাম, ‘দুর্নীতি খেয়ে ফেলেছে স্বাস্থ্যখাতকে’। না, জার্মানির স্বাস্থ্যখাত নিয়ে লিখেনি তারা, লিখেছে আমাদের দেশের স্বাস্থ্যখাতকে নিয়ে। ‘মানবজমিন’ বাংলাদেশে আসা চীনা চিকিৎসকদের বরাতে জানালো, ‘বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি দেখে দেখে হতাশ চীনা বিশেষজ্ঞরা’। ভয়েস অব অ্যামেরিকার একটি প্রতিবেদনে বলা হলো, ‘বাংলাদেশে করোনা সংক্রমনের পরীক্ষা ব্যবস্থা সংকুচিত করে ফেলা হচ্ছে’।
তিনটা শিরোনামকে মিলিয়ে দেখলে দেখবেন, একটা চিত্র পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। চীনা চিকিৎসকরা হতাশ বাংলাদেশের সংক্রমনের অবস্থা দেখে। অর্থাৎ বাংলাদেশের সংক্রমনের চিত্র ভয়াবহ রকমের। আর এই ভয়াবহতার মধ্যে ‘ভয়েস অব অ্যামেরিকা’র বাংলা বিভাগ বললো, পরীক্ষার ব্যবস্থা সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। মানে হলো, সংক্রমনের ভয়াবহতায় যেখানে পরীক্ষা বাড়ানোর কথা সেখানে কমছে। আর ‘ডয়চে ভেলে’ এসবের কারণটা বলে দিলো এই কথায়, দুর্নীতি স্বাস্থ্যখাতকে খেয়ে ফেলেছে। সব মিলিয়ে চিত্র পরিষ্কার না হবার কোনো কারণ নেই।
স্বাস্থ্যখাতের অবস্থা কতটা খারাপ তার বোঝা গেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির এক সদস্যের খেদোক্তি থেকে। নোয়াখালী- ৪ (সদর- সুবর্ণচর) আসনের শাসক দলের এমপি একরামুল করিম চৌধুরী সামাজিকমাধ্যমে বললেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগ একটা আজগুবি বিভাগ, এটা কে চালায়?’ তার এই ‘আজগুবি বিভাগে’র আজগুবি কায়কারবার অজানা নেই কারো। চারিদিকে মৃত্যুর মিছিল। দেশের গুণিজনেরাও সেই মিছিলে অকাতরে সামিল হচ্ছেন। চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা কেউ বাদ যাচ্ছেন না। এসব দেখেও থেমে নেই স্বাস্থ্যবিভাগের দুর্নীতিবাজরা। এরা যেনো মিসরের ‘ফারাও’ হয়ে উঠেছেন, তাদের সাথে কবরে দিয়ে দিতে হবে এসব অর্থ। মৃত্যুর পরও কালোধনে তারা মৌজ-মাস্তি করবেন! বলিহারি এসব ‘নিও-ফারাও’দের।
মৃত্যুর এমন মিছিল দেখে মানুষ যখন আতঙ্কিত। ‘মেন্টাল ডিসঅর্ডারে’ ভুগছেন কেউ কেউ। প্রতিদিন কাজে যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু বাসায় ফিরলেই জাঁকিয়ে ধরছে মৃত্যুভয়। জীবানু নিয়ে সাথে ফিরলেন কী না, নিজে কিংবা প্রিয়জনেরা সংক্রমিত হলো কী না, এমন চিন্তায় একধরণের ‘ট্রমা’র মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে মানুষ। অথচ ‘নব্য ফারও’দের সে ভয় নেই। তারা আছে টাকা কামানোর ধান্ধায়। অর্থ লোভে মানুষ নাকি পিশাচ হয়ে যায়, কথাটার সত্য-রূপ দেখতে পাচ্ছি আমরা চোখের সমুখে।
মিসরের ‘ফারাও’রা নিজেদের দেবতার বংশধর ভাবতেন। আমাদের ‘নব্য ফারাও’রা বোধহয় তাই ভাবছেন নিজেদের সম্পর্কে। সাধারণ মানুষের মৃত্যু তাদের বোধকে কোনভাবেই বিদ্ধ করছে না। এমনকি গুণিজনদের মৃত্যুও। আদালতের আদেশও তাদের বিচলিত করতে পারেনি। ‘দেবতা’রা বিচারেরও উর্ধ্বে! হয়তো এমনটাই ভাবনা তাদের। হয়তো ভাবছেন উপার্জিত ‘কালো ধন’ নিয়ে তারা পাড়ি জমাবেন তাদের কথিত স্বর্গালোক ‘সেকেন্ড হোমে’। কারণ তাদের ‘সেকেন্ড হোম’গুলো ইতোমধ্যে সফল ভাবে সামাল দিয়ে উঠেছে করোনা পরিস্থিতি। অতএব ‘ভো উড়াল’।
ইউরোপের দেশগুলি সত্যিকার অর্থেই সামলে উঠছে করোনার ভয়াবহতাকে। ধীরে ধীরে তাদের জীবন স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে। বিপরীতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি আশঙ্কার অন্ধকার টানেলে পতিত হচ্ছে। যার শেষে কোনো আলোর রেখা নেই। তার উপর রয়েছে ‘বিষ ফোঁড়া’ দুর্নীতিবাজরা।
শেষ করি শাসক দলের সেই এমপির বক্তব্য উদ্ধৃত করে, ‘একটা দেশে এ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিভাগের এ উদাসীনতা গ্রহণযোগ্য নয় এবং তা কোনো বিবেকবান মানুষ মেনে নিতে পারেন না।’ পারে কি?
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন