০
১১৭৫ বার পঠিত
কাকন রেজা :
দক্ষিণ এশিয়ার ট্রেন্ডটাই এরকম। আমাদের মুশকিল হলো, আমরা যাকে পছন্দ করতে শুরু করি তার সব দোষও আমাদের কাছে গুন হয়ে যায়। যার ফলে শিবাজী’র মতন একটা মারাঠা দস্যু, যে কিনা শতাব্দীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর মানুষ হিসেবে স্বীকৃত। মানুষের জান-মাল-ইজ্জত কিছুই তার কাছে গণ্য ছিলো না। তার চোখ ছিলো শুধু লুণ্ঠনের দিকে। সম্পদের দিকে। সেই শিবাজী রবি ঠাকুরের মতন ব্যক্তির কাছেও ত্রাতা হিসেব দেখা দিয়েছিলেন। শিবাজীকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন ‘শিবাজী বন্দনা’র মতন একটা স্তুতিকাব্য। এবং রবি ঠাকুরও আমাদের কারো কারো কাছে ঈশ্বর সমান!
অ্যাডওয়ার্ড সুলিভান তার ‘প্রিন্সেব অব ইন্ডিয়া’ বইয়ে শিবাজী চরিত্রকে উন্মোচিত করেছেন। ঐতিহাসিক সুলিভান থেকে অনুবাদকৃত একটা লাইন এখানে উল্লেখ করি। তিনি শিবাজী ও মারাঠাদের সম্পর্কে বলছেন, ‘যেখানেই তারা গিয়েছে সেখানেই কেবল ধ্বংস ও মৃত্যু রেখে এসেছে’। এরচেয়ে বেশি আর কী বলা যায়। সুলিভানের ভাষায়, শিবাজী’র ধ্বংসলীলা থেকে মন্দির থেকে শুরু করে কোন কিছুই রক্ষা পায়নি। এমন কী তারা হিন্দু ব্রাহ্মণ এবং গো-হত্যাও করেছে। তারপরেও দক্ষিণ এশিয়ার কোন অংশে শিবাজী এখনো পূজিত হয়। বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদীরা এখনো শিবাজীকে ত্রাতা মনে করে ব্রাহ্মণ ও গো-হত্যা সত্বেও।
দক্ষিণ এশিয়ার একটা শ্রেণির এই মতান্ধতা, বিশ্বাসের বর্বরতা সত্যিই বিস্ময়জনক। তারা চরম চাপাবাজকেও নেতা ও দেবতাজ্ঞানে পূজা করে। তার সকল কথাকেই বিশ্বাস করে। টাউট হয়ে ওঠে বিজ্ঞজন, বুদ্ধিজীবী। এখানে মস্তিষ্কের চেয়ে জিহ্বার গুরুত্ব প্রবল। আপনি যদি মনভোলানো কথা জানেন তবেই কেল্লা ফতে। আপনার আপার চেম্বার খালি কী না নিশ্চিত তা কেউ উঁকি দিয়ে দেখতে যাবে না।
যদি কেউ কোনো রকমে কথায় ভোলাতে পারে, তবে তাকে আর আটকানোর পথ নেই। তার চৌর্যবৃত্তি, রমণবৃত্তি, হত্যাবৃত্তি সব জায়েজ হয়ে যাবে। ঠিক শিবাজী’র মতন। যে ব্রাহ্মণ ও গো-হত্যা করেও হিন্দুত্ববাদীদের নেতা হয়ে উঠেছে। গঙ্গারাম নামে এক কবি তার কবিতায় শিবাজী ও তার বাহিনীর নারীদের উপর অত্যাচার সম্পর্কে লিখলেন, ‘একজন ছাড়ে তাতে আর জনে ধরে / রমণের ডরে ত্রাহি শব্দ করে।’ আর আমাদের গ্রামাঞ্চলে এখনো গীত হয়, ‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে’। তারপরেও শিবাজী’র কোন দোষ হয় না। এই প্রবৃত্তি হলো দাসপ্রবৃত্তি। এই চিন্তা অন্ধ আনুগত্যের। কুকুরের মতন বলতে পারেন। প্রভু চোর, ডাকাত না খুনি তাতে কিছু এসে যায় না কুকুরের। এমন মানবদের কুকুরমানবও বলা যায়। দক্ষিণ এশিয়ায় এমন কুকুরমানবের সংখ্যা নেহাতই কম নয়। ডগমাটিজম বিষয়টি এমন ধারণা থেকেই আসা। ডগমাটিকরা কুকুরদের মতই অনুগত হয়। তাদের চোখে প্রভুর কোনো দোষ চোখে পড়ে না। তারা ডাকাতের বাড়ি পাহারা দেয় চোরদের হাত থেকে রক্ষার জন্য।
মারাঠাদের রাজত্বে সাধারণ হিন্দু যাদের অস্পৃশ্য বলা হতো, তাদের হাতে পরতে হতো কালো সুতা। যাতে অস্পৃশ্যদের চিহ্নিত করা যায়। তাদের ছায়ায় মারাঠারা অপবিত্র না হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় এই ট্রেন্ডের অনুকরণটা এখনো চালু রয়েছে। এখনো ক্ষমতাধররা ক্ষমতাহীনদের অচ্ছ্যুৎ ভাবে। হাতে কালো সুতা বাঁধা বাধ্যতামূলক না হলেও নানা প্রকরণে চিহ্নিত করতে চায় তাদের। যেমন ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা দলিত, মুসলিম কিংবা কম্যুনিস্ট অভিধায় চিহ্নিত করে ক্ষমতাহীন ও বিরোধীদের। এ ধারা একেবারেই চলতি দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে।
হালসময়ে এই শিবাজী’রা ঝাঁড়েবংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। যাদের কাছে মানুষের জান-মাল-ইজ্জত কোনো কিছুই বিষয় নয়, অর্থ-সম্পদই মূল। এ নিয়ে নচিকেতার ‘হাল্লাবল’ শিরোনামে একটা চমৎকার গান রয়েছে। যে গানে দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান প্রেক্ষাপট চমৎকার ভাবে বর্ণিত হয়েছে। ভারত থেকে পাচারকৃত টাকা যে সুইসব্যাংকগুলিতে, তা চমৎকার ভাবে বলেছেন তিনি। টাকা পাচারের এই ধরণটাও হালের বেশ চলতি একটা ট্রেন্ড। শিবাজী সম্পদ লুণ্ঠন করে দেশেই রাখতেন। তবে সে সময় সুইসব্যাংকগুলি থাকলে কী করতেন তা জানার উপায় না থাকলেও, হালের শিবাজীরা সুযোগটা ছাড়ছেন না। তারা দেশ উজাড় করে বিদেশে উজাড় উড়াল দেবার আশে সুইসব্যাংকগুলির স্মরণাপন্ন হচ্ছে। অর্থাৎ দৈবাৎ যদি ঝামেলা হয় তবে সোজা ডানা মেলে দেয়া।
শেষ কথা, দক্ষিণ এশিয়ায় শিবাজী’র লুণ্ঠন নীতিই করপোরেট নীতি হয়ে উঠেছে। যে লুণ্ঠনের জন্য গুম-খুন-ধর্ষণ সব জায়েজ মনে করছে হালের শিবাজীরা। আর আমজনতাকে তারা মনে করছে অচ্ছ্যুৎ। যখনই প্রতিবাদের ভাষা শোনা যাচ্ছে তখনই তাকে নানা ট্যাগ দেয়া হচ্ছে। সেই মারাঠাদের মত, অচ্ছ্যুৎ চিহ্নিত করতে তাদের হাতে কালো সুতা বেঁধে দিচ্ছে এ সময়ের বর্গীরা। ধরণটা এ রকম, কাউকে নিধন করতে হলে, তাকে একটা খারাপ নাম দাও, তারপর নিশ্চিন্তে নিধন কর। চাণক্যের চেয়েও এগিয়ে আছে এখনকার করপোরেট চিন্তা। সাম-দাম-দণ্ড-ভেদ এই প্রক্রিয়ার সরাসরি চুড়ান্ত পর্বে চলে যায় তারা। দণ্ড দেয়, না হলে ভেদ। সাম মানে বোঝানো, দাম মানে কেনার চেষ্টা করা। এসবের ধার ধারে না হালের শিবাজী’রা সরাসরি দণ্ড দেয়। তাতেও কাজ না হলে ভেদ যার অর্থ হলো বধ, মানে শেষ করে দেয়া।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন