৩
১৩০০ বার পঠিত
“সদা-সর্বত্র বিরাজমান তন্দ্রা-নিদ্রাহীন সদা সজাগ প্রতিনিয়ত করূণা বর্ষণকারী সর্বশক্তিমান হে প্রভূ ! আমরা শূধু তোমারই মহিমা স্বরণ করি, তোমারই জয়গান গাই । প্রভূ হে ! আমাদের সর্বোত্তম আত্নিক পথে,আলোকিত পথে পরিচালনা করো । আমরা যেন সব-সময় সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকে অনূধাবন করতে পারি”।
না, এটি কোরানের সুরা ফাতিহার বঙ্গানুবাদ নয়। সুরা ফাতিহা যেমন প্রার্থনা এটিও একটি প্রার্থনা তবে এগুলো ঋগবেদ এর আয়াত। [ঋগবেদঃ ৩.৬২.১০]
হিন্দুদের মূল ধর্মগ্রন্থ হলো ‘বেদ’। এটি প্রায় শতাধিক গ্রন্থের সমষ্টি। বেদ চার ভাগে বিভক্ত যথা; (১) ঋগ্বেদ, (২) সামবেদ, (৩) যজুর্বেদ (৪) অথর্ববেদ। এই চারটি বেদের প্রতিটি আবার চারটি করে অংশে বিভক্ত। এগুলো হলো (১) সংহিতা (২) ব্রাহ্মণ (৩) আরণ্যক (৪) উপনিষদ্। ‘সংহিতা’ অংশে লিপিবদ্ধ হয়েছে ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ, বিষ্ণু, রুদ্র প্রমুখ বৈদিক দেবতার বিভিন্ন মন্ত্র ও স্তবস্তুতি। ‘ব্রাহ্মণ’ অংশে রয়েছে মন্ত্রের ব্যাখ্যা ও যাগযজ্ঞের নিয়মকানুন। ‘আরণ্যক’ অংশে রয়েছে বনবাসী তপস্বীদের যজ্ঞভিত্তিক বিভিন্ন ধ্যানের বর্ণনা। ঋক্ মন্ত্রের দ্বারা যজ্ঞে দেবতাদের আহ্বান করা হয়, যজুর্মন্ত্রের দ্বারা তাঁদের উদ্দেশে আহুতি প্রদান করা হয় এবং সামমন্ত্রের দ্বারা তাঁদের স্তুতি করা হয়।
বৈদিক মন্ত্র পড়ে ইন্দ্র,অগ্নি, বরুণ, বিষ্ণু, রুদ্র প্রমুখ দেবতাদের উপর দরুদ পড়া হয় তাদের প্রশংসা করা হয় আর দেবতাদের কাছে দোয়া করা হয় বালা মুসিবত থেকে রক্ষা করার জন্যে, শত্রুর উপর জয় লাভ করানোর জন্যে এবং প্রচুর ধন সম্পদ দান করার জন্যে। মুসলমানদের দোয়া-দরুদের কিতাবে যা কিছু আছে বেদেও তার সবটুকুই আছে। অসংখ্য দোয়া দরুদ আছে এই বেদে। তবে কি এটি শুধু দেবস্তুতি আর প্রার্থনার কিতাব? বেদের কিছু আয়াত তেলাওত করা যাক;
“হে ঈশ্বর, যারা দোষারোপ করে বেদ ও ঈশ্বরের তাদের উপর তোমার রাগ বর্ষণ কর।” (ঋগবেদ ২।২৩।৫)
“যে লোক ঈশ্বরের আরাধনা করেনা এবং যার মনে ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগ নেই,তাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে হত্যা করতে হবে।” (ঋগবেদ ১।৮৪।৮)
“গবাদিপশুগুলো কি করছে নাস্তিকদের এলাকায়, যাদের বৈদিক রীতিতে বিশ্বাস নেই? যারা সোমার সাথে দুধ মিলিয়ে উতসর্গ করে না এবং গরুর ঘি প্রদান করে যজ্ঞও করে না? ছিনিয়ে আনো তাদের ধনসম্পদ আমাদের কাছে”। (ঋগবেদ ৩।৫৩।১৪)
“কীকটবাসী [বেদের বাহিরের লোক] তাহারা গাভীর কি উপযোগ নেয়, না পানযোগ্য দুধ আদি দোহন করে, এবং না ঘৃতকে উত্তপ্ত করে। হে ঐশ্বর্যবান! নিজ ধন আমোদ প্রমোদে ব্যয়কারী পুরুষের ধনকে আমাদের প্রাপ্ত করাও আমাদের মধ্যে কুপ্রবৃত্তিবান লোক কে দমন করো “। (ঋগবেদ ৩/৫৩/১৪, জয়দেব শর্মা)
“তাদেরকে হত্যা করো, যারা বেদ ও উপাসনার বিপরীত”। (অথর্ববেদ ২০।৯৩।১)
” এবং যজুর্বেদ ৭/৪৪ তাদের যুদ্ধের মাধ্যম বশ্যতা স্বীকার করাতে হবে”।
“সেনাপ্রধান হিংস্র ও নির্দয়ভাবে শত্রুদের পরিবারের সদস্যদের সাথেও যুদ্ধ করবে।” (যজুর্বেদ ১৭।৩৯)
“শত্রূদের পরিবারকে হত্যা করো, তাদের জমি ধংস করো”। (যজুর্বেদ ১৭/৩৮)
“হে সেনাপ্রধান, আমাদের আশা পুর্ণ করো। হে ধনসম্পদের বাদশা, তোমার সহায়তায় আমরা যেন সম্পদশালী হতে পারি এবং যুদ্ধে জয় লাভ করে প্রচুর ধন সম্পদের মালিক হতে পারি।” (যজুর্বেদ ১৮/৭৪)
এই গুলো বেদের শেখানো দোয়া। কিন্তু কথা হলো বেদের শত্রু কারা? যারা বেদের বাহিরে বা বেদে যাদের বিশ্বাস নেই তারা। এক কথায় বৈদিক ধর্মের বাহিরে যারা। ঠিক যেমন কোরানের ভেতরে যারা তারা ইমানদার মুসলমান আর যারা এর বাহিরে তারা অমুসলিম কাফির। এবার আমাদেরকে জানতে হবে ‘বেদ’ এর জন্মদাতা কে বা কারা। মুক্তমনা লেখক রণদীপম বসু তার একটি প্রবন্ধে লিখেন;
“ধর্মীয় অমানবিকতার আদিম ধারাটির নাম বৈদিকসংস্কৃতি। জগত জুড়ে ধর্মীয় সংস্কৃতির যে ক’টি প্রধান ধারার অস্তিত্ব এখনো বহাল রয়েছে তার মধ্যে সম্ভবত বৈদিক সংস্কৃতিই প্রাচীনতম। তার উৎস হচ্ছে বেদ (Veda), যা বর্তমান হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বিশ্বাস করা হয়। অথচ বহিরাগত একদল লিপিহীন বর্বর আক্রমণকারী শিকারি আর্য গোষ্ঠির দ্বারা এককালের আদিনিবাসী জনগোষ্ঠির মাধ্যমে গড়ে ওঠা সমৃদ্ধ প্রাচীন হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস হওয়া এবং এই ধ্বংসাবশেষের উপর ক্রমে ক্রমে গড়ে ওঠা আর্য সংস্কৃতির বিকাশের আর্যাবর্ত ধারাক্রমই মূলত এই বৈদিক সংস্কৃতি। যেখানে আর্যরা (Aryan) হয়ে ওঠে মহান শাসক আর আদিনিবাসী জনগোষ্ঠিটাই হয়ে যায় তাদের কাছে অনার্য বা শাসিত অধম, নামান্তরে দাস বা শূদ্র (Sudra)। তাই এই বৈদিক সংস্কৃতির ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের মধ্যেই একটি সভ্যতার উন্মেষ ও পর্যায়ক্রমে তার মাধ্যমে ধর্ম নামের একটি শাসনতান্ত্রিক ধারণার জন্ম ও আধিপত্য কায়েমের মধ্য দিয়ে এ ব্যবস্থার পরিণতি পর্যবেক্ষণ করলেই ধর্ম কী ও কেন- এ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় বলে বিদ্বানেরা মনে করেন। আর প্রতিটা ধর্মেরই যেহেতু অন্যতম প্রধান শিকার হচ্ছে নারী, তাই আধিপত্যবাদী পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক এই ধর্মের প্রত্যক্ষ আক্রমণে কিভাবে সামাজিক নারী তার পূর্ণ মানব সত্তা থেকে সমূলে বিতাড়িত হয়ে কেবলই এক ভোগ্যপণ্য চেতনবস্তুতে পরিণত হয়ে যায় তারও উৎকৃষ্ট নমুনা-দলিল এই প্রাচীন বৈদিক শাস্ত্রই। বয়সে প্রবীণ এই শাস্ত্রের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা ও সাফল্য থেকেই সম্ভবত পরবর্তী নবীন ধর্মশাস্ত্রগুলো তাদের পুরুষতান্ত্রিক শোষণের হাতিয়ারটাকে আরেকটু আধুনিক ও বৈচিত্র্যময় করে তার শাসন-দক্ষতাকেই সুচারু করেছে কেবল, খুব স্বাভাবিকভাবেই কোন মৌলিক মানবিক উন্নতি ঘটেনি একটুও”।
ঠিক এ ভাবে একদিন মুসলিম খলিফারা পারস্য আক্রমন করে তাদের সহস্র বছরের কৃষ্টি সংস্কৃতি ধংস করেছিলেন। সেদিন মরুদস্যুদের হাতে ছিল কোরান আর সিন্ধুসভ্যতা ধংসকালে আর্যদের হাতে ছিল বেদ। অনার্যদের শাসন-শোষণ করার জন্যে ভারতীয়দের পদানত করে রাখার লক্ষ্যে বহিরাগত লুটেরা ডাকাত আর্যদের একখানি ধর্মগ্রন্থের প্রয়োজন ছিল। সেই ধর্মগ্রন্থটির নাম ‘বেদ’। কালের পরিবর্তনে যুগের প্রয়োজনে ‘বেদ’এর রূপের আকারের অনেক পরিবর্তন পরিমার্জন পরিবর্ধন, সংযোজন হয়েছে। প্রকৃতির কার্য-কারণ নির্ধারণে ব্যর্থ কিছু অসহায় অশিক্ষিত মানুষের কল্পনা থেকে সৃষ্ট এই গ্রন্থখানি এক সময় ধুরন্দর রাজনীতিবিদ আর শাসকদের প্রজা নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আধুনিক যুগে এসে কী ভাবে সে গ্রন্থখানি বিজ্ঞানময় কিতাব হয়ে গেলো আমরা এবার সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করবো।
চলবে-
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
জানুয়ারি ১৯, ২০১৭; ১:১৪ পূর্বাহ্ন
চলুক, অপেক্ষায় আছি।
জানুয়ারি ১৯, ২০১৭; ২:১১ পূর্বাহ্ন
@আকাশ মালিক ভাই:
রণদীপম বসুর কোট করা অংশটা তাঁর লেখা কোন বইয়ে উদ্ধৃত? সূত্র উল্লেখ করলে একটু কাজে দিতো।
জানুয়ারি ২১, ২০১৭; ৩:১৪ পূর্বাহ্ন
সমস্ত নিরাকারবাদী ধর্মই কী এইরকম অফেন্সিভ?