বাংলাদেশের মানুষের পলিটিকাল স্ট্যান্ড বোঝার ক্ষমতা আমার নাই। কিন্তু কেন এদের পলিটিক্যাল স্ট্যান্ড এমন আনপ্রেডিক্টেবল হয়েছে সেটা খোঁজার বা বোঝার একটা আগ্রহ আমার আছে। এই দেশের প্রবাদবাক্যের মধ্যেই এই দেশের জনগণের দীর্ঘমেয়াদী মনস্তত্বের একটা আঁচ আছে। যেমন ধরুন আমাদের দেশের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রবাদবাক্য হলো- এরা শক্তের ভক্ত নরমের যম। হাহাহাহাহা অর্থাৎ বাঙালি, শক্তকেই ভক্তি করে আর তারা নরম মানুষের জন্য যম এই বিষয়ে তারা নিজেরাই একপ্রকার রায় দিয়ে দিয়েছে। আর এই প্রবাদবাক্য নিয়ে অন্য কেউই এখনো কোনও আদালতে মানহানির মামলা করতে যায় নি। তাই এই শক্তের ভক্ত নরমের যম প্রবাদের সূত্র নিয়ে এবার আমি একটু গোঁড়া থেকে ঘুরে আসি। দেখি এদের সমস্যা কী?
পাঁচশ জুতা গুণে খায়, ফুলের ঘায়ে মুর্ছা যায়…
আপনি যে কোনও একজন বাংলাদেশি’কে জিজ্ঞেস করেন কিংবা নিজেকেও জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন- আপনি আসলে কে? উত্তর নাই। থতমত অবস্থা। আমতা আমতা করে হয়তো বলা যায়- ‘বাংলাদেশি‘ (বর্তমানের একটা সিনেমার নাম, ট্রেলারটা চরম।) বাংলাদেশি বলতে আসলে কী বুঝায়? আপনার ইতিহাস কী? আপনি পৃথিবীর যেই দেশেই যান, সেই দেশেরই একটা ইতিহাস আছে, সংস্কৃতি আছে, ভাষা আছে, নিজেদের ঐতিহ্য বা জাতিগত গৌরব আছে। আপনার কী আছে? একটু বলেন? আমি আসাম করে বসে একটু শুনি। কৈ বলেন বস? কী? ১৯৭১? আচ্ছা! ১৯৫২? আচ্ছা!
আপনি মুসলমান বাঙালি? আচ্ছা! এইবার একটু থামেন। আপনাকে একটা মন থেকে প্রশ্ন করি, উত্তর দেন। আপনার এই দেশে সব জনগণ কী, ১৯৭১ মানে? অর্থাৎ তারা কী ১৯৭২ এর সংবিধান বিশ্বাস করে? একটা ধর্ম নিরপেক্ষ সেকুলার রাষ্ট্রের জন্য যে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেটা কী সবাই সাপোর্ট করে? সত্যি কইরা বলেন- এই বিষয়ে এই দেশে জাতীয় ঐক্য আছে? যদি না থাকে তাইলেতো আর এইটা এই দেশের সবার পরিচয় না, তাই না বস? দেখেন, যারা এই দেশটাকে স্বীকৃতি দিল- আপনি সেইসব দেশরে দুই চোখে দেখতে পারেন না। আর যারা এই দেশটারে স্বীকৃতি দেয় নাই, বা দিলেও এই দেশের জাতির পিতার হত্যার পরে স্বীকৃতি দিছে, সেই দেশের প্রতি আপনার ভালোবাসার কোনও সীমা পরিসীমা নাই। তাইলে আপনার এই দেশপ্রেমে নিশ্চয়ই ভণ্ডামি আছে। বাংলাদেশকে দ্বিতীয় রাষ্ট্র হিসেবে ভারত স্বীকৃতি দিলো ০৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, সেই ভারতরে আপনি দুই চোখে দেখতে পারেন না। মায়ানমার সপ্তম রাষ্ট্র হিসেবে ১৩ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে স্বীকৃতি দিলো, হেরেও আপনি দেখতে পারেন না। সাতাশতম রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল স্বীকৃতি দিলো ০৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২, পাসপোর্টে লেইখা থুইসেন নট ফর ইসরায়েল। আর পাকিস্তান দিলো ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪, সে আপনার বড় প্রিয়, কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখছেন। সৌদি আরব দিলো – ১৬ আগস্ট ১৯৭৫, শেখ মুজিবুর রহমান’কে স্ব-পরিবারে হত্যার পর, সে আপনার বড় প্রিয়, ভিটা বাড়ি বেইচ্চা সেই দেশে যান, নিজেগো মেয়েদেরও পাঠান, চীন দিলো- ৩১ আগস্ট ১৯৭৫, চীন আপনার বন্ধু, আপনি বিরাট চীনপন্থি পরিবেশ-বিদ, মাওয়াবাদী। ভাইজান ঘটনা কী? আপনি আসলে কেডা? যারা আপনার দেশেরে ঠিকসে মাইর দেয়, রেপ করে, গণহত্যা করে, এবং যারা তাঁদেরকেই সকল প্রকার সাপোর্ট দেয়, তাঁদেরকেই ভক্ত বানান, আর যারা ১,০০০০০০০ শরণার্থী আশ্রয় দেয়, আপনার সাথে আপনার শত্রুর লগে যুদ্ধ করে, আপনার সাথে একলগে মরে, আপনার স্বাধীনতার অংশীদার হয়, যারা আপনার দেশরে ভালো পায়, তাগোর জন্য আপনি ঘৃণার যম? আপনার ঘটনা কী? আপনি আসলে কে?
ঢেঁকি অবতার…
১৯৫২ সনের কথা বললেন একবার মনে হলও? এইবার আসি এই কথায়। আপনার গৌরব ১৯৫২ এইটা মানতে পারলাম না। হাসি আসছে আমার। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে কী হয়েছিল? রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই উর্দুর পরিবর্তে? হাসাইলেন ভাই। আচ্ছা আরেকটা কথা জিগাই? না শুধাই? নিজের ছেলে-মেয়ে অথবা আপনার ভাই-বোন, চাচা-চাচি, মামা-মামি, খালা-খালুর ছেলে-মেয়ে হইলে কী নাম রাখেন? কোন ভাষার? কোন দেশের? সহজ কথা বাংলা নাম রাখেন কী? আমি জানি বস, রাখেন না। আমাকেও অনেকেই নাম দিতে বলে, সুন্দর সুন্দর নাম, কিন্তু একটা ছোট্ট শর্ত থাকে, নামটা যেনও এরাবিক হয়। তারা জানেও না যে এরাবিক কোনও একটা নির্দিষ্ট ধর্মের ভাষা না। আরবি ভাষাটা প্রাক-ইসলামিক আরবের যুগে বেদুঈনদেরও ভাষা, প্যাগানদেরও ভাষা, ইহুদিদেরও ভাষা, খ্রিস্টানদেরও ভাষা। ইসলাম পরবর্তী সময়ে শুধু ওই সমস্ত জাতি আরব থেকে বিতাড়িত হইছে। কিন্তু তারা এখনো তো তাঁদের পূর্ব-পুরুষের ভাষাতে অনেকেই কথা বলে। আরবি ভাষায় বহু প্যাগান সাহিত্য আছে, ইহুদি সাহিত্য আছে, খ্রিস্টান সাহিত্য আছে, তখনও ওই অঞ্চলে ইসলাম নাযিল হয় নাই। এইবার আমারে বলেন, চীনের লোক তাঁদের দেশের ভাষায় তাঁদের সন্তানের নাম রাখে, রাশানরা রুশ ভাষায়, আরব’রা আরবি ভাষায়, গ্রিস’রা গ্রিক ভাষায়। আপনি তো ভাই আপনার দেশের ভাষাতেই আপনার সন্তানের নাম রাখেন না। নিজের ভাষাকে শরম পান, ঘৃণা করেন, অপমান করেন, ছোট করেন, আপনের কেমনে ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে গৌরবের ইতিহাস হয়? ১৯৭১ সালের পর ২০১৭ পর্যন্ত কী এমন করছেন যেটা এই দেশের নিজের স্বতন্ত্র ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা, কৃষ্টি, আচার, প্রথা, সমাজ, শিক্ষা, ইতিহাস হিসেবে আপনেরে গৌরব দিতেছে?
গায়ে গু মাখলে যমে ছাড়ে না…
আসেন, এইবার বলেন আপনার মুখ থেকে শুনি? আপনার আর ইতিহাস কী? ১৯৭১ আর ১৯৫২ তো আপনার না। প্রমাণিত। অন্য কিছু থাকলে এইবার বলেন। আপনি আসলে সিরাজউদ্দৌলার ফ্যান? তীতুমিরের বাঁশের কেল্লার ভক্ত? তীতুমির তো সৈয়দ আহমেদ শহীদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ওয়াহাবী মতবাদের অনুসারী ছিলেন বস। ওয়াহাবি মতবাদ কী জনাব এই বঙ্গের? আপনার অঞ্চলের? নাকী সৌদির? আর সিরাজ ছিলেন একজন চরিত্রহীন, লম্পট, মদখোর, নারী লিপ্সু, অপটু, ভোগবাদী তরুণ রাজা। তার এডমিনিস্ট্রেশন আর ব্রিটিশ এডমিনিস্ট্রেশন কী এক? বাংলায় এবং ভারতে বিধবা বিবাহ রোধ আইন, সতীদাহ প্রথা রোধ আইন স্কুল কলেজ, নারী শিক্ষার বিল ব্রিটিশরাইতো পাশ করে গেছে স্যার। সিরাজ’তো কিছুই করেনি এমন। উদাহরণ দিয়েন-তো দুই একটা থাকলে। যাইহোক, ব্রিটিশ’রা চলে গেছে। ক্ষমতা কিন্তু সেই উর্দুভাষী সিরাজের মতো মুসলিম নবাব সলিমুল্লাহদের হাতেই দিয়ে গেছে। তাই না? এরপর সলিমুল্লাহ, সোহরাওয়ার্দি, এরা কি করেছে স্যার? সারা ভারতের সমস্ত স্টেটের মধ্যে জিন্নার মুসলিম লীগ শুধু এক জায়গায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়েছে- হায় সেটা এই বাংলায়! লজ্জা লজ্জা। আপনার ইতিহাস কী স্যার? এরাই তো? আমরা বাঙালি হয়ে, এই দেশের মাটিতে- জলে জন্ম নিয়ে, কীভাবে হাজার মাইল দূরের এক হুইস্কি-খোর বিলেত ফেরত শূকরের মাংস খাওয়া উকিলের দলকে ভোট দেই- টু নেশন থিউরিতে। তাঁকে বানাই কায়েদে আজম, জাতির পিতা! এইতো আমাদের ইতিহাস? কারণ গান্ধী নরম। বাপুজি অনশন করেন, তিনি লেংটি পড়ে ছাগল নিয়ে ঘোরেন, আর জিন্নাহ স্যুটেড বুটেড, জেন্টলম্যান। এইতো আমাদের ইতিহাস। আমরা শক্তের ভক্ত নরমের যম।
মান্ধাতার আমল…
কোন জাতির ইতিহাস মাত্র অর্ধ শতক অথবা দুই এক শতকের হতে পারে না। বাংলার তো কখনোই নয়। এই দেশের ইতিহাসে অনেক বড় একটা ভ্যাকুয়াম আছে। আমি সেটা এখানে কিছুটা বলবো। তাতে এটাও বুঝতে সুবিধা হবে- কীভাবে এই অঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়ী হয়।
আদিম বা ক্রম্যাগনন মানুষের পরবর্তী পর্যায় হচ্ছে আধুনিক সভ্য মানুষ। আনুমানিক ৬০- ৮০ হাজার বছর পূর্বে এই মানুষের জন্ম। পৃথিবীতে অঞ্চল ও ভৌগোলিক প্রকৃতির ভিন্নতার অনুসারে মানবশ্রেণীকে ভাগ করা হয় সাধারণত চার ভাগে।
১. নিগ্রোয়েডঃ এরা আফ্রিকার নিগ্রো মানুষ। দীর্ঘ আকৃতি, সুঠাম দেহ, কালো চোখ, কালো কোঁকড়ানো চুল আর মোটা ঠোট এদের বৈশিষ্ট্য।
২. মঙ্গোলয়েডঃ আমাদের দেশের মণিপুরি , চাকমা, মারমা ণৃগোষ্ঠী মঙ্গোলয়েড বংশোদ্ভূত। অর্থাৎ, বর্তমানে মঙ্গোলিয়াসহ পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহে শ্বেতবর্ণের চ্যাপ্টা নাক বিশিষ্ট যে সম্প্রদায় দেখতে পাওয়া যায়, তারাই মঙ্গোলয়েড। এদের চুল কালো ও খাঁড়া, শরীরে লোমের পরিমাণ কম, চওড়া কাঁধ আর সরু চোখ।
৩. ককোশয়েডঃ ইউরোপ, মিশর, আরব, আফ্রিকার কিছু অঞ্চলের মানুষ। এদের দেহের রঙ উজ্জ্বল, ফর্সা, চোখ বাদামী, নীল, কালো, এমনকী ধুসর বর্ণের হয়। চুলের রঙ সোনালী, সাদা, কালো, এদের নাক তীক্ষ্ণ, ঠোটের পুরত্ব মাঝারি থেকে পাতলা।
৪. আদি-অস্ট্রোলয়েডঃ আফ্রিকার থেকে যে ণৃগোষ্ঠী ভারত হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে স্থিত হয়, এরাই আদি আদি-অস্ট্রোলয়েড মহাজাতি। এরা নিগ্রোদের চেয়ে খাটো। চেহারা রঙের দিক থেকে অস্ট্রোলয়েডরা নিগ্রোদের নিকটবর্তী হলেও শারীরিক গঠনের দিক থেকে নিগ্রোরা ককোশয়েডদের সমীপবর্তী। বর্তমানে খুব অল্প সংখ্যক আদি-অস্ট্রোলয়েড অস্ট্রেলিয়ায় প্রত্যক্ষ হয়। তবে এদের খুঁজে পাওয়া যায় দক্ষিণ ভারত থেকে শুরু করে উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ পর্যন্ত। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই আদি-অস্ট্রোলয়েড থেকে উদ্ভূত বলে মনে করা হয়।
আদাড় গাঁয়ে শিয়াল বাঘ…
এখন ভাইজান আপনি কোনটা? আমিতো চারটাই লিখলাম। আমি বলি আপনি কী? আপনি হচ্ছেন এই পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন-প্রায়- আত্মপরিচয়-হীন- পরশ্রীকাতর- হীনমন্য- বাংলাদেশি। কারণটা একটু দেখাইয়া দেই? ভুল হইলে ধরাইয়া দিয়েন। আফ্রিকানদের হাজার হাজার বছরের সভ্যতা আছে, ইতিহাস আছে। সংস্কৃতি আছে, ঐতিহ্য আছে। ইউরোপিয়ানদেরও আছে, মঙ্গোলিয়ানদেরও আছে, মধ্যে প্রাচ্যেরও আছে, চীনেরও আছে, ভারতেরও আছে। মুশকিল হইলো আপনার নাই। আপনার ইতিহাসে ১৯৭১ও নাই ১৯৫২ও নাই। আপনার ইতিহাস শুরু হয় বড় জোড় জিয়ার আমল থেকে। কিংবা জিন্নার দেশভাগ। আপনার পূর্ব-পুরুষ পাকিস্তান আর উর্দু ভাষা ভালোবাসছে আপনি তাদের আওলাদ। তাই আজ যখন পাকিস্তান আর এই বঙ্গদেশে নাই আপনারও আর চেতনায় নিজের কোনও দেশ নাই। তাই এখন আপনার ভাষা- পোশাক- আচার- আচরণ- সংস্কৃতি- জীবন-যাপন সব ককোশয়েডদের মতোন। কেন আপনি এই অঞ্চলে জন্ম নিয়াও আদি-অস্ট্রোলয়েড হইয়াও ককোশয়েডদের প্রেমে পড়লেন ভাবছেন কখনো?
চুলকাইয়া ঘা করা…
দেখেন এই বঙ্গের ইতিহাস বা সভ্যতা হাজার পাঁচেক বছরের বেশি বই কম না। আমাদের এই অঞ্চলে গুপ্তা ডাইনেস্টি ২,৫০০ হাজার বছর পূর্বের। এই প্রাচীন বঙ্গে তাম্র প্রস্তর যুগের নিদর্শন পাওয়া গেছে। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় দেড় হাজার বছর আগের অর্থাৎ ৩,৫০০ বছর পূর্বের সভ্যতার নিদর্শন। এই ৩,৫০০ বছর পূর্বে পান্ডু রাজার ঢিবিতে বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে এক উন্নত মানের সভ্যতার নিদর্শন উদঘাটিত হয়েছে। পান্ডু রাজার ঢিবিতে স্টিটাইট পাথরের কতগুলো চিহ্ন-খোদিত একটি গোলাকার সিল পাওয়া গেছে। এবং সিলটি ভূমধ্যসাগরীয় ক্রীট দ্বীপের, প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের পূর্বে নির্মিত। এইসব নিদর্শন থেকে নিঃসন্দেহে বোঝা যায়, প্রায় তিন-হাজার বছর পূর্বেই এই অঞ্চলে উন্নত মানের সভ্যতার অধিকারী মানব জাতির বাস ছিলও। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে, অর্থাৎ ২,৪০০ বছর আগে গ্রিকঐতিহাসিকের লেখনী থেকে বাংলাদেশের অবস্থা অনেকটা স্পষ্টতার সাথে বোঝা যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে আলেকজান্ডার যখন ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ভাগ আক্রমণ করেন, তখন বাংলাদেশে এক পরাক্রান্ত রাজ্য বিরাজমান ছিলও তার সাক্ষ্য সমসাময়িক গ্রিক ও লাতিন লেখনীতে পাওয়া যায়। ঐতরেয় ব্রাক্ষ্মণে পুণ্ড্রের নাম উল্লেখ ছিলও। পুন্ড্রজাতি উত্তরবঙ্গে বাস করতো। গ্রিক লেখকের বর্ণনায় গন্ডরিডাই বা গঙ্গরিডই বা গঙ্গারেড্ডি নামে এক পরাক্রান্ত জাতির উল্লেখ পাওয়া যায়। দিওদেরাসের লেখনীতে এই গ্নজ্ঞারেড্ডি জাতির বিপুল সৈন্যবাহিনী ও চার হাজার রনহস্তীর উল্লেখ আছে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে ২,৩০০ বছর আগে রচিত কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থে বাংলার সূক্ষ্ম সূতিবস্ত্রের উল্লেখ আছে। এতেও এ কথাই প্রমাণ করে এই বঙ্গের বয়নশিল্প ঐতিহ্যও অতি সুপ্রাচীন। এই অঞ্চল ভূর্জপত্রে যখন লিখা শুরু করছে তখন আলেকজান্ডার এই দেশে পা দেয় নাই। আলেকজান্ডারের সেনাপতি কার্টিয়াস এদেশে ভূজপত্রে লেখার প্রচলন দেখে গেছে। ভূজপত্রে লেখা প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপি খরোষ্ঠী ধম্মপদ (৪র্থ খ্রিস্ট-পূর্ব) ২,৪০০ বছর আগে। আসাম থেকে প্রাপ্ত কাষ্ঠফলকে লেখা প্রাচীন পাণ্ডুলিপির নিদর্শন অক্সফোর্ডে রক্ষিত আছে। পেরিপ্লাস গ্রন্থ ও টলেমির বিবরণে থেকে জানতে পারি এই সময়ে গংগারেড্ডি রাজ্য বেশ প্রবল ছিলো। এই দেশে প্রসিদ্ধ বন্ধর ছিলও। সূক্ষ্ম মসলিন কাপড় এই দেশ থেকে সুদূর পশ্চিমে রপ্তানি হতো। এর সন্নিকটে কোথাও সোনার খনি ছিল বলে গ্রিক লেখনীতে উল্লেখ আছে। পেরিপ্লাস গ্রন্থে নিম্ন গাঙ্গেয় ভূমিতে ক্যালটিস নামক স্বর্ণমুদ্রা প্রচলনের কথাও উল্লেখ আছে।
যিশুর জন্মের শত শত বছর পূর্বে, ইসলাম ধর্ম তৈরি হবার প্রায় হাজার বছর আগে, এই অঞ্চলে অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার। বৌদ্ধদের বিশ্ববিদ্যালয়। হ্যাঁ স্যার আপনার এই অঞ্চলে। এই দেশে। এই মাটিতে। বগুড়ায় ট্রয়ের মতো নগরী প্রাচীর দিয়ে ঘেরা শহর মহাস্থান। তেতুলিয়ার পৃথু রাজের ভিতর গড়ের কয়েক কিলোমিটার জুড়ে বিশাল চওড়া প্রাচীর। নরসিংদীর উয়ারী বটেশ্বর। সবই ২৫০০ বছরের আগের নগর সভ্যতা। বিক্রমপুরে খুঁড়ে বের করা হচ্ছে মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই অঞ্চলের আছে চর্যাপদ, গীত গোবিন্দ, বৈষ্ণব-পদাবলী, বাউল দর্শন, ভাওয়াইয়া, কীর্তন, ভাটিয়ালি, আমরাই এই অঞ্চলের ‘Son of the Soil’। মূল আদিবাসী। আমি হালাকু খা-চেঙ্গিস খানের বংশধর নই, আমি তৈমুর লং এর বংশধর মোঘল নই, আমি পাঠান নই, আমি বেদুইন আরব নই, আমি তাঁতারের ভাগ্যান্বেষী যাযাবর সৈনিক নই, আমি তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলিজি নই। আমি এই দেশের Son of the Soil.
আমার আফসোস লাগে এত বিপুল ইতিহাসের বৈভব আমরা জানি না। কেন জানি না? কবে থেকে জানি না? এই অঞ্চলে আমরা গুপ্তা, পাল, সেন ডাইনেস্টির ইতিহাস শুনি। কিন্তু পর্যাপ্ত নিদর্শন নেই। খুব অপ্রতুল ডকুমেন্ট পাওয়া যায়। যা পাওয়া যায় তা অন্যের কাছে। টলেমী, আলেকজান্ডারের সেনাপতি, কালিদাস, হিউএনসাং বা অন্য নানান বিচ্ছিন্ন তথ্য। আমার প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের এই দেশে সমস্ত ডকুমেন্ট কবে থেকে পাওয়া যায় না? গ্রন্থাকারে লিখিত উপাদান নেই, কম, খুব কম। যা পাই কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান।
আমাদের পালি, সংস্কৃত, ব্রাক্ষ্মীলিপি নেই তেমন। অথচ এই অঞ্চলে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়।
জুতা মেরেছে, অপমান তো করেনি…
বিসিএসএর প্রশ্ন উত্তর পর্বে কি লেখা একটু দেখি।
বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ
প্রশ্ন: অন্ধকার যুগ কী?
উত্তর : বাংলা সাহিত্যের যে যুগে বাংলা সাহিত্যের কোনো নিদর্শন মেলে না তাকে অন্ধকার যুগ বলে।
প্রশ্ন: অন্ধকার যুগের সময়সীমা কত?
উত্তর: ১২০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মোট দেড়শ বছর।
প্রশ্ন: অন্ধকার যুগের কোনো সাহিত্যিক নিদর্শন মেলে কী?
উত্তর: অন্ধকার যুগে বাংলা সাহিত্যের কোনো নিদর্শন না মিললেও কিছু সংস্কৃত সাহিত্যের নিদর্শন মেলে। যেমন-
১. রামাই পণ্ডিতের ‘শূন্য-পুরাণ’ এবং ২. হলায়ূধ মিশ্রের ‘সেক শুভোদয়া’।
প্রশ্ন: বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার যুগের জন্য কোন শাসককে দায়ী করা হয়?
উত্তর: এখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী।
এই লোক পুরো নালন্দা বিশ্ব বিদ্যালয়ে রক্ষিত সমস্ত পুস্তক জ্বালিয়ে দিয়েছেন। ৫০,০০০ বই। আমাদের ইতিহাস, সাহিত্য, জ্ঞান, তার সাথে সাথে হত্যা করেছেন সমস্ত বৌদ্ধ ছাত্র ও শিক্ষকদের। এই অঞ্চল থেকে বৌদ্ধরা পালিয়ে যায়। তিনি একের পর এক মঠ ধ্বংস করেন। বাংলায় আরবের শাসন কায়েম করেন। ১২০৫ থেকে এই পূর্ববঙ্গের সমস্ত ইতিহাস ঐতিহ্য স্থাপনা নিদর্শন ধ্বংস করা হয়। এই অঞ্চল এক লম্বা সময়ধরে অন্ধকারের দিকে চলে যায়। এই বখতিয়ারের শাসন আমল থেকে এই অঞ্চলে শুধু মুসলিম জনসংখ্যাই বেড়েছে। আর এই অঞ্চলের Son of the Soil. যারা তাঁরা এই অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হয়েছে। তাই ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে জিন্নার মুসলিম লীগ এই অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ভোট পায়। আমরা পুঁথি পাঠ, বাউল গান, পড়াশোনার চেয়েও ঘোড়ায় চড়ে আসা তলবারি নাচানো তুর্কি সেনাপতির ভক্ত হই। আমরা শক্তের ভক্ত নরমের যম। আমরা মাটি খুঁড়লেই দেখি বিষ্ণুর মুর্তি, বৌদ্ধের মুর্তি, গরুড়ের মুর্তি, আরও নানান দেব-দেবীর। কারো মাথা ভাঙ্গা, কারো হাত ভাঙ্গা, কারো মুখে চোখে বুকে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। আমাদের জাতীয় যাদুঘরে গেলেই এই কথার সত্যতা পাওয়া যাবে। নালায় ডোবায় মজে যাওয়া পুকুরের কাদার তল থেকে বেড়িয়ে আসে। এদের দেখে কী একবারও মনে প্রশ্ন আসে না?এরা আমাদের পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য। এইসব অমূল্য অপূর্ব শৈল্পিক কারুকার্যে খচিত কষ্টি পাথরের মূর্তিগুলি আমাদের ইতিহাস, আমার গৌরব, আমাদের পূর্ব পুরুষের সভ্যতার চিহ্ন। এদেরকে কারা এভাবে বাড়ির কাছে ডোবায় ফেলে দিয়েছিল? এভাবে আইএসআইএস এর মতো কুপিয়েছিলও? আমাদের সভ্যতাকে যারা ঘৃণা করে তারা আমার আপন কীভাবে হয়? কই তারা তো কিছুই সৃষ্টি করে দিয়ে যায়নি। শুধু ঘৃণার বীজ, রায়োট, আর পশ্চাৎপদ হয়েছে। পৃথিবীর সব দেশ তাঁদের ঐতিহ্য ধরে রাখে, আমরা কেন আমাদের ঐতিহ্যকে ঘৃণা করি? পাকিস্তানের লাহোর আর করাচী, রামের দুই সন্তানের নামে ছিলও। হায়! আজ সেখানে একজনও হিন্দু নাই। জঙ্গিবাদ আর মৌলবাদে কী অবস্থা আজ এই দুই শহরের। যারা এর অধিবাসি আজ তারা জানে না তারা কার শহরে থাকে। তেমনি আজ এই পূর্ববঙ্গের মানুষও জানে না তাঁদের পূর্ব-পুরুষের ইতিহাস। পাকিস্তানের গড়ার ক্ষমতা না থাকুক ভাঙ্গার ক্ষমতা আছে। যেমন আমরা আমাদের ইতিহাস আর ত্রয়োদশ শতাব্দীর পূর্ব থেকে তেমন কিছুই পাই না।
নাড়া বনে কীর্তন…
আমরা সহ্য করে করে- ভানুর কৌতুকের মতো- দেখি না আর কী করে, দেখি না আর কী করে? করতে করতে সেই খিলিজির আমল থেকে দেখেই আসছি- আর কী করে? এরা আমাদের শিকড় কেটেছে, ব্রেনওয়াশ করেছে, মূর্খ করেছে, উলটা পা হাঁটা শিখিয়েছে, আত্মঘাতি হওয়া শিখিয়েছে, পূর্ব-পুরুষকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছে, নিজের দেশ মাটি, ভাষা, জাতি, ইতিহাস ঐতিহ্যকে ভুলে যেতে শিখিয়েছে, আমরা এখনো দেখেই যাচ্ছি। এই পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন-প্রায়- আত্মপরিচয়-হীন- পরশ্রীকাতর- হীনমন্য- বাংলাদেশি হয়ে।
আমাদের ভিতর কোনও শিকড় অনুসন্ধান নেই। আমরা সত্য সহ্য করতে পারিনা। আমরা সত্য জানতেও চাই না। আমাদের মুখের ওপর কেউ আয়না ধরলে আমরা রেগে যাই। আমাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধটাও নেই। আমরা দেশ ও জাতির কোনও একটা বিষয়ে জাতীয় ঐক্যে পৌছাতে পারি না কেবলমাত্র ধর্মীও মৌলবাদ এবং পরম সহিষ্ণু মানবতাবাদের কারণে। মানে উল্টো কিছু করতেই হবে। কেবলমাত্র এই কারণেই অন্য জাতি এসে আমাদের এত সহজেই গোলাম বানিয়ে শাসন করতে পারে। এই দুই সম্প্রদায়েরই বাঙালি জাতীয়তাবোধ নেই। জাতীয়তাবাদ ক্ষতিকর। কিন্তু সেটা সভ্য সমাজের একেবারেই এডভান্স স্টেজে। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রাথমিক অবস্থায় জাতীয়তাবাদ বাদ দিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদ এবং অতি উদার মানবতাবাদ ওইদেশ ও জাতির জন্য আরও বেশি ক্ষতিকর।
দুইটা উদাহরণ দেই:
১. ধর্মীয় মৌলবাদীরা বলছে- রোহিঙ্গারা এদেশে থাকুক বৌদ্ধদের মায়ানমার পাঠিয়ে দেই। মারহাবা জাজমেন্ট। মানবতাবাদী আর উদারবাদীরা চুপ। আজব পলিটিক্স !
২. আমাদের প্রিয় ইমরান এইচ সরকার, রোহিঙ্গাদের ওপর মায়ানমার আর্মির অত্যাচারের বিরুদ্ধে। এটা ইমরানের কাছে অমানবিক। কিন্তু তিনি তাঁর ফেসবুক ওয়ালে ৭ ই সেপ্টেম্বর ছবিসহ পোস্ট দিয়েছেন- এই অমানুষগুলো আমাদের জাতীয় কলংক। পালিয়ে আসা অসহায় রোহিঙ্গা যুবতীদের অপহরণ করে ধর্ষণ করতো আর তাদের সাথে থাকা মালামাল লুট করতো এই পিশাচরা।
স্থানীয়রা ধরে কিছুটা আপ্যায়ন করেছে। আশাকরি বাকীটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করবে!
রোহিঙ্গারাও মায়ানমারে বৌদ্ধ মেয়েদের রেপ করেছে, বৌদ্ধদের হত্যা করেছে, ওদের মালামাল লুট করেছে। এখন ওই দেশের জনগণের কাছে কি এই রোহিঙ্গারা তাহলে জাতীয় বেইমান হবে ইমরান সাহেব? তাদেরকেও কী ধরে বেঁধে কিছুটা আপ্যায়ন করা যাবে? তারাও কী আশা করবে বাকীটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করবে?
নাকী জাজমেন্ট সব আমরাই দিব? কোনটা মানবতা আর কোনটা দানবতা? কী আশ্চর্য পলিটিক্যাল স্ট্যান্ড !
যারা এই দেশটা এতো শতক ধরে পুরো ধ্বংস করছে আমার তাদের উপর রাগ লাগে, তবে তারচেয়ে বেশি রাগ লাগে যারা উদার মনে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে মহান ভাব ধরে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে সবটাই ধ্বংস হতে দেখছে।
“The world will not be destroyed by those who do evil, but by those who watch them without doing anything”
– Albert Einstein