মাথার উপরে ছাদ, পায়ের নীচে মাটি না থাকলে মানুষের স্বস্তি হয় না। এলিমেন্টাল ফোর্সের হাত থেকে বাঁচার প্রয়োজনে মানুষের একটা আবাস স্থলের দরকার। সেই আদিকালে মানুষ গুহায় বাস করত। তারপরে তাবু, কুঁড়েঘর ইত্যাদি তৈরি করল। এরপরে নগর সভ্যতায় দালান-কোঠা তৈরি হল। কিন্তু গুহাবাসের মত সবার মাথার উপরে ছাদের নিশ্চয়তা রইল না। দুনিয়ার সকল শহরে এখন কিছু মানুষ আছে যাদের মাথার উপরে ছাদ নেই; বসবাসের জন্য নিরাপদ জায়গা নেই। পৃথিবীর বিখ্যাত নামী দামী শহর কেউই এই অভিশাপ থেকে মুক্ত নয়। প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মত ঝলমলে শহরে গলিঘুপচিতে বাস্তুহারা মানুষের বাস।
দুনিয়ার ভাসমান মানুষের মধ্যে রোমা পিপলরা অন্যতম । তারা যাযাবরের মত সারা ইওরোপ আমেরিকার সব শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করে। তবে তাদের হোমলেস বলা যাবে না। স্বভাবগত ভাবেই তাদের যাযাবর জীবন। রোমা জাতির মানুষ আদিতে ভারতবর্ষের অধিবাসী ছিল।
কেন ভারতের রাজস্থানের মানুষ এখন সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল?
হান্টার-গ্যাদারার মানুষ একসময় সারা দুনিয়া চষে বেড়াত। মানুষের ইতিহাসে অভিবাসন সব সময় ঘটে চলছে। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সমগ্র ইওরোপ থেকে ইহুদীরা দলে দলে মধ্যপ্রাচ্যে এসে বসতি স্থাপন করল। অথবা এখন এশিয়া-আফ্রিকা থেকে মানুষ জীবন হাতে নিয়ে ইওরোপ আমেরিকাতে অভিবাসী হচ্ছে। কিন্তু এরা কেউই হোমলেস নয়।
হোমলেস মানুষ যারা তাদের একটা বড় অংশ মানসিক রোগগ্রস্ত, যুদ্ধাহত ওয়ার ভেটেরান, নেশাগ্রস্ত, প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে ইকনমিক লুপ থেকে ছিটকে পড়া মানুষ। এদের সবার আগে দরকার মানসিক ও শারীরিক শুশ্রুষা। তারপরে সম্মানজনক জীবিকা ও আবাসনের ব্যবস্থা। বর্তমান ডগ ইট ডগ ওয়ার্ল্ডে সেটা কে করবে? সরকার করার কথা। কিন্তু সব সময় প্রফিট মোটিভে চলা সরকার এসব জনকল্যাণমূলক প্রোগ্রামে কেন টাকা খরচ করবে? কারণ জনগণের নির্বাচিত সরকার হিসেবে সেটা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
জনগণের মধ্যে একটা অংশের হোমলেস মানুষদের প্রতি বৈরী ভাব আছে। তারা মনে করে তাদের ট্যাক্সের পয়সায় এসব লোক বসে খাচ্ছে। সেটাও পলিসি মেকারদের জন্য অনেক সময় বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তার উপর এসব মানুষের ভোট নেই। এরা যেখানে থাকে সে এলাকার প্রপাটিজ এর ভ্যালু কমে যায়। ছোটখাট চুরি-চামারি, নেশা-ভাং ইত্যাদি অপরাধ বাড়ে। ফলে ‘ভদ্রলোকেরা’ তাদের পছন্দ করে না। তার উপরে কেউ কখনো যদি হোমলেসদের কারণে ক্ষতির স্বীকার হয় তাহলে একেবারে মারমুখী হয়ে যায়।
আরেকটা ভীতি কাজ করে। সেটা হলো নিজেকে হোমলেস অবস্থায় কল্পনা করার ভয়। সামাজিক নিরাপত্তা এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে থাকা মানুষের আজ রাজা কাল ফকির হতে কতক্ষণ। ফলে এরা একধরণের ডিনায়ালের মধ্যে থাকে। যেকোন ভাবে হোমলেস মানুষের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে চায়। তাদের বর্তমান অবস্থার জন্যে তাদেরকে দায়ী করা সহ হোমলেস মানুষকে ঘৃণার চোখে দেখে শয়ে এদেরকে নিজের চতুর্সীমানা থেকে দূরে রাখতে চায়।
সহমর্মীতা, সহানুভূতি দিয়ে হোমলেস সমস্যার সমাধান হবে না। কিন্তু সমাধানের পথে কাজ করা যাবে। কেন মানুষ হোমলেস হয়, এবং বর্তমান সমাজে হোমলেস থেকে মুক্ত হয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরা কেন মোটামুটি অসম্ভব এটা যদি না বুঝানো যায় তাহলে কাউকে হোমলেস মানুষদের প্রতি সহানুভূতি জাগানো সম্ভব নয়। সরকার অনন্ত যুদ্ধের ফুট সোলজার হিসেবে তাদের ব্যবহার করে তারপরে তাদেরকে রাস্তায় ফেলে দেয়। মানসিক রোগী, নেশাগ্রস্ত যুবক হোমলেস হয়ে দিনকে দিন হতাশার চোরাবালিতে ডুবতে থাকে। ইচ্ছা থাকলেও তারপক্ষে আবার ‘স্বাভাবিক’ জীবনে ফেরত আসা সম্ভব হয় না। প্রথমতঃ তার কোন রেফারেন্স নেই। চাকরিদাতারা তাদের অবিশ্বাস করে, সন্দেহের চোখে দেখে। কেন ইচ্ছে করে কোন ব্যবসায়ী নিজেকে রিস্কের মধ্যে ফেলবে। যেখানে কাজ করার লোকের অভাব নেই। হলিউডের ‘পারস্যুট অফ হ্যাপিনেস’ মুভিতে এ বিষয়টা কিছুটা দেখানো হয়েছে।
কেউ কেউ অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে কাজের জোগাড় করতে পারলেও তাদের রিল্যাপস হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। ফলে তারা আবারো চাকরি হারিয়ে পথে নেমে পড়তে বাধ্য হয়।
হোমলেস হবার একটা বড় কারণ আবাসন সমস্যা। আমেরিকাতে একজন চাকরিজীবীর সবচেয়ে বড় খরচ হলো তার বাসস্থানের ভাড়া। ছোটখাট চাকরিজীবীদের মোট আয়ের ষাট থেকে সত্তর শতাংশ চলে যায় বাসা ভাড়ায়। বাকি টাকা দিয়ে তার খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে অন্য সবকিছু। কোন কারণে কারো চাকরি চলে গেলে তার পক্ষে বাড়ি ভাড়া যোগাড় করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তার বিল বাকি পড়তে থাকে। বিল বাকি পড়লে ক্রেডিট স্কোর খারাপ হতে থাকে, বিল কালেক্টরের কাছে চলে যায়। এভাবে একবার লুপ থেকে ছিটকে পড়লে তারপক্ষে আবার লুপে ঢোকা খুবই কঠিন। ভাল ক্রেডিট স্কোর ছাড়া তারপক্ষে বাড়ি ভাড়া নেয়া বা গাড়ি কেনা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
একবার হোমলেস হয়ে পড়লে লাইফ অনেক সিম্পল। আমেরিকাতে খাবারের অভাব নেই। প্রতিদিন হোটেল রেস্তোরাঁয় প্রচুর খাবার নষ্ট হয়। এছাড়া নানা জায়গা থেকে খাবার সংগ্রহ করা যায়। বাড়ি ভাড়া, আবাসনের তুলনায় খাবার অনেক শস্তা। ফলে রাস্তার হোমলেস জীবনে একবার অভ্যস্ত হয়ে পড়লে হতাশার সাথে স্বাধীনতার একটা অনুভূতি হয়। তাকে আর কারো দাসত্ব করতে হবে না।
আবহাওয়া সাথে হোমলেসনেস এর সম্পর্ক আছে। আমেরিকার মিডওয়েস্ট বা শীতপ্রধান অঞ্চলের তুলনায় গরম অঞ্চলে হোমলেস মানুষের সংখ্যা বেশি। শীতপ্রধান দেশে এজন্য বাউল বাউল- ফকির, ওয়াণ্ডারিং মংক বা দরবেশ চোখে পড়ে না। গরম এলাকায় হোমলেস মানুষ যেমন বেশি তেমনি এসব হোমলেস মানুষদের মধ্যে অনেক কবি-সাহিত্যিক, গীতিকার আছে। পথের মানুষ, পথের সংগ্রামী জীবন নিয়ে তাদের অনেক কবিতা ও গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
বর্তমান হোমলেস সমস্যার সমাধান সহজে হবে না। কারণ দুনিয়ার কোথাও মানুষের সরকার নেই। যে মানুষের উৎপাদন ক্ষমতা নেই, অর্থ-বিত্ত নেই কোথাও তার জায়গা নেই। সরকারগুলো মুখরক্ষার জন্যে নামকাওয়াস্তে কিছু প্রোগ্রাম চালু রেখেছে। ব্যস্ত নাগরিকদেরও হোমলেসদের জন্য কোন সময় নেই। বরং হোমলেসদের দারিদ্র্য, মলিন পোষাক-আশাক, চুরি, নেশা ইত্যাদির কারণে বেশিরভাগ মানুষের তাদের জন্য কোন সিমপ্যাথি নেই।
সবার জন্যে এফোর্ডেবল হাউজিং ব্যবস্থা করা গেলে ভবিষ্যতে হোমলেস হবার সম্ভাবনা কমানো যেত। কিন্তু বাড়ির মালিক হওয়া আমেরিকান ড্রিমের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাড়ির উচ্চমূল্যের কারণে আমেরিকান ড্রিম এখন বিশাল সংখ্যক আমেরিকানদের জন্য ‘শ্যাটারড ড্রিম’। যাদের ইতোমধ্যে বাড়ি আছে তারা কোনভাবে চাইবে না তাদের বাড়ির দাম কমে যাক। অনেকের জন্য বাড়ির মালিকানাই তাদের জীবনের একমাত্র এবং সবচেয়ে বড় ইনভেস্টমেন্ট। ফলে তারা কিছুতেই চাইবে না বাড়ির দাম কমে সবার জন্য বাড়ির ব্যবস্থা হোক। আর যাদের বাড়ি আছে তারা অলরেডি সরকারের কাছ থেকে অনেক ইনসেন্টিভ, ট্যাক্স ব্রেক ইত্যাদি পাচ্ছে। এরা স্বাভাবিকভাবে সমাজের প্রিভিলেজড অংশ, বড়লোক। তারা যা চাইবে তাই হবে। এর সাথে ব্যাংকিং, মর্টগেজ, ফাইন্যান্সিয়াল নানা প্রতিষ্ঠান জড়িত তাদের কেউই চাইবে সবাই সুলভ মূল্যে বাড়ির মালিকানা পাক। ফলে বাড়ির দাম কমে না, মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসে না। একজন সাধারণ ক্রেতা ২০-৩০ বছর ধরে একটু একটু করে ঋণ পরিশোধ করে মরার আগে বাড়ির মালিকানা হাতে পায়। এর মধ্যে পিরিয়ডিক নিয়মানুযায়ী হাউজিং মার্কেটে বাবল বার্স্ট হলে যে মর্টগেজ শোধ করতে পারবে না তার বাড়ি ফোরক্লোজ হয়ে তার আম-ছালা দুটোই হারাতে হয়।
হোমলেসদের জন্য শেল্টার করা হলেও তারা সেখানে থাকতে চায় না। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শেল্টারগুলো লোকালয় বা সিটি সেন্টার থেকে অনেক দূরে। হোমলেসদের জন্য সেটা কারাগারের মত। ‘শুধু রুটি খেয়ে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না‘। তার উপর ন্যাংটার নেই বাটপারের ভয়। যার একবার খোলা আকাশের নীচে স্বাধীনভাবে থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে সে কেন জাস্ট একটু ছাদের জন্য সিটির লাইম লাইট ছেড়ে কারাগারে গিয়ে থাকবে। ফলে হোমলেস মানুষ কিছুদিন শেল্টারে থেকে আবার পথের জীবনে চলে আসে, এভাবে চলতে থাকে। এর সাথে নেশা এবং মানসিক রোগ পুরো পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে ফেলে।
হোমলেস সমস্যার সমাধান জনগণের সরকার। সেরকম সরকার যারা প্রত্যেকটি মানুষকে সমান মর্যাদার চোখে দেখবে। মানুষের মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার দায়িত্ব নিবে। সবকিছুতে শুধু লাভ দেখবে না। মানুষকে একটা সংখ্যা, উৎপাদনশীল যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা না করে তাকে রক্ত-মাংসের তৈরি মানবিক বোধ-বুদ্ধি সম্পন্ন প্রাণি হিসেবে দেখবে। জনগণের সেবক যারা হবে তাদের হতে হবে সহানুভূতিশীল, সেবার মন-মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ। শুধু জব করার জন্যে যারা আসবে তাদের সেবক হবার দরকার নেই। জনগণের যে অংশের শারীরিক-মানসিক সাহায্য দরকার তাদের জন্য নানা ধরণের প্রোগ্রাম থাকতে হবে। মোট কথা সারপ্লাস প্রোডাকশানের দুনিয়াতে মৌলিক চাহিদার অভাবে যাতে মানুষের জীবন ব্যর্থ না হয় সেটা নিশ্চিত করার মত সরকার ব্যবস্থা গঠন করতে হবে।