সাংবাদিক রোজিনাকে নিগ্রহ করার ক্ষেত্রে কমান্ডিং অফিসার হিসেবে জেবুন্নেসা ও এক্সিকিউশান সোলজার হিসেবে কনস্টেবল মিজান ও এমএলএসএস পলির নাম পাওয়া গেছে। জেবুন্নেসার স্বামী আরেকজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী মিডিয়ায় নিশ্চিত করেছেন, মিস নেসা ঐ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত; কিন্তু রোজিনাকে নির্যাতনে তিনি অংশ নেননি এমন খোঁড়া যুক্তি দেখিয়েছেন স্বামীটি। ডিনাইয়াল বা অপরাধ অস্বীকারই তো দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতাকাঠামোর লোকেদের একমাত্র আশ্রয়।
রোজিনা নিগ্রহের ঘটনায় পদাধিকার বলে জেবুন্নেসার সুপারভিশনেই তার অধীনে কর্মরত দুই সরকারী ফুটসোলজার রোজিনাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের খাস-কামরার কনসেনট্রেশান ক্যাম্প বসিয়ে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির খবর রোজিনাকে কে দেয়, সেই সোর্সের নাম বের করেছে তার গলার টুটি চেপে ধরে।
রোজিনার স্বামীর মিডিয়ায় দেয়া বক্তব্য অনুসারে রোজিনা তার সোর্সের নাম বলেছে। এটি রোজিনার পেশাদারিত্বের একমাত্র দুর্বল জায়গা। কারণ সাংবাদিকের ঈশ্বর হচ্ছে তার সোর্স। সাংবাদিক জীবন দেবে তবু সোর্সের নাম বলবে না; এটাই সাংবাদিকতার শপথ। রোজিনা খ্যাতিমান অনুসন্ধানী সাংবাদিক; তার নিরাপত্তা তার সাংবাদিক বন্ধুরা; তার মাধ্যমে সত্য তথ্য পাওয়া পাঠকেরা। কিন্তু ঐ যে ছোট খাট মানুষের ঈশ্বর সোর্স; যে দুর্নীতির বিষ থেকে দেশকে বাঁচাতে তথ্য দেয়; সে কী এখনো বেঁচে আছে! এই প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যবিত্তের আশা-আনন্দ-দুঃখ-বেদনার এইসব দিনরাত্রির হুমায়ূন আহমেদ তো কেবল আমরা নই; আমরা নিম্নবিত্ত-বিত্তহীন-উপায়হীন ছোট-খাট মানুষের ঈশ্বরের আরাধনা করি। রোজিনা যে সোর্সের নাম বলেছেন; রাষ্ট্রের কাছে তাদের নিরাপত্তা দাবী করি। কারণ এই গুমগঞ্জে সরকারের প্রদীপেরা তো আছেই পাখির মতো গুলি করে মানুষ মারতে। এইসব নরভোজির ‘হাউ মাউ খাউ মানুষের গন্ধ পাও’ রক্তনেশার বলি হতে পারে; যে কেউ যে কোন সময়। রক্তের স্বাদ পেয়ে ভ্যাম্পায়ার এই মানুষখেকো নিও রুলিং এলিট ডটেড ব্ল্যাক প্যান্থারেরা।
এখন রোজিনা ট্র্যাজেডিকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষপটে প্রতিস্থাপন করলে; রোজিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে তথ্য যুদ্ধের সাহসিকা; জেবুন্নেসা দুর্নীতির দখলদার বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার; পাকিস্তানের ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীদের একজনের মতোই তার ভূমিকা। তার অধীনের কনস্টেবল ও পিয়ন পাকিস্তানের ৯৩০০০ দখলদার সেনার দু’জন। সুতরাং মূল আসামী কমান্ডিং অফিসার। কেষ্টা ব্যাটাই চোর বলে সলিম বুঝ দিলে তো চলবে না। অতিরিক্ত সচিবকে বাঁচিয়ে নিয়ে কনস্টেবল-পিয়নকে জেলে দেয়ার ছাগলনাইয়া কালচার অনেক দেখেছি আমরা। একজন ইউএনও-র বাসার আলমিরাতে ৫০ লাখ টাকা পাওয়া গেলেও তার ফুটসোলজার পিয়নের ৫০ হাজার টাকা চুরির হৈ চৈ ন্যায়বিচারে; দুর্নীতি উপনিবেশের প্রশাসকেরা ঠিকই চুপে চাপে বাঁচিয়ে নিয়েছে ৫০ লাখ টাকার ইউএনওকে। তাই বিচার হতে হবে দায়িত্বপূর্ণ চেয়ারে বসা জেবুন্নেসার। যার চাকরিজীবনের আগের ও আজকের মুখাবয়বের জেল্লাতেই কেল্লার রাজ-কর্মচারী হয়ে সেবকের পরিবর্তে প্রভু হয়েছেন তিনি; এই প্রামাণিক জ্যামিতি উপস্থিত।
আর এই রোজিনা ট্র্যাজেডিতে ১৯৭১-এর দৈনিক সংগ্রাম সন্নিহিত রাজাকার দের মতো কারা গত দু’দিন ভিক্টিম ব্লেমিং করেছে; চোরের খনি স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের সহমতভাই হয়েছে; মানে ২০২১-এর ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায়! এই বইটি তো ফেসবুকের দৈনিক শিয়াল, সাপ্তাহিক জোনাকি, ২৫০ টাকা রেটে মন্তব্য কেনার ব্যাপারী রঙ ময়, সাইবদর, রাজভোঁদড়-দের স্ট্যাটাসে স্টেটাসে লেখা হয়ে আছে জাস্টিফিকেশানের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্পের যৌবনজ্বালার স্লামডগ মিলিওনিয়ার কিংবা হোয়াইট টাইগার অরণ্যের পাতায় পাতায়। বানানভুল ময় হাতেমও নেপোটিজমের ভাস্কর্য হয়ে রয়ে গেলেন ফেসবুক আর্কাইভে; বিবেক বিবর্জিত কাটপিস ভিডিও দেখিয়ে রোজিনাকেই অপরাধী প্রমাণের কতনা অশ্রুজল তার বানান ভুল ভাট-কাব্যে।
তারমানে রাজাকারের একটি নিত্যতাসূত্র আছে; সময়ের পরিবর্তনে রাজাকার শুধু চেহারা ও লিপসার্ভিসে শ্লোগান বদলায়। কিন্তু লক্ষ্য তার একটাই মানুষের মুক্তির যুদ্ধের টুটি চেপে ধরা।
(এ লেখায় ব্যবহৃত ছবিটি দুর্নীতি উপনিবেশের একজন কমান্ডিং অফিসারের; যিনি দুর্নীতি বিরোধী লড়াই-এর তথ্যযোদ্ধার টুটি চেপে ধরেছে; দেশের মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করা একজন অনুসন্ধানী প্রতিবেদককে নিজের কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে পাঁচ ঘন্টা আটকে রেখে তারপর পুলিশকে ব্যবহার করে জনযুদ্ধের সাহসিকাকে কারাগারে পাঠিয়েছে। অনেক নতুন পলিটিক্যালি কারেক্ট তরুণ প্রশ্ন করতে পারে; আমি কী বডি শেমিং করছি; এর উত্তর হচ্ছে না। গত ৩০ বছর জমি চাষ করছেন যে কৃষক, গত ৩০ বছর ধরে গার্মেন্টসে কাজ করছেন যে সেলাই শ্রমিক; তাদের ৩০ বছর আগের ও পরের ছবিগুলো খুঁজে দেখুন; বা মনে করুন; বুঝবেন আমি শোষকের সঙ্গে শোষিতের, কেল্লার ভেতরের ও বাইরের মানুষের পুষ্টি জৌলুসের পার্থক্য নির্ণয়ের চেষ্টা করছি মাত্র।)