অধ্যায়: এক
প্রথম জীবন
আমার জন্ম বর্তমান বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অংশে, মৌলভীবাজার জেলার তিলকপুর গ্রামে। ধলাই নদীর তীরে অবস্থিত গ্রামটি সত্যিই চমৎকার একটা গ্রাম, যার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটার শুরু ভারতে খুব ছোট্ট একটা ছড়া হিসেবে; যা গ্রীষ্মের সময় মাত্র ফুটখানেক গভীর থাকে। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে গ্রামে এই ছোট্ট নদীটির ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়, গ্রামের পর গ্রাম, অসংখ্য মানুষ হয় গৃহহীন। সেখানেই আমার বাবা স্বর্গত ললিত মোহন সিনহা পড়াশোনা করেন নরমাল হাই স্কুল ও কলেজে, যার অবস্থান শিলচর, ভারতের কাছাড় জেলায়। তিনি সেখানেই বাংলা সাহিত্যে নর্মাল ডিগ্রিতে অধ্যয়ন করেন যা আজকের দিনে আর্টস এ স্নাতকের সমতুল্য। মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় তিনি স্কুল শিক্ষক হিসেবে তার পেশাজীবন শুরু করেন, স্কুলের নাম বাটুলী রাগানা উচ্চ বিদ্যালয়। আমার মা স্বর্গত ধনবতী সিনহা পড়াশোনা শুরু করেন কাছাড়ের করিমগঞ্জে, বড় বোনের বাড়িতে।
আমার মাসী প্রয়াত কোকিলা সিনহা স্বামীর সঙ্গে থাকতেন, যিনি ছিলেন একজন সাব-রেজিস্টার। যেহেতু মাসিমা ছিলেন খুব অল্পবয়স্ক, তাই তিনি খুব একাকী বোধ করতেন, আর আমার দাদা-দাদী তার সঙ্গী হবার জন্য মাকে পাঠালেন। তারা দুবোন ছিলেন পিঠাপিঠি আর তাই খুব ঘনিষ্ঠ। বাবা যখন রাগানা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকরিরত ছিলেন, তখন আমার মাকে বিয়ে করেন। মায়ের বয়স তখন ছিল খুব কম।
আমার বাবার দিকের আত্মীয়ের মধ্যে, তার এক ছোট ভাই ছিলেন প্রয়াত ভুবনেশ্বর সিনহা, যিনি ছয় ফুটেরও বেশী লম্বা এবং সুস্বাস্থ্য ও পেটানো শরীরের অধিকারী ছিলেন। তিনি পড়াশোনার ব্যাপারে একেবারেই মনোযোগী ছিলেন না এবং বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করেই সময় নষ্ট করতেন, আর ঠাকুরদার কাছ থেকে একধরণের প্রশ্রয় পেতেন। আমার ঠাকুরদা ধ্যানস সিনহা ছিলেন ‘টোলে’ (সংস্কৃত স্কুল) শিক্ষা লাভ করা ব্যক্তি আর উপনিষদ ও বেদ চর্চার মাধ্যমে তিনি বিশেষ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন ধর্মীয় দর্শন বিষয়ে। তিনি এই বিষয়ে বেশ কিছু পুস্তকও রচনা করেন। আমার বাবা সেগুলো সযত্নে রক্ষা করেন এবং পাঠ করতেন। স্বাভাবিকভাবেই, আমার পিতামহের দুনিয়াবি বিষয়গুলিতে কোন আগ্রহ ছিল না। আমাদের বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে একটি বড়সড় আমগাছ ছিল আর গাছের নিচে তিনি একটি মন্দির স্থাপন করেছিলেন। যাকে তিনি বৃন্দাবন বলে অভিহিত করতেন, যেটা ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি তীর্থস্থান। তাঁর আশ্রমে, তিনি ‘রাখাল নাচ’ (ছেলেদের নাচের) শিক্ষা দিতেন এবং গ্রামবাসীদের প্রতি মাসে রাখাল নৃত্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা রাখতেন। এছাড়াও তিনি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দীক্ষা দিতেন, শ্রী গীতা ও মহাভারত পাঠ হত নিয়মিত; আর ভক্তদের আপ্যায়ন করা হত ‘প্রসাদ’ দিয়ে—দেবতাদের নিবেদিত ফলে।
আমার চাচা, পিতার অনুপস্থিতি আর পিতামহের দুনিয়াবি বিষয়গুলোয় আগ্রহের অভাবের ফলশ্রুতিতে যথাযথ শিক্ষা গ্রহণ করার প্রতি আগ্রহী হননি। তিনি ফুটবল ও হকি নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। ১৯৪৭ এর শেষ দিকে বাবার বাড়ি ফিরে আসার পর আমার মা বাড়িতে চাচাকে শিক্ষাদান শুরু করেন আর পরবর্তীতে হাই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকরি শুরু করেন। আমার পিতা বাঙলা সাহিত্য, গণিতের শিক্ষক হিসাবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। তিনি গণিত বিশেষ করে পাটিগণিতে খুব দক্ষ ছিলেন।
আমদের ছিল খামার আর চষা জমি যা থেকে বিভিন্ন ধরণের ফসল ফলানো হত, যার দেখভাল করত স্থায়ী কামলারা। দুধের জন্য অনেকগুলো গরু ছাড়াও জমি চাষ দেবার জন্য ছিল দুটি মহিষ। আমার মাকে বেশ বড়সড় যৌথ পরিবারের জন্য রান্না করতে হত। আমাদের পরিবারে একটা রীতি ছিল যে কাজে যাওয়ার আগে বাড়ির পুরুষেরা গরুগুলোর যত্ন নিতেন।
বাবা এর মধ্যে মুন্সীবাজারে কালীপ্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগ দেন, যার অবস্থান আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার উত্তরে। পুরো বর্ষাকাল জুড়েই রাস্তাটা এত কাদাটে হয়ে থাকত যে, প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া সম্ভব ছিল না; যদি তার একটি বাইসাইকেল ছিল। তাই, তিনি একটি বাড়ি ভাড়া করেন এবং আমার বড় ভাইকে নিয়ে সেখানে বসবাস করতে থাকেন, যাকে হাই স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল। অবশেষে বাবা থানা সদরে, কমলগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগ দেন, যেখানে আমিও পড়ালেখা করেছিলাম। আমার পিতা উত্তরাধিকারসূত্রে পূর্বপুরুষের কাছ থেকে কিছু গুণ অর্জন করেছিলেন এবং ঠাণ্ডা মেজাজের ধর্ম মনস্ক লোক ছিলেন। অন্যদিকে, মা ছিলেন তার সন্তানদের প্রতি বেশ কঠোর এবং সন্তানদের দৈনন্দিন যাপনের বিষয়গুলি কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করতেন। পাঁচটি পুত্র ও এক কন্যা সামলাতেন তিনি। এর মাঝে একটা সন্তান কলেরায় মারা যায়, যখন সে ক্লাস সিক্সে অধ্যয়নরত ছিল।
ভাইবোনদের মধ্যে আমি দ্বিতীয়, আর আমার বড় ভাই প্রকৌশলী হিসেবে ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি লন্ডনে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন আর চট্টগ্রামের মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টে চাকরি করেন। আমার তৃতীয় ভাই একজন ব্যাংকার, চতুর্থ ভাই একজন ডেন্টিস্ট এবং বর্তমানে তারা মার্কিন নাগরিক। আমার একমাত্র বোন সত্যভামা সিলেট মহিলা কলেজে শিক্ষালাভ করেন। যেহেতু বাবা-মা আমাদের শিক্ষা নিয়ে সচেতন ছিলেন, তাই আমরা সব ভাই-বোনই সঠিকভাবে শিক্ষালাভ করি। বাবার দিনগুলো অনেক ভোরে শুরু হত যখন তিনি বাড়িতে ছাত্রদের শিক্ষাদান করতেন। ছাত্রদের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষুধা নিবৃত্ত করার বেলায় তার নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা ও তুখোড় মেধা সকলের কাছেই প্রশংসনীয় ছিল।
আমার মা পাঁচ সন্তানের লালন পালনের পাশাপাশি বেশিরভাগ গেরস্থালী কাজের দায়দায়িত্ব ভাগ করে নিতেন। আর পরবর্তীতে, চাচা দ্বিতীয়বার বিয়ে করার পর, তার স্ত্রী মানে আমার কাকিমাও বাড়ির কাজে মাকে সাহায্য করতেন। মা একজন জাঁদরেল মহিলা হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং আমি বিশ্বাস করি যে তার প্রবৃত্তি ও কঠোর পরিশ্রমের মানসিকতাই সন্তানদের যথাযথ শিক্ষা ও বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করেছে। শৈশব আমি খুব দুরন্ত ছিলাম। দুপুরের দিকে খেলা করতাম আর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতাম এবং প্রচুর খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুললাম। আমার আরেকটি আগ্রহ ছিল যা নিবৃত্ত করতে পারিনি আর তা হল, গ্রামের ছোট নদীতে বন্ধুদের নিয়ে সাঁতার কাটা এমনকি যখন বন্যা পরিস্থিতির উদ্ভব হত তখনো। সবসময়ই আমার কিছু বন্ধু ছিল যারা বয়সের দিক থেকে ছিল আমার বড়।
যখন আমি বড় হলাম, বড় ভাই নরেন্দ্র কুমার সিনহার সাথে সাথে, পারিবারিক খামারের শ্রমিকদের সাহায্য করতে শুরু করি। চাষের জন্য মহিষগুলি ব্যবহারের পাশাপাশি আমরা অগুলোকে শরৎকালে আখ চাষের জন্য ব্যবহার করতাম; যা কিনা নদীর তীরে চাষ করা হত। বিপুল পরিমাণ জমি, প্রায় ২৫ বিঘা আখ চাষের জন্য ব্যবহৃত হত যা ধলাই নদীর জলে প্রায়ই প্লাবিত হত।
১৯৭০ সালে আমি মদনমোহন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করি আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের ভর্তি হই। যেহেতু কলেজে অর্থনীতিতে আমার রেজাল্ট ভালো ছিল তাই অধ্যাপক আমাকে অর্থনীতিতে ভর্তির পরামর্শ দেন। তখন দেশের রাজনীতির হাওয়া খুব অস্থির ছিল। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাবা চট্টগ্রামে পড়াশোনা করতে দিতে চাননি এবং বাণিজ্য শিক্ষক হিসাবে তার স্কুলে যোগ দিতে বলেছিলেন। নিরাপত্তা জনিত কারণে চট্টগ্রামে শিক্ষার খরচ বহন করতে বাবা অনিচ্ছুক হওয়ায় আমি খুব দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যাই, চট্টগ্রামে পড়াশোনা করব নাকি ফিরে যাব। তিনমাস পর সিলেট ফিরলাম আর বাবার অনুমতি না নিয়েই সিলেট ল’ কলেজে ভর্তি হলাম।
বাবা যখন জানতে পারলেন, আমি আইনে ভর্তি হয়েছি তখন ক্ষিপ্ত হয়ে বাড়িতে ফিরতে আদেশ করেন। মূলত, তিনি স্কুলে আমার জন্য চাকরির ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, আইনজীবীরা মিথ্যাবাদী এবং তারা মিথ্যা কথার উপর ভর করে টাকা উপার্জন করে। তার জন্য কল্পনা করাও কঠিন, যে একজন আদর্শ শিক্ষকের ছেলে আইনজীবী হতে পারে আর মিথ্যা বলার মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করতে পারে। ফলস্বরূপ, আইন বিষয়ে পড়াশোনা নিয়ে বাবার সাথে আমার সম্পর্কে ফাটল ধরে । আমি স্পষ্ট ভাষায় তাঁকে বলে দিলাম যে, স্কুল শিক্ষক হিসাবে আমি আমার জীবন শেষ করতে পারিনা এবং তাকে এও জানিয়ে দিলাম, এমনকি আর্থিক সহায়তা না পেলেও আমি আইনে পড়া চালিয়ে যাব। তখন থেকে, ছাত্রদের শিক্ষাদানের মাধ্যমে সিলেটে খাইখরচ ও অন্যান্য মেটাতাম।
এদিকে আমার চাচা ভুবনেশ্বর সিনহা অল্প বয়স থেকেই কিডনি রোগে ভুগছিলেন। ষাটের দশকে কিডনি রোগের জন্য তাকে অপারেশান করা হয় এবং তার কিডনি পাথরমুক্ত করা হয়। অস্ত্রোপচারটি হয় টাঙ্গাইলের কুমুদিনী হাসপাতালে, যেটি দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বেশ বিখ্যাত হাসপাতাল। এরপর ১৯৭০ এর শেষ ভাগে তার প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া ও বাধার সৃষ্টি হয়। এ কারণে, আমি তাকে সিলেট নিয়ে এলাম আর ১৯৭১ এর মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করলাম। তিনি হাসপাতালের খাবার খেতে চাইতেন না আর তাই আমি যেখানে থাকতাম, সেই মাছিমপুর থেকে খাবার নিয়ে যেতাম। অস্ত্রোপচার বিভাগের বিখ্যাত শিক্ষক অধ্যাপক শামসুদ্দীন আহমেদ ২৫ মার্চ, ১৯৭১ সালের পাঁচ-ছয় দিন আগে তার কিডনির পাথর অপসারণ করেন। স্বাভাবিকভাবেই ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় আমি সাইকেলে করে তার খাবার আনলাম। খেয়াল করলাম তার গায়ের তাপমাত্রা খুব বেশি ছিল এবং রাতের বেলায় সেখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যদিও তিনি বুঝতে পারছিলেন, দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়।
পুরো শহর জুড়ে একটা চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিল আর সেটা হাসপাতালেও দেখা গেল। প্রায় সব রোগী ও তাদের সাথে থাকা লোকেরা হাসপাতাল কম্পাউন্ড থেকে বেরিয়ে এসে বলতে লাগল, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আধা কী একঘণ্টার মধ্যেই আমরা শুনতে পাই নির্বিচারে গোলাগুলি আর অগ্নিসংযোগের শব্দ। সকল রোগী ও অন্যান্যরা হাসপাতালের ভেতরে আশ্রয় নিলেন আর তার ঘণ্টাখানেক পর রিকশা ও ভ্যানে করে গুলিবিদ্ধ লোকদের আনা হল একের পর এক। একঘণ্টার মধ্যে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ জন আহত লোককে হাসপাতালে আনা হয় এবং জরুরি বিভাগের রক্তে ডুবে যায়।
রোগীদের দেখভাল করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রফেসর শামসুদ্দীনকে নিয়ে আসার জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্স পাঠায়। যেহেতু পরিস্থিতি ভয়াবহতার দিকে মোড় নিচ্ছিল, তাই চাচা আমাকে চলে যেতে আদেশ করলেন এই বলে যে, মাসিমা আমার সম্পর্কে ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে পারে; কারণ আসবার আগে তাকে বলিনি, এখানে থাকব রাতে আর ঘর ছাড়ার আগে কিছু খেয়ে আসিনি।
তাই, কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে দাড়িয়াপাড়া হয়ে মাছিমপুরের দিকে আগাই। কিন্তু আমি জিন্দাবাজারের কাছে বড় রাস্তায় প্রবেশের আগেই দেখলাম গলির প্রান্তে অনেক লোক দাঁড়িয়ে আর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ঘরে ফিরতে পারছিল না, কারণ কারফিউ ছিল; কেউ কেউ বলেন, কারফিউ ছিল না। আমরা বিভ্রান্ত অবস্থায় কথা বলছিলাম আর তখন দেখতে পেলাম পুলিশের জিপ আসছে একটা। আর লামাবাজার থেকে জিন্দাবাজারের দিকে একজন ঘোষণা দিচ্ছে কারফিউ জারি করা হয়েছে এবং দেখামাত্র গুলির নির্দেশ। একটু পরে কয়েকটা আর্মি জিপ এলো আর নির্বিচারে মেশিনগানের গুলি ছুঁড়তে শুরু করল। আমি সাইকেলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম আর হাসপাতালে ফিরে গেলাম। লক্ষ্য করলাম যারা আমার সাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম তাদের অনেকের শরীরেই বুলেটের ক্ষতের চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল।
হাসপাতালে ফিরে আমি হন্তদন্ত হয়ে চাচার কেবিনে ঢুকে মেঝেতে পড়ে গেলাম। জ্বরে আক্রান্ত আমার চাচার পেটে অস্ত্রোপচারের সেলাইগুলো ভালোভাবে শুকায়নি। তবুও তিনি বিছানা থেকে নেমে এসে জিজ্ঞেস করলেন আমিও কি আহত, যেহেতু আমার কাপড়ে রক্তের দাগ ছিল। তিনি আমাকে এক গ্লাস পানি দিলেন। কয়েক মিনিট পর যখন আমি সম্বিৎ ফিরে পাই তখন দুঃখজনক ঘটনাটির বর্ণনা দিলাম। তাকে বললাম, আমার পাশে থাকা অন্য লোকগুলোকে গুলি করে মারা হয়েছে আর আমি বেঁচে গিয়েছি আমার এই সাইকেলের জন্য।
আর তারপর দেখলাম প্রফেসর শামসুদ্দীন আহমেদ সারাদিন ধরে কোন বিশ্রাম না নিয়ে আহতদের চিকিৎসা দিতে থাকেন। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না এবং হাসপাতালের খাদ্য সরবরাহও ছিল কম, তাই আমাদের খাওয়ার মত কোনো খাবার ছিল না। অবস্থা দৃষ্টে, কিছু রুটি এবং অন্যান্য খাবার চাইতে আমি হাসপাতাল সুপারের কাছে গেলাম। তিনি উত্তর দিলেন যে রেশন সরবরাহ করা হয়নি এবং এমনকি নিয়মিত রোগীদের সকালের নাস্তা, দুপুর বা রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। অতএব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত রোগীদের ‘খিচুড়ি’ সরবরাহ করা হবে।
আমাদের কাছে অল্প কটা টাকা ছিল আর আমি চাচাকে বললাম, রাস্তার বিক্রেতার কাছ থেকে রুটি আনব। ওরা হাসপাতালের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে দাড়িয়াপাড়ার কাছাকাছি চা ও রুটি বিক্রি করে। পুরনো সিলেট মেডিক্যাল কলেজ ছিল পশ্চিম দিকে এবং হাসপাতালটি পূর্বের দিকে, একটি রাস্তায় বিভক্ত যা দাড়িয়াপাড়া থেকে যায় এবং লামাবাজার থেকে জিন্দাবাজার পর্যন্ত প্রধান রাস্তায় সংযোগ ঘটায়। মাত্র আধা পাউন্ড রুটি খুঁজে পেলাম এবং কিনলাম। এটি আনা। আমরা একটা অনিশ্চিত অবস্থায় পতিত হলাম: দুজন লোকের জন্য আমাদের ছিল মাত্র আধ-পাউন্ড রুটি। কোনও পানীয় ছিল না আমাদের আর তাই বাথরুম ট্যাপ থেকে পানি পান করা শুরু করতে হয়েছিল। ওই একটা রুটি খেয়ে আমরা দুইদিন ছিলাম! আমার চাচা রুটি খেতে আমাকে চাপ দিচ্ছিলেন আর আমি তাকে অসুস্থ অবস্থায় রুটি খেতে অনুরোধ করছিলাম। সত্যি বলতে আমরা শুধু রুটি আর পানি খেয়েই ছিলাম। ৪৮ ঘণ্টা পর কারফিউ তুলে নেওয়া হলে, বিস্মিত হয়ে আমরা দেখি যে, রুটির অর্ধেক তখনও রয়ে গেছে। আমি চাচাকে বললাম যে পরিস্থিতি পুরোপুরি অনিশ্চিত, আর আমি কিছু খাবার ও টাকা আনতে যেতে চাই বাড়িতে, যেভাবেই হোক।
দুই দিন পর, হাসপাতালটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে এবং চিকিৎসক ও নার্সরা চিকিৎসা দিতে ব্যস্ত হয়ে যায়। চাচার অবস্থার কেমন উন্নতি হয়েছে সেটা জানতে প্রফেসর শামসুদ্দীনের কাছে যাই, যাতে তার অনুমতি নিয়ে আমরা অনিশ্চয়তার এই সময়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারি। তিনি আমাদের অস্ত্রোপচার ক্ষত নিরাময়ে কিছু ঔষধ দিলেন, ব্যান্ডেজ বদলে দিলেন আর বাড়ি যাবার অনুমতি দিলেন। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পনেরো দিন পর তিনি চাচাকে আবার দেখবেন বলে জানালেন। তাই আমি তাকে আটদিন পর রিকশায় মাছিমপুরে নিয়ে এলাম। সম্ভবত কয়েক দিনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ এবং কষ্টের কারণে আমি প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হলাম যা টাইফয়েডে পরিণত হয়েছিল।
গুজব শোনা যাচ্ছিল যে সিলেটের বাইরে যাবার সব রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অতএব, আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শহর ত্যাগ করতে হবে নতুবা পরবর্তীতে শহর ত্যাগ খুব কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। মে মাসের শেষ সপ্তাহে আমার জ্বর সামান্য হ্রাস পায় আর আমরা এক সকালে গ্রামের দিকে যাত্রা শুরু করি আমাদের স্ত্রীর পরিবারের লোকসহ মোট চারজন। আমার স্ত্রীর ঠাকুরদা অর্জুন বাবু, সিলেট জেলা পরিষদের একাউন্টেন্ট জেনারেল, ছিলেন একজন জনপ্রিয় ব্যক্তি। জেলা পরিষদের ঠিকাদারদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ঠিকাদারদের একজন সুরমা নদীর বিপরীত তীর থেকে আমাদের জন্য একটি ট্রাকের ব্যবস্থা করলেন। নৌকায় সুরমা নদী অতিক্রম করে আমরা শহরের বাইরে পৌঁছতে পারলাম। আমি দুইজন লোকের ঘাড়ে ভর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম কারণ অসুস্থতা হেতু তখন পর্যন্ত মুখে কোন খাবার নিতে পারিনি। আমরা গোধূলিবেলায় তাজপুর ডাকবাংলোয় পৌঁছলাম। স্থানীয় লোকেরা আমাদের আপ্যায়ন করলেনে এবং ‘খিচুড়ি’ রান্নার জন্য চাল ও মুরগি সরবরাহ করলেন। দুই সপ্তাহ পর আমি এক বাটি খিচুড়ি খাই এবং শরীরে একটু বল পাই।
পরদিন সকালে আমরা হাঁটতে শুরু করি আর মাঝে মাঝে রিক্সা ভ্যানের সাহায্য নেই, শিশু ও অসুস্থ ব্যক্তিদের বহনের জন্য, যখনই পাওয়া যায়। এইভাবে আমরা শেরপুর ফেরিঘাটে পৌছাই। শেরপুর নদী পার হওয়ার পর, আমরা একটা ট্রাকের দেখা পাই। চালক আমাদের শ্রীমঙ্গল নিয়ে যেতে রাজি হয়। আমরা প্রায় ৩ টার দিকে শ্রীমঙ্গল পৌঁছাই এবং সেখানে থেকে ১২ কিলোমিটারেরও বেশি শ্রীমঙ্গল-ভানুগাহ জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে শুরু করি। এই যাত্রা ছিল অকল্পনীয় কষ্টের। শ্রীমঙ্গল ও ভানুগাহের মধ্য দিয়ে একটি রাস্তা ছিল, কিন্তু সেটা ছিল পুরোপুরি কর্দমাক্ত। এমন নয় যে খুব বেশী ক্ষুধার্ত বা অসুস্থ ছিলাম; বরং আমাদের মনের মধ্যে একমাত্র ভয় ছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মুখোমুখি না হতে হয়। আমরা আঁকাবাঁকা বা জিগজ্যাগ ফ্যাশনে ভ্রমণ করেছি এবং পদ্মচেরা চা এস্টেট অতিক্রমের পর, আমরা চিংগঙের মাধবপুর গ্রামের সর্ব পশ্চিমে আমাদের মামার (সোনাই মামার) বাড়ি পৌঁছাই। সোনাই মা আমাকে খুব ভালোবাসতেন এবং আমার স্বাস্থ্যের অবস্থা দেখে সেখানে আমাদের থাকার জন্য অনুরোধ করেন। আমরা কিছু মুড়ি ও পানি নেই আর আমাদের গ্রামের দিকে শুরু করি, যা ধলাই নদী থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে উত্তর-পূর্ব দিকে। আমরা দিন শেষ হবার আগেই বাড়িতে পৌঁছাবার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম কারণ আমরা যদি রাতে মামার বাড়িতে থেকে যাই আর শরীরের অবস্থা খারাপ হয় তাহলে বাড়িতে ফিরতে পারব না। অবশেষে, আমরা রাত পৌনে নয়টার দিকে আমাদের বাড়িতে পৌঁছেছিলাম।
বাড়ীতে সাত দিন বিশ্রাম নেবার পরে আমি সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হই। আমাদের বাড়ির সামনে রাস্তাটা মৌলভীবাজার শহর থেকে শেষ কুমরারছরা চা এস্টেটে চলে গেছে যার শেষমাথায় ত্রিপুরা, ভারতের সঙ্গে সীমান্তে। সড়কের দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। রাস্তার অবস্থা ছিল শোচনীয়। কোথাও ভেজা কাদার গভীরতা ছিল এক ফুটেরও বেশি আর উপরে দিকে শুকিয়ে যাচ্ছিল। ইতোমধ্যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শমশের নগর বিমান বন্দরে তাদের শিবির স্থাপন করে এবং থানা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় শান্তি কমিটি গঠনের মাধ্যমে। আর শান্তি কমিটির মাধ্যমে রাজাকার নিয়োগে শুরু করে দেয়। সেনাবাহিনী গ্রামবাসীদেরকে শান্তি কমিটির সহায়তায় রাস্তা চলাচলের উপযোগী করে তৈরির নির্দেশ দেয়। কিছু মৌলবাদী মণিপুরি ইম্পালা, ভারত থেকে এসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সমর্থন দেয় যাদের নেতা ছিল মৈতৈ মনিপুরী সুধীর। তারা হোমেরজান গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি মণিপুরি মৈতৈ দের মধ্য থেকে রাজাকার নিয়োগের কাজ শুরু করেন। রাস্তার মেরামত করতে গ্রামবাসীদের উপর চাপ দেয়া হচ্ছিল, কিন্তু রাস্তার গর্তগুলি ভরাট করার জন্য শুকনো মাটি ছিল না কারণ তখন ছিল বৃষ্টির সময়।
আমার এক বন্ধু অনিলের কাছ থেকে শুনেছি যে, সেনাবাহিনী রাজাকার বাহিনীর পরিবর্তে রাস্তা নির্মাণের কাজের দায়িত্ব দিতে স্থানীয় তরুণদেরকে খুঁজছিল। যখনই আমরা শুনি যে সেনাবাহিনী আমাদের এলাকায় চলে এসেছে, তখন আমরা পশ্চিম দিকের ধানক্ষেতে আশ্রয় নিতাম, যেখানে ধলাই নদীর তীরে একটি বিশাল এলাকায় কোন মনুষ্য বসতি ছিল না। কখনও কখনও সকালে থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এভাবে যেত আর জোঁক আমাদের রক্ত চুষে নিত কিন্তু আমরা নড়াচড়া করতে পারতাম না। এটি ছিল এক নৃশংস পরিস্থিতি।
অবশেষে, সেনাবাহিনী গাছের শাখাগুলি স্থাপন করে এবং তার উপর মাটি ভরাট করে রাস্তা নির্মাণে সক্ষম হয়। যখন সড়কটি কার্যকর ছিল তখন সেনাবাহিনীর আসা যাওয়া নিয়মিত ছিল। কারণ দক্ষিণের সীমান্তটি আমাদের ঘর থেকে প্রায় বিষ কিলোমিটার দূরে। সম্ভবত সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা হিসাবে রাস্তাটি ব্যবহার করার কথা ভেবেছিল, ভানুগাহ থেকে পত্রখোলা চা এস্টেটের বিকল্প সড়ক হিসেবে, যা কিনা যাতায়াতের বেশ উপযোগী ছিল। এই সময়ে, আমি বন্ধু গৌরমোহনের সাথে ভারতে মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেই এবং সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য মাধবপুর গ্রামে আশ্রয় নেই। আমরা তিন রাতের জন্য সেখানে থাকি, কিন্তু সীমান্ত অতিক্রম করতে পারিনি কারণ ইতিমধ্যেই সেনাবাহিনী দূরবর্তী এলাকায় শান্তি কমিটি ও রাজাকার দল গঠন করেছিল এবং সীমান্ত সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সীমান্তবর্তী পুরো এলাকাতেই জনসংখ্যার অধিকাংশই হিন্দু ও মুসলিম মৈতৈ সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। আমি যে মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়ের অন্তর্গত, তার চেয়ে ওদের ভাষা বেশি প্রচলিত ছিল। এই মৈতৈ হিন্দু ও মুসলমানরা ছিল পাকিস্তানের সমর্থক। ফলত, সীমান্ত অতিক্রম করা আমাদের জন্য কঠিন ছিল। সংবাদদাতারা আমাদের জানান যে ভারত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে সতর্কতা হিসাবে সীমান্ত সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে ফেলা হয়েছে। তাই, তিনদিন পর আমি বাড়ি ফিরে যাই, কিন্তু গৌরমোহন মাধবপুরে তার বোন বাড়িতে থাকলেন। পরে আমি জানতে পারলাম তিনি পনের দিন পর সীমান্ত অতিক্রম করতে পেরেছিলেন।
আমি প্রায় সারাদিনই পশ্চিম দিকের ধানক্ষেতে বসে থাকতাম আর সন্ধ্যায় ঘরে ফিরতাম। সেপ্টেম্বরের দিকে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যক্রমের ব্যাপারে খবর পাই এবং তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করে। তারা পূর্বদিকের গভীর বন থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে এবং সেনাবাহিনী ক্যাম্পের তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চালায়। আমরা তাদের দরকারি তথ্য, খাদ্য এবং প্রয়োজন মাফিক আশ্রয় দিতে শুরু করি। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধার প্রথম ব্যাচ আমাদের এলাকায় প্রবেশ করেছিল এবং আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছিলাম। আমি অনিলের পাশাপাশি চাল, ডাল, আলু সংগ্রহ করেছিলাম এবং খিচুড়ি রান্না করেছিলাম রাজবাড়ী পুকুরের দক্ষিণ দিকে। একইরকম দ্বিতীয় ঘটনায় আমাদের বলা হয় বিশজন লোকের জন্য রান্না করতে। তখন প্রায় অপরাহ্ন দুটো ত্রিশ থেকে তিনটা হবে । আবদুল মান্নান নামে সিও (বিভাগীয়) অফিসের একজন ক্লার্ক, যে ছিল মুসলিম মৈতৈ সম্প্রদায়ের সদস্য এবং সম্ভবত তার সম্প্রদায়ের এক মাত্র এসএসসি পাশ সদস্য, পশ্চিম দিক থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে খবর দিয়ে নিয়ে এলো পার্শ্ববর্তী ধলাই নদী পার করে। সেনারা নদী পার হয়ে মেশিনগান দিয়ে ব্রাশফায়ার শুরু করে আর আমাদের গ্রামে আক্রমণ করে। আমরা সবাই পূর্ব দিকে পালিয়ে গেলাম। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মঙ্গলপুরে আশ্রয় নিয়েছিলেন আর আমি তিন কিলোমিটার পূর্বে চিতলিয়াতে ফাল্গুনি সিনহার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম, যিনি বয়সে আমার কাছাকাছিই, এবং ছিলেন মৈতৈ সম্প্রদায়ের। মৈতৈ সম্প্রদায়ের হলেও যেহেতু তিনি আমার বাবার ছাত্র ছিলেন, তাই আমাকে তিনি দুই দিন আশ্রয় দিলেন। যেহেতু আমার কাছে শীতের কাপড় ছিল না তাই তিনি আমাকে মণিপুরি মোড়ানো এক ধরণের পোশাক দিলেন। আমি দুই দিন পর দেশে ফিরে আসি। বাবা মা ধরে নিয়েছিলেন যে আমি সামরিক বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছি, কারণ আমি দুদিন ধরে অনুপস্থিত ছিলাম আর তারা আমাকে অস্থির করে তুলছিলেন। আমি তাদেরকে বললাম যে, আমার সাথে মুক্তিবাহিনীর যোগাযোগ আছে আর আমি তাদের জন্য তথ্যদাতা হিসেবে কাজ করছি। আমি চিতলিয়াতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমি ভীত ছিলাম যে সেনাবাহিনী আমাকে রাতে খুঁজতে পারে এবং সেজন্য সতর্কতা হিসাবে আমি ঘরে ফিরে আসিনি।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে, মুক্তিবাহিনী আমাদের গ্রাম ও আশেপাশের গ্রামগুলি নিজেদের দখলে নিয়েছিল, তারপর তারা সমগ্র থানা দখল করে। ১২ ডিসেম্বর থেকে আমাদের সমগ্র এলাকা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। গৌরমোহন ও মুজিববাহিনী বাহিনী আমাদের গ্রামে আসার পর, আমরা আমাদের পদক্ষেপ বিষয় তথ্য পাচারের জন্য আব্দুল মান্নানকে হত্যা করতে গেলে, সে টিটিয়াগাঁও এর একটি মুসলিম মৈতৈ গ্রামে আশ্রয় নিলো। তখন আমরা জানতে পারলাম যে এলাকার এক মুক্তিযোদ্ধা নেতা যিনি ছিলেন আমার বন্ধু—তার বাড়িতে আব্দুল মান্নানকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তার নাম উল্লেখ করে আমি তাকে বিব্রত করতে চাই না। আমি এমন আচরণের জন্য তাকে অভিযুক্ত করেছিলাম, বন্ধু আমাকে বলেছিলেন যে মান্নান সিও (বিভাগীয়) অফিসের ক্লার্ক এবং তার কাছ থেকে সে অনেক সাহায্য গ্রহণ করেছিল। তিনি আব্দুল মান্নানের বিয়ের অভ্যর্থনাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সেই সময়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে আমার বিদ্বেষ জেগে উঠল। জালালাবাদী, আমার কলেজের এক বন্ধু, যিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নেতা ছিলেন তিনি থানা সদর দফতরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলেন। স্বাধীনতার পর আমার সকল বন্ধু মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট গ্রহণ করেন। কিন্তু সেই একটি কারণেই আমি তা সংগ্রহ করার কোন চেষ্টাও করিনি।
চলবে…
==============
নবযুগ সম্পাদকের নোট: তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে দীর্ঘ সামরিক শাসনের ইতিহাস মাথায় রেখে যারা বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করে তারা আসলে কেউই মনে রাখেননা, দিনশেষে তারা সামরিক শাসক নন, জনগণের নির্বাচিত সরকার। পর্দার আড়ালে ঘটে যাওয়া ঘটনা সামনে আসবার নজির খুব কম বলেই, আমরা সম্পূর্ণটা কখনো জানতে পাই না। তাই রূপকথার মতো মনে হয় আমাদের বাস্তবতাগুলো, সেই জাদুবাস্তবতার বাংলাদেশের জন্য সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা’র আত্মজীবনীমূলক বই ‘একটি স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী: আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র’ একটি মোক্ষম চপেটাঘাত, আমাদের ঘুমন্ত নাগরিকদের জেগে ওঠার আহ্বান।
বইটি দ্রুত অনুবাদের জন্য ড. নাজিম উদ্দিন-এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী গবেষক ও লেখক আদিত্য রাহুলকে। আশাকরি অনেকেই এটা পাঠ করে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে একটা ধারণা পাবেন। এই অধ্যায়টি অনুবাদ করতে গিয়ে লেখকের শৈশব ও যুবক বয়সের কিছু গ্রাম ও মানুষের নাম ইংরেজিতে যেভাবে লেখা হয়েছে তার বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ করতে কিছুটা সংশয় হওয়ায়, আগ্রহী পাঠক ও জ্ঞাত ব্যক্তিদের এই বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে অনুরোধ করা যাচ্ছে। গ্রাম ও ব্যক্তির নামগুলো কারো যদি জানা থাকে তবে সেগুলোর সঠিক বানান, জানাবার অনুরোধ রইল। সকলকে শুভেচ্ছা।