অধ্যায়: দুই
জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার লড়াই
মুক্তিযুদ্ধের ঠিক পর পরই আমি দ্বিতীয় শ্রেণীতে সর্বোচ্চ নাম্বার নিয়ে এল এল বি পরীক্ষা পাস করি। আইন পড়ার কারনে আমার বাবা আমাকে সম্পূর্ণ রুপে ত্যাজ্য করেন এবং বলেন যে আমি আইন পেশায় যুক্ত হলে তাঁর সন্তানের পরিচয় দিতে পারব না। আইন পাশ করার পরে আমি এমনিতেই অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। প্রথমত, সিলেটে আমার কোন থাকার জায়গা ছিল না; দ্বিতীয়ত, তখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল; তৃতীয়ত, পরিবারের সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া আইন পেশা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব; এবং সবশেষে, একজন ভাল আইনজীবী হবার পূর্বশর্ত হলো অন্য একজন ভাল পসারের বয়োজ্যাষ্ঠ আইনজীবীর চেম্বারে যোগ দেয়া। এ সব কিছুর জন্য সাহায্য-সহযোগিতা দরকার এব এর কোনটাই আমার ছিল না। তখনকার সময়ে আমার সব বন্ধু-বান্ধব আইন পাশ করার পরে টিকে থাকার জন্য স্থানীয় মহকুমা বারে যোগদান করে। কিন্তু আমি সিলেটে থাকার সিদ্ধান্ত নেই কারন একজন ভাল আইনজীবী হতে হলে আমাকে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে জেলা আদালতে থাকতে হবে। আমি তখন সিলেটের কোন ভাল আইনজীবীকে চিনতাম না। শুধু ছাত্র হিসেবে কিছু সিনিয়র আইনজীবীকে চিনতাম। সে সময় সব আইনজীবীর চেম্বার রাত বারোটা পর্যন্ত খোলা থাকত। নতুন পাশ করা কাউকে ভাল আইনজীবী হতে হলে তাকে কোন একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবীর চেম্বারে লেগে থেকে কঠোর পরিশ্রম করতে হতো। আমিও তাই কোন একজন ভাল আইনজীবীর সাথে যোগ দিয়ে প্রমান করতে চাচ্ছিলাম যে আইনজীবী মানেই মিথ্যুক নয়, ভাল আইনজীবী হলে তারা সমাজে একজন সম্মানিত মানুষ হিসেবে গন্য হন।
বন্ধুদের সাথে আলাপ করে আমি বিখ্যাত ফৌজদারী আইনজীবী এবং সামাজিকভাবে অত্যন্ত সম্মানিত উকিল সোলেমান রাজা চৌধুরীর চেম্বারে যোগ দিব বলে মনস্থির করলাম। সিলেট ল কলেজে তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন। এক বুক আশা নিয়ে, সাহস সঞ্চয় করে একদিন সন্ধ্যায় আমি চৌধুরীর চেম্বারে গেলাম। সেখানে আমি কিছু মক্কেল এবং তার সহকারী মুনিরুদ্দিন আহমেদকে দেখতে পেলাম। আমাকে দেখে চৌধুরী আমার আসার কারন জানতে চাইলেন, আমি খুব বিনয়ের সাথে তাঁর কাছে আমার মনের ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। কোন রকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়া আমি তাঁকে বললাম যে, আমি যে জাতি থেকে উঠে এসেছি তার নাম বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, তারা খুব সহজ সরল প্রকৃতির মানুষ, বেশিরভাগই কৃষিকাজ বা শিক্ষকতা করে জীবিকা নির্বাহ করে। এদের জীবন-যাত্রা খুবই সহজ এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী যেমন, মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের তুলনায় এরা গরীব। এমনকী কোটার কারনে আদিবাসী পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর মানুষেরাও সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও সরকারী চাকরিতে ঢুকতে পারে, সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব আছে, তাদের মধ্য থেকে একজন মন্ত্রীর পদমর্যাদারও অধিকারী হন। অপর দিকে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের জন্য মন্ত্রী পদমর্যাদা তো দূরের কথা সংসদেও কোন প্রতিনিধি নেই, সমারিক বাহিনী, পুলিশ বা সিভিল প্রশাসনে কোন অফিসার নেই। অর্থনৈতিক ও সামাজিক মূল্যায়নে মুসলিম এবং হিন্দুদের সাথে তুলনায় তাদেরকে তাই নীচু জাতের বলে গন্য করা হয়। এডভোকেট চৌধুরী আমাকে সরাসরি বলে দিলেন যে তিনি আমাকে তার জুনিয়র হিসেবে রাখতে পারবেন না, অন্য কোন সিনিয়র আইনজীবীর সাথে যোগ দেবার পরামর্শ দিলেন। আমি এতে খুব মুষড়ে পড়ি কিন্তু মানসিকভাবে পজিটিভ থাকার চেষ্টা করি। আমার সাথে কথা শেষ করে তিনি তখন আবার কাজে মনোযোগ দিলেন, আমি তাঁকে আর কিছু না বলে সেখানেই মাথা নীচু করে বসে থাকি। তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি তার সাথে কাজ করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম তাই ইতোমধ্যে চেম্বারে তার সহযোগী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাবার প্রক্রিয়ায় যে কোন ধরনের অপমান সহ্য করে নিব বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছি। কিছু সময় পরে আমি লক্ষ্য করলাম তার চাপরাশি এসে তাকে ড্রয়িং রুমে যেতে ইশারা করছে। তারপরে দেখলাম চৌধুরী তার সহকারী মুনিরুদ্দিনকে সাথে নিয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে গেলেন। ড্রয়িং রুমটা ছিল তার চেম্বারের উত্তর পাশে, চেম্বার আর ড্রয়িং রুমের মাঝে আরেকটা রুম ছিল। আমি বুঝতে পারলাম তারা সেখানে চা পান করছেন। আমাকে তারা চায়ের জন্য বলেনি যদিও আমি এক সময় তার ছাত্র ছিলাম। আমি অপমানিত বোধ করছিলাম কিন্তু সেটা প্রকাশ করিনি।
পরদিন থেকে আমি নিয়মিত চেম্বারে যেতে শুরু করলাম। চৌধুরী আমাকে না দেখার ভান করলেন আর তার সহকারী আমার সাথে কথা বলত না। আমি মুনিরুদ্দিনের পাশে একটা চেয়ারে বসতাম। কোন কোন সময় একসাথে বেশি মক্কেল আসলে চৌধুরী আমাকে সরে পেছনের বেঞ্চে মক্কেলদের চেয়ারে বসতে বলত। এতসব অবহেলা অপমান সত্ত্বেও আমি মাসের পর মাস চৌধুরীর চেম্বারে নিয়মিত যেতে থাকলাম। আমার বিশ্বাস ছিল যদি একবার তাঁর কাছ থেকে মামলার খসড়ার জন্য শ্রুতিলিখন নেবার সুযোগ পাই তাহলে চৌধুরী আমাকে তাঁর সহযোগী হিসেবে নিতে বাধ্য হবেন। মুনিরুদ্দিনের হাতের লেখা এবং ডিক্টেশান নেবার ধরন দেখে আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমি মুনিরুদ্দিনের চেয়ে অনেক ভাল এবং সেটা জানতে পারলে চৌধুরী জুনিয়র হিসেবে আমাকেই প্রাধান্য দিবেন। সোলেমান চৌধুরী ডান হাতে লিখতে পারতেন না, একটা একসিডেন্টের পর থেকে তার এ সমস্যা দেখা দেয় যার কারনে তিনি বাম হাতে সই করতেন। এদিকে প্রায় রুটিনের মত চৌধুরী আমাকে বাদ দিয়ে চা পান করতেন, কিন্তু তার আচরণে আমি মন খারাপ করতাম না, কারন তার সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাওয়া আমার আমার একমাত্র স্বপ্ন ছিল।
শেষ পর্যন্ত এক ঝড়ের রাতে আমার ধৈর্য্য এবং লেগে থাকা স্বার্থক হয়। সেদিন ঝড়-বৃষ্টির মধ্য দিয়ে চেম্বার আসার সময়ে আমি ভিজে সপসপে হয়ে পড়েছিলাম। এ সময় দরজা-জানালা বন্ধ ছিল তারপরেও আমি বারান্দায় অপেক্ষা করেছি। এক সময় আমি দরজার বেল টিপলে চাকর ছেলে এসে দরজা খুলে দেয়। চেম্বারে ঢুকে আমি ফ্যানের বাতাসে আমার জামা শুকাতে চেষ্টা করলাম। কিছু সময় পরে কয়েকজন মক্কেল আসল কিন্তু সে সন্ধ্যায় মুনিরুদ্দিন আসতে পারেনি। আমি চাকরকে বললাম চৌধুরী সাহেবকে বল যে মক্কেল এসেছেন। ঐদিন চৌধুরী সাহেব দ্বিতীয় বারের মত আমার সাথে কথা বলেন। তিনি আমার দিকে তাকালেন, দেখতে পেলেন আমার জামা-কাপড় সম্পূর্ণ ভিজা, তারপরে একটু আশ্চর্য হয়ে মন্তব্য করলেন এমন আবহাওয়ায় আমি ছাতা ছাড়া এসেছি। কাজের প্রতি আমার ভক্তি দেখে হয়ত তার মনে হয়ত দয়া হয়েছিল, চাকর ছেলেটাকে বললেন আমাকে একটা তোয়ালে দিতে, আর আমাকে বললেন যেহেতু আমি এসেছি এবং তারও মামলার জন্য কিছু জরুরী খসড়া করার দরকার, তাই আমি শ্রুতিলিখন করতে পারি কিনা জানতে চাইলেন। আমি পজিটিভ জবাব দেবার সাথে সাথেই তিনি ডিক্টেশান দেয়া শুরু করলেন। তিনি দেখতে পেলেন আমি অনেক ভাল ও তাড়াতাড়ি শ্রুতিলিখন করতে পারি, তাছাড়া আমার হাতের লেখাও অনেক সুন্দর। লেখা শেষ হলে তিনি আমার ইংরেজির প্রশংসা করলেন, আমার হাতের লেখাও ভাল বললেন, এবং বলতে চাইলেন কেন আমি তাকে আগেই সেটা বলিনি। সেদিন সন্ধ্যায় তিনি আমাকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে গেলেন এবং আমাকে চা-নাশতা খেতে দিলেন। সে সন্ধ্যায় আমি এতটা অভিভূত হয়েছিলাম যে কোন রকমে আবেগ দমিয়ে রেখে এ সুযোগ দেয়ার জন্য মনে মনে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করতে লাগলাম।
পরের দিন মুনিরুদ্দিন এবং আমি দুজনেই কাজ করতে আসলাম। যখন শ্রুতিলিখনের সময় আসল, মুনিরুদ্দিন তার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল কিন্তু চৌধুরী তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “তুমি এখানে সিনিয়র, এবার সুরেনকে কিছু সুযোগ দেয়া উচিত। ” আমি বুঝতে পারলাম আমার কাজে সোলেমান রাজা চৌধুরী সন্তুষ্ট। সেদিন থেকে প্রত্যেকদিন যখনই শ্রুতিলিখনের প্রয়োজন পড়ত মুনিরুদ্দিনকে বাদ দিয়ে আমাকে সুযোগ দেয়া হত। আরেকটা ব্যাপার আমার অনুকূলে ছিল সেটা হল, প্রত্যেকদিন সন্ধ্যা হবার সাথে সাথে আমি চেম্বারে গিয়ে হাজির হতাম, মুনিরুদ্দিন সেটা পারত না কারন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তার কিছু মক্কেল ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই চৌধুরী আমাকে পছন্দ করতে লাগল। কিন্তু আমি তখন আরেক সমস্যায় পড়লাম। টাকা-পয়সার ব্যাপারে চৌধুরী খুব কিপটে ছিল। তিনি মাসে দু’বার সর্বোচ্চ ১০০ টাকা করে দিতেন, কখনও একবার। তখনকার দিনে আমি খুব গরীবী হালতে থাকতাম কিন্তু তারপরেও ঐ টাকা দিয়ে সব খরচ মেটানো সম্ভব হত না। শেষে একদিন বার কাউন্সিলে হাজিরা দেয়ার দিন স্থির হল কিন্তু আমার কাছে ঢাকা গিয়ে পরীক্ষায় অংশ নেবার মত কোন টাকা ছিল না। আমি চৌধুরীর কাছে পরীক্ষায় অংশ নেবার জন্য ৫০০ টাকা চাইলাম এবং তিনি তৎক্ষণাত সেটা দিয়ে দিলেন। আমার তখন কোন কোট বা জুতা ছিল না। তাই সেকেন্ড হ্যান্ড মার্কেট থেকে একটা কোট কিনে সেটা অল্টার করে কালো রঙ করে নিলাম। দেওয়ানী মামলা পরিচালনার জন্য বিখ্যাত আইনজীবী বি এন চৌধুরী আমার বার কাউন্সিলের ভাইভা পরীক্ষা নিয়েছিলেন। তিনি জানতে চাইলেন আমি কোন বার থেকে এসেছি। আমি সিলেট বলায় তিনি বললেন, “ও সিলেট থেকে, পয়সাওয়ালাদের আদালত এবং সেখানকার ছাত্রেরাও ভাল পোষাক পরে থাকে”। তিনি আমাকে একটাই প্রশ্ন করলেন, সেটা ছিল চুরি, ডাকাতি এবং হাইজ্যাকিং এর মধ্যকার পার্থক্য নিয়ে। আমি সঠিক উত্তর দেই এবং তিনি আমার উত্তরে সন্তুষ্ট হন।
পরীক্ষার পরে আমি এডভোকেট হিসেবে যোগ দেই, কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় হয়নি। আমি তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি পড়লাম। আমি আমার বাবার কাছ থেকে অর্থনৈতিকভাবে কোন সহযোগিতা পাইনি এবং আমার সিনিয়র আমাকে পর্যাপ্ত টাকা দিত না। আমার সহকর্মীরা মহকুমার ফৌজদারী আদালতে ভাল পয়সা কামাচ্ছিল। তারা কেবল জামিনের বন্ডে সই করে টাকা পাচ্ছিল কিন্তু চেম্বারে আমার সিনিয়র আইনজীবীরা আমাকে জামিনের আইনজীবী হতে নিষেধ করল কারন সেটা সম্মানজনক কোন কাজ নয়। এদিকে আমি যেহেতু জামিনের বন্ডে সই করি নাই তাই আমার আয়-রোজগার ছিল খুব কম, নিজের খরচই জোগাতে পারতাম না। আমি বুঝতে পারলাম আগে আমাকে টিকে থাকতে হবে তারপরে আইনজীবী হওয়া। আমি যদি টিকেই থাকতে না পারি তাহলে কিভাবে আইনজীবী হব। আমি আরো বুঝলাম মহকুমার আদালতে যোগ না দিলে আমি আমার জীবিকা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে পারব না। আমি লক্ষ্য করলাম আমার সব বন্ধুরা ততোদিনে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল, অপরদিকে আমি এখনও নিজের খাওয়া-পরার সংস্থান করতে পারছি না।
তাই একদিন সাহস সঞ্চয় করে সিনিয়রকে বলেই ফেললাম যে, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যদি তিনি অনুমতি দেন তাহলে মৌলভীবাজার বার এ যোগ দিব। তিনি বললেন, জেলার আইনজীবী হিসেবে অবশ্যই তুমি মৌলভীবাজার বার এ যোগ দিতে পার, তোমার নিজের ভবিষ্যত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবার যোগ্যতাও তোমার আছে। তিনি আরো বললেন যেহেতু আমি ইতোমধ্যে স্থানীয় বারে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, তাই তাঁর আর আমাকে বাধা দেবার কোন অধিকার নেই।
পরের দিন আমি মৌলভীবাজার গিয়ে সেখানকার আদালতে হাজির হলাম। সেখানে সিনিয়র আইনজীবী আব্দুল মুহিত চৌধুরী এবং সাইয়েদ আব্দুল মতিন আমাকে স্বাগত জানালেন, তারা দু’জনেই ছিলেন আমার সিনিয়র সোলেমান চৌধুরীর আত্মীয়। চৌধুরীর সাথে আমার সম্পর্কের কারনে তারা আমার পূর্ব পরিচিত ছিলেন। মুহিত চৌধুরী ছিলেন একজন বিখ্যাত দেওয়ানী আইনজীবী, তিনি সিলেটের আদালতে চা বাগানের মামলা নিয়ে হাজির হতেন। মফস্বলের আদালতের হাল-চাল বুঝতে আমি মুহিত চৌধুরীর পাশে বসলাম। আমি দেখলাম যখনই কোন মামলা গ্রহন করা হয় তখন আইনজীবীরা খরচের একটা লম্বা তালিকা ধরিয়ে দেয় যেমন, কাগজ, কেরানী, শমন জারি, নোটিশ, মামলা দাখিলের জন্য ৬০ থেকে ৬৫ টাকা পিওনের ফি, ৫০ থেকে ৬০ টাকা আইনজীবীর ফি ইত্যাদি। আমি এতে খুব আশ্চর্য বোধ করলাম এবং মুহিত সাহেবকে জিজ্ঞাসা না করে থাকতে পারলাম না কেন সে একেবারে ২০০ অথবা ২৫০ টাকার বিল না ধরে এভাবে ভেঙে ভেঙে বিল ধরছে। তিনি বললেন যদি একেবারে ঐ টাকা চাওয়া হয় তাহলে মক্কেল সাথে সাথে ভাগবে। তাই তারা বাধ্য হয়ে এমন ভেঙে ভেঙে বিলের তালিকা ধরে দেয়। পুরো টাকাটা কিন্তু উকিল নিজের কাছেই রাখে। জেলা এবং মহকুমা আদালতের আইন চর্চার ধরনটাই আলাদা। আমি এ ধরনের কাজ করতে পারব না তাই একেবারে হতাশ হয়ে পড়লাম, সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি চলে গেলাম। বাড়িতে পৌঁছে কারো সাথে কোন কথা না বলে একটানা সাতদিন ঘুমালাম।
এক সপ্তাহ পরে মৌলভীবাজার এসে আমার বন্ধু আখতারের কাছ থেকে চিঠি পেলাম। সে জানাল তাদের না জানিয়ে আমি সিলেট ছেড়ে চলে এসেছি এবং সোলেমান চৌধুরী তাকে বলেছে আমি তাকে যেভাবে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছি তাতে সে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল। চৌধুরী আখতারকে আরো বলেছে যে তিনি নাকি আমার মধ্যে ভবিষ্যতে একজন ভাল আইনজীবী হবার সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি এটাও স্বীকার করেছেন যে আমি অর্থনৈতিক কষ্টের মধ্যে ছিলাম, কিন্তু সেটা তো সাময়িক, এখন যেহেতু আমার আইনজীবী হিসেবে প্রাকটিস করার লাইসেন্স আছে তাই এখন হলো টাকা কামানোর সময়। তাছাড়া, আমার যেহেতু ভাল আইনজীবী হবার সম্ভাবনা আছে তাই সিলেটে থাকাটা আমার জন্য ভাল হবে। চিঠিটা পড়া মাত্রই আমি সিলেটে ছুটে গেলাম এবং সেদিন সন্ধ্যায় চৌধুরী সাহেবের সাথে দেখা করে আমার সিলেট ফেরত আসার কথা জানালাম। আমার সিদ্ধান্ত জেনে তার যে আনন্দ তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। তিনি আমাকে বললেন, কেউ ভাল আইনজীবী হতে হলে তাকে অবশ্যই অর্থনৈতিক,শারীরিক ও মানসিক বাধা অতিক্রম করতে হবে। আমি তখন সেখানে আমার দ্বিতীয় জীবন শুরু করলাম কিন্তু আয় স্বল্পতার কারনে আমি খরচ মেটাতে পারছিলাম না। আমি যেহেতু নিম্ন আদালতে জামিন নিয়ে কাজ করি না, একজন জুনিয়র আইনজীবীর সেটাই মূল রোজগার, তাই আমার স্থানীয় কোন মক্কেল ছিল না। কোন রকমে টিকে থাকার জন্য আমি রীতিমত হিমশিম খাচ্ছিলাম।
সে সময় একদিন দেওয়ানী মামলার জন্য বিখ্যাত আইনজীবী গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী আমাকে তার চেম্বারে যোগ দিতে বলল। সে সময় তার চেম্বারে ১২ জন সহকারী ছিল কিন্তু প্রতিদিন এত পরিমান মামলা আসত যে তারা কূলাতে পারতেছিল না। গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী ছিলেন একজন মুক্তমনা, হাসি-খুশি, উদার মনের আইনজীবী। তার অনেক কামাই-রোজগার ছিল আবার দু’হাতে খরচও করত। জুনিয়রদের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল অনেক উদার। আমি বুঝতে পারলাম তার চেম্বারে যোগ দিলে আমার অর্থকষ্ট দূর হবে। কিন্তু আমি সোলেমান রাজা চৌধুরীর মত মর্যাদাবান, সৎ ও নীতিবান আইনজীবীকে এড়িয়ে চলতে পারব না। তিনি আমার প্রতি নির্ভরশীল ছিলেন, কারন সেশান মামলায় বিচার চলাকালীন সময়ে জেরা করার জন্য স্বাক্ষীদের বক্তব্য লিখে নিতে হয়, আমি সে কাজটা ভালভাবে করছিলাম। সেজন্য আমি গোলাম কিবরিয়া চৌধুরীকে বললাম আমি সোলেমান রাজা চৌধুরীকে ছেড়ে আসতে পারব না কারন তিনি সম্পূর্ণভাবে আমার উপর নির্ভর করেন। তিনি যদি সোলেমান চৌধুরীর অনুমতি নিতে পারেন তাহলেই একমাত্র আমি তার সাথে যোগ দিতে পারব। গোলাম কিবরিয়া চৌধুরীর মতে ফৌজদারীর মামলায় ড্রাফটিং এর ঝামেলা কম কিন্তু দেওয়ানী মামলায় অনেক বেশি ড্রাফটিং করতে হয়, আমার যেহেতু ড্রাফটিং এর হাত ভাল তাই আমাকে তার চেম্বারে বেশি দরকার।
শেষ পর্যন্ত আমি সোলেমান রাজা চৌধুরীকে এড়িয়ে যেতে পারলাম না, সিদ্ধান্ত নিলাম যে তার চেম্বার ছাড়ব না। আমি প্রস্তাব দিলাম যে রাতে তার চেম্বারে কাজ করব, এদিকে ভোর ছয়টা থেকে সকাল দশটা পর্যন্ত গোলাম কিবরিয়ার চেম্বারে কাজ করব। এভাবে কাজ শুরু করলাম, সকালে গোলাম কিবরিয়ার শ্রুতিলিখন করতাম, কখনও অভিযোগ আবার কখনও লিখিত স্টেইটমেন্ট। প্রতিদিন সকালে দু’তিনটা ড্রাফট শেষ করতাম এবং তার গাড়িতে করে তার সাথে আদালতে যেতাম। প্রত্যেকদিন তিনি আমাকে ২০ টাকা করে দিতেন, সে সময় সেটা অনেক পরিমান টাকা ছিল। সকালে তার বাসায় খালিপেটে যেতাম তারপরে ২০ টাকা হাতে পাবার পর কোর্টের ক্যান্টিনে নাশতা করতাম। এভাবে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত কাটালাম। এ সময়ের মধ্যে আমি দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলার বিষয়ে অনেক কিছু জানলাম, বিশেষ করে একই সাথে দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলার মূল বিষয়গুলো শিখলাম। ১৯৭৭ সালের শেষ দিকে এসে আমি বুঝতে পারলাম যে একজন বিখ্যাত আইনজীবী হতে হলে আমাকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে যেতে হবে।একমাত্র তাহলেই আমার পক্ষে একজন বড় আইনজীবী হবার ইচ্ছা পূর্ণ হবে।
এ সময়ে আমি তখনকার বাংলাদেশের সেরা আইনজীবী সবিতা রঞ্জন পাল (এস আর পাল) এর সাথে ভাল সম্পর্ক গড়ে তুলি। আমি যেহেতু মামলার কাগজপত্র নিয়ে প্রায় ঢাকা যেতাম, সেখানে সবিতা পালের সাথে কাজের সূত্রে সম্পর্ক ছিল, যেটা আমাকে তার সাথে পরিচয় হতে সাহায্য করেছে। আমি সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার ব্যাপারে একটু ইতঃস্তত করছিলাম কারন সেখানে বড় বড় আইনজীবীরা কাজ করেন এবং ভাল অর্থনৈতিক ভিত্তি না থাকলে সেখানে আইনজীবী হিসেবে টিকে থাকাই মুশকিল। এ সময়টাতে আমি ঢাকায় অনেক সময় কাটাতাম যার ফলে গোলাম কিবরিয়া এবং সোলেমান চৌধুরীর দু’জনেরই চেম্বারে কাজের ক্ষতি হচ্ছিল। ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি মাসের কোন এক সকালে সোলেমান রাজা চৌধুরী আমাকে তিরষ্কার করে বললেন, একজন আইনজীবীকে তার পেশার ব্যাপারে সিরিয়াস হতে হবে, কিন্তু একজন আইনজীবী যে কিনা টাউটের মত কখনও সিলেট আবার কখনও সুপ্রিম কোর্টের ব্রিফ নিয়ে ঢাকা যাচ্ছে সে কখনও একজন ভাল আইনজীবী হতে পারবে না। তিনি পরামর্শ দিলেন আমি যেন হয় সিলেটে থাকি অথবা সিলেট ছেড়ে স্থায়ীভাবে ঢাকা চলে যাই। চার বছর আইন পেশায় নিজেকে নিযুক্ত রেখে আমি শেষ পর্যন্ত আমার বাবাকে বুঝাতে পারলাম যে আইন পেশা একটি সম্মানজনক পেশা। তিনি আমার যুক্তি মেনে নিলেন আর আমার পেশাকেও মেনে নিলেন। সোলেমান রাজা চৌধুরীর সাথে কথা বলার পরেই তার মতের পরিবর্তন হয়। সোলেমান চৌধুরী এবং তার স্ত্রী সুরাইয়া চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে আমার বিয়ে হয়, সুরাইয়া চৌধুরী একজন সম্মানিত ভদ্রমহিলা ছিলেন। বিয়ের পরবর্তী অনুষ্ঠানাদিও সোলেমান চৌধুরীর বাড়িতে সম্পন্ন হয়। সোলেমান চৌধুরীর মত আইনজীবীর মান-মর্যাদা দেখে আমার বাবা নিশ্চিত হন যে আইনজীবীরা মিথ্যুক নন। আমিও সোলেমান রাজা চৌধুরীর কড়া সমালোচনাকে আমলে নিয়ে শেষ পর্যন্ত ঢাকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।
১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে সবিতা পালের সাথে একটা ভাল সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসলাম। আমি তাঁর কাছে আমাকে তাঁর সহকারী হিসেবে নেবার অনুরোধ জানালাম যেটা তিনি বলা মাত্র বাতিল করে দিলেন। আমার জন্য একজন বিখ্যাত আইনজীবীর সাথে কাজ করে ভাল একজন আইনজীবী হবার উচ্চাশা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেল। আমি সুপ্রিম কোর্টে প্রাকটিস করতে এসেছি শুনে পাল বললেন সেটা একটা ভাল আইডিয়া, কিন্তু যখনই তাঁর চেম্বারে যোগ দেবার কথা বললাম তখন তিনি এমনভাবে নিতে অস্বীকার করলেন যেন আমাকে চিনেনই না। পাল ছিলেন খুবই স্পষ্টবাদী মানুষ যেটা ঠিক মনে করতেন সেটা প্রকাশ করতে দ্বিধা করতেন না। আমার দূরবস্থা নিয়ে আমি আমার খুব ঘনিষ্ঠ মানুষ প্রয়াত এডভোকেট আব্দুল হান্নানের সাথে আলাপ করলাম। তিনি শুধু রাজস্ব বিষয়ক মামলা নিয়ে কাজ করতেন। সব কিছু শুনে তিনি বললেন, সুধীর চন্দ্র দাস (এস সি দাস) এর স্বাধীন প্রাকটিস আছে এবং সে পালের সাথে কাজ করে। হান্নান আমাকে বলল, দাস এবং পাল একই চেম্বারে বসে কাজ করে, তাই আমি যদি দাসের চেম্বারে যোগ দেই তাহলে পালের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা আমার জন্য সহজ হবে। তার প্রস্তাব আমার মনোঃপুত হল এবং আব্দুল হান্নান আমাকে এস সি দাসের সাথে পরিচয় করিয়েদিল। আমি দাসের সাথে কাজ শুরু করলাম এবং যখনই সুযোগ পেতাম পালের সাথে দেখা করতাম। ফ্রি থাকলে তিনিও অন্যান্য আইনজীবীদের সাথে গল্প-সল্প করতে পছন্দ করতেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যদি আমি কোনভাবে পালের সাথে কাজ করার সুযোগ পাই তাহলে তিনি আমাকে ঠিকই সুযোগ দিবেন। এভাবে আমি প্রায় ছয় মাস কাটিয়ে দিলাম, এস সি দাসের চেম্বারে থেকে পালের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতাম, মাঝে মাঝে দাসের সাথে পালের চেম্বারে যেতাম। ধীরে ধীরে পালের সাথে আমার সম্পর্ক কিছুটা উন্নত হল। এস আর পাল বড় বড় মামলা পরিচালনা করতেন এবং কে এম সাইফউদ্দিন তার সাথে কাজ করতেন। সাইফউদ্দিন একটু বাচাল ধরনের ছিলেন, তাকে সিরিয়াস মনে হত না। আমি বুঝতে পারলাম আইন বিষয়ে ওনার জ্ঞানের গভীরতা নেই এবং তার হাতের লেখাও ভাল ছিল না।
একদিন বিকেলে আমি দাসের চেম্বারে বসে ছিলাম, এস আর পাল সবেমাত্র আদালত থেকে ফিরে এসেছেন। আমাকে দাসের চেম্বারে একা বসে থাকতে দেখে জানতে চাইলেন আদালতে আমার আর কোন কাজ বাকী আছে কি না। আমি জবাবে না বলায় তিনি জানতে চাইলেন আমি কি তার সাথে তার বাসায় গিয়ে একটা জরুরী রীট পিটিশনের জন্য ড্রাফট করতে পারব। আমি যেহেতু এমন একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম তাই সাথে সাথে তার অফার লুফে নিলাম। তিনি আমাকে তার গাড়িতে করে তার বাসায় নিয়ে গেলেন এবং পিটিশনের ডিকটেশান দিলেন। পালের ড্রাফটিং খুবই স্বতঃস্ফূর্ত, সচল, গুরুত্বপূর্ণ এবং সংক্ষিপ্ত। কোন রকমের বাধা ছাড়াই আমি ওনার ডিক্টেশান নিয়েছিলাম কারন বর্ণনায় তিনি ছিলেন তুখোড়। আমার ড্রাফটিং এ পাল এত সন্তুষ্ট হয়েছেন যে সাথে সাথে আমাকে ৫০০ টাকা দিলেন। তিনি আমার প্রশংসা করলেন এবং বললেন আমি যদি তার চেম্বারে যোগ দিতাম তাহলে তার পক্ষে খুব সহজে মামলা তৈরি করা সম্ভব হত। তিনি আমাকে তার চেম্বারে যোগ দেবার অফার দিলেন কিন্তু একই সাথে বললেন যে সুধীর হয়ত বিষয়টা ভালভাবে নিবে না। মনে হল ব্যাপারটা তিনি আমার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। আমি তাঁকে সরাসরি বললাম প্রথমদিকে আমি আপনার সাথেই কাজ করতে চেয়েছিলাম এবং সে চিন্তা মাথায় রেখেই আমি দাসের চেম্বারে যোগ দিয়েছি যাতে আমি তার চেম্বারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারি। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে সুযোগ পেলে আমি আমার যোগ্যতা দিয়ে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারব। পরদিন থেকে আমি পালের সাথে কাজ শুরু করি, যেটা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এর প্রধান কারন পাল ছিলেন তখনকার সময়ে সবচেয়ে বিখ্যাত আইনজীবী এবং তার খ্যাতি এমন ছিল যে, প্রায় সব বিচারক কোন রকম ইতঃস্তত না করে আইনী ব্যাপারে তার পরামর্শ গ্রহণ করত। পালের চিন্তা-ভাবনা সব সময় খুব পরিষ্কার ছিল, এবং বই না খুলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে মতামত দিতে পারত। যার ফলে সব সিনিয়র আইনজীবী, কোন কোন সময় বিচারক, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদেরা তার কাছে পরামর্শের জন্য আসত। এভাবে আমার পরিচয়গত সংকট কাটিয়ে আমি দেশের বিখ্যাত মানুষদের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়েছিলাম।
এস আর পাল কেবল একজন আইনজীবীই ছিলেন না, তিনি নিজে ছিলেন একটা প্রতিষ্ঠানের মত। তার জ্ঞানের গভীরতা, আইন এবং ভাষা বিষয়ে তার দক্ষতা দেশের নানা স্তরের মানুষের কাছে প্রশংসনীয় ছিল। তিনি আইনী বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত বা টীকাভাষ্যের দারস্থ হতেন না, যখনই কোন আইনী প্রশ্ন উঠত শুধু ধারা দিয়ে তিনি সেটা সমাধান করতেন। তিনি আমাকে উপদেশ দিয়েছিলেন আইনটা ভালভাবে জান, কোন আইন একবারে না বুঝলে দুইবার, তিনবার পড় প্রয়োজনে একশত বার পড় তারপরেও আইনের মানে বুঝার চেষ্টা কর। তার মতে একবার আইনের বিষয়বস্তু বুঝতে পারলে তখন ঐ বিষয়ে আরো ভাল করে বুঝার জন্য আইনী সিদ্ধান্ত এবং টীকা-ভাষ্য ইত্যাদি পড়তে হবে। কখনই তাকে আইনী সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালতে হাজির হতে দেখিনি, কেবল ধারা দিয়ে তিনি যথোপযুক্ত আইনী যুক্তি দাঁড় করাতে পারতেন। তাঁর আইন এবং বিচার বিষয়ক সততা মানুষ বংশানুক্রমে মনে রাখবে। তিনি ছিলেন আমার পৃষ্ঠপোষক যিনি যে কোন মামলার তথ্য থেকে আইনী বিষয়গুলো ধরতে ও বুঝতে শিখিয়ে আমার জীবনকে পরিবর্তিত রুপে সাজিয়ে তুলতে সাহায্য করেছেন। তার অসামান্য ব্যক্তিত্ব আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল যার ফলে নিজের পেশার প্রতি আরো বেশি মনযোগী হয়েছি। তাঁর কাছ থেকে আমি জীবন ও আইন পেশার মানে বুঝেছিলাম। খুব সহজভাবে মাত্র একটি বা দু’টি উদাহরণ দিয়ে আইন ব্যাখ্যা করে মূল বিষয় ধরিয়ে দিতেন। আমার জন্য দ্বিতীয় আরেকটা সুবিধা ছিল, যেসব মক্কেল তাকে নিতে পারত না তারা আমাকে ধরত, তারা ভাবত আমি হয়ত এস আর পালের সাথে মামলা নিয়ে আলাপ করতে পারব। আমি তখন চট্টগ্রাম এবং দেশের আরো নানা জায়গা থেকে মামলা পেতে শুরু করলাম। প্রথমদিকে আমি শুধু সিলেটের মামলা নিতাম কিন্তু পালের সাথে যোগ দেবার পরে আমি সারাদেশের প্রায় সকল বারে একজন আইনজীবী হিসেবে পরিচিতি পেলাম। আমার তৃতীয় যে উপকার হয়েছিল যেটা আমাকে একজন ভাল আইনজীবীতে পরিণত করেছে সেটা হল, যখনই আমি কোন মামলা নিতাম তখন পালের সাথে একাকী সেটা নিয়ে আলাপ করার জন্য অপেক্ষা করতাম। এবং তাকে ভাল মুডে পেলে মামলার যুক্তিগুলো নোট করে নিতাম। যে কোন মামলায় আইনী কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে যুক্তি দেবার অথবা যেকোন বিষয়ে রায় পেতে এটা আমাকে ভীষণভাবে সাহায্য করেছে। সেসব দিনে কোন বিষয়ে শুনানি পাওয়াটা এমনকী সিনিয়র আইনজীবীদের জন্যেও কঠিন ছিল। আমার মাপের আইনজীবীরা সিনিয়র ছাড়া একাকী আদালতে হাজির হতে সাহস করত না। এমনকী পাঁচ দশ বছরের অভিজ্ঞতা আছে এমন আইনজীবীরাও সিনিয়রদের ছাড়া আদালতের সিদ্ধান্তের জন্য কোন ইস্যু উপস্থাপনের সাহস পেত না। এর মধ্যে আমি ছিলাম ব্যতিক্রম। এটা আমাকে সাহসী করে তোলে এবং আমি আদালতে মামলার সর্বশেষ শুনানিতে সবচেয়ে সিনিয়র আইনজীবী যেমন, সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, আশরারুল হোসেইন, বি এন চৌধুরী, হামিদুল হক চৌধুরী, আব্দুল মালেক, জুলমত আলী খান, এম এইচ খন্দকার, খন্দকার মাহবুবউদ্দিন আহমেদ, টি এইচ খান, এমনকী খোদ এস আর পাল এদের বিরুদ্ধে যুক্তি দিতাম। বিচারকেরাও আমাকে সদয়ভাবে দেখতে শুরু করলেন কারন আইন বিষয়ে আমার জানা-শোনা এবং মামলার খসড়া আবেদনপত্র তৈরিতে আমার দক্ষতাকে তারা ভাল চোখে দেখতেন।
এভাবে আমি তাঁর মাধ্যমে প্রখ্যাত সব বিচারক, আইনজীবী এবং সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিদের কাছাকাছি আসার সুযোগ পেলাম। আমি মনে করি আমার আজকের অবস্থান এবং আইনের জ্ঞানের বেশির ভাগ আমি তাঁর কাছ থেকে শিখেছি। হাইকোর্টের বেঞ্চে বিচারক হিসেবে উন্নীত হবার আগে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে আমার খুবই ভাল পসার ছিল। আমার আন্তরিকতা, সততা, আইনজীবী হিসেবে দায়বদ্ধতা, সিলেটে আমার সিনিয়রদের সমর্থন ও সহযোগিতা এবং এস আর পালের সাথে দীর্ঘ সম্পর্কের কারনে আইনী সমাজে আমি একজন খুবই আস্থাভাজন সদস্য হিসেবে বিবেচিত হতাম। তার উপর, আইন এবং আইনশাস্ত্র বিষয়ে আমার অসামান্য আত্মনিয়োগ, মামলা পরিচালনায় নৈপুণ্য ও আইনী যুক্তি বিচার করে সেগুলো সাজিয়ে আদালতে স্বতন্ত্রভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে উপস্থাপন করা, এ বিষয়গুলো আইন পেশায় আমাকে একজন প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিত্বে পরিণত হতে সাহায্য করে।
চলবে…
==============
নবযুগ সম্পাদকের নোট: তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে দীর্ঘ সামরিক শাসনের ইতিহাস মাথায় রেখে যারা বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করে তারা আসলে কেউই মনে রাখেননা, দিনশেষে তারা সামরিক শাসক নন, জনগণের নির্বাচিত সরকার। পর্দার আড়ালে ঘটে যাওয়া ঘটনা সামনে আসবার নজির খুব কম বলেই, আমরা সম্পূর্ণটা কখনো জানতে পাই না। তাই রূপকথার মতো মনে হয় আমাদের বাস্তবতাগুলো, সেই জাদুবাস্তবতার বাংলাদেশের জন্য সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা’র আত্মজীবনীমূলক বই ‘একটি স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী: আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র’ একটি মোক্ষম চপেটাঘাত, আমাদের ঘুমন্ত নাগরিকদের জেগে ওঠার আহ্বান।
বইটি দ্রুত অনুবাদের জন্য ড. নাজিম উদ্দিন-এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী গবেষক ও লেখক আদিত্য রাহুলকে। আশাকরি অনেকেই বইটি পাঠ করে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে একটা ধারণা পাবেন।
এই বইটি অনুবাদ করতে গিয়ে লেখকের শৈশব ও যুবক বয়সের কিছু গ্রাম ও মানুষের নাম ইংরেজিতে যেভাবে লেখা হয়েছে তার বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ করতে কিছুটা সংশয় হওয়ায়, আগ্রহী পাঠক ও জ্ঞাত ব্যক্তিদের এই বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে অনুরোধ করা যাচ্ছে। গ্রাম ও ব্যক্তির নামগুলো কারো যদি জানা থাকে তবে সেগুলোর সঠিক বানান, জানাবার অনুরোধ রইল। সকলকে শুভেচ্ছা।