অধ্যায় ৩
বিচারক পদে উত্তরণ
সে সময় একজন আইনজীবী ৫০ বছরের বেশি বয়স হলে তাকে বিচারকের পদের জন্য বিবেচনা করা হত, যদিও সংবিধানে মাত্র ১০ বছরের আইন পেশায় নিয়োজিত থাকার বিধান আছে। আমার বয়স যখন চল্লিশের কোঠায় ছিল তখন আমাকে পর পর দু’বার বিচারকের পদের জন্য মনোনয়ন দেয় হয় কিন্তু বয়সের কারনে আমার নাম বাদ পড়ে যায়। সাবেক প্রধান বিচারপতি এটিএম আফজাল একবার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, আমার বয়সটাই বিচারক পদে আমার জন্য বড় বাধা, যদিও তিনি আমাকে বিচারক পদে পদোন্নতি দিতে খুবই আগ্রহী ছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে তখনকার আইন মন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু আমাকে ডেপুটি এটর্নী জেনারেল পদ অফার করেছিলেন। আমি সেটা নিতে অস্বীকৃতি জানালে তিনি আমার উপরে বিরক্ত হন। এটর্নি জেনারেলের অফিসে ফৌজদারী আইনে অভিজ্ঞ আইনজীবীর অভাব ছিল। আমি তাঁকে বলেছিলাম অতিরিক্ত এটর্নী জেনারেল পদ দিলে আমি বিবেচনা করে দেখতে পারি, তাতে তিনি বললেন সে পদ ইতোমধ্যে মাহবুবে আলমকে দেয়া হয়েছে। আমি তাঁকে বললাম, গত সরকারের সময় অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল এর জন্য একের চেয়ে বেশি পদ ছিল। তিনি বললেন সেসব নিয়োগ আইনের পরিপন্থী। আমি বললাম, সেটা আমার সমস্যা নয়, তবে আমি অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেলের নীচের কোন পদে যোগ দিব না। যদিও তখন আমার নাম আগে থেকেই হাইকোর্টের বিচারক পদে নিয়োগের তালিকায় ছিল, কিন্তু আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরুর সাথে মতানৈক্যের ফলে আমার নাম প্রথম ব্যাচ থেকে বাদ পড়ে যায়। তখন সুপ্রিমকোর্টে আমার খুব সফল প্রাক্টিস থাকায় আমিও হাইকোর্টের বিচারক পদের জন্য অতোটা লালায়িত ছিলাম না। আমার সিনিয়র আইনজীবী এস আর পালও এটা চাইতেন না, তাঁর মতে একজন সফল আইনজীবীর জন্য এমন প্রস্তাব গ্রহণ করা ঠিক না। হাইকোর্টের জন্য দ্বিতীয় ব্যাচে বিচারক নিয়োগের সময় আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু আমার বাসায় পরপর তিনবার ফোন করেন। প্রত্যেকবার আমার স্ত্রী ফোন ধরেন এবং আইনমন্ত্রী তাঁর সাথে চা পানের জন্য আমাকে বলতে বলেন। তৃতীয়বার ফোন পাবার পরে আমার স্ত্রী সুষমা কিছুটা রাগের সাথেই আমাকে বলল একজন মন্ত্রী যখন বার বার ফোন করছেন তখন আমার তার সাথে দেখা করা উচিত, তাঁর অনুরোধ রক্ষা করা আমার কর্তব্য। আমার স্ত্রী আমাকে জানালেন এটা যদি বিচারক পদে নিয়োগের জন্য হয় তাহলে আমি তাঁর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে পারি কিন্তু তাঁর ফোনের জবাবে সাড়া না দেয়াটা ঠিক হচ্ছে না।
শেষ পর্যন্ত আমি বিকেলের দিকে শেরাটন হোটেলের উত্তর পাশে পথকলি ট্রাস্টের অফিস যেখানে তিনি সান্ধ্যকালীন অফিস করতেন সেখানে দেখা করতে যাই। কিছুক্ষণ পরে আমি লক্ষ করলাম সেখানে আব্দুল ওয়াহাব মিয়াও আছেন, সাথে এডভোকেট সাইয়েদ রেজা। আমি বুঝতে পারলাম খসরু বিচারক নির্বাচনের কাজ করছেন। আব্দুল ওয়াহাব মিয়া যেহেতু কুমিল্লার আওয়ামী লীগ নেতা সাইয়েদ রেজার সাথে এসেছেন তার মানে সাইয়েদ রেজা আব্দুল ওয়াহাবের তদ্বির করতে এসেছেন। কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনার পরে সাইয়েদ রেজা ওয়াহাব মিয়ার সিভি দিলেন। খসরু আমাকেও সিভি দিতে বললেন। তিনি জানালেন আমাদের মধ্যে যা কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে সেটা কবর দিয়ে দিতে। তিনি আমাকে আরো বললেন, দেশে প্রগতিশীল চিন্তাধারার বিচারকের অভাব আছে তাই আমার উচিত তাঁর প্রস্তাব গ্রহণ করা। আমি তাঁকে বললাম, আমি এ নিয়ে আমার চিন্তা-ভাবনা করব এবং আমার স্ত্রীর সাথে আলাপ-আলোচনা করে দেখব। আমাদের আলাপের মধ্যে মাগরিবের নামাজের সময় হলে আমরা উঠে পড়ি। কিন্তু খসরু আমাকে আরো কিছুক্ষণ থাকতে বললেন। নামাজ শেষে তিনি আমাকে অন্য আরেকটা রুমে নিয়ে যান এবং আমাকে হাতে ধরে অনুরোধ জানান যাতে আমি তার প্রস্তাব ফিরিয়ে না দেই। আমি তখন আমার স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করে তাকে মন্ত্রীর ইচ্ছার ব্যাপারটা জানালাম। আমার স্ত্রী আমাকে বলল, সে কোন মতামত দিবে না কেবল এটুকু বলবে যে বিচারক পদে কাজ করাটা খুবই সম্মানজনক একটা ব্যাপার হবে কিন্তু একই সাথে আমি যেন আর্থিক অবস্থাটাও বিবেচনায় রাখি।
সে সময় ঢাকার ধানমণ্ডির মধুবাজারে আমার একটা চারতলা বাড়ি ছিল। আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে আমি আইনমন্ত্রীর প্রস্তাবটি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং তাঁকে আমার সিভি দিলাম। তিনি আমাকে এটর্নি জেনারেলের অফিস পুনর্বিন্যাস এবং বিচারক নির্বাচনে সহায়তা করার অনুরোধ জানান। আমরা কিছু সময় ধরে অন্তত দশজন বিচারক নির্বাচন নিয়ে আলোচন করেছি, কিন্তু উপযুক্ত ব্যক্তি নির্বাচন করা খুব কঠিন ছিল। তিনি আমাকে বললেন সাইয়েদ রেজা এবং আওয়ামী লীগের আরো কিছু নেতা মিলে আব্দুল ওয়াহাব মিয়াকে নিয়োগ দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করছেন। তিনি আরো জানালেন দু’জন জেলা জজকেও অন্তর্ভূক্ত করা হবে, এ ব্যাপারে তিনি আমার কাছে মমতাজ উদ্দিন আহমেদ সম্পর্কে জানতে চান। আমি আব্দুর রশিদ উকিলের নাম সুপারিশ করি, তিনি প্রগতিশীল এবং ভাল আইনজীবী। তিনি আমার প্রস্তাব গ্রহণ করেন। তারপর আমি তাঁকে আরো দু’জন ডেপুটি এটর্নি জেনারেল নিয়োগের পরামর্শ দেই যাদেরকে যথাসময়ে বিচারক পদে নিয়োগ দেয়া যাবে। এদের একজন ছিলেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, আরেকজন হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। আমি তাঁকে বললাম, এ দু’জন তরুণ আইনজীবী প্রতিশ্রুতিশীল এবং ভবিষ্যতে এদের ভাল বিচারক হবার সম্ভাবনা আছে। পরদিন সকালে তারা দুজনে আইনমন্ত্রী খসরুর সাথে দেখা করেন এবং ডেপুটি এটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ পান। আমার নিয়োগ চুড়ান্ত হওয়ার পরে যখন গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় তখন আমি আমার জুনিয়র মাহবুব আলীকে ডাকি, যিনি বর্তমানে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য, এবং সে সময় সহকারী এটর্নি জেনারেল পদে কাজ করতেন। আমি তাকে বললাম যে সে আমার সাথে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেছে তাই আমি আমার মামলাগুলো (শেরেস্তা) তাকে দিতে চাই। যদি সে আমার চেম্বারের দায়িত্ব নিতে চায় তাহলে আমি বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করব। আর যদি সে সাত দিনের মধ্যে আমার অধীনস্থ মামলাগুলো গ্রহণ না করে তাহলে আমি শপথ নিব না। আমি ভেবে দেখলাম আমার শেরেস্তায় প্রায় ৪০০০ এর মত মামলা আছে, একজন বিশ্বস্ত আইনজীবী না পেলে আমি বিচারকের পদ গ্রহণ করব না। মাহবুব আলী বললেন তিনি সরকারি প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে চিন সফরে যাচ্ছেন, সেখান থেকে ফেরত আসার পরে মামলার দায়িত্ব বুঝে নিতে তার আরো একমাস সময় লাগবে। আমি তাকে বললাম যদি সে মামলাগুলো ঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারে তাহলে সেগুলো থেকে যে টাকা আসবে তা দিয়ে প্রতিমাসে চিন সফর করতে পারবে। আমি তাকে পরিষ্কার বলে দিলাম তাকে চিন যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করে আমার মামলাগুলোর দায়িত্ব নিতে হবে, নতুবা আমাকে ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এডভোকেট মাহবুব আলী আমার প্রস্তাব গ্রহন করেন এবং পরদিনই আইনমন্ত্রীর কাছে সহকারী এটর্নি জেনারেল পদ থেকে অব্যাহতি চেয়ে পদত্যাগপত্র দাখিল করেন। আব্দুল মতিন খসরু তার পদত্যাগপত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলেন এটর্নি জেনারেলের অফিসে সৎ কর্মকর্তার অভাব আছে, তাই তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করা উচিত। মাহবুব আইনমন্ত্রীর কথা শোনেনি এবং পরদিন আমার কাছে এসে তার পদত্যাগের কথা জানান। জুনিয়র আইনজীবী হলেও মাহবুব একজন সৎ আইনজীবী এবং খুবই সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। তিনি সততা ও মর্যাদা বজায় রেখে চলতেন, কিন্তু তার বাসায় ৪০০০ মামলার নথিপত্র রাখার মত জায়গা ছিল না। তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন যাতে ফাইলগুলি আমি দু’মাসের জন্য আমার বাসায় রাখি। আমি বললাম, পনের দিন সময় দিতে পারব, এরমধ্যে ফাইলগুলো সংরক্ষণের জন্য তাকে একটা উপযুক্ত জায়গা খুঁজে নিতে হবে। তিনি যখন বললেন, পনের দিনের মধ্যে এতগুলো ফাইল স্থানান্তর করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না, তখন আমি তাকে বললাম সেগুলো আমার সুপ্রিম কোর্টের চেম্বারে নিয়ে রাখতে, যেটা আমি এডভোকেট এস এ রহিম এ সাথে শেয়ার করতাম, ভদ্রলোক কদাচিৎ আদালতে আসতেন। মাহবুব আলী তখন মাহবুবে আলমের সাথে একই চেম্বারে বসতেন কিন্তু চেম্বার আলমের ফাইলে ঠাসা ছিল। আমার পরামর্শ অনুযায়ী মাহবুব আলী ফাইলগুলো স্থানান্তর করল।
আরো সাতজন বিচারকের সাথে ১৯৯৯ সালের ২৪ অক্টোবর আমি বিচারক হিসেবে শপথ নিলাম। পদোন্নতি সত্ত্বেও আমার মনে কোন পরিবর্তন আসেনি কারণ আমি এতদিন আইনজীবী এস আর পালের সাথে ছিলাম, পাল একজন সাধারণ বিচারকের চেয়ে অনেক বেশি মর্যাদার অধিকারী। বিচারক হিসেবে আমার পদায়ন নিশ্চিত হবার মাত্র পনের দিন আগে সরকার পরিবর্তন হয় এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করে। আমি নিশ্চিত ছিলাম, যদি ক্ষমতাসীন দল আমার নিয়োগ নিশ্চিত না করে তাহলে আমি আবার আইন প্রাকটিসে ফেরত যাব। সেজন্য আমি তেমন উদ্বিগ্ন ছিলাম না। সে সময় মাহমুদুল আমিন চৌধুরী প্রধান বিচারপতি ছিলেন। দু’দিন পরে তিনি আমার মামলাগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলেন, সেগুলো কোথায় কার জিম্মায় আছে। আমি তাঁকে বললাম, আমি সেগুলো মাহবুব আলীর কাছে দিয়েছি এবং টেলিফোনের লাইন কেটে দিয়েছিলাম। এর দিন চারেক পরে প্রধান বিচারপতি আবার আমাকে ফোন দিয়ে আবারো আমার মামলার অবস্থা জানতে চাইলেন। তার প্রশ্ন শুনে আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, যে আমি তাকে আগেই বলেছি আমার মামলাগুলো মাহবুব আলীর কাছে আছে। বলেই আমি ফোন কেটে দিলাম। এ ঘটনার পরে আমি ভাবছিলাম কেন প্রধান বিচারপতি (মামুন ভাই) আমার মামলা সম্পর্কে দু’বার জানতে চাইলেন, যদিও সিলেটে আমার আইন পেশার প্রথম থেকেই তিনি আমাকে চিনেন। সিলেটের আদালতে আমরা একই টেবিলে বসতাম। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। রাজনৈতিক কারণে আমার নিয়োগ নিশ্চিত করা না হলে আমার কোন আপত্তি থাকবে না। কিন্তু অন্য কোন কারণে হলে সেটা নিয়ে আমাকে ভাবতে হবে। আমার সততা, দক্ষতা এবং আমি ছিলাম বারের আইনজীবীদের দ্বারা গ্রহণযোগ্য একজন ভাল বিচারক, এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। কিছুদিনের মধ্যে আমি কানাঘুঁষা শুনতে লাগলাম যে আটজন বিচারকের মধ্যে তিনজনকে নিশ্চিত করা হবে না, আমি তখন ধরে নিলাম ঐ তিনজনের একজন অবশ্যই আমি। কেউ বলতে পারছিল না অন্য দু’জন কারা, কিন্তু বাদ যাওয়ার তালিকায় সবাই আমার নাম বলছিল। তখন আমি বুঝতে পারলাম প্রধান বিচারপতির প্রশ্ন ও চলমান গুজবের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে। আমি পরে শুনলাম বারের সহ-সভাপতি এবং আরো কিছু আইনজীবী প্রতিনিধিত্ব করে বিচারক হিসেবে আমার নিশ্চিতকরণের বিপক্ষে প্রধান বিচারপতির কাছে অভিযোগ করেন। পরদিন সকালে প্রধান বিচারপতির ব্যক্তিগত সহকারী আমার চেম্বারে এসে জানাল,
“স্যার, আমি আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে বিচারক হিসেবে আপনার নাম নিশ্চিত করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।”
আমি অন্য আর কে কে সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন তাদের নাম জানতে আগ্রহী ছিলাম। সে আমাকে তার অপারগতা জানিয়ে বলল, আমাকে সে বাবার মত জানে তাই আমার নিশ্চিতকরণের খবরটা দিয়েছে। সেদিনই আদালতে সময় শেষে বিকেলের দিকে আমি আব্দুল ওয়াহাব মিয়াকে বিচারক পদে তার নিয়োগ নিশ্চিতকরণের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানতে ফোন করি। ফোনের ইন্টারকমে ক্রস-কানেকশানের কারণে আমি আড়িপেতে ওয়াহাব মিয়া এবং মমতাজউদ্দিনের মধ্যে যা শুনতে পাই তাতে রীতিমত আশ্চর্যবোধ করি। বিচারপতি আব্দুল ওয়াহাব মিয়া তখন বিচারপতি মমতাজউদ্দিনকে খুব পরিষ্কার ভাষায় বলছিলেন যে সিনহার নিয়োগ নিশ্চিত করা হবে না কারণ সে একজন দূর্নীতিবাজ বিচারক এবং তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। তাদের আলাপ শোনার পরে, আমার বিরুদ্ধে ছড়ানো গুজব শুনে আমি পুরোপুরি হতবাক হয়ে পড়লাম। আমার আরো হতভম্ব লাগছিল কারণ এ গুজবে ছড়ানোর মূল হোতা আর কেউ নয় আমারই ঘনিষ্ঠ সহকর্মী।
এর দুদিন পরে গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। আমি প্রধান বিচারপতিকে কল করে তাঁর সাথে সংক্ষিপ্ত নোটিসে দেখা করার অনুমতি প্রার্থনা করলাম। তিনি তৎক্ষণাৎ আমাকে দেখা করার জন্য সময় দিলেন, কিন্তু আমি বললাম, আমি তাঁর সাথে বাসায় দেখা করতে চাই। তিনি আমাকে মাগরিবের নামাজের পরে আসতে বললেন। আমি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলাম যে তিনি আমাকে অনেকদিন থেকে চিনেন এবং বিখ্যাত আইনজীবীদের সাথে আমার যোগাযোগ আছে এটা জানেন। প্রথমবার তিনি যখন আমার মামলাগুলো সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন তখন আমি ভীত হইনি। কিন্তু দ্বিতীয়বারের সময় আমি একটু উদ্বিগ্ন হলাম কারণ পেশাগতভাবে আমাকে জানার পরেও তিনি যখন আমার মামলাগুলো নিয়ে জানতে চাচ্ছেন এবং তিনি যেহেতু আমার বিচারক পদ নিশ্চিতকরণের সুপারিশ করার জন্য একমাত্র ব্যক্তি তাই আমি ভাবলাম আমাকে সঠিক জবাব দিতে হবে, এর বেশি বললে সেটা তাঁকে প্রভাবিত করবে এবং নিশ্চিতভাবেই সেটা নীতি বিরুদ্ধ হবে। প্রধান বিচারপতিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি তাঁর বিচারে যাদের যোগ্য মনে হয় তাদেরকে বিচারক পদের জন্য সুপারিশ করেন। গেজেট প্রজ্ঞাপনের পরে আমি বিষয়টা পরিষ্কার করার জন্যে তাঁর কাছে এসেছিলাম। তখন আমি মাহবুব আলীকে আমার মামলাগুলো হস্তান্তরের বিষয়টা খুলে বলি এবং প্রধান বিচারপতিকে বলি যদি তিনি কোন গরমিল খুঁজে পান তাহলে আমি গেজেট প্রকাশের পরেও শপথ নিব না। তিনি আব্দুর রহিমের কাছে ব্যাপারটা নিশ্চিত হতে পারেন। সব শুনে প্রধান বিচারপতি অসন্তুষ্ট হয়ে আমাকে বকাঝকা করলেন এবং বললেন আমার ওনাকে বিষয়টা আগেই বলা উচিত ছিল। তিনি বললেন, বেশিরভাগ আইনজীবী আমার নিশ্চিতকরণের বিপক্ষে ছিল এমনকী সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশানের সহ-সভাপতি (নামটা ভুলে গেছি, বরিশালের মানুষ) তাঁর কাছে অভিযোগ দাখিল করেছেন। আমার নাম সুপারিশ করার জন্য তাঁকে অনেক চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আমি তাঁকে বলতে চাইছিলাম, যে তাঁর সুপারিশ অবশ্যই স্বাধীন এবং কোন রকমের প্রভাব ছাড়া হতে হবে। যদিও তাঁর সাথে আমাদের আইন পেশার প্রথম দিক থেকে ভাল সম্পর্ক ছিল, আমি তাঁকে বলিনি কারণ আমি নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার ছিলাম যে আমি কোন অনৈতিক কিছু করিনি। পরবর্তীতে তিনি আমাকে বললেন বিচারক পদে আমার পদোন্নতির ছয়মাসের মধ্যে জেষ্ঠ্য বিচারকেরা আমার বিচারকার্যে সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে নিশ্চিতকরণের সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নেন কিন্তু চাপের কারণে তিনি বিভ্রান্ত ছিলেন।
অধ্যায় ৪
জরুরী অবস্থা
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২০০১ সালে সরকার গঠনের পর, বেশকিছু মামলা দায়ের করা হয় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতারাও এর বাইরে ছিলেন না। ছাত্রলীগের সভাপতি, সহসভাপতি ও সচিবকে আটক করা হয়। পরে তাদের জামিনে মুক্তি দেয়া হয় এবং বিভিন্ন জেলায় ডজনেরও বেশী হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের হেফাজতে থাকা অপরাধীদের গ্রেফতার করার বিষয়ে পুলিশকে নির্দেশনা প্রদান পূর্বক সুয়ো-মোটো ক্ষমতার অনুশীলন করার ক্ষেত্রে হাবাস কর্পস পিটিশনে আমি সব মামলা বাতিল করেছিলাম। এছাড়াও আমি জামিনে অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতাদের মুক্তির ব্যবস্থা করি। এটা সরকারকে প্রচণ্ড ক্ষেপিয়ে তোলে। তৎকালীন আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমেদ আমাকে সংসদে ‘আওয়ামী সমর্থক বিচারক’ হিসাবে চিহ্নিত করে লীগ নেতাদের অযৌক্তিক অনুগ্রহ প্রদর্শনের জন্য সমালোচনা করেন। আব্দুর রশীদ নামে আমার এক বন্ধুর পরামর্শে চ্যানেল-১ এ সরাসরি সম্প্রচার কৃত সংসদ অধিবেশন দেখেছিলাম, আর তার এই সমালোচনায় আমি ভীষণ একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম।
এই চর্চা একটা প্রথার মত হয়ে উঠেছে যা দেশের দুটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দলই অনুসরণ করতে থাকে; যখনই তারা অন্য দলকে পরাজিত করে ক্ষমতায় আসে, তখনই রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে মামলা দায়ের করে। যা হোক, বিশেষ গোয়েন্দা বিভাগ দুর্নীতির একটা মনগড়া অভিযোগ এনে আমার বিরুদ্ধে রিপোর্ট জমা দেয়, যা আমি দুর্নীতি দমন কমিশন তৎকালীন চেয়ারম্যান, প্রয়াত বিচারপতি সুলতান হোসেন খানের থেকে জানতে পেলাম। তাকে তদন্তের চালিয়ে যাবার জন্য অনুরোধ করলাম এবং বললাম, আমি তদন্তের জন্য সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত। তিনি বললেন, এটি খুব এক খারাপ বিষয় হবে জ্যেষ্ঠতার ক্রমের জন্য এবং সংবিধানও এমন পদ্ধতি অনুমোদন করে না। আমি তাকে বললাম যে, সংস্থাটি আমার মানহানি করবার জন্য তাদের নিরন্তর প্রচেষ্টা বন্ধ করবে না। অবশ্য আমি এও জানতাম, কেন এই বিভাগ দুর্নীতিবাজ বিচারক হিসাবে আমাকে নিন্দার্হ করার জন্য এত আগ্রহ দেখাচ্ছে।
(বি এন পি শাসনামল শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের) প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে একটি অচলাবস্থার সূত্রপাত হয়। আওয়ামী লীগ বিচারপতি কে এম হাসানের নিয়োগ বিষয়ে প্রতিবাদ জানায় এবং শেষ পর্যন্ত হাসান সাহেব প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজুদ্দিন আহমেদ সংবিধানের বিধানগুলি পাস করে প্রধান উপদেষ্টা পদে অধিষ্ঠিত হন। আওয়ামী লীগের আন্দোলনের কারণে মোটের উপর এই সময়টাতে এক ধরনের অরাজকতা চলছিল। শেষমেশ সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি চাপ প্রয়োগ করে এই বলে যে, সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের সাথে সরকার যদি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন না করে, তাহলে জাতিসংঘে নিয়োজিত শান্তিরক্ষী বাহিনীর বাংলাদেশী সদস্যদের ফেরত পাঠানো হবে। এই বিষয়টা সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
সেনাবাহিনীর চাপের কারণে ইয়াজুদ্দিন আহমেদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন, দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয় এবং ফখরুদ্দিন আহমেদকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে খুশি হলেও অন্যান্য প্রধান রাজনৈতিক দল বেশ হতাশ হয়ে পড়েছিল। এই সব ঘটন-অঘটনের সময় বিচারপতি বি কে দাশের স্ত্রী হঠাৎ মারা যান (২00৭ সালে) এবং খবর শুনে আমি তার বাসায় যাই তড়িৎ গতিতে। তার কিছুক্ষণ পরেই আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ ও সিনিয়র নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সেখানে উপস্থিত হন। আমরা একে অপরের খুব কাছাকাছি বসেছিলাম সেখানে। সুরঞ্জিত তার উচ্ছ্বাস সামলে রাখতে পারছিলেন না এই জরুরী অবস্থা ঘোষণার বিষয়ে এবং তার দল আওয়ামী লীগই যেন ক্ষমতায় এসেছে, এইভাবে নিজের দলকে কৃতিত্বের বাহবা দিতে থাকেন। তিনি বলেন, তার দল পরবর্তী সরকার গঠন করবে, এটি একটি সময়ের বিষয়। মনে হচ্ছিল, তিনি এমনকি ভুলে বসেছেন যে, আমরা শোকগ্রস্ত পরিবারের প্রতি আমাদের দুঃখপ্রকাশ করতে গিয়েছিলাম, বিশেষ করে বি কে দাসের প্রতি।
সুরঞ্জিত কিছু কাজে ব্যস্ততার কথা বলে চলে যেতে চাইলেন। আমি তাকে থামিয়ে বললাম, “হ্যালো লিডার, যাবার আগে আমার কিছু কথা বলার আছে, দয়া করে বসুন।” আমি বললাম যে, তার মতো নেতারা পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক মূল্যায়ন না করে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করায় নাচছেন। তাকে বলেছিলাম যে দৃশ্যত, তিনি দেশে সৃষ্ট বিপদের আশঙ্কাজনক পরিণতি সম্পর্কে একদম ভুলে গেছেন। “আপনি নির্বোধভাবে সেনাবাহিনীর ইমপ্যাক্ট না বুঝে তাকে স্বাগত জানাচ্ছেন। আপনার দলই প্রথম টার্গেট হবে এবং এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন শীঘ্রই আপনারা কোনো নির্বাচন পাচ্ছেন না।” যখন আমি কারণগুলি ব্যাখ্যা করলাম, তখন মনে হল যেন সে একটু বিভ্রান্ত আর বললেন, “দেখা যাক।” আমার শঙ্কা দিন কয়েকের মধ্যেই সত্য প্রমাণিত হয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীর প্রথম লক্ষ্য ছিল। সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী না হলেও দুর্নীতির অভিযোগে মামলা দায়ের করা কিছু মামলায় তিনি অবিলম্বে গ্রেফতার হন। এদিকে, সেনাবাহিনীর শক্তির একীভূতকরণের পর আরো রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
এর প্রায় ছয় মাস পর, রেজিস্ট্রার সাহেব জানালেন যে, রাষ্ট্রপতি ইয়াজুদ্দিন আহমেদ আমাকে পরদিন বিকেলে বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি যখন তাঁর সাথে দেখা করতে গেলাম, তখন দেখলাম তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আমিনুল করিম হাতে একটি ফাইল নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। প্রাথমিক ভাবে কোন সন্দেহ পোষণ করিনি, বরং মনে করছিলাম আমাকে বিশেষ নিয়োগ দেওয়ার জন্য ডাকা হয়েছিল। যা হোক, আমার অনুমান মিনিটখানেকের মধ্যেই ভুল প্রমাণিত হয়। রাষ্ট্রপতি বললেন যে আমাকে পদত্যাগ করতে হবে। কেন প্রশ্ন করলে জবাবে বলেন, আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তাঁকে বললাম যে রিপোর্টটি মিথ্যা ছিল এবং বিষয়টি নিয়ে তার আরও চিন্তাভাবনা করা উচিত। ওই সময় সামরিক বাহিনীর সচিব হাতের ফাইল দেখিয়ে কিছু বলতে চেষ্টা করছিলেন। আমি তাকে থামিয়ে বললাম যে তার আমার সাথে কথা বলা উচিত নয় কারণ আমি রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে সেখানে গিয়েছিলাম।
আমি রাষ্ট্রপতিকে বলেছিলাম, আমি এভাবে পদত্যাগ করব না আর তাকে এও স্মরণ করিয়ে দিলাম যে পদত্যাগ করলে এমনকি আমার পেনশন সুবিধাও পাব না। তারপর তিনি বললেন, যদি তার প্রস্তাবে রাজি হই তবে সরকার আমাকে পেনশনের দ্বিগুণ পরিমাণ দেবে। এমনকি যদি ভারতে যেতে চাই, তবে সরকার আমাকে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দেবে। ‘আমি দুঃখিত’ বললাম তাকে এবং এই বিষয়ে আবার চিন্তা করার জন্য অনুরোধ করলাম এবং আমাকে দেয়া চা না পান করেই আমি ফিরে আসি। প্রধান বিচারপতি মোঃ রুহুল আমিন তখন দেশের বাইরে ছিলেন এবং তিনি ফিরে আসার তিনদিন পর ঘটনাটি বর্ণনা করে আমি তার পরামর্শ চেয়েছিলাম। কোনরকম ঝুঁকি ও চাপ মাথায় না নিয়েই তিনি আমার বিচার কাজ চালিয়ে যেতে বলেন। এরমধ্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমীন, যিনি পরিচিত ছিলেন বিহারী আমিন নামে, ডিজিএফআই এ বদলি হলেন। তিনি আমার উপর চাপ বাড়াতে থাকলেন পদত্যাগের জন্য। একদিন রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব সুপ্রিম কোর্টের টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে আমার সাথে কথা বলতে চাইলেন। আমি তার সাথে কথা বলতে অস্বীকার করি। ড. কামাল হোসেন তখন ইউ কে তে ছিলেন আর খবর পাওয়া মাত্র নিজের মেয়ে একটিভিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার সারা হোসেনকে আমার কাকরাইলের বাসভবনে পাঠালেন এই বার্তা দিয়ে যে, তার ফেরার আগ পর্যন্ত আমার কিছু করা উচিত হবে না। পরবর্তীতে আমার ও রাষ্ট্রপতির মধ্যকার আলোচনার বিষয়ে মতামত জানাতে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ে থেকে একটি চিঠি পাই। ইতোমধ্যেই ড. হোসেন বিদেশ থেকে ফিরে আসেন, চেম্বারে এসে আমার সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং একটি লিখিত জবাব আমাকে দেন। আমি তাকে আমার নিজের প্রস্তুত করা প্রতি উত্তরটা দেখাই। উত্তর পড়ার পর, তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন যে, এটা তার লেখাটির চেয়ে চেয়ে অনেক ভাল হয়েছে। আমি সরাসরি রাষ্ট্রপতির কাছে জবাব দিয়েছিলাম যে আমরা উভয়ই সংবিধানের অধীনে শপথ গ্রহণ করেছি: সংবিধান পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে আমাদের উভয়ের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে সংজ্ঞায়িত করেছে এবং সংবিধানের অধীনে শপথ লঙ্ঘন করে এমন কিছু করা থেকে তার বিরত হওয়া উচিত। এরপর ব্যাপারটা অনেকাংশেই স্তিমিত হয়ে পড়ে।
অধ্যায় ৫
অসুস্থতা, চিকিৎসা ও আপিল বিভাগে উন্নতি
২০০৯ সালে আমি বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ি। দুর্ভাগ্যবশত, ডাক্তারগণ নিশ্চিত করে রোগের বিষয়টি জানাবার আগে প্রায় ছয় মাস অতিবাহিত হয়ে যায়। চরম শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি, মানসিক যন্ত্রণাও বাড়তির দিকে যাচ্ছিল যেহেতু আমি বিশ্বাস করেছিলাম যে আমার দিন শেষ হয়ে আসছে অনেকটা আকস্মিকভাবেই। বেশ নিবিড় আলোচনার পর ডাক্তাররা রেডিয়েশন ও কেমোথেরাপির মাধ্যমে আমার চিকিত্সা করার সিদ্ধান্ত নেন। কেমোথেরাপি দ্বিতীয় দফা প্রদানের পরপর আমাকে এত ভয়াবহ অসুস্থতা সহ্য করতে হয়েছিল যে সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, যেন এত কষ্ট ও অশান্তির বদলে তিনি আমার জীবন নিয়ে নেন।
এমনতরো সময়ে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের কাছ থেকে ফোন কল পাই। তিনি জানান সরকার আমাকে আপিলাত বিভাগে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি তার প্রস্তাব অস্বীকার করি এই বলে যে, আমার অবস্থা ভয়াবহ আর কতদিন বাঁচব তার সম্ভাবনা সম্পর্কেও কিছু জানি না। এমনকি চিকিৎসকেরাও ন্যূনতম ছয় সপ্তাহের শেষ হবার আগ পর্যন্ত চিকিত্সার ফলে উন্নতি হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে কিছু বলতে পারেননি। তিনি বললেন সরকার ও বাংলাদেশের সকলে আশা করে, আমি শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবো আর যদি আমি আপিল বিভাগে উন্নীত না হই, তবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানি সম্ভব হবে না।
আমি তাকে বললাম, স্বাস্থ্যগত কারণে দায়িত্বটি গ্রহণ আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। ছয় বা সাত দিন পর তিনি আবার ফোন করে স্বাস্থ্যের অবস্থা জানতে চাইলেন। সেই সময়ে আমাকে দেয়া কেমোথেরাপি প্রায় শেষ হয়ে যায়, মাত্র দুই বা তিনটি রেডিওথেরাপির সেশন বাদে। আমি তাকে জানাই আমার বমি বমি বোধ হওয়ার বিষয়টা প্রায় শেষ হয়ে গেছে ও মৌখিকভাবে কিছু তরল খাবার নিতে পারছিলাম। চিকিৎসার পর আমাকে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন আর জানালেন, প্রয়োজন হলে যাতায়াতের জন্য সরকারের তরফ থেকে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আমি ভাবলাম সিঙ্গাপুরে বিপুল অর্থ অপচয় করে আর থাকার কোন মানে হয় না আর তাই বাংলাদেশে ফিরবার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই অনুযায়ী, জুনের মধ্যভাগে ঢাকায় ফিরে এলাম। ২০০৯ সালের ১৫ জুলাই তারিখে মোঃ আবদুল আজিজ, বি কে দাস ও এবিএম খায়রুল হক সহ আমি শপথ গ্রহণ করি। আমি ছিলাম সবচেয়ে কনিষ্ঠ বিচারক। শিকদার মকবুল হক টপকে আমি নিয়োগ পাই। এ ব্যাপারে সুপারিশের উপর আমার নিয়ন্ত্রণ ছিল না, কিন্তু দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিক মীজানুর রহমান খান এর সমালোচনা করেছিলেন। সিকদার মকবুলের হাতে ছয় মাস বেশি সময় ছিল আর আমি ছয় মাস পরেও আপিল বিভাগে যুক্ত হতে পারতাম। যাই হোক, বিচারপতি সিকদার মকবুল ও তার পরিবার এই নিবর্তনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।
আমি জানতে পারলাম প্রধান বিচারপতি তোফাজ্জল ইসলাম, মোঃ আবদুল আজিজ, বি কে দাস, মোঃ মোজাম্মেল হোসেন ও আমাকে নিয়ে একটা বেঞ্চ গঠন করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানি শেষের জন্য। যদিও প্রায় ছয়জন সিনিয়র বিচারক ছিলেন, তবুও সবাই বেঞ্চে ছিল না কারণ তাদের মধ্যে কয়েকজন বিব্রত বোধ করেছিলেন এবং ফজলুল করিম ও এবিএম খায়রুল হক হাইকোর্ট বিভাগে আপিলের শুনানি করেন। কেন আমি সিকদার মকবুল হোসেনকে পরাজিত করেছিলাম তার সমীকরণ আমার কাছে স্পষ্ট ছিল। যদিও সকল বিচারকই জ্যেষ্ঠ ও দক্ষ ছিলেন, তবুও ফৌজদারি আইন সম্পর্কে তাদের কিছুটা কম ধারণা ছিল আর আমি বাদে বেঞ্চের বাকি সব সদস্য সাধারণ নাগরিক (সিভিল অপরাধ) বিষয়গুলি নিয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।
শপথ গ্রহণের পর, চূড়ান্ত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আমি সিঙ্গাপুরে যাই আর ডাক্তাররা মনে করছিলেন যে চিকিত্সার ফলাফল ইতিবাচক ছিল আর রোগটা পুনরায় ফিরে আসার সম্ভাবনা মাত্র ১০-১৫ শতাংশের মত। খবরটা যেদিন শুনি, সেদিন মনে প্রথম যে কথাটা মনে হয় সেটা হল, আমার নাতিকে আমি দেখতে পাবো, যে কিনা ইতিমধ্যেই পৃথিবীর আলোয় এসেছে। সিঙ্গাপুরে শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যে একজন ছিলেন সিদ্দিকী, যিনি আমাকে অযুত সাহায্য করেছিলেন, যদিও তার সাথে আগে পরিচিতি ছিল না। ঘরের নতুন সদস্য, নবীন প্রজন্মের একজনের জন্য স্বর্ণের চেইন কিনতে সাহায্য করার জন্য তাকে অনুরোধ করলাম…
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার নিষ্পত্তি হয়ে যাবার পর, অন্য আরেক ডাক্তারের মতামতের জন্য আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলাম। মেডিকেল রেকর্ড দেখা আর রক্ত পরীক্ষার পর আমাকে তারা বললেন সব কাগজপত্র ফেলে দিতে আর সিঙ্গাপুরের ড. চ্যাং ছাড়া অন্য কোন ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ না করতে। তারা জোর দিয়েই বললেন তিনি বিশ্বের সেরা ক্যান্সার চিকিৎসকদের একজন এবং আমাকে সঠিক চিকিৎসাই দিয়েছিলেন। তারা আরও জানায় আমি যদি সঠিক ডাক্তারের সাথে পরামর্শ না করতাম তবে আমার ভাগ্যে ভিন্ন কিছুও ও হতে পারত।
চলবে…
==============
নবযুগ সম্পাদকের নোট: তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে দীর্ঘ সামরিক শাসনের ইতিহাস মাথায় রেখে যারা বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করে তারা আসলে কেউই মনে রাখেননা, দিনশেষে তারা সামরিক শাসক নন, জনগণের নির্বাচিত সরকার। পর্দার আড়ালে ঘটে যাওয়া ঘটনা সামনে আসবার নজির খুব কম বলেই, আমরা সম্পূর্ণটা কখনো জানতে পাই না। তাই রূপকথার মতো মনে হয় আমাদের বাস্তবতাগুলো, সেই জাদুবাস্তবতার বাংলাদেশের জন্য সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা’র আত্মজীবনীমূলক বই ‘একটি স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী: আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র’ একটি মোক্ষম চপেটাঘাত, আমাদের ঘুমন্ত নাগরিকদের জেগে ওঠার আহ্বান।
বইটি দ্রুত অনুবাদের জন্য ড. নাজিম উদ্দিন-এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী গবেষক ও লেখক আদিত্য রাহুলকে। আশাকরি অনেকেই বইটি পাঠ করে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে একটা ধারণা পাবেন। উল্লেখ্য, ৪র্থ পর্বে ৩টি অধ্যায় যুক্ত করা হয়েছে। ৩য় অধ্যায় ড. নাজিম উদ্দিন এবং ৪র্থ ও ৫ম অধ্যায় অনুবাদ করেছেন আদিত্য রাহুল।
এই বইটি অনুবাদ করতে গিয়ে লেখকের শৈশব ও যুবক বয়সের কিছু গ্রাম ও মানুষের নাম ইংরেজিতে যেভাবে লেখা হয়েছে তার বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ করতে কিছুটা সংশয় হওয়ায়, আগ্রহী পাঠক ও জ্ঞাত ব্যক্তিদের এই বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে অনুরোধ করা যাচ্ছে। গ্রাম ও ব্যক্তির নামগুলো কারো যদি জানা থাকে তবে সেগুলোর সঠিক বানান, জানাবার অনুরোধ রইল। সকলকে শুভেচ্ছা।