অধ্যায় সাত
বিচার বিভাগীয় সার্ভিস কমিশন
মোঃ মোজাম্মেল হোসেন আমার জ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও আমি বিচার বিভাগীয় কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পেলাম। বিচার বিভাগীয় প্রশিক্ষণ কার্যালয়ের কিছু রুম নিয়ে বিচার বিভাগীয় কর্ম কমিশনের কাজ শুরু হয়। সেখানে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বসার জন্য জায়গার খুব সংকট ছিল। তাই কমিশনের কর্মকর্তাদের বসার স্থান সংকুলানের জন্য দেরী না করে আমি প্রশিক্ষণ কার্যালয়ের ওপরে আরো তিনতলা বানানোর উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করি। আমি জানতাম সরকারি কাজ ধীরগতিতে চলে, কিন্তু আমার হাতে প্রকল্প শেষ করার জন্য খুব কম সময় ছিল, আশংকা ছিল তাড়াতাড়ি না করলে ভেস্তে যেতে পারে। তবে আমার একটা সুবিধা ছিল তখনকার অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফজলে কবীর, একজন সজ্জন, অমায়িক ভদ্র বুদ্ধিমান মানুষ, তিনিও কমিশনের একজন সদস্য ছিলেন। একসময় তিনি নিজে বলেছেন, আমাকে তিনি দীর্ঘদিন ধরে চিনেন ও আমার একজন গুণমুগ্ধ। আমি তাঁকে বললাম তিনি যদি আমাকে সমর্থন না দেন তাহলে আমার পক্ষে কমিশনের উন্নয়নের কাজ সমাপ্ত করা সম্ভব হবে না। আমার কথা শুনে তিনি নিজে থেকে আমার দিকে সাহায্যের হার বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, যখনই কোন উন্নয়ন প্রয়োজন হবে তখন তিনি ফান্ড সরবরাহ করবেন।
আমার সেক্রেটারি ফরিদ আহমেদ সিবলি একজন চৌকস কর্মকর্তা, তাকে দ্রুত ভবনের সম্প্রসারণের জন্য ড্রয়িং এবং অন্যান্য কাগজ-পত্র তৈরি করার নির্দেশ দিলাম। অন্যান্য অফিসারদের সাথে তার ভাল সম্পর্ক থাকায় ভবনের সম্প্রসারণের কাজ খুব দ্রুত শেষ হয়েছিল। তারপর আমি অর্থসচিবকে প্রয়োজনীয় ফান্ডের তাগাদা দিলাম। ফান্ড পাওয়ার পরে পরিকল্পনা চুড়ান্ত করে আমি একজন কর্মকর্তাকে উন্নয়ন কাজ তদারকির জন্য নিয়োগ দিলাম। ইতোমধ্যে পুরাতন কিছু কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করে কমিশনে কিছু চৌকস কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হল। কর্মকর্তাদের ছাড়াও প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত প্রকৌশলীদের সাথেও আমি কথা বলতাম। এক সময় আমি লক্ষ করলাম, ঠিকাদার সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারায় বছর শেষে ফান্ডের বাকি টাকা সরকারি তহবিলে ফেরত দেয়া হয়েছে। এতে আমি খুব বিরক্ত হলাম কারন সরকারি টাকা ফেরত আনতে অনেক সময় লাগবে। আমি ঠিকাদারকে কাজ চালিয়ে যেতে বললাম, অর্থনৈতিক ব্যাপারটা আমি দেখব। আমার মনে কাজ শেষ করা নিয়ে আমার ক্রমাগত চাপ দেয়া দেখে ঠিকাদার কাজ ফেলে চলে যায়।
আমি অফিসকে ঠিকাদারের সিকিউরিটির টাকা বাজেয়াপ্ত করতে বললাম এবং অবিলম্বে নতুন ঠিকাদার নিয়োগের নির্দেশ দিলাম। নতুন ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হয় কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়ের ঢিলেমির কারণে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ফান্ড আসতে দেরি হচ্ছিল। আমি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য একজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেই, যার ফলে দু’বছরের মাথায় প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়।
আমি নিজে মেঝের টাইলস থেকে শুরু করে টয়লেট এবং ফার্নিচারের সবগুলো আইটেম বাছাই করে কিনি। সার্ভিস কমিশনে আমি একটি সভাকক্ষ, দু’টি মৌখিক পরীক্ষার কক্ষ, একটি লাইব্রেরি, অভ্যর্থনা কক্ষ এবং সবার ওপর তলায় আরেকটি সভাকক্ষের ব্যবস্থা রাখি। প্রথমদিকে সাধারণ গ্রিল এবং জানালা দিয়ে মিলনায়তন তৈরি হচ্ছিল। আমি তাদের বললাম মিলনায়তনের পুরো দেয়াল রঙিন কাচের তৈরি হবে, বিদেশে যেমন হয়। ঠিকাদার এবং প্রকৌশলী দু’জনেই আমার কথা শুনে একটু দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। কিন্তু আমি তাদের বললাম যাতে মিলনায়তন থেকে ঢাকা শহরের সৌন্দর্য দেখা যায় এবং শেষ পর্যন্ত তারা আমার কথা মেনে নিল। এখন এটি ঢাকা শহরে ভালভাবে তৈরি সুন্দর মিলনায়তনগুলোর অন্যতম। কমিশনে যখনই বিদেশী অতিথিরা আসেন তাদেরকে এ মিলনায়তনে আপ্যায়ন করা হয়। তারা সবাই এর স্থাপত্য এবং অাভন্তরীণ ডিজাইনের প্রশংসা করেন। এমনকী মেঝে এতো সুন্দরভাবে সাজানো যে তারা বলেন এটি ঢাকা শহরে তাদের দেখা সবচেয়ে সুন্দর ভবন। আমি সেখানে বইয়ের বিশাল সংগ্রহ দিয়ে একটি আধুনিক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করি, গ্রন্থাগারের মাঝে তিনটি কম্পিউটার স্থাপন করি যাতে ডিজিটালভাবে সারা দুনিয়ার অন্যান্য গ্রন্থাগারের সাহায্য নেয়া যায়। গ্রন্থাগারটি দেখাশোনার জন্য আমি একজন যোগ্য গ্রন্থাগারিককে নিয়োগ দিই।
মৌখিক পরীক্ষার কক্ষ দুটি বছরে মাত্র ১০-১৫ দিন ছাড়া তেমন ব্যবহার করা হয় না, অনেক সময় আরো বেশি সময় ফাঁকা পড়ে থাকে। আমি অফিসকে বললাম, কক্ষ দুটোকে এমনভাবে সাজাতে যাতে সেগুলোকে সালিশ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়। প্রত্যেকবার সালিশে বসার জন্য ৬০০০ হাজার টাকা ফি ধার্য করলাম। গ্রন্থাগার এবং সালিশ কেন্দ্র চালু হবার পরে অবসরপ্রাপ্ত বিচারকেরা যারা সালিশি করতেন, জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন তাদের অন্যতম পছন্দের জায়গা হয়ে পড়ল। আমি অন্যান্য ব্যক্তি মালিকানাধীন সালিশ কেন্দ্রের চেয়ে ভাড়া কিছুটা কম রাখলাম। সেখানে দুই শিফটে সালিশির কাজ চলত এবং এর থেকে পাওয়া টাকা সরকারি ফান্ডে যোগ হত। বলতে গেলে সালিশ কেন্দ্র থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে কমিশনের খরচ মেটানো সম্ভব। এছাড়া আমি কমিশনে একটি মহাফেজখানা, ব্যায়ামাগার এবং দু’জন অতিথি থাকবার ব্যবস্থা করি। তখন আমার মাথায় ছিল দেশের বাইরে সব জায়গায় বিচার বিভাগে বিচারক অতিথিদের থাকার জন্য একটা বাড়ি থাকে। ভারতের সকল রাজ্যে বিচারকদের জন্য আলাদা গেস্ট হাউজ আছে। তাই যখন কোন বিচারক বাংলাদেশ ভ্রমণে আসতে চান, প্রধান বিচারপতিকে তখন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। অতিথিকে কোন পাঁচ তারকা হোটেলে রাখার বন্দোবস্ত করতে তাঁকে তখন বাধ্য হয়ে আইনমন্ত্রী, এটর্নি জেনারেল বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দারস্থ হতে হয়। কিন্তু কমিশনে স্যুইট চালু হবার পরে ভারত বা অন্যদেশ থেকে আসা বিচারকদের সেখানে রাখার ব্যবস্থা করা গেছে। যেহেতু বিচারকেরা বাংলাদেশ ভ্রমণের সময় থাকার ব্যবস্থা করার জন্য প্রধান বিচারপতিকে বলেন, তাঁকে সব সময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হত। এখন এ সমস্যার সমাধান হয়েছে। আমি প্রধান বিচারপতি হবার পরে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের কমপ্লেক্সের এক নম্বর বাসাকে পূননির্মাণ করে সেটিকে অতিথিশালা হিসেবে নির্ধারিত করি। যার ফলে সুপ্রিম কোর্টে এখন আন্তর্জাতিক মানের অতিথিশালা আছে।
এক সময় আমি দেখলাম বিচার বিভাগের সকল পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাচ্ছে, আমি তখন আমার সকল কর্মকর্তাদেরকে এটা বন্ধ করার উপায় খুঁজতে বললাম। দুজন কর্মকর্তাকে একাজের দায়িত্ব দিলাম এবং কমিশনকে অনলাইনে আবেদনপত্র গ্রহণের ব্যবস্থা নিতে বললাম। তখনকার নিয়মানুযায়ী যখনই কোন পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হত তখন আবেদনকারীকে কেবলমাত্র সোনালী ব্যাংকের কিছু নির্দিষ্ট শাখা থেকে আবেদনপত্র সংগ্রহ করতে হত। তাই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল বা বিদেশে অবস্থানরত আবেদনকারীকে অনেক দূর ভ্রমণ করে আবেদন পত্র সংগ্রহ করতে হত। কমিশনের পরীক্ষা পদ্ধতির উন্নয়নের জন্য বিদেশীরা কীভাবে করে তা জানতে আমি ভারত, যুক্তরাজ্য, স্কটল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এবং ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণ করেছি। আমাদের পদ্ধতিকে ডিজিটাল করতে আমি স্কটল্যান্ডের বিচার বিভাগের কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। আমাদের কাছ থেকে সেরকম প্রস্তাব পাঠানো হলে তারা আমাদেরকে যথাসাধ্য সাহায্য করারা জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা পদ্ধতি মোট তিনধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথম পরীক্ষার মাধ্যমে শতকরা ষাট ভাগ পরীক্ষার্থীকে বাদ দেয়া হয়। ৫০০০ থেকে ৮০০০ প্রার্থীর মধ্য থেকে মাত্র ১০০ জন বা তারও কমসংখ্যক প্রার্থীকে বাছাই করা হয়। এটি খুবই জটিল কাজ। দু’জন পরীক্ষককে প্রশ্নপত্র তৈরির জন্য বলা হয়, তারপর সেটা তৃতীয় আরেকজন চুড়ান্ত করেন। আমি সিদ্ধান্ত নিই, যে পদ্ধতি আছে তা চালু থাকবে কিন্তু চুড়ান্ত প্রশ্নপত্রে পরীক্ষকবৃন্দ বা মডারেটর কারো প্রশ্ন থাকবে না। আমার সেক্রেটারির সাথে বসে প্রশ্ন চুড়ান্ত করতাম, প্রশ্নগুলোকে ঘুরিয়ে, পেঁচিয়ে এমনভাবে করে দিতাম যাতে পরীক্ষকরা ভেবে পেতেন না প্রশ্ন কীভাবে এতোটা পরিবর্তিত হয়েছে। একসময় সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) থেকে তাদের পরীক্ষা পদ্ধতির মানোন্নয়নে আমাদের সাহায্য চেয়েছিল।
আমাদের সমস্যা হল কিছু আইন আছে আমরা যার বাইরে যেতে পারি না। আইনের বিধিমালায় পরীক্ষার সিলেবাস নিয়ন্ত্রিত। ফলে পরীক্ষকদের অনেক প্রশ্ন পুনঃপুন করতে হতো। বিচার বিভাগীয় কর্ম কমিশনের সভায় আমরা অনেকবার সিদ্ধান্ত নিয়ে আইন সচিবকে প্রশ্ন প্রণয়নের নিয়ম পরিবর্তন করে সেটা কমিশনের ওপর ন্যস্ত করার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। প্রত্যেক সভায় আইন সচিব প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিবেন বলেন কিন্তু আমরা আশানুরূপ কোন ফল পাই নি। সভায় জনপ্রশাসন সচিব, অর্থ সচিব এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ছিলেন কিন্তু কিছুতেই কোন ফল হয়নি। একসময় আমি আইন সচিবের কাছে এ বিষয়ে বিলম্বের কারণ জানতে চাইলাম। তাঁর জবাব শুনে আমি আশ্চর্যান্বিত হলাম। তাঁর জবাব ছিল, যদি বিএনপি-জামাতের কোন ব্যক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান পদে বসেন তাহলে তিনি এমনভাবে প্রশ্ন প্রণয়ন করবেন যাতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা অবহেলিত হবে। আমি তাঁকে বললাম, একই ঘটনা সরকারি কর্ম-কমিশনেও ঘটতে পারে। তাছাড়া তিনি যদি আইন পাল্টাতে পারেন তাহলে অন্যান্য রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসলে তারা পারবে না কেন?
আসল ঘটনা হল আইন সচিব বিচার বিভাগীয় কর্ম কমিশনকে অকার্যকর করে রাখলেন। একটা দুঃখজনক ঘটনার কথা মনে আসছে। আইন অনুযায়ী ডিসেম্বর মাসের ৩১ তারিখের মধ্যে পরবর্তী বছরে নিয়োগের জন্য মোট প্রার্থীর চাহিদাপত্র দাখিল করবে। সম্ভবত ২০১৩ একাডেমিক সালে বার বার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও আইন মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগের জন্য কোন চাহিদাপত্র দেয়া হয়নি। এপ্রিল মাসের কোন এক সময়ে তিনি আমাদের ২৪ জন প্রার্থী নিয়োগের চাহিদাপত্র দেন। এদিকে আমাদের বিবেচনায় শতাধিক প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া দরকার ছিল। আমি আইন সচিবকে দেখানোর জন্য ১৫০ টি সম্ভাব্য খালি পদের তালিকা নিয়ে একজন কর্মকর্তাকে পাঠালাম। আমাদের যুক্তি ও ন্যায্যতায় তার কানের মাছিও নড়ল না। তিনি চাহিদাপত্রে কোন পরিবর্তন আনলেন না। আমরা ভাবলাম পরীক্ষা পদ্ধতি যেহেতু অনেক দক্ষযজ্ঞ ব্যাপার এবং মাত্র ২৪ জন্য প্রার্থীর জন্য এতো সময় ও শক্তি খরচ করার কোন মানে হয় না। কিন্তু আমরা আইন সচিবের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারলাম না। এক সময় তিনি বললেন, চাহিদাপত্র পরিবর্তন করলে তাকে জেলে যেতে হবে। আমি তাকে অবসরে যাওয়ার তালিকায় যেসব কর্মকর্তা আছেন তাদের দেখালাম এবং বললাম মাত্র দশ মিনিটে এ হিসাব করা সম্ভব। শেষ পর্যন্ত আমরা তাকে বুঝাতে সক্ষম হলাম যার ফলে তিনি ১৫০ টি ফাঁকা পদ থাকা সত্ত্বেও মাত্র ৫৪ জন প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য চাহিদাপত্র দিয়েছিলেন।
পরীক্ষা পদ্ধতি খুবই দীর্ঘ এবং এতে প্রায় এক থেকে দেড় বছর সময় লেগে যায়। পুলিশ ভেরিফিকেশনের পরে মন্ত্রণালয় থেকে গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশে ছয় মাস সময় লেগে যায়। ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে আমরা এমন স্থবির প্রক্রিয়ার খারাপ ফল ভোগ করি। তখন সারাদেশে সহকারি বিচারকের তীব্র সংকট চলছিল। একজন কর্মকর্তা নিয়োগ পাবার পরে দু’এক বছরে পুরোপুরি বিচারক হয়ে ওঠতে পারেন না। তার প্রশিক্ষণের দরকার হয়, তাকে নিয়োগের দু’বছরের মধ্যে বিভাগীয় পরীক্ষায় পাশ করতে হয়। একজন প্রাজ্ঞ বিচারক হয়ে ওঠতে একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার প্রায় ছয়-সাত বছর সময় লাগে। যার ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হলে আদালতের স্বল্পতার কারণে মামলা-মোকদ্দমার সাথে জড়িত মানুষেরা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হন। যথাসময়ে নিয়োগে গাফিলতির কারণে ২০১৬ সালে কমিশনের চেয়ারম্যান ১০০ জন প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেন কিন্তু তাঁকে ৩০০ জনের ফলাফল প্রকাশ করতে বাধ্য হতে হয়েছিল। কোন একটা ব্যাচে একসাথে একশো’র বেশি প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়ার অনেক সমস্যা আছে, কারণ নিয়োগের পরে সিনিয়রিটির ভিত্তিতে একই ব্যাচের কেউ অতিরিক্ত জেলা জজের পদে পদোন্নতি পাবেন অপরদিকে তার সহকর্মীরা সিনিয়র সহকারি জজ হিসেবে পড়ে থাকবেন এটা তাদের জন্য বিব্রতকর।
পরীক্ষা পদ্ধতিতেও আমি অনেক পরিবর্তন এনেছিলাম। আবেদন পত্র দাখিলের প্রথমেই প্রত্যেক পরীক্ষার্থীকে একটি গোপন কোড দিয়ে শনাক্ত করা এবং কমিশনের একজন বিশ্বস্ত সদস্য সে কোডের মানে বলতে পারবেন। তারপরে প্রাথমিক পর্যায়ের বাছাইয়ের মত করে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়। প্রত্যেক বিষয়ে তিনজন বিশেষজ্ঞ পরীক্ষকের দ্বারা প্রশ্ন তৈরি করে সেগুলো মডারেটর এবং চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো হত, তারা সেগুলোকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে পরিবর্তিত করে চুড়ান্ত রূপ দেন যাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং পুনঃপুন একই প্রশ্ন করা প্রতিরোধ করা যায়। আমরা আবিষ্কার করলাম বেশিরভাগ প্রশ্নপত্র বিজি প্রেস থেকে ফাঁস হয়। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম শুধু প্রশ্নপত্র নয় উত্তরপত্রও কমিশন নিজেরাই প্রস্তুত করবে যদিও কমিশনের যথেষ্ট লোকবল ছিল না। তা সত্ত্বেও আমরা তিনটি প্রিন্টিং মেশিন কিনলাম এবং তারপর থেকে সকল প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র আমরা নিজেরাই ছাপাতে লাগলাম, কমিশন স্বাবলম্বী হল। আমি কমিশন ছাড়ার সময় এটি একটি স্বাবলম্বী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছিল। পরীক্ষা পদ্ধতি এতটা সুচারু হয়েছিল যে স্বয়ং পরিচালক চাইলেও তার পক্ষে কোন প্রার্থীকে পাশ করানো সম্ভব ছিল না। আমাদের নতুন পদ্ধতির স্বচ্ছতা বুঝাতে আমরা একটি ভিডিও ক্যাসেট তৈরি করেছিলাম। ভিডিও দেখে দিল্লীর বিচার বিভাগীয় কমিশনের পরিচালক আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতির ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং বলেন দিল্লিতে পরবর্তী পরীক্ষার সময় তিনি অনুরূপ ব্যবস্থা চালু করবেন।
কমিশনের পরিচালক হিসেবে বিভিন্ন দেশের নিয়োগ প্রক্রিয়া বুঝতে আমি নানা দেশভ্রমণ করেছি যেটা আমি আগেই বলেছি। ভারতে থাকাকালীন সময়ে আমি সেখানকার প্রধান বিচারক, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও অন্যান্য জ্যেষ্ঠ বিচারকদের সাথে সাক্ষাত করি এবং অফিসিয়াল সভায় তাদের সাথে মত বিনিময় করি। সভায় আমাদের হাই কমিশনারও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে আমি বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের জন্য ভারতের ভোপালে অবস্থিত জাতীয় জুডিশিয়াল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণের জন্য সহযোগিতা চাই। প্রধান বিচারক আলতামাস কবির আমাকে প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার নিশ্চয়তা দেন, তিনি আরো জানান পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল এবং ভুটানের বিচারকেরা ইতোমধ্যে সেখানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। আমি প্রধান বিচারপতি হিসেবে থাকাকালীন সময়ে বাংলাদেশ থেকে বিচারকদের প্রথম ব্যাচ সেখানে প্রশিক্ষণ নিতে যান।
ইন্দোনেশিয়াতে আমি প্রধান বিচারক এবং বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশনের পরিচালকের সাথে সাক্ষাতের সময় আমি জানতে পারলাম তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য পাশ করা আইনের মেধাবী ছাত্রদের মধ্যে থেকে নির্বাচন করে তাদের বিচারক বানানোর জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। তার একে বলেন ‘গ্রিন হার্ভেস্টিং’। একই প্রক্রিয়া সিঙ্গাপুর এবং দক্ষিণ কোরিয়াতেও অনুসরণ করা হয়। আইন কর্মকর্তা হিসেবে সবচেয়ে ভাল ছাত্রগুলোকে নির্বাচিত করা হয়, তারপরের দিকের ভাল ছাত্রেরা পাবলিক কৌশলী হিসেবে নিয়োগ পায় আর তালিকার শেষের দিকে যারা থাকে তারা আদালতে উকিলের কাজ করে। আমি বিদেশের এটর্নি জেনারেলদের সাথেও কথা বলেছি যাদের পদমর্যাদা একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর সমান। ইন্দোনেশিয়াতে আমি বিচার বিভাগীয় প্রশিক্ষণ কার্যালয়ে গিয়েছি সেখানে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি দেখেছি। সেখানকার কমিশনের পরিচালক ভদ্রমহিলার অনুরোধে উভয় প্রশিক্ষণ সূচিতে আমার কিছু কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমি তাদেরকে আমাদের বিচার বিভাগ এবং আদালত পরিচালনার শক্ত, বুনিয়াদি উত্তরাধিকারের কথা বললাম। যুক্তরাজ্য এবং স্কটল্যান্ডে নিয়োগ প্রক্রিয়া অন্যান্য দেশের চেয়ে সম্পূর্ণ পৃথক। সেখানে কমিশনের পরিচালক থাকেন একজন সাধারণ নাগরিক, অন্যান্য সদস্যরা হলেন উচ্চ আদালতের বিচারকবৃন্দ এবং সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়ের ব্যবহারিক জ্ঞান আছে এমন বিভিন্ন দল ও মতের অনুসারী মানুষ। এমনকী সর্বোচ্চ আদালতে বিচারকও প্রার্থীদের আবেদনের ভিত্তিতে যাচাই করে নির্বাচন করা হয়। ইংল্যান্ডে এমনকী একজন ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগের জন্য সর্বনিম্ন যোগ্যতা ব্যারিস্টার হিসেবে কমপক্ষে দশ বছরের অভিজ্ঞতা।
চলবে…
==============
নবযুগ সম্পাদকের নোট: তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে দীর্ঘ সামরিক শাসনের ইতিহাস মাথায় রেখে যারা বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করে তারা আসলে কেউই মনে রাখেননা, দিনশেষে তারা সামরিক শাসক নন, জনগণের নির্বাচিত সরকার। পর্দার আড়ালে ঘটে যাওয়া ঘটনা সামনে আসবার নজির খুব কম বলেই, আমরা সম্পূর্ণটা কখনো জানতে পাই না। তাই রূপকথার মতো মনে হয় আমাদের বাস্তবতাগুলো, সেই জাদুবাস্তবতার বাংলাদেশের জন্য সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা’র আত্মজীবনীমূলক বই ‘একটি স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী: আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র’ একটি মোক্ষম চপেটাঘাত, আমাদের ঘুমন্ত নাগরিকদের জেগে ওঠার আহ্বান।
বইটি দ্রুত বাংলা ভাষান্তরের জন্য ড. নাজিম উদ্দিন-এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী গবেষক ও লেখক আদিত্য রাহুলকে। আশাকরি অনেকেই বইটি পাঠ করে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে একটা ধারণা পাবেন। এই পর্ব, অর্থাৎ ৭ম অধ্যায় -এর ‘বিচার বিভাগীয় সার্ভিস কমিশন‘ অংশটি অনুবাদ করেছেন ড. নাজিম উদ্দিন।
এই বইটি বাংলা ভাষান্তর করতে গিয়ে লেখকের শৈশব ও যুবক বয়সের কিছু গ্রাম ও মানুষের নাম ইংরেজিতে যেভাবে লেখা হয়েছে তার বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ করতে কিছুটা সংশয় হওয়ায়, আগ্রহী পাঠক ও জ্ঞাত ব্যক্তিদের এই বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে অনুরোধ করা যাচ্ছে। গ্রাম ও ব্যক্তির নামগুলো কারো যদি জানা থাকে তবে সেগুলোর সঠিক বানান, জানাবার অনুরোধ রইল। সকলকে শুভেচ্ছা।