অধ্যায় ১০
বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ
বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন এর অবসরে যাবার তিন মাস আগে থেকে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে অনেক কানাঘুষা চলছিল। শামসুদ্দিন চৌধুরী পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হবার জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, এছাড়া সম্ভাব্য প্রধান বিচারকের পদে দেশের মুন্সেফ আদালতের প্রথম নারী জজ, জেলা জজ, হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে নাজমুন আরা সুলতানার নামও শোনা যাচ্ছিল। নাজমুন আরা সুলতানা প্রধান বিচারপতি হলে তাঁর অবসরের পরে আমার প্রধান বিচারপতি হবার সম্ভাবনা থাকে। তার উপর দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং স্পীকার নারী হওয়ায়, প্রধানমন্ত্রী চাইলে সারা দুনিয়াকে দেখাতে পারতেন যে বাংলাদেশে সরকারের তিনটি শাখার প্রধান নারী। এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা হতে পারত, কারণ গোটা দুনিয়ায় এমন কোন নজির ছিল না। শামসুদ্দিন চৌধুরী তাকে নিয়োগের জন্য নানা জায়গায় ছোটাছুটি করছিলেন। তাঁকে নিয়োগ দেয়া হলেও আমার প্রধান বিচারপতি হবার সুযোগ থেকে যায়, কারণ তার অবসরের সময় নাজমুন আরা সুলতানারও আগে ছিল।
এদিকে এসব গুজবে আব্দুল ওয়াহাব মিয়া খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন।। যদিও তিনি জানতেন যে তাঁকে এ পদের জন্য নির্বাচিত করা হবে না, কিন্তু তাঁর ভয় ছিল বাকি যে দুজনের কথা শোনা যাচ্ছে তারা দুজনেই তার বয়োকনিষ্ঠ, সেক্ষেত্রে তাঁর জন্য পদত্যাগ ছাড়া আর কোন রাস্তা খোলা থাকবে না। কিন্তু আমাকে নিয়োগ দেয়া হলে তিনি ৩১ জানুয়ারী, ২০১৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যেতে পারবেন। সেজন্য তিনি আমাকে বারবার অনুরোধ করতে লাগলেন যাতে আমি প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য নীতি নির্ধারকদের বলে কয়ে আমার বয়োজ্যেষ্ঠতা টিকিয়ে রাখি। আমি তাঁকে বললাম, আমি জানি না আমাকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেয়া হবে কি না, কিন্তু আমি জানি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে এ পদের জন্য বিবেচনা কর হবে না কারণ তিনি প্রধান বিচারপতি পদের জন্য মোটেই উপযুক্ত নন। এছাড়া, প্রধানমন্ত্রীর ভাল-মন্দ বোঝার মত যোগ্যতা ও পরিপক্কতা আছে। তিনি আদালতের সবচেয়ে বয়োকনিষ্ঠ বিচারককে প্রধান বিচারপতি পদে বসাবেন না। আমি ওনাকে আরো বললাম, প্রধান বিচারপতি পদে আমার নিজের জন্য সুপারিশ করতে আমি হব সর্বশেষ ব্যক্তি।
এ প্রসঙ্গে বলা যায়, হাইকোর্টে থাকাকালীন সময়ে শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রধান বিচারপতির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। কয়েকবার তার বেঞ্চ পরিবর্তন করা হয়েছিল তারপরেও তিনি কয়েকবার সরকারী কর্মচারীদের বিরুদ্ধে রায় প্রদান করেছিলেন। কোন কারণ ছাড়া আদালত অবমাননার রায় দিয়ে তাদের স্বশরীরে আদালতে হাজির হবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আদালত চলাকালীন তিনি তাদেরকে পুরো সময় দাঁড়িয়ে রাখতেন তারপরে আদালত মুলতবি ঘোষণা করতেন। তার আচরণে সরকার অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়েছিল। রীট বেঞ্চে থাকার সময়ে তিনি সাধারণ ফৌজদারি মামলায় হস্তক্ষেপ করেছিলেন যেটা সাংবিধানিকভাবে তাঁর বেঞ্চে আওতা বহির্ভূত ছিল। তাকে ঠেকাতে এক সময় আমি প্রধান বিচারপতিকে বেঞ্চের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করার সুপারিশ করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত গত্যন্তর নাই দেখে সরকার তাঁকে আপীল বিভাগে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যাতে করে তিনি সেখান থেকে কোন আদেশ না দিতে পারেন। কারণ আপীল বিভাগে তিনি হবেন সবচেয়ে বয়োকনিষ্ঠ সদস্য। ফলে সেখানে তাঁর তেমন কর্তৃত্ব থাকবে না। তাঁর নিয়োগ নিয়ে খুব মজার একটা গল্প আছে। যদিও প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেনের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল, তা সত্ত্বেও প্রধান বিচারপতি কিন্তু তাঁর নাম সুপারিশ করেননি। সংবিধানের নিয়মানুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির সাথে শলা-পরামর্শ করে বিচারকদের নিয়োগ দিবেন। রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির সাথে সে ধরণের কোন শলা-পরামর্শ ছাড়াই তাঁকে বিচারক পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন, শামসুদ্দিন চৌধুরী তখন লণ্ডনে অবস্থান করেছিলেন। টিভির স্ক্রলে তাঁর নিয়োগের খবর দেখিয়েছিল। সরকারের এমন কাজ দেখে প্রধান বিচারপতি আইনুমন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করে শামসুদ্দিন চৌধুরীর নাম সরিয়ে নিতে বলেছিলেন। আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ এ ব্যাপারে আমার পরামর্শ চেয়েছিলেন। আমি তাঁকে এ ব্যাপারে চিন্তা না করতে বললাম, এর পরিবর্তে তিনি যেন প্রধান বিচারপতিকে বলেন যে, সরকার সংবিধানের ৯৬ ধারা সংশোধনের ব্যাপারে গুরুত্ব সহকারে চিন্তা-ভাবনা করছে যাতে করে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যদের ভোটে পাস করা সিদ্ধান্তে সুপ্রিম কোর্টের যে কোন বিচারকের অসদাচারণ বা অযোগ্যতা প্রমাণিত হলে তাঁকে বরখাস্ত করা যায়। আসলেই সেরকম কিছু একটা ঘটতেছিল, সাবেক প্রধান বিচারপতি খাইরুল হক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এম পি ও আরো কিছু সংসদ সদস্য মিলে সংবিধান সংশোধন করে এমন একটা বিধান রাখার ব্যাপারে গুরুতর ভাবে চাপ দিয়ে আসছিলেন। তখন এটর্নি জেনারেলের অবর্তমানে অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা এটর্নি জেনারেলের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি আমার কাছে ছুটে এসে আমাকে জানালেন, প্রধান বিচারপতি যদি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে মেনে নিতে রাজী না হন তাহলে খুবই মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি হবে। আমি তাঁকে বললাম এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রীর সাথে আমার কথা হয়েছে। তা সত্ত্বেও আমি এবং মুরাদ রেজা দু’জনেই লণ্ডনে বিচারক শামসুদ্দিন চৌধুরীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলাম যাতে তিনি দ্রুত দেশে ফিরে আসেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে আমরা তাঁর সাথে যোগাযোগ করে পরবর্তী ফ্লাইট পাওয়ামাত্র দেশে ফেরত আসতে বললাম। মুরাদ রেজা এবং আমি মিলে তাঁকে দেশে ফেরার কারণ জানালাম এবং তিনি আমাদেরকে চেষ্টা করবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। ইতোমধ্যে আমরা খবর পেলাম প্রধান বিচারপতি আইন মন্ত্রীর কাছ থেকে সংবিধানের সম্ভাব্য সংশোধনীর কথা শুনে ভীত হয়ে শামসুদ্দিন চৌধুরীর নিয়োগ নিয়ে তাঁর কোন অভিযোগ নেই বলে জানিয়েছেন।
আমি মনে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম, যদি প্রধানমন্ত্রী মুসলিম প্রধান দেশে একজন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির সদস্যকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিতে না চান তাহলে নাজমুন আরা সুলতানা অথবা সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এদের যেকোন একজন প্রধান বিচারপতি হতে যাচ্ছেন। আমি নিশ্চিতভাবে জানতাম প্রধানমন্ত্রী আমাকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করতে আগ্রহী কিন্তু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর একজন সদস্যকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ফলাফল খুব সাবধানতার সাথে বিবেচনা করে দেখছিলেন। দেশের তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আমাকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ না দেবার কোন কারণ ছিল না। আমি এমন সিদ্ধান্তও নিয়েছিলাম, যদি আমাকে নির্বাচিত না করা হয় তবে আমি সাথে সাথে পদত্যাগ করব। কিন্তু আমি আমার অনুভূতির কথা কাউকে জানাইনি। ইতোমধ্যে আব্দুল ওয়াহাব মিয়া এতটা উদ্বিগ্ন ছিলেন যে তিনি আমাকে প্রতি একদিন অন্তর চাপ দিয়ে আসছিলেন, আমি যেন উপর মহলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলি যাতে করে আমার নাম সুপারিশ করা হয়। আমি তাঁকে স্পষ্ট বলে দিলাম কোন উঁচু পদের জন্য প্রার্থী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সুপারিশ করার জন্য আমি হলাম সর্বশেষ ব্যক্তি। কিন্তু আমি তাঁকে আশ্বস্ত করলাম, আর যাই হোক শামসুদ্দিন চৌধুরী নিয়োগ পাবেন না।
শেষ পর্যন্ত মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেনের অবসরে যাবার প্রায় সাত দিন আগে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আমার সাথে গোপন কোন স্থানে দেখা করতে চাইলেন। আমি তাঁকে আইন বিভাগীয় কর্মকমিশনের সভাকক্ষে আসতে বললাম, এ ধরণের কোন সভার জন্য সেটা ছিল উপযুক্ত জায়গা। কথামত সেদিন বিকেলে আইনমন্ত্রী এসে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে আমাকে নির্বাচিত হওয়ার জন্য অভিনন্দন জানালেন। তিনি আমাকে জানালেন বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর নিজের উপস্থিতিতে এক সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
আমি ব্যাপারটা গোপন রাখলাম, কিন্তু পরদিন ব্যাপক গুজব ছড়িয়ে গেল শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন। গুজব শুনে আমি নিজে নিজে হাসলাম; কিন্তু যতই গুজব ছড়াচ্ছিল আব্দুল ওয়াহাব মিয়া ততই উদ্বিগ্ন হতে লাগলেন। আমি লক্ষ্য করলাম তিনি বিচারিক প্রশাসনিক কাজে মনোনিবেশ করতে পারছেন না। একদিন আমি তাঁকে খুব শক্তভাবে বললাম গুজবে কান না দিয়ে তাঁর কাজে মন দেয়া উচিত। ভাগ্য সহায় থাকলে আমি প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ পাব, কিন্তু তাঁকে আশ্বস্ত করলাম যে শামসুদ্দিন চৌধুরীর একজন প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হবার মত সুযোগও নেই। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তাঁর ক্ষমতানুযায়ী প্রধান বিচারপতিকে নির্বাচিত করবেন ও নিয়োগ দিবেন। কিন্তু বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতির কোন ক্ষমতাই নেই। এটা শুধু তখনকার কথা নয়, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পর থেকেই এমন হয়ে আসছে। ওয়াহাব মিয়া ভাঙ্গা হৃদয় নিয়ে আমার চেম্বার ত্যাগ করলেন। রীতি অনুযায়ী, শপথ গ্রহণের একদিন বা দু’দিন আগে সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হল যে আমাকে বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধান বিচারপতি পদে মনোনীত করা হয়েছে। সে অনুযায়ী জুলাই ১৫, ২০১৫ সালে আমি শপথ গ্রহণ করি। এটি ছিল এক ঐতিহাসিক মূহুর্ত, কারণ গোটা দুনিয়াতে কোন মুসলিম প্রধান দেশে একজন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সদস্য আগে কখনও এমন উঁচু পদ অলংকৃত করেনি। প্রথা অনুযায়ী শপথ গ্রহণের দিন প্রধান বিচারপতিকে সম্বর্ধনা জানানো হয়। আমি এর জন্য সকাল সাড়ে দশটায় সময় নির্ধারণ করলাম। এটি ছিল স্মরণীয় একটি ঘটনা। আমি আরো চাইলাম রাজনৈতিক মত-পার্থক্য ভুলে সকল দলের আইনজীবীরা যাতে সংবর্ধনায় অংশ নিতে পারে, যদিও গত পাঁচ-ছয় টার্মে শুধু সরকারি দলের কিছু আইনজীবী অংশ নিয়েছিলেন। সেবারই প্রথম আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত, গনতান্ত্রিক ফোরামের আইনজীবীরা যোগ দিয়েছিলেন। এক নম্বর আদালত কক্ষে তিল ধরার জায়গা ছিল না, অনেক আইনজীবী আদালত ভবনের পশ্চিম ও দক্ষিণের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। সেজন্য আমি রেজিস্ট্রিকে বাড়তি চেয়ারের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলাম যাতে সবাই বসতে পারেন এবং স্পীকারের ব্যবস্থা নিতে বললাম যাতে সবাই সভার কথা-বার্তা শুনতে পান। সংবর্ধনার জবাবে আমি আইনজীবীদের বললাম বিচার বিভাগের সংস্কার করাটা আমার অগ্রাধিকার হিসেবে থাকবে। প্রথম যেসব কাজ করব সেগুলো হলঃ
ক) বিচার বিভাগের সংস্কার;
খ) বিচার বিভাগের কাজে আদালত কর্তৃক নির্ধারিত পূর্ণ সময় ব্যয় করব যেমন, সময় মত আদালতে বসা ও প্রস্থান করা;
গ) বিচার বিভাগকে ডিজিটালকরণ;
ঘ) নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ ছাড়া বিচার বিভাগ পরিচালনা করা;
ঙ) আদালতে কোন দোষী বা নির্দোষী ‘মেনশান’ হবে না, কোন বিষয়ে অগ্রীম শুনানির জন্য কোন বরাদ্দ চলবে না, চেম্বারে উপস্থিত বিচারকের তালিকা অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে মামলা সেদিনের মোকদ্দমার তালিকায় স্থান পাবে;
চ) সুপ্রিম কোর্টের ছুটির দিন হ্রাস করা হবে।
ছ) শুনানির পর থেকে শুরু করে ছয় মাসের মধ্যে দ্রুততার সাথে রায় এবং আদেশে সই করতে হবে;
জ) আদালতে সংখ্যা বৃদ্ধি করা এবং বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় আমার পুর্ববর্তী বিচারকদের সময়ে প্রতিদিন আদালতের দেড় ঘন্টা সময় নষ্ট হত। সেটা হল, যদিও সকাল ৯টায় আদালত বসার কথা কিন্তু সেটা বসত সাড়ে নয়টা বা পৌনে দশটার সময়। তারপরে চা বিরতির পরে সকাল এগারটায় আবার বসার কথা কিন্তু আমরা সাধারণত সাড়ে এগারোটা থেকে পৌনে বারোটার সময় বসতাম এবং দুপুর সোয়া একটার বদলে একটার সময়ে উঠে পড়তাম। প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন দেশের বাইরে থাকাকালীন সময়ে আমি অনেকবার তাঁর দায়িত্ব পালন করেছিলাম। কিন্তু সে সময় আমি আদালতের সময় পরিবর্তন করতে চাইলে বিচারপতি আব্দুল ওয়াহাব মিয়া আমাকে বাধা দিতেন, বলতেন, আমি প্রধান বিচারক হলে তখন আদালতের সময় পরিবর্তন করতে পারব, তার আগে বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন যতদিন অবসরে না যাচ্ছেন ততোদিন আগের নিয়মে চলুক। অন্যান্য বিচারকরা চুপ থাকতেন তার মানে তারাও আব্দুল ওয়াহাব মিয়ার দৃষ্টিভঙ্গীকে সমর্থন করেন, যার কারণে আমি নির্দিষ্ট সময় স্থির করতে পারিনি। আমি যখন আদালতে বসার সময়সীমা নিয়ে বিস্তারিত বললাম তখন বিচারকরা আমার সাথে সময়মত বসতে বাধ্য হলেন।
আরেকটা সমস্যা ছিল প্রতি রোববারে আদালতে প্রথমবারের মত মামলার শুনানিতে অনেক সময় নষ্ট হত। প্রতিদিন আইনজীবীদের একটা লম্বা লাইন পড়ে যেত। তারা বলত তাদের মামলাগুলো ততো জরুরী নয় সেজন্য তারা প্রধান বিচারপতির নির্দেশ মত চেম্বার জাজের সাথে বিষয়টা মিটমাট করছেন কিন্তু তাদের মামলাগুলো নথিবদ্ধ হয়নি। যখন আমি প্রধান বিচারপতির পাশে বসতাম তখন দেখেছি ে নিয়ে তাঁর অনেক সময় নষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। তখন বড়লোকেরা টাকার বিনিময়ে তাদের মামলাগুলোকে তালিকাবদ্ধ করতেন এমন দূর্নীতির অভিযোগ ছিল। অনেক সময় কিছু চিহ্নিত মানুষ লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে এসব করতেন, এটা ছিল ‘ওপেন সিক্রেট’।
এসবের অবশ্য কারণ ছিল। আগের প্রধান বিচারপতি বয়োজ্যেষ্ঠ বিচারকদের সাথে দ্বিতীয় কোন বেঞ্চ গঠন করেননি, তিনি সাত জন বিচারকের সাথে বসে বিভিন্ন মামলার শুনানি শুনতেন। বড় বড় আইনজীবীরা এ নিয়ে হাসাহাসি করতেন, তারা আমাদের কাছে জানতে চাইতেন কেন আমরা দ্বিতীয় আরেকটা বেঞ্চ গঠন করিনি। আমি এতে বিব্রত বোধ করতাম বলতাম এটা সম্পূর্ণ রূপে প্রধান বিচারপতির বিশেষ অধিকার। প্রধান বিচারপতি যখন ১৯৭৩ সালের তথ্য ও যোগাযোগ আইনের অধীনে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্ত দু’তিনটি আপীল আবেদনের সিদ্ধান্ত দিলেন তখন তিনি নাজমুন আরা সুলতানাকে প্রধান করে দ্বিতীয় আরেকটি বেঞ্চ গঠন করলেন। তাঁর দায়িত্বকালীন তিন বছর আট মাস সময়ে প্রধান বিচারপতি আমাকে কখনও স্বাধীন কোন বেঞ্চের দায়িত্ব দেননি। কেবল তিনি বিদেশ থাকাকালীন সময়ে আমি বেঞ্চ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলাম।
বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সাধারণত যখন নতুন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নেন তখন তিনি পুষ্পস্তবক দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যান। এমনকী বিদেশী সম্মানিত অতিথি, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এদের ভ্রমণের সময় তাদের বাংলাদেশে অবস্থানের সময় প্রথম দিনে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কখনও কোন প্রধান বিচারপতি সম্মান প্রদর্শন করতে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যান নি। তাই সম্বর্ধনা শেষে আমি বিচারকদের বললাম, আমি জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে যাব। তাঁরা সবাই আমার সাথে যেতে চাইলেন। এটি ছিল একটি স্মরণীয় ঘটনা। সেনাবাহিনীর নবম ডিভিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রধান বিচারপতি এবং তার সহগামী বিচারকদের অভ্যর্থনা জানালেন। গণমাধ্যমের প্রতিনিধি এবং সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে আমি অফিসিয়ালি জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করলাম এবং ভিজিটর বইয়ে মন্তব্য লিখলাম। এ ঘটনা গণমাধ্যমে খুব আলোচিত হয়েছিল।
পরদিন আমি দুটি বেঞ্চ গঠন করলাম, একটায় প্রধান বিচারপতি হিসেবে শুধু আমি ছিলাম, আরেকটা পরিচালনার দায়িত্বে বিচারক আব্দুল ওয়াহাব মিয়া, এবং দুটো আদালত একসাথে কাজ শুরু করেছিল। আমি অফিসে বললাম যেসব মামলা তালিকায় ঊঠেনি সেগুলো সব প্রতিদিনের মামলার তালিকায় তুলতে যাতে আদালতে আইনজীবীদের দ্বারা প্রাথমিক শুনানীর জন্য সময় নষ্ট না হয়। আমি দায়িত্ব নেবার ছয় মাসের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আবহাওয়া সম্পূর্ণ পালটে গেল এক সময় আমি দেখলাম বিরতির পরে তেমন বেশি আইনজীবীকে দেখা যাচ্ছে না। আদালতে মামলার আনুষ্ঠানিক আবেদনের দিন আমি প্রায় একশত থেকে একশত বিশটির মত মামলার নিষ্পত্তি করতাম, আর আপীলের দিন আমি বার থেকে পনেরটি আপীল আবেদনের নিষ্পত্তি করতাম। শতকরা প্রায় ৬০ থেকে ৭০ ভাগ মামলার আবেদন খোলা আদালতে আদেশ নিষ্পত্তি হত যেটা সুপ্রিম কোর্টে আগে কখনও হয়নি। এক থেকে দু’ সপ্তাহের মধ্যে মামলার আদেশ বা রায় হত, কখনো এক বা দু’দিনে সেটা হত। ফলে মক্কেলরা দীর্ঘদিন ধরে আদালতের আদেশের জন্য অপেক্ষা করার হাত থেকে রেহাই পেল, আইনজীবীরাও এতে খুশি ছিল।
আরেকটা ব্যাপারে আমি কিছুটা উন্নয়ন করতে পেরেছিলাম সেটা হল যে কোন বিষয়ে আইনজীবীদের কালক্ষেপণ করাটা নিয়ন্ত্রণ করেছিলাম। এক থেকে দুই মিনিটের মধ্যে আমি পয়েন্ট বের করে নিতাম। আমার জেরার মুখে মাঝেমধ্যে আইনজীবীদের অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়তে হত। পাঁচ থেকে ছয় মিনিটে জটিল সব বিষয়াদির মীমাংসা করে দিতাম। যে কোন মামলার জন্য আমি দশ মিনিটের বেশি সময় দিতে রাজী ছিলাম না। পূর্বে এসব মামলা ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে শোনা হত। এর ফলে যেটা হল মামলা নিষ্পত্তির হার শতকরা ষাট ভাগ বেড়ে গেল। এক বছরের মধ্যে এমন হল যে কিছু আইনজীবী তাদের মামলা খারিজ হোক এটা চাইত না, তারা তাদের মামলা তালিকায় তুলতেই অস্বস্তি বোধ করত।
আমি অফিসে বলে দিয়েছি বছর অনুযায়ী মামলাগুলোকে তালিকাবদ্ধ করতে যাতে কোন ধরণের হস্তক্ষেপ বা অবৈধ লেনদেন ছাড়া সেগুলো প্রতিদিনের মামলার তালিকায় উঠতে পারে। পুরাতন মামলা নিয়ে আমি কোন আইনজীবীকে হাজির হতে দেখতাম না। অনেক সময় আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সামনের ডেস্কে বসা আইনজীবীকে আপীলের জন্য পিটিশান করতে দিতাম। আদালতে আরেকটা রেওয়াজ ছিল কোন মামলা পরপর তিনটি আদালতে খারিজ হয়ে যাবার পরেও আপীলের আবেদন খারিজ করার সময় লম্বা রায় দেয়া হত। আমি এটা বন্ধ করে দিলাম এবং সংক্ষিপ্ত আদেশে সেগুলো বাতিল করে দিলাম। যে আবেদনের কোন মূল্য নেই সেটা খারিজ করে দেবার জন্য আদালতের সময় নষ্ট করে লম্বা রায় দেবার কোন প্রয়োজন নেই, এবং এ ব্যবস্থা দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিতেও সহায়ক হয়েছিল। বিচারকেরাও অপ্রয়োজনীয় কাজের চাপ থেকে মুক্তি পেলেন। আমি আমার সহকর্মী বিচারকদের সংক্ষিপ্ত আদেশ লিখতে উৎসাহিত করতাম এবং আপীলের জন্য আবেদন মঞ্জুর করার সময় অল্প সময় দিতে বলতাম যাতে করে তারা দ্রুত আদেশে সই করতে পারেন। আমি আগে দেখেছি কিছু আবেদনের আদেশপত্রে তিনি বছরেও সই করা হয়নি, যে সময়ে আপীল আবেদনও নিষ্পত্তি হয়ে যেতে পারত। কাজে কর্মে একটা আমূল পরিবর্তন হয়েছিল যার ফলে উকিল, মক্কেল, বিচারক সবাই খুশি ছিলেন। কিন্তু বেঞ্চ রিডারদের অনেক বেশি মামলা সামলাতে হত তাই তারা বেশ কাজের চাপে থাকতেন।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৯ তারিখে ‘এ গোল্ডেন এইজ’ বইয়ের লেখিকা, নৃতাত্ত্বিক তাহমিনা আনাম নিউইয়র্ক টাইমসের আন্তর্জাতিক ভার্সনে বাংলাদেশে তখন চলমান অবরোধ নিয়ে লিখেছিলেন, “ প্রায় প্রতিদিন পুলিশের সাথে সংঘর্ষ এবং হামলা চলছে, স্কুল-কারখানা বন্ধ, ব্যবসায় মন্দা চলছে, শহরের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়াটাও নিরাপদ নয়। এমন খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে মুসলিম প্রধান দেশে একজন হিন্দু এবং সংখ্যালঘু হিসেবে প্রথম প্রধান বিচারপতি হিসেবে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা’র নিয়োগ একটি ছোট আলোকবর্তিকার মত। ” সে আরো লিখেছিল, “ বিচারপতি সিনহা এরমধ্যে বিচার বিভাগকে আধুনিকায়ন করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। শপথ নেবার পরে প্রথম জনসভায় তিনি ঔপনিবেশিক যুগের আইন সংস্কার করে আদালতের কর্মদক্ষতা বাড়ানোর প্রস্তাব করেন। তিনি বিচারবিভাগকেও নিজেদের কাজ কর্মের পর্যালোচনা করে, কঠোর পরিশ্রম ও গণতান্ত্রিক উপায়ে আরো স্বচ্ছতা আনার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। বিচারপতি সিনহা যদি আরো দশ বছর আগে আসতেন, যখন বিচার ব্যবস্থা আমার পরিবারকে ধ্বংস করতে উঠে পড়েছিল… বিচারপতি সিনহা বিচারকের সংখ্যা দ্বিগুন করার প্রস্তাব করেন এবং আদালতের প্রশাসনিক কাজের আধুনিকায়ন করে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা প্রচলন করার আহবান জানান।” সে আরো বলেছিল, “আইন কোন প্রাচীন কৃৎসামগ্রী নয় যে তাক থেকে নামিয়ে সেটার সৌন্দর্য্য, মূল্য ইত্যাদির প্রশংসা করে আবার তাকে তুলে রাখা হবে। তিনি তাঁর আদলতকে সব ধরণের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা করে তুলতে চান। বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে উদযাপন করার মত তেমন কোন বিষয় নেই। তাই বলে তাঁর নিয়োগ থেকে এটাও বলা যাবে না যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সাথে যে আচরণ করা হয় তার মৌলিক কোন পরিবর্তন হয়েছে। বিচার ব্যবস্থাতেও দমনের সংস্কৃতি চালু আছে যেটা খুবই মারাত্মক। তাই প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব খুব সহজ কাজ নয়, আমাদের আদালতগুলোর সততা এবং রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখা তাঁর দায়িত্বের অন্তর্গত। সেজন্য বিচারপতি সিনহার নিয়োগকে সর্বরোগ নিরাময়ক ভাবা যাবে না। কিন্তু তিনি যদি উদ্বোধনী বক্তব্যে অটল থাকতে পারেন তবে তিনিই হবেন সেই নেতা। ”
আন্তর্জাতিক আরো যেসব গণমাধ্যমে আমার নিয়োগ নিয়ে প্রশংসাসূচক কথা ছাপা হয়েছে তার মধ্যে ‘দ্য ইকনমিক্স টাইমস অফ ইন্ডিয়া’, ‘জেনারেল নলেজ অফ ইন্ডিয়া’, ‘পাকিস্তান ডিফেন্স’, ‘জাগরণ জোস ওফ ইন্ডিয়া’র নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ব্রিটেইনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় অতিরিক্ত বিচারক পদে নিয়োগ থেকে শুরু করে আমার আপীল বিভাগে নিয়োগ, বিচার বিভাগীয় কর্ম-কমিশনের পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন এবং বিদেশে বিভিন্ন সেমিনারে পেপার উপস্থাপনা ইত্যাদি বিস্তারিত ছেপেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আমার নিয়োগকে প্রশংসা করে ১০০০০ এর বেশি মন্তব্য করা হয়েছে, এসব মন্তব্যে বিচার বিভাগে আমার দায়িত্ব পালনের সময় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল।
পূর্ববর্তী প্রধান বিচারপতির সময়কালে আব্দুল ওয়াহাব মিয়া এবং এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর মধ্যে ঝগড়া-ঝাটির কারণে গুরুতর মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয় যে তাঁরা একে অপরের সাথে কথা বলতেন না। বিচারক আব্দুল ওয়াহাব মিয়া মনে করতেন শামসুদ্দিন চৌধুরী তাঁকে পর্যাপ্ত সম্মান প্রদর্শন করছিলেন না এবং তার কথার মাঝে শামসুদ্দিন চৌধুরী হস্তক্ষেপ করেন। একজন ভাল বিচারক হবার জন্য তাঁর কোন সৌজন্যবোধ নেই, তাঁর মধ্যে ভাল আচার-ব্যবহারের অভাব আছে। শামসুদ্দিন চৌধুরীর মতামত সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি আব্দুল ওয়াহাব মিয়াকে হেয় করতেন। উচ্চ আদালতের কোন বিচারক যখন অবসরে যাবেন তখন তাঁর সম্মানে অন্য বিচারকেরা মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করার একটা রেওয়াজ ছিল। সে রীতি অনুসারে মোজাম্মেল হোসেনের শেষ কর্মদিবসে তার সম্মানে বিদায়ী ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। মোজাম্মেল হোসেন এবং শামসুদ্দিন চৌধুরী দু’জনে ব্যারিষ্টার হওয়ায় তাদের মধ্যে খুব খাতির ছিল। আমি প্রধান বিচারপতিকে শামসুদ্দিন চৌধুরী এবং আব্দুল ওয়াহাব মিয়ার মধ্যেকার ঝামেলা মিটিয়ে তাদের মধ্যে মিটমাট করে দিতে বললাম, কারণ তাদের মধ্যে ঝামেলা থাকলে কাজ করার একটা সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখা কষ্টকর হবে। তিনি কথা বলে তাদের মধ্যে মিল-মিশ করে দিলেন।
একদিন সকালে আব্দুল ওয়াহাব মিয়া খুব খারাপ মুডে আমার কাছে এসে বললেন বিচার বিভাগের অভিভাবক হিসেবে আমাকে বিচারকদের মান-মর্যাদার বিষয়টা দেখা উচিত। আমি তাঁকে বললাম, প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচার বিভাগের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে যেকোন কিছু করতে আমি দ্বিধা করব না, তাঁর কি হয়েছে সেটা বলার জন্য বললাম। তিনি আমাকে রূঢ়ভাবে বললেন যে, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আগামীকাল আইনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার জন্য আইনগত ব্যবস্থা নিবেন সেজন্য আমার অনুমতি নিতে এসেছেন। আমি তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, ঠিক কী হয়েছে, কেন তিনি আইনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এমনভাবে ক্ষেপে আছেন? আইনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তাঁর রাগের কারণ শুনে আমি খুবই বিব্রত বোধ করলাম। আসল ঘটনা ছিল আইনমন্ত্রী এর আগেরদিন কোন এক সভায় মন্তব্য করেছিলেন যে বিচারকেরা রায় প্রস্তুত ও সই করতে অনেক সময় নিচ্ছেন যার ফলে মক্কেলরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আব্দুল ওয়াহাব মিয়া আইনমন্ত্রীর কথাকে ব্যক্তিগতভাবে নিলেন, কারণ তিনি সব সময় রায় দিতে দেরী করতেন। আমি তাঁকে বললাম, তিনি যেহেতু সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ বিচারক তাই তাঁর পক্ষে এমন কিছু করা ঠিক হবে না। কারণ আইনমন্ত্রী কারো নাম উল্লেখ না করে একটি সাধারণ মন্তব্য করেছেন, এখন তিনি যদি তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনেন তাহলে এটা প্রমাণিত হবে যে তিনিই রায় দিতে দেরী করেন, যেটা আসলে সত্য ছিল; দ্বিতীয়ত, আমি বললাম, বয়োজ্যেষ্ঠ বিচারক হয়ে তিনি যদি এমনটা করেন তাহলে জুনিয়র বিচারকেরা তাঁর কাছ থেকে কী শিখবে?
আমি তাঁকে বলেছি সামান্য কারণে হাইকোর্টের বিচারকদের আদালত অবমাননার অভিযোগ আনার ব্যাপারে আমি বিব্রত বোধ করতাম এবং শামসুদ্দিন চৌধুরীর উদাহরণ দিলাম। আব্দুল ওয়াহাব মিয়া আমার মনোভাব বুঝতে পেরে বিদায় নিলেন। এটা স্মরণ করা যেতে পারে একজন বা দুজন বিচারক বাদে বেশির ভাগ বিচারক রায় লিখতে দেরী করতেন। আব্দুল ওয়াহাব মিয়া যখন আপীল বিভাগে উন্নীত হয়েছিলেন তখন আমার নজরে এসেছিল তাঁর কাছে তিন বছরের পুরনো রায় লেখা বাকী ছিল। শামসুদ্দিন চৌধুরীও যখন আপীল বিভাগে আসেন তখন তাঁর ৩০০ এর বেশী রায় বাকি ছিল। কিছু বিচারক ছিলেন তাঁদের অবসরের সময় তাদের কাছে দু’তিন বছরের পুরনো রায় সই না করা অবস্থায় পাওয়া যেত।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন যদিও আব্দুল ওয়াহাব মিয়াকে আপীল বিভাগে উন্নীত করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন, তিনি সম্পূর্ণভাবে তাঁর উপর নির্ভর করতে পারতেন না। একটা ঘটনায় আমি তাঁর এ মনোভাব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছিলাম। প্রধান বিচারপতি হবার পরে মোজাম্মেল হোসেন বিদেশ ভ্রমণে যাওয়া শুরু করেন। যখনই কোন নিমন্ত্রণ আসত, সেটা প্রধান বিচারপতির জন্য শোভন কীনা তা নিয়ে তাঁর কোন চিন্তা ছিল না। ইউএনডিপি’র অর্থায়নে তিনি অন্যান্য বিচারকদের সাথে আমেরিকা ও কানাডার মামলা পরিচালনা ও এ সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়াদি দেখতে গিয়েছিলেন। প্রত্যেক ছুটিতে বা লম্বা কোন ছুটিতে মোজাম্মেল হোসেন বিদেশে এক বা একাধিক ভ্রমণে যেতেন। এক সময় আদালতের ছুটির পূর্বে আমি বিচার বিভাগীয় কর্ম-কমিশনের পরিচালক হিসেবে বিদেশ ভ্রমণের একটা পরিকল্পনা করি। আমার কাঙ্খিত ভ্রমণের কিছুদিন পূর্বে আমি প্রধান বিচারপতির কাছে দেশ ছাড়ার অনুমতি চেয়ে দরখাস্ত দিলাম। প্রধান বিচারপতি আমাকে বললেন, তিনিও সে সময় একটা সেমিনারে যোগ দিতে সিঙ্গাপুরে যাবেন। তিনি বিদেশ থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমার ভ্রমণ পিছিয়ে দিতে বললেন। আমি তাঁকে বললাম, আমার ভ্রমণসূচী প্রায় ছয় মাস আগে চুড়ান্ত করা হয়েছে এবং আমি টিকেটও কিনে ফেলেছি, যার ফলে আমার ভ্রমণসূচী পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। প্রধান বিচারপতি রেজিস্ট্রার এবং অন্যান্য বিচারকদের সাথে যাচ্ছিলেন। পরে আমি জানতে পারলাম তিনি তাঁর সহযাত্রীদের নামের তালিকা পরিবর্তন করে আব্দুল ওয়াহাব মিয়াকে যোগ করেছিলেন। তাঁরা ফেরৎ আসলে আমি আব্দুল ওয়াহাব মিয়ার কাছে জানতে চাইলাম, তিনি কী সভায় কোন পেপার দিয়েছেন? তিনি আমাকে বললেন, যাওয়ার মাত্র দু’দিন আগে তাঁকে তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়। কোন ধরণের আলোচনায় অংশ না নিয়ে তিনি স্রেফ সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করে এসেছেন। নাজমুন আরা সুলতানাকে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দিয়ে মোজাম্মেল হোসেন তাঁকে ভ্রমণে সাথে করে নিয়ে গেছেন কারণ তিনি আব্দুল ওয়াহাব মিয়াকে দায়িত্ব দিয়ে নিরাপদ বোধ করতেন না। বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের ভ্রমণগুলো তদন্ত করা হলে এটা পরিষ্কার হবে। আমরা যদি আমাদের সহকর্মী বিচারকদের প্রতি সম্মান এবং বিশ্বাস না রাখতে পারি তাহলে সেটা বিচার বিভাগের জন্য অস্বাস্থ্যকর, এবং আমি কিছু বিচারককে দেখেছি তারা দ্বৈত নীতি অনুসরণ করতেন, তারা অন্যকে পছন্দ করে না কিন্তু সামনা সামনি আন্তরিকতার ভান করে।
রেফারেন্সঃ
১। সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদ
অধ্যায় ১১
জমে যাওয়া মামলার জট
উচ্চ ও নিম্ন বিচারালয়ে প্রচুর মামলা জমা হয়ে আছে। নিম্ন আদালতে প্রায় তিরিশ লক্ষ এবং হাইকোর্ট বিভাগে প্রায় তিন লক্ষ মামলা ঝুলে আছে। আপিল বিভাগে কাজের প্রচণ্ড চাপ থাকা সত্ত্বেও আমি মামলার সংখ্যা বাড়তে দিইনি। তারপরও সেখানে পনের হাজার মামলা ঝুলে আছে। এই বিশাল পরিমাণ মামলা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম এবং আমি বুঝতে পারছিলাম যে প্রচলিত সেকেলে ধরণের আইন দিয়ে ক্রমবর্ধমান মামলা জট সমস্যার সমাধান করা যাবে না। মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় অগ্রগতি সাধিত হবার পরও মামলা জট বৃদ্ধি পাবার কতগুলো কারণ আমি চিহ্নিত করেছিলাম। কিছু জরুরী ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণেরও দরকার ছিল।
আমি বিশ্বাস করতাম যে এখন সময় এসেছে বিচার প্রশাসন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ব্যবসা বাণিজ্য ব্যবস্থাপনার কৌশলসমূহ প্রয়োগ করার এবং বিচার প্রশাসন সংস্কারের জন্য অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্রের পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটানোর। সকলেই স্বীকার করে যে বিচার বিভাগ হল গণতন্ত্রের একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। বিশ্বায়নের এই যুগে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে দ্রুত বিচারিক সেবা প্রদান করা অপরিহার্য। যে সমস্ত দেশ বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ সস্তা শ্রমের জন্য একটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। বিচার বিভাগকে যদি উন্নততর অবস্থায় নিয়ে না যাওয়া যায় তাহলে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করা কষ্টসাধ্য হবে। এটা অনস্বীকার্য যে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের বিচার বিভাগের অবকাঠামো নিতান্তই দুর্বল। এটার জরুরী ভিত্তিতে উন্নয়ন ঘটানো দরকার। আমাদের বিচার বিভাগের জন্য বরাদ্দ খুব সামান্য। এই অন্যায্য অবস্থা যদি অচিহ্নিত থেকে যায় তাহলে অপরাধ সংঘটিত হতেই থাকবে, এবং জনগণের মনে নির্বাহী বিভাগ সম্পর্কে অসহায়ত্ব, আতঙ্ক এবং ক্ষোভ তৈরী হবে। এমন নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতি সমাজের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত উপাদানের সৃষ্টি করে এবং পেশী ও অর্থ শক্তি দ্বারা সমস্যার সমাধানের চেষ্টা হয়। সমাজের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সমগ্র বিচার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করাটাই এখন সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ। সেই জন্য বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক উন্নতিকল্পে যা কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন দরকার যেমন, বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করা, সমৃদ্ধ পাঠাগার, উন্নত তথ্য প্রযুক্তি অবকাঠামো এবং বিচারক, আইনজীবী এবং মোকদ্দমাকারীদের কার্যে সুবিধা হয় এমন সকল কিছুর অবিলম্বে ব্যবস্থা করা দরকার।
সেই উদ্দেশ্য সামনে রেখেই আমি নিয়োগ পাবার অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করি।আমি হিসেব করে দেখি যে বেশকিছু আদালত কক্ষের স্বল্পতা রয়েছে যেগুলো তাড়াতাড়ি নির্মাণ করতে হবে। সেই সাথে ধাপে ধাপে বিচার ব্যবস্থাকে ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় আনারও পরিকল্পনা করি। বিচার বিভাগের স্বার্থে আমি এসব পরিকল্পনা প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করি এবং উল্লেখ করি যে দেশের সামগ্রিক উন্নতির সাথে বিচার বিভাগের উন্নতির এই বিষয়গুলো জড়িত। তার কিছুদিন পরে আমি বেদনার সাথে লক্ষ্য করলাম যে প্রধানমন্ত্রী আমার সেসব পরিকল্পনা আইন মন্ত্রনালয়ে পাঠিয়েছেন এবং তারা সেটা ধূলিসাৎ করেছে। জমে থাকা কাজগুলো সম্পাদন করাটাকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং এই ভয়াবহ অবস্থার উন্নতির জন্যে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রথম পদক্ষেপ হবে আদালত কক্ষ এবং বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো। বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো খুব সহজ কাজ নয়। কারণ কেউ দুই বা তিন বছরের মধ্যে দক্ষ বিচারক হয়ে ওঠে না। পরিপক্ক বিচারক হবার জন্য অভিজ্ঞতা এবং প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। সেহেতু প্রাথমিক পদক্ষেপ হবে বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা এবং শূন্যস্থান পূরণের জন্য অস্থায়ী সমাধান হিসেবে জেলা জজদের অবসরের বয়স বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। পাঁচশো বিচারক নিয়োগ দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ শেষে বিচারকার্যে বসাতে হবে।একজন বিচারকের পরিপক্ক হবার পূর্বশর্ত হচ্ছে অভিজ্ঞতা।
পেশাগতভাবে দক্ষ বিচারকের ঘাটতির কয়েকটা কারণ রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে বিরাট জনসংখ্যার দেশে প্রচুর সংখ্যক মামলা। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সম্ভবত সবচেয়ে কম সংখ্যক বিচারক রয়েছেন। এমনকি আমরা ভুটান ও নেপালের মতো ছোট দুটো দেশের তুলনায়ও পিছিয়ে আছি। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে দেশে প্রচলিত সেকেলে আইন। ঔপনিবেশিক শাসকেরা কার্যকরভাবে দেশ শাসন ও রাজস্ব সংগ্রহের জন্যই মূলত বেশিরভাগ আইন প্রণয়ন করেছিল। সেই উদ্দেশ্যেই তারা মূল আইনগুলো যথা দেওয়ানী কার্যবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি, দণ্ডবিধি, স্বাক্ষ্য আইন, সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, তামাদি আইন, অধিগ্রহণ আইন প্রণয়ন করেছিল। একটা সম্পূর্ণ সার্বভৌম দেশে রূপান্তরিত হবার পরও ওই আইনগুলো এখনো বহাল রয়েছে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যেসব নীতি, উদ্দেশ্য এবং প্রেরণা থেকে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিল, এই সমস্ত আইনের অধিকাংশই সেসবের সাথে সাংঘর্ষিক। তাছাড়া এগুলো আমাদের সংবিধানের মূল আদর্শের সাথেও যায়না। আমরা দাবী করতে পারিনা যে আমরা ১৯৪৭ সালেই স্বাধীন হয়েছি কারণ সেই সময়ে আমরা ভীনদেশী শাসকের অধীনস্থ ছিলাম। আমরা আসলে ১৯৭১ সালের আগে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বাধীনতার স্বাদ পাইনি। আমরা চিন্তার স্বাধীনতা, প্রকাশের স্বাধীনতা, কর্মসংস্থানের স্বাধীনতা এবং ভাষার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত ছিলাম। চলমান মামলাগুলো বিরাজমান আইনে এবং জনবল, অবকাঠামো এবং প্রাসঙ্গিক সুবিধার সল্পতার কারণে শুনানি এবং নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। ঔপনিবেশিক আইনগুলো অবশ্যই বাতিল করতে হবে। দণ্ডবিধির কিছু আইন প্রণীত হয়েছিল শুধু “বিদ্রোহীদের ” নিয়ন্ত্রণ এবং শাস্তি দেবার জন্য। এসকল আইন আমাদের সংবিধানে বর্নিত মৌলিক অধিকারের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। ফৌজদারি বিচার পদ্ধতি একেবারেই সেকেলে এবং আঠারো ও একুশ অধ্যায় বাতিল করার পরে এই পদ্ধতিটি কার্যকারিতা হারিয়েছে। সিআরপিসিতে যে সংশোধনী আনা হয়েছে তা সিআরপিসির অন্য ধারার সাথে সাংঘর্ষিক। বর্তমান আইনে একজন অপরাধী যদি খুন বা ধর্ষণের পরে খুন, বা ডাকাতি ও খুনের মতো জঘন্য কাজও করে তবুও তাকে পনের দিনের বেশী জেলহাজতে রাখা যায়না। আমি একটা মামলায় পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলাম এবং এ্যটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রীকে সতর্ক করেছিলাম আইনে সংশোধনী আনার জন্য, কিন্তু কোন ফল হয়নি।যদি ওই পনের দিনের মধ্যে তদন্ত সম্পূর্ণ না হয় তাহলে অপরাধীকে জামিনে মুক্তি দিতে হয়। সিআরপিসির ৩৪৪ ধারা দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা যায়না কারণ এটা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ১৮ তম অধ্যায়ের জন্য। আইনের ২০ ধারায় বাদী এবং পুলিশ বাদী মামলার বিষয়ে জগাখিচুরী ধারা রয়েছে।একইভাবে দেওয়ানী কার্যবিধিও সংশোধনীর পরে কর্মক্ষমতা হারিয়েছে।এর ২১ ধারার ক্ষেত্রে যথাযথ পরিবর্তন আনা দরকার। ভারত যদিও ১৯০৮ সালের দেওয়ানী কার্যবিধি রেখে দিয়েছে, তবুও তারা এতে এমনভাবে সংশোধনী এনেছে যেন একটি অপরটির সাথে সাংঘর্ষিক না হয়।আমরা যথপোযুক্ত সংশোধনী আনতে পারিনি যার ফল হচ্ছে কাজ বাড়ছে।
আইনের কিছু ধারা আছে যেগুলো লোন রিকভারি এ্যক্টের দ্বারা বকেয়া ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কিন্তু এখানেও প্রচুর অসঙ্গতি আছে।আমি নিরপরাধ ব্যক্তির সম্পত্তির অধিকার রক্ষার জন্য একটা রায়ের মধ্যে এই অসঙ্গতি দূর করার চেষ্টা করেছিলাম যেখানে এক ব্যক্তির সম্পত্তিকে অবৈধভাবে ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি আমার রায়ের মধ্যে সে অসঙ্গতি দূর করতে পারিনি। প্রত্যেক আইনি প্রক্রিয়ায় এরকম অনেক অসঙ্গতি রয়েছে যেগুলো বাতিল করে অভিজ্ঞ আইনজীবী, অধ্যাপক, সাধারণ মানুষ এবং বিচারকদের মধ্য থেকে লোক নিয়ে গঠিত শক্তিশালী আইন কমিশনের মাধ্যমে নতুন আইন প্রণীত হওয়া দরকার।
ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে বের হয়ে এসে মূল আইনগুলো অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের এবং সংবিধানের চেতনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ আইন প্রণয়ন করতে হবে। বর্তমান যে অবকাঠামো তা দিয়ে মামলার চাপ সামলানো যাবে না। জনবল তিনগুণ বৃদ্ধি করতে হবে।প্রত্যেক জেলায় যথেষ্ট বিচার প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান থাকতে হবে এবং সকল পর্যায়ের বিচারকদের প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকাতে কেন্দ্রীয় বিচার একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা দরকার। সেখান মামলা ও আদালত ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এমন একটা আইন থাকতে হবে যাতে করে মামলায় জড়িত পক্ষরা সালিসের মাধ্যমে সমাধানে আসতে বাধ্য হয় এবং যদি কোন পক্ষ সালিসের রায় মানতে অস্বীকৃতি জানায় এবং মামলা দায়ের করে হেরে যায় তাহলে সেই পক্ষের ঘাড়ে মামলার যাবতীয় ব্যয়, আইনজীবীর ফিস, প্রতিপক্ষের হয়রানির দায় বর্তাবে। ফৌজদারি আইনের বিচারের বেলাতেও, কিছু জঘন্য অপরাধ ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই ধরণের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এটা মূলত একটা বিচার-পূর্ব সমঝোতা যেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি বাদী পক্ষ হতে কিছুটা ছাড় পাওয়ার বিনিময়ে বাদী পক্ষের সামনে অপরাধের দায় স্বীকার করে। সওয়াল জবাবের এরকম তিন ধরনের ব্যবস্থা আছে: অভিযুক্ত আসামীর ক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তি কম দোষ স্বীকার করে, রায়ের ক্ষেত্রে আসামী কম সাজা পেতে দোষ স্বীকার করে। সত্য বলতে কি এসব দর কষাকষিতে একটা চুক্তির ভিত্তিতে কিছু নতুন তথ্য যোগ করা হয়, বিনিময়ে অন্য কিছু তথ্য প্রমাণ হিসেবে যোগ করা হয় না। এ পদ্ধতি একট বড় সংখ্যক ফৌজদারী মামলায় বিকল্প হিসেবে কাজ করে।
চলবে…
==================================
নবযুগ সম্পাদকের নোট: তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে দীর্ঘ সামরিক শাসনের ইতিহাস মাথায় রেখে যারা বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করে তারা আসলে কেউই মনে রাখেননা, দিনশেষে তারা সামরিক শাসক নন, জনগণের নির্বাচিত সরকার। পর্দার আড়ালে ঘটে যাওয়া ঘটনা সামনে আসবার নজির খুব কম বলেই, আমরা সম্পূর্ণটা কখনো জানতে পাই না। তাই রূপকথার মতো মনে হয় আমাদের বাস্তবতাগুলো, সেই জাদুবাস্তবতার বাংলাদেশের জন্য সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা’র আত্মজীবনীমূলক বই ‘একটি স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী: আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র’ একটি মোক্ষম চপেটাঘাত, আমাদের ঘুমন্ত নাগরিকদের জেগে ওঠার আহ্বান।
বইটি দ্রুত বাংলা ভাষান্তরের জন্য ড. নাজিম উদ্দিন-এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী গবেষক ও লেখক আদিত্য রাহুলকে। আশাকরি অনেকেই বইটি পাঠ করে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে একটা ধারণা পাবেন। এই পর্ব, অর্থাৎ ১০ম অধ্যায়-এর ‘বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ‘ (Appointment of Chief Justice ) ১১তম অধ্যায় অর্থাৎ ‘জমে যাওয়া মামলার জট ‘ (Backlog) অংশটি অনুবাদ করেছেন ড. নাজিম উদ্দিন ।
এই বইটি বাংলা ভাষান্তর করতে গিয়ে লেখকের শৈশব ও যুবক বয়সের কিছু গ্রাম ও মানুষের নাম ইংরেজিতে যেভাবে লেখা হয়েছে তার বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ করতে কিছুটা সংশয় হওয়ায় ও সময়াভাবে কিছু বানানে ত্রুটি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে; আগ্রহী পাঠক ও জ্ঞাত ব্যক্তিদের এই বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে অনুরোধ করা যাচ্ছে। সকলকে শুভেচ্ছা।