৭৫৫ বার পঠিত
Any body can do it, please do it…
ইউরোপ কিংবা উন্নত বিশ্বের প্রায় সকলেই কমবেশী ছবি আঁকতে পারে। সেটা ব্রিটিশ অথবা মার্কিনী ইংরেজী বলতে পড়তে পারা শিক্ষিত দেশ জাতি হোক আর র্জামান জাপানের মত ইংরেজী বলতে পড়তে না পারা অশিক্ষিত দেশ জাতী হোক। আপাতত কারনটি কিছুই নয় সেখানকার স্কুলের পাঠ্য ক্রম। না সকলে অংকন দক্ষতায় দূর্দান্ত কিছু নয় তবে, নিজের নোট বা ডাইরীকে অলংকৃত করবার মত সক্ষমতা প্রায় সকলেরই আছে।
ভাষা আবিস্কারের আগে, মানুষ ও অন্যান্য প্রানী কুলের পার্থক্য গড়ে দেয় যে অস্ত্র (ভাস্কর্য্য), তার নির্মানের আগে বালিতে বা গুহার দেয়ালে আঙ্গুল কাঠি ও রঙএর আঁক দিয়ে জীব ও জগতকে বয়ান করলো যে প্রানীটি তার নাম মানুষ। ছবি এঁকে ছবি আকঁতে পেরে জগতের অযুত প্রানীকুলের মধ্যে মানবাকৃতির প্রানীটি মানুষ হয়ে উঠলো বা মানুষ হওয়ার পাথে যাত্রারম্ভ করলো।
আদি আঁকিয়ের দেহাবসানের লক্ষ কিংবা কোটি বর্ষ পরে, জত্তো-ভিঞ্চী থেকে রেমব্রান্ট হয়ে দেলাক্রয়ার অংকন দক্ষতা পেরিয়ে আলোকচিত্রের আবিস্কারের মধ্য দিয়ে ইউরোপ আবিস্কার করলো সূর্য্য দেবতা রবি বা বরুনকে আর তার সাত রঙের সাত ঘোড়াকে। নিউটন হলেন ব্রিটিশ রয়্যাল একাডেমী অব সায়েন্সের সভাপতি। ব্রিটিশ টার্নার- জাপানি হকুসাই পথ দেখালেন ফরাসীদের, ফরাসী রয়্যাল একাডেমী অব আর্টসের প্রবেশপথের ধারে যে তরুণেরা তাদের আঁকা ছবির মহাত্য বর্ননায় বলেছিল ‘ল্যুভ পুড়িয়ে দাও, ওখানে জমছে কারুকর্মের স্তুপ’; তাদের বলা হল প্রতিচ্ছায়াবাদী (Impressionist)। ভ্যানগগ তাদের নিকট উত্তরসূরী, সেজান, সূরা, পলগগা সে পথেই ছবিতে আনতে চাইলেন চর্মচক্ষে দেখবার অতিরেক কিছু…
যাহাদের চিত্রকর্মে পশ্চিমী বিমূর্ততার যাত্রা শুরু সেই হুইসলার-এর বেড়ে ওঠা রুশ আবহাওয়ায়, কুপকা পূর্ব ইউরোপের (চেক) রবার্ট ডেলনয় ও মাতিস হলেন ফরাসী। সোভিয়েৎ বিপ্লবের ম্যালভিচ, ক্যান্দিনেস্কি চিন্তার দেখাকে চোখের দেখায় পরিণত করতে চাইলেন তাদের সংগে ছিলেন নোয়াম গ্যাবো ও অন্যান্য রুশ অথবা সোভিয়েৎ আভাগার্দরা (১৮৯০-১৯৩০), জন্ম হল ইউরোপীয় বিমূর্ত শিল্পের, যাহাকে আমাদের বাম বুদ্ধিজীবিরা পুঁজিবাদের শিল্পকলা বলেন।
২
ইউরোপ কিংবা ভারত বাংলাদেশ সর্বত্রই বিমূর্ত শিল্পকলা লইয়া ব্যঙ্গ বিদ্রুপের কমতি নাই। চিন্তাশীলতাকে বিদ্রুপ বা পাথর ছুড়িয়া মারিবার ঘটনা আমরা সকলেই জানি… মিশরে মুসা তাড়া খাইয়াছেন, গ্রীসে সক্রেটিস বিষপানে মরিয়াছেন, ভারতে বৌদ্ধ রাজপুত্র বলিয়া বাঁচিয়াছেন, যীশুর ক্রশ বহন চিন্তাশীলতার পরিণতি, আরবের মুহম্মদের গল্প বাংলার ঘরে ঘরে জানা… আলবেরুনী, গ্যালীলিওর গল্পও আমরা যৎকিঞ্চিত জানি। তবে চিন্তাশীলতার ভান বা ‘লালসালু’র মজিদের সংখ্যা প্রকৃত চিন্তাশীলের শতগুন। আর মজিদের কর্মকান্ড চিন্তাহীনদের উৎসাহীত করে চিন্তাশীলদের প্রতি বিদ্রুপের পাথর ছুড়িতে আর তাহা ঘটে মজিদের রাখালীতে।
৩
যে দেশের মানুষ ছবি আঁকা ফটো তোলা পাপ কিনা এ ভাবনা ভাবিতে ভাবিতে বিলেত-আমেরিকার স্বর্গের হুরপরীদের দেখিবার লোভে পাসপোর্টের ফটো তুলিতে ক্যামেরার সামনে দাড়ায়। যে দেশে ‘ছবি এঁকে কি হবে’ বলিয়া বামনেত্রী আর্ট কলেজে ভর্তি ইচ্ছুক কিশোরকে নিরস্ত্র করবার সাধনা করে। সে দেশে শিল্পচর্চায় আগ্রহীকে এ বাক্য প্রায়সই শুনতে হবে ‘আরে, এটা আমিও পারি’ এটাই স্বাভাবিক, বক্তা অংকন দক্ষতার গর্বে গর্বিতও হতে পারেন; অথবা চিত্র-মূর্খও হতে পারেন…
৪
তবুও এ দেশে বিমূর্ত চিত্রের চর্চা হয়, হচ্ছে, হবে। কিছুটা শিল্পের প্রয়োজনে, বাকিটা লালসালুর মজিদের চর্চা। কারন বাজার, আমাদের দেশীও ক্রেতারা চিন্তাহীনতার আরব পূণ্য ভূমিতে বাস করেন। তাই তারা স্রষ্টার অপরূপ সৃষ্টি মানব/মানবীর দেহ সৌন্দর্যকে পেন্টহাউস/প্লেবয় ম্যাগাজিনের পাতায় দেখতে পছন্দ করেন। কেউ কেউ দেখবার আনন্দে দেহ সৌন্দর্যকে ইউরোপীয় জাদুঘরের দেয়ালে রেখে দেখে নেন। হালে অবশ্য পাঁচতারা হোটেলের ফ্যাশন ক্যাট ওয়াকেও দেখবার কিছু আশা মেটে। আর অন্ত্র্জালের দুনিয়া স্মার্ট ফোনের স্ক্রীনেও আজকাল ভাসমান। কিন্তু শিল্প বা ‘দেখবার ও দেখাবার আনন্দ’ বা আত্মভাবনা?
৫
আমাদের আত্মভাবনায় ফারসী শিখেছিলাম মুঘল হবো বলে। ইংরেজরা শিক্ষিত তাই ইংরেজীতে কথা বলে; আমরাও হলাম শিক্ষীত। উর্দু বলিতাম কারন আমরা মুঘল বাদশার ‘সেপাহী’ ছিলাম আর পাকিস্তানেরও সেপাই…
আপনি বিমূর্ত চিত্রের চর্চা করবেন বাজার ধরবার জন্য, আমাদেরও বাজার ধরার প্রসঙ্গ… যদিও চীন, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রাজিল ও অন্যান্য অশিক্ষিত দেশে ইন্টারপ্রেটর লাগে…
৭
যাহা বোঝা যায় না তাহাই বিমূর্ত। মূর্ত শব্দের অর্থ তাহলে বোঝাবুঝি। কিনেছি যখন তখন কি আর না বুঝি, রঙটা দেখেন কি দারুন লাল… আর এটা দেয়ালের টেক্সচার… বাথরুমের দেয়ালের, ড্যাম্প থেকে যে টেক্সচার… হায় ক্যান্দিনেস্কি, বেচারা তাপিস।
৮
আমি ছবি আঁকি, প্রদর্শনী করতে চাই, গুরুজনেরা বলেন ‘কি এমন এঁেকছো যে প্রদর্শনী করতে চাও?’ জর্মান কালচার সেন্টার, জাতীয় জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমী, চারুকলার ইদুঁরের বাসা ভেঙ্গে জয়নুল গ্যালারী বানাই; প্রদর্শনী করি। গুরুজনেরা বলেন, ‘অন্য রকম ছবি, নতুন ধরনের ছবি, কিন্তু…’। আমার আঁকা দেখা যায় লিটলম্যাগ আর পত্রিকার পাতায়। কবি মৌলানা ‘নারী ও স্তন’ লিখেন, আমি আঁকি, কবি সম্পাদকের কাছে অভিযোগ করেন, শিল্পী বোরকা আঁকতে পারে না। উপন্যাসিক ৭৪’এর বাসন্তীর জাল বস্ত্রের গল্প লেখেন, আমি আঁকি, উপন্যাসিক অভিযোগ করেন, শিল্পী বোরকা আঁকতে পারে না।
চরুকলার ক্লাস কিংবা চাকুরির সাথে বিমূর্ত ছবি আঁকি আর ফাইলে লুকিয়ে রাখী। এ আমার একান্ত ভুবন। জল কালি কাগজের সাথে আমার কথোপকথন। ১৯৮৭ থেকে এ আমার আনন্দ আশ্রম…
৯
১৯৯৬-৯৮ থেকে দূরে সরতে সরতে বহু দূরে…
নাজিব কি ছবি আঁকে? না ও তো ব্রান্ড মার্কেটিং নিয়ে আছে…
নাজিব তুমি লেখালিখিটা অন্তত চালাতে পারতে…
তুমি ছবি আঁকো?…
সময় পাও?
কেউ না জানে ১৯৮৭ থেকে এ আমার আনন্দ আশ্রম…
১০
ঢাকা চারুকলায় ভর্তি হয়েছিলাম কেন? কেন দূরে সরে যাওয়া?
থাক সে সব প্রশ্ন, ২০০৯-এ আমিনুল ইসলাম বললেন ন্যু-ইয়র্ক থেকে ফিরে ‘আমার সহপাঠি বতেরোকে চেন, আলাপ হয়েছিল কখনো…’
ভুলেতো ছিলাম সব… শুরু হল আবার সরে যাবার খেলা… তবে কি এবার ঘরে ফিরবার পালা…
১১
পল ক্লে সাত/আট শো বছরের পরিপ্রেক্ষিত আর ছায়াতপের ইউরোপীয় দক্ষতাকে এড়িয়ে শিশুর আঁকবার আনন্দকে উপভোগ করতে চেয়েছিলেন। আমিও পুনরায় ‘দেখবার ও দেখাবার আনন্দ’কে ফিরে পেতে চাই… তাই ইউরোপীয় ‘প্রত্যক্ষনের অনুকরনই শিল্প’ বোধেই পুর্নযাত্রা…
১২
জানি, এই সব যে কেউ আঁকতে পারে। অংকন দক্ষতার গর্বে গর্বিত আকিঁয়ে; অথবা চিত্র মূর্খ আঁকিয়ে। যে কেউ এভাবে আকঁতে পারে, এটা আঁকতে পারে। আমার তিন বছুরে ছেলে বিপুল উচ্ছাসে কালি তুলিতে আঁকতো; কাগজে, মেঝেতে, বিছানার চাদরে ও দেয়ালে। আমি তার মত আঁকতে চাইছি, হচ্ছে কি? না, হয় না শিশুর সারল্য জলকালীতে যে নির্মান করে তাহার পূর্ননির্মান…
আমি জানি Any body can do it, please do it…
৩ জুলাই ২০১৪
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন