০
১৩৭২ বার পঠিত
কম টেস্ট করে কম রোগি দেখানোর একটা বড় বিপদ হচ্ছে- এতে করে মৃত্যুহার বেড়ে যায়, যা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও চিকিৎসার নিম্নমান প্রকাশ করে। গতকাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্ত ৪ লক্ষ ২২ হাজার ৫৮২ জনের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ১৮ হাজার ৮৯১ জন। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী মৃত্যুহার হচ্ছে- ৪.৪৭%। করোনা ভাইরাসে চীনে মৃত্যুহার ৪.০৩%, ইতালীতে ৯.৮৬%, যুক্তরাষ্ট্রে ১.৪২%, স্পেনে ৭.১১%, জার্মানিতে ০.৪৮%, ইরানে ৭.৭৯%, ফ্রান্সে ৪.৯৩%, সুইটজারল্যান্ডে ১.২৪%, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১.৩৩%, যুক্তরাজ্যে ৫.২২%, অষ্ট্রিয়ায় ০.৫৩% এবং মালয়েশিয়ায় ০.৯৯%।
বাংলাদেশে এই মৃত্যুহার কত? মোট আক্রান্ত ৩৯ জনের মধ্যে ৫ জন, অর্থাৎ- ১২.৮২%। ১০ এর বেশি রোগি সনাক্ত হয়েছে এমন দেশগুলোকে আমলে নিলে পৃথিবীতে বাংলাদেশেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগিদের মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। অবশ্য গাম্বিয়া, সুদান, জিম্বাবুয়ের মত দেশ, যারা এখনো ৩ এর নামতা পড়া শুরুর পর্যায়ে আছে, মানে ৩ জন আক্রান্ত রোগির মধ্যে ১ জনের মৃত্যু দেখিয়েছে, তাদের চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো, এই বিবেচনায় গর্বিত ও হতে পারেন।
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় পৃথিবীতে মোট চারটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে; যার মধ্যে তিনটি পদ্ধতি স্বীকৃত ও অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছে। জনপ্রিয় তিনটি পদ্ধতি হচ্ছে চাইনিজ মেথড, কোরিয়ান মেথড, এবং মিক্সড মেথড।
চীনে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর তারা এটি মোকাবেলা করেছে পুরো উহান শহর লকডাউন করে দিয়ে। প্রথমে তারা শহর লকডাউন করেছে তারপর তারা যাদের মধ্যে এই রোগের উপসর্গ দেখা গিয়েছে তাদেরকে ব্যাপকভাবে টেস্ট করেছে এবং হাসপাতলে এনে চিকিৎসা দিয়েছে। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ করার জন্য তারা রাতারাতি অনেকগুলো অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করে ফেলেছিল। এই পদ্ধতিতে সেনাবাহিনী নামিয়ে পুরো এলাকা অবরুদ্ধ করায় জনগণের কষ্ট হয়েছে, কিন্তু জীবন বাঁচানোর স্বার্থে তারা এই কষ্ট মেনে নিয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার পদ্ধতিটি ছিল একটু ভিন্ন ধরনের। তারা ব্যাপকভাবে টেস্টিং এবং ক্লাস্টার আইডেন্টিফাই করার টেকনিক অবলম্বন করেছে। তারা চেষ্টা করেছে, যত বেশি সংখ্যক ভাইরাস বহনকারী মানুষকে খুঁজে বের করে তাদের আইসোলেট করতে। এজন্য তারা চীনের মতো লকডাউন করেনি। একজন রোগী করোনাভাইরাস টেস্টে পজিটিভ হওয়ার পর তারা তার কাছ থেকে তথ্য নিয়েছে: সে কার কার সাথে মিশেছে, কোন কোন এলাকায় গিয়েছে এবং কোথা থেকে তার এই সংক্রমণ হয়েছে। তারপর সেই তথ্য অনুসরণ করে অন্যান্য ব্যক্তিদের খুঁজে বের করেছে। এই পদ্ধতি অবলম্বন করে তাদের জনগণকে লকডাউন এর মত কষ্টকর পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়নি আবার ভাইরাসের বিস্তার মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছে সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, জার্মানি এবং অস্ট্রিয়ার মতো দেশগুলো। ফলে এই দেশগুলোর মৃত্যুহারও অনেক কম।
এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে গিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া কোন ধরনের সংকোচ বা দ্বিধায় ভোগে নি। কোন কোন ক্লাস্টার থেকে এই ভাইরাস দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে তারা নিঃসংকোচে সেগুলো প্রকাশ করেছে এবং ওই ক্লাস্টার এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে বাছ-বিচার ছাড়াই পরীক্ষা করেছে। বিশেষ করে কেইস-৩১ হিসেবে চিন্হিত একজন রোগির মাধ্যমে একটি চার্চ থেকে এই ভাইরাসের সবচেয়ে বড় ক্লাস্টার ছড়ানোর বিষয়টি তারা প্রতিটি সংবাদ সম্মেলনে প্রচার করে, যাতে করে মানুষ এই ধরণের ক্লাস্টার এড়িয়ে সতর্ক থাকতে পারে।
মালয়েশিয়া অনুসরণ করেছে মিক্সড মেথড। তারা চীনের মতো সম্পূর্ণ না হলেও আংশিক লকডাউন করেছে এবং ব্যাপক হারে টেস্ট করেছে। একটি মুসলিম প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও এবং বর্তমান সরকার সম্পূর্ণভাবে ইসলামিস্টদের সমর্থনের উপর নির্ভরশীল হওয়ার পরেও তারা নির্ভয়ে প্রকাশ করেছে যে মালয়েশিয়ায় করোনা ভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের জন্য দায়ী একটি তাবলীগ জামাত অনুষ্ঠান।
২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে ১ মার্চ পর্যন্ত শ্রী-পেটালিং মসজিদে অনুষ্ঠিত তাবলিগ জামাতে অংশ নেওয়া ১৬ হাজার মুসল্লির মধ্যে যারা মালয়েশিয়ান তাদের প্রত্যেককে খুঁজে বের করে টেস্ট করেছে এবং তারা যে সকল স্থানে গিয়েছেন যাদের সাথে মিশেছেন তাদের পরিবারের সদস্যসহ সকলকে টেস্ট করেছে। এখনো পর্যন্ত প্রতিদিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে উল্লেখ করা হয় তাবলীগ ক্লাস্টার এর মধ্যে কয়জন নতুন আক্রান্ত হয়েছেন অথবা তাদের মধ্যে কয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এটা ইসলাম ধর্ম বা তাবলীগ কে হেয় করার জন্য করা হয় না, এটা করা হয় মানুষকে সতর্ক করার জন্য।
মালয়েশিয়ায় ব্যাপক টেস্টিং এর একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা বুঝতে পারবেন। ইনফ্লুয়েঞ্জা এর উপসর্গ (সর্দি-কাশি) নিয়ে যারা স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে গিয়েছেন এমন মোট ২৫ হাজার ৫শত ৮১ জনের করোনাভাইরাস টেস্ট করে মাত্র ২৬ জনকে পিজিটিভ হিসেবে সনাক্ত করা হয়েছে। করোনাভাইরাস এ আক্রান্ত কিন্তু কোন লক্ষণ নেই এমন ৪ হাজার ৮০৩ জনকে কোয়রান্টিন এ রাখা হয়েছে। এত ব্যাপক পদক্ষেপ নেওয়ার কারণেই মালয়েশিয়ায় করোনা ভাইরাস আক্রান্তে মৃতের সংখ্যা ১% এর কম।
এই কাজটি করতে ব্যর্থ হওয়ায় ইরান, ইতালি, স্পেন কে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। চীনের উহান থেকে ব্যবসায়িক সফর শেষে ফেরা একজন ইরানি ব্যবসায়ী তাদের শিয়া মতাবলম্বীদের পবিত্র শহর হিসেবে বিবেচিত ক্বওম শহরে অবস্থিত বিবি ফাতিমার মাজার শরীফ জিয়ারত করতে যান। পরবর্তীতে এই মাজার জিয়ারত কারীদের মধ্যেই ইরানে করোনাভাইরাস সংক্রামনের সবচেয়ে বড় ক্লাস্টারটির সন্ধান পাওয়া যায়।
কিন্তু শিয়া ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিবি ফাতেমার মাজার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কারণে ইরান সরকার এই বিষয়টিকে এড়িয়ে যায় এবং শুধুমাত্র করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার পর লক্ষণগুলো দৃশ্যমান হয়েছে এমন ব্যক্তিদের টেস্ট করে চিকিৎসা দিতে থাকে। শীতের শেষে বসন্তের শুরুতে ইতালি এবং স্পেনের পর্যটন ব্যবসা তুঙ্গে থাকে, সেই ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভয়ে এই দুই দেশের সরকার প্রথম দিকে ইরানের মতো শুধুমাত্র অসুস্থ ব্যক্তিদের টেস্ট করেছে এবং চিকিৎসা দিয়েছে। ভাইরাস সংক্রমণের উৎস এবং ক্লাস্টার খুঁজে বের না করে, ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ প্রকাশিত হয়নি এমন সংক্রমিত ব্যক্তিদের টেস্টের আওতার বাইরে রেখে, তাদেরকে নির্বিচারে চলাফেরা করতে দিয়ে, তাদের মাধ্যমে অন্যদেরকে সংক্রমিত হওয়ার পথ খোলা রেখে যে ভুল ইরান, ইতালি ও স্পেন করেছে, তার খেসারত আজ তাদের দিতে হচ্ছে।
চীনের প্রকাশিত উপাত্ত অনুযায়ী, করোনা ভাইরাস আক্রান্ত ৮০% ব্যক্তির মধ্যে তেমন কোন উপসর্গ দেখা যায় না, আপাতদৃষ্টিতে এই মানুষগুলোকে সূস্থ মনে হলেও তারা ভেতরে বহন করে যাচ্ছেন করোনাভাইরাস। তারা যাদের সাথে মিশছেন, সেই মানুষগুলো সংক্রমিত হচ্ছেন। সেই কারণে এই মানুষগুলো সবচেয়ে বেশি বিপদজনক। এই মানুষ গুলোর মাধ্যমে আরো অনেক বেশি মানুষকে রাতারাতি করোনাভাইরাস আক্রান্ত হওয়া ঠেকাতে চীনের মতো সম্পূর্ণ লকডাউন করে সবাইকে আলাদা করে রাখার মত পদ্ধতি আছে, আবার ক্লাস্টার সনাক্ত করে ব্যাপক টেস্টিংএর মাধ্যমে এই বিপদজনক মানুষগুলোকে সন্দেহভাজন কোয়রান্টিনে রাখার মত কোরিয়ান পদ্ধতি আছে, এমনকি আংশিক লকডাউন করে ব্যাপক টেস্টিংয়ের মালয়েশিয়ান পদ্ধতিও আছে। বাংলাদেশ কোন পদ্ধতি গ্রহণ করবে তার উপর নির্ভর করছে আগামী তিন মাসে আমাদের কত লাশ গুনতে হবে।
স্বল্প সংখ্যক টেস্ট করে স্বল্প আক্রান্তের সংখ্যা দেখানোর চতুর্থ ভারতীয় পদ্ধতি খোদ ভারতেই সমালোচিত হচ্ছে। আশা করি এমন ভুল পদ্ধতি গ্রহণ করে আপনারা বাংলাদেশের অবস্থা ইতালি, স্পেন বা ইরানের মতো করবেন না।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন