মানুষের কৃষিভিত্তিক সভ্যতার দশ হাজার বছর হল। এ সভ্যতার কারণে মানুষ নগর তৈরি করে একসাথে থাকা শুরু করে। কৃষি মানুষের খাবারের চিন্তা দূর করে, তাতে মানুষ কিছুটা অবসর পায়। সার্বক্ষণিক খাবারের চিন্তা থেকে অবসর পেয়ে কিছু মানুষ তখন শিল্পকার্যে, সৃজনশীল কাজে নিযুক্ত হবার সময় পায়, প্রকৃতিকে আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পায়। অবসর সময়ে তারা নতুন নতুন প্রযুক্তির আবিষ্কার করে, মানুষের জীবন তাতে আরো আয়েসী হয়। এরকম একটা সময়ে যুথবদ্ধ মানুষের মধ্যে নেতৃত্বের প্রয়োজনে আদিম গোত্রের দলনেতা এবং আধ্যাত্মিক প্রয়োজন মেটাতে আদিম গোত্রভিত্তিক শামান স্থায়ী আসন গেঁড়ে নেয়।
সভ্যতার বয়স আরেকটু বাড়লে, কৃষি, পশু-পালনে মানুষের সক্ষমতা আরো বাড়ে, ফলে ধীরে ধীরে আরো বেশি মানুষের অবসর মেলে। এ সময় কিছু মানুষকে রুটিরুজির কায়িক শ্রম থেকে বাদ দিয়ে জ্ঞানচর্চা, হিসাব বিজ্ঞান, প্রতিরক্ষা, জ্যোতিষ, ধর্ম ইত্যাদিতে ব্যস্ত রাখার মত ফুরসত ঘটে। অর্থাৎ, সমাজে একটা শাসক গোষ্ঠী তৈরি হয় যারা কৃষিকাজের উদ্ধৃতের উপর বেঁচে থাকে। আরেক অংশে থাকে কায়িক শ্রমিক, কৃষক, এবং দাস যারা সরাসরি উৎপাদনের কাজে নিযুক্ত থাকে। সভ্যতা আর দাসত্ব তাই একসাথে উচ্চারিত হয়, সভ্য সমাজে মানুষ প্রথমবারের মত শ্রেণিবিভক্ত হয়ে পড়ে। সভ্যতার প্রথম দিক থেকেই যারা নেতৃত্ব দিত, ধর্মীয় প্রথার তদারক করত তারা নিজেদের জন্য একটা চিরস্থায়ী ব্যবস্থা করে নেয়। ধীরে ধীরে পরিবার প্রথা এবং উত্তরাধিকারের মাধ্যমে তারা ভূ-সম্পত্তির উপর একচেটিয়া মালিকানা লাভ করে। জ্ঞান যেহেতু মুখে মুখে সঞ্চারিত হত, তাই কৃষক বা দাসের পক্ষে কোনভাবে ক্ষমতার ভাগ বা ভোগ করা সম্ভব হয় না। তাই যারা কায়িক শ্রম দিয়ে অন্যদের বাঁচিয়ে রাখত, তাদেরকে বংশ-পরম্পরা কায়িক দাসত্ব করে যেতে হয়। আর যারা সমাজের নেতৃস্থানীয়, জ্ঞানী, ধর্মগুরু, সেনাপতি তারা বংশানুক্রমে সকল সুবিধা ভোগ করে যেতে লাগল। সমাজে স্পষ্টঃতই একটা শ্রেণি বিভাজন শুরু হয়।
সভ্যতার মাঝামাঝিতে এসে পাঁচ হাজার বছর আগে যখন লেখালেখির আবিষ্কার হল, তখন সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণি নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে তাদের অবস্থানকে লিখিতভাবে স্থায়ী রূপ দিতে শুরু করে। দাসেরা অভিশপ্ত, জন্ম-জন্মান্তর তাদের দাসের জীবন যাপন করে যেতে হবে। অপরদিকে অভিজাত রাজা, সর্দার, সামন্ত, পুরোহিত এরা দ্বিতীয় জন্ম নেয়া, নিষ্কলুষ, দুনিয়াতে তারা সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি। সৃষ্টিকর্তার ম্যান্ডেট নিয়েই তারা তাদের এলাকা, রাজ্য শাসন করে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ তাদের খোদার প্রতিনিধি মনে করত, তাদের বিরুদ্ধে তাই প্রশ্ন করার সাহস পেত না। কখনো কোথাও সেরকম বিদ্রোহ দেখা দিলে তাদের কঠোরভাবে দমন করা হত। তারপরেও ইতিহাসে দেখা যায় দীর্ঘসময়ে বিচ্ছিন্নভাবে নানা জায়গায় দাস বিদ্রোহ, শুদ্র বিদ্রোহ হয়েছে। এরমধ্যে স্পাটার্কাসের দাস বিদ্রোহ উল্লেখযোগ্য। দাসেরা সংখ্যায় বেশি হয়েও তাদের নানা শাস্তি, ধর্মীয় অনুশাসনের ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখা যেত। সেজন্য দাস বিদ্রোহ দানা বেঁধে ওঠা কিছুটা অসম্ভব ছিল। আরেকটা ব্যাপার, সভ্যতার চাকা তখন দাসের কাঁধে, দাসের শ্রমে উৎপাদন, বিপণন সবই চলত। উৎপাদন প্রক্রিয়াকে গতিশীল করতে বেশি সংখ্যক দাস নিয়োগ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় মানুষের জানা ছিল না।
দীর্ঘকালের দাস ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মানুষ প্রযুক্তিতে আরো উন্নতি লাভ করে, মধ্যযুগে আরবে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়। ইওরোপেও একসময়ে দাস প্রথা বিলুপ্ত হয়ে সামন্ত-প্রজা, প্রভূ-ভুমিদাস সম্পর্ক তৈরি হয়। আগেকার দাসেরা এখন জমিদারের জমিতে খেটে খাওয়া শ্রমিক, বংশানুক্রমে এভাবে চলতে থাকে। এ সময়ের গল্প-সাহিত্যে শুধু রাজ-রাজড়ার গল্প, সাধারণ কায়িক শ্রমিক, দাস, সৈন্য, প্রজা, এরা হাজারে হাজারে জীবনপাত করে কিন্তু তাদের কোন গল্প হয় না, তাদের জীবনের কোন গল্প নে্ই, তারা ‘ভালগার মাস’। আমাদের রূপকথাগুলো তাই ‘এক দেশে এক রাজা, তার ছিল দুই রাণী’, ‘রাজকন্যা আর রাজত্বের’ গাঁথা দিয়ে ঠাসা।
এরপরে ইওরোপে রেনেসাঁর সময়ে মানুষের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্পৃহা বাড়তে থাকে, নতুন নতুন আবিষ্কারে জীবনযাত্রা আরো সহজ হয়। বৈজ্ঞানিক যন্ত্র-পাতির আবিষ্কারের ফলে ইওরোপে শিল্প-বিপ্লব সম্ভব হয় আর দাস-ভূমিদাসের কাঁধ থেকে সভ্যতার জোয়াল এবারে মেশিনের উপর চাপে। দুনিয়ায় প্রথমবারের মত মানুষের অমানবিক কায়িক শ্রম থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হয়। মানুষ এখন গতির বদলে ত্বরণের কথা ভাবার অবসর পায়, এর আগে গতি বাড়ানো মানে ছিল দাসের উপর আরো জুলুম, আরো অত্যাচার। কিন্তু এখন মেশিনকে আরো গতিশীল করে মানুষকে দূরত্বকে জয় করে, উৎপাদনের সময় কমিয়ে আনে। সমাজে উদ্ধৃত্ত সম্পত্তি তৈরি হয়। শহরে, বন্দরে গ্রামীণ কৃষি সমাজ থেকে ওঠে উন্মূল মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। নতুন একটা শ্রমিক শ্রেণির সৃষ্টি হয়, যারা তাদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, কর্মক্ষেত্রেও তার কাজের ভাগ সে পায় না। সারাদিন ধরে যে কাজ করে তার একটা সামান্য অংশ মজুরি হিসেবে সে পায়, ফলে কাজের জায়গাতেও সে নিজেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করে। নতুন শহুরে সমাজে তার আধ্যাত্মিক বিচ্ছিন্নতাও প্রকট হয়ে ওঠে। ব্যক্তি মানুষের জন্ম হয়, আর তার আধ্যাত্মিক প্রয়োজন মেটাতে সৃষ্টি হয় সাহিত্য, উপন্যাস। এই প্রথম জন্ম-গোত্র নির্বিশেষে ব্যক্তি মানুষের আশা-আকাঙ্খা, দুঃখ-বেদনা, হাসি-আনন্দ সাহিত্য, গল্পের উপাদান হয়।
বৈজ্ঞানিক শিল্প বিপ্লবের কারণে ব্যক্তির কায়িক শ্রম কিছুটা কমে, কিন্তু তার কাজের সাথে, জীবন-জীবিকার সাথে তার বিচ্ছিন্নতা কাটে না। তার কাজের ফল মালিক ভোগ করে ফুলে ফেঁপে ওঠে, এদিকে সে যেই দাস সেই দাসই থেকে যায়। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই বিজ্ঞানের কল্যাণে জীবন-যাত্রা আগের চেয়ে অনেক সহনীয় হয়, আগের পালকি বাহক এখন হয়ত মালিকের রিকশা চালায়, কিন্তু তার জীবনের নিয়ন্ত্রণ এখনো মালিকের হাতে, শ্রমের ন্যায্য ভাগ সে পায় না। সমাজে অন্য ফরম্যাটে, নতুন ভাবে দাসত্ব বজায় থাকে। এখনও কেউ বাজারে শ্রম বেচতে যায়, আরেকজন তাকে ক্রয় করে। এখানে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, কীভাবে একজন জন্মেই দেখে তাকে আজীবন শ্রম বিক্রয় করে যেতে হবে? আবার আরেকজন কীভাবে জন্ম থেকেই অপরের শ্রম কেনার ক্ষমতা রাখে? কঠোর শ্রম দিয়েই যদি মালিক তার সম্পত্তি অর্জন করে থাকে, তাহলে আরেকজন সারাজীবন শ্রম দিয়েও কেন তারই চাকরি করে যেতে হয়। সুতরাং শিল্প সমাজে ব্যক্তিগত কঠোর শ্রম দিয়ে কেউ এত টাকার পাহাড় গড়তে পারে না। অপরের শ্রমের ন্যায্য মূল্য পরিশোধ না করে, তাকে ফাঁকি দিয়েই সমাজে কেউ কেউ বড়লোক হয়, এবং উত্তরাধিকার সূত্রে সেটা পরিবাহিত হয়। তাই ‘সব মানুষ সমান’, সবক্ষেত্রে সব মানুষের সমানাধিকার কথাটা কাগজে-কলমেই ঠিক। বাস্তবে জন্ম থেকেই মানুষে মানুষে ফারাক,কেউ সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মায়, আর কেউ জন্মেই জগতের নির্মমতা দেখতে পায়, মায়ের স্তনে দুধ পায় না। দু’একটা ব্যতিক্রম ছাড়া এ অবস্থার তেমন কোন ব্যাত্যয় দেখা যায় না, বড়লোক বড়লোকই থাকে, সামাজিক অবস্থানের কারণে তার পতন সহজে হয় না। অপরদিকে গরীব গরীবই থাকে, সামাজিক মই বেয়ে তার উপরে ওঠা খুবই কঠিন। দু’একজন সেটা করতে পারলে আমরা তাকে উদাহরণ দেই, কিন্তু সেটা দু’একজনই হয়।
এমন পটভূমিতে মানুষের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির কারণে উৎপাদন বেড়েছে অনেক, কিন্তু যার শ্রমে উৎপাদন হয় সে শ্রমিক,কৃষক, খেটে খাওয়া মানুষ যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই আছে। দিনকে দিন ধনী-গরীবের এ বৈষম্য বাড়ছে। ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ মানুষকে বৈজ্ঞানিক পরিবর্তনের সূত্র দিয়ে মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থান পরিবর্তনের আকাঙ্খা জাগিয়ে তোলে। মালিক এবং শ্রমিকের বৈষম্য দূর করে মানুষকে অর্থনৈতিক সাম্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রত্যাশা তৈরি করে। জন্মে সকল মানুষ সমান, প্রকৃতিতে তার সমান অধিকার। কিন্তু আমরা কী দেখি ? আমরা দেখি জন্ম এবং অবস্থানের কারণে মানুষ বংশ পরম্পরা দারিদ্র্য, কষ্ট, শোষণ আর বঞ্চনার শিকার হয়। শুধু জন্মের কারণে এত ‘সাধের মানব জনম’ বৃথা যেতে পারে না। মানুষ যদি নিজেকে ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ মনে করে তাহলে বর্তমান পরিস্থিতিকে পালটানো তার সবচেয়ে জরুরী দায়িত্ব।
মাঠে একই প্রজাতির সকল পশু যখন চরাতে বের হয়, তখন সবার সমান অধিকার। যার বেশি প্রয়োজন সে হয়ত বেশি খাবে, যার কম দরকার সে কম খায়, কিন্তু পুরো মাঠে চরে বেড়িয়ে খেতে তার কোন বাধা নেই। তেমনি পাখি যখন খাবারের জন্য আকাশে ওড়ে তখন তার শক্তি-সামর্থ্য মত অবারিত আকাশের সবটুকুই তার, সেখানে উড়ে বেড়াতে, কূজন করতে তার কোন বাধা নেই। অপরদিকে আমরা মানুষেরা ব্যক্তিগত সম্পত্তি, মালিকানা, কাঁটাতার, প্রতিরক্ষা দিয়ে অপর মানুষকে সেখানে অবাঞ্চিত ঘোষণা করছি। আমাদের আইন-কানুন সবই এ ব্যক্তি সম্পত্তি, ভোগ-দখল জারি রাখার জন্য। লাখ লাখ শ্রমিকের বেতন-বোনাস মেরে দেয়া এক দু’জন মালিক বা মালিকের লোককে রক্ষা করতে, নিরাপত্তা দিতে, নিরাপদে সরিয়ে নিতে শিল্প-পুলিশ এগিয়ে আসে। লাখ লাখ নাগরিকের ন্যায্য দাবীরও ক্ষুদ্রাংশ, যেটা মালিক তাদের শ্রমের মূল্য হিসেবে ধার্য্য করে, সেটা আদায়ের জন্য তাদের অনাহারে আধাপেটা আন্দোলন, সংগ্রাম, অনশন চালিয়ে যেতে হয়। যেটা আমরা কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই প্রতিবছর ঘটতে দেখি।
এরকম পরিস্থিতিতে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বৈজ্ঞানিক পরিবর্তনের সূত্রকে মূল ধরে সামাজিক পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করতে চায়। যেমন, পানি অনেকক্ষণ ধরে জ্বাল দিতে থাকলে পরিবহন এবং পরিচলন প্রক্রিয়ায় পানির সবগুলো অনু ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হতে থাকে, তারপরে একটা সময়ে পানির তাপমাত্রা যখন ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায় তখন পানির গুনগত পরিবর্তন হয়ে সেটা বাষ্পে পরিণত হয়। মানুষের সমাজেও তেমনি পরিবর্তন আসে, সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিবর্তন এবং জনসচেতনতার মাধ্যমে মানুষ নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হয়, তার মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্খা জাগ্রত হয়। এভাবে বেশি সংখ্যক মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের জোয়ার আসলে কোন এক মাহেন্দ্র ক্ষণে মানুষ তার পরিপার্শ্বের, সমাজের গুনগত পরিবর্তন ঘটায়। সমাজ তখন নতুন রূপ নেয়, মানুষের নতুন যুগের সূচনা হয়। এভাবে এক সময় মানুষ আদিম সাম্যাবস্থা থেকে সভ্যতার দাসযুগে প্রবেশ করে, কিন্তু দাসযুগও চিরস্থায়ী হয়নি, সময়ের প্রয়োজনে, নতুন সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থায় মানুষ দাসযুগ থেকে সামন্তযুগে প্রবেশ করে। এক সময় মনে হয়েছিল সামন্ত যুগ বুঝি চিরস্থায়ী হবে, রাজা-রাজড়া-মন্ত্রী-সান্ত্রী-আমাত্যের জয়-পরাজয়, মাহাত্ম্যের কাহিনী নিয়েই মানুষ যুগ যুগ পার করে দিবে। কিন্তু সেই সামন্ত যুগও টিকেনি, এল আমাদের বর্তমান যান্ত্রিক, বৈজ্ঞানিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের যুগ, পুঁজিবাদের যুগ। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে পুঁজিবাদই বুঝি চিরকাল টিকে থাকবে। কিন্তু প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক এবং বৈজ্ঞানিক নিয়ম মত এ যুগেরও অবসান ঘটবে, এর পরে আসবে ‘কমিউন’, বা বহু মানুষের যুগ। ব্যক্তির যুগ ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে, ব্যক্তির জীবন নিয়ে রচিত উপন্যাসে ব্যক্তি মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত, মনঃস্তাত্ত্বিক সবরকম বিশ্লেষণ হয়ে গেছে। উপন্যাসে আর নতুন কিছু বলার নেই, তারপরেও মানুষের সাময়িক চাহিদার কারণে, যুগের চিত্র তুলে ধরতে এখনও উপন্যাস রচিত হচ্ছে।
ব্যক্তির, সমষ্টির মুক্তির জন্য উনিশ শতকে বিশ্বের কয়েকটি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটে যায়। এসব বিপ্লবের মাধ্যমে মানুষের ইতিহাসে প্রথমবারের মত সব মানুষকে সমান মর্যাদা দেবার চেষ্টা করা হয়। এ বছর রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লবের শতবার্ষিকী। সভ্যতার শুরু থেকে যারা সকল রকমের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে এসেছে তারা সহজে সেটা ছাড়তে চাইবে না, প্রয়োজনে তারা মরণ কামড় বসাবে। রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর থেকে পুঁজিবাদী দেশগুলোতে আজ অবধি যে পরিমাণ বিরোধীতা হয়েছে, যে পরিমাণে বিরুদ্ধ প্রচারণা চলছে এ নিয়ে তা ইতিহাসে নজির বিহীন। দুনিয়ার বুক থেকে সমাজতন্ত্রকে উৎখাত করার জন্য যে পরিমাণ টাকা ঢালা হয়েছে তা মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা হলে আজকে আমরা একটা দারিদ্র্যমুক্ত, ক্ষুধামুক্ত দুনিয়া দেখতে পেতাম। তারপরেও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলে দুনিয়াতে একটা ব্যাপক পরিবর্তন হয়, দেশে দেশে সাধারণ মানুষের জন্য, শ্রমিক বান্ধব অনেক আইন-কানুন তৈরি হয়। দুনিয়ায় শ্রমিকের অধিকার আদায়ের একটা মঞ্চ তৈরি হয়। আজকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নানা দিক আলোচনা- সমালোচনা হচ্ছে এবং সামনেও হবে, যেটা খুবই জরূরি। বর্তমানে সারা দুনিয়ায় মানুষ সরকারের ‘কৃচ্ছতার নীতি’র (austerity measures) কারণে অতীষ্ঠ। বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি ব্যাবহার করে এত উৎপাদন, প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন হবার পরেও কেন সরকারের পক্ষ থেকে জনগণকে কৃচ্ছতা সাধন করতে বলা হয় ? একদিকে বলা হচ্ছে ক্রমাগত ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে, অপরদিকে নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নেয়া হচ্ছে, তাহলে ঘাপলাটা কোথায়? আসলে উন্নয়ন ঠিকই হচ্ছে, কিন্তু তার সুযোগ-সুবিধা সাধারণ নাগরিকেরা পাচ্ছে না, বরং তাদের জীবনমানের অবনমন ঘটছে। দেশে দেশে ফাটকা বাজারি, ব্যাংক জালিয়াতি করে সাধারণ মানুষের উপর ঋণের বোঝা আরো বাড়ানো হচ্ছে। শেয়ার বাজারে যখন ধ্বস নামে তখন দেখা যায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মালিক এবং বড় কর্তারা বড় বড় বোনাস পায়, প্রমোদ ভ্রমণে বেড়াতে যায়। এরকম পরিস্থিতিতে এটা খুবই স্বাভাবিক যে মানুষ সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে আগ্রহী হবে।
মানুষকে আমরা ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ ভাবলে, মানুষকে যদি আমরা দুনিয়াতে ‘সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি’ মানি, তাহলে মানুষের জন্য আমরা এ কেমন দুনিয়া বানালাম? একজন মানুষ কীভাবে আরেকজন মানুষের মালিক হয়? কেন কিছু মানুষকে জন্মের কারণে আজীবন দাসত্ব করে যেতে হবে? অপরদিকে কেন কিছু মানুষ জন্ম এবং উত্তরাধিকারের কারণে হাজার হাজার লাখ-লাখ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করবে? যে পশুদের আমরা নিম্নস্তরের প্রাণি মনে করি সেই পশুদের মাঝে তো এমনটা নেই। কৃষি সভ্যতার কারণে যে দাস ব্যবস্থা চালু হয়েছে আজকের আধুনিক বিজ্ঞানের সুফল দিয়ে আমরা কেন সেই দাসত্বকে সরাচ্ছি না? দুনিয়ার অর্ধেক সম্পত্তি কেন মাত্র ১% মানুষের অধিকারে? এসব প্রশ্নের জবাব কী? সারা দুনিয়ার অসংখ্য মানুষ এরকম অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে, একটা চাপা অসন্তোষ সারা দুনিয়ার মানুষের মধ্যে কাজ করছে। যার কারণে আমরা ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’, ‘আরব স্প্রিং’ এর ঘটনা ঘটতে দেখছি। মানুষ প্রতিবাদী হচ্ছে, তারা হয়ত জানে না তারা ঠিক কী চায়, কিন্তু একটা বিষয়ে সবাই পরিষ্কার যে, যা চলছে সেটা চলতে দেয়া যায় না, বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তন দরকার।
ব্যক্তির মৃত্যুর ঘন্টা বেজে গেছে। মানুষ এখন সামষ্টিক, যৌথ উদ্যোগের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে আগ্রহী। উপন্যাসের অধোগতি এবং প্রযুক্তিতে যৌথ উদ্যোগ সেই নতুন যুগের বার্তা। আমরা দেখতে পাচ্ছি পুঁজিবাদের সিস্টেমে থেকেও ‘উইকিপিডিয়া’র মত প্রকল্পে বিনা পারিশ্রমিকে মানুষ কাজ করছে, নিজেদের চাঁদায় কো-অপ করে বিশুদ্ধ খাবার এবং বস্তুনিষ্ঠ খবরের ব্যবস্থা করছে। এমন আরো অনেক যৌথ, সামষ্টিক উদ্যোগে দুনিয়ার লাখ-লাখ মানুষ জড়িত। প্রযুক্তি মানুষকে নতুন প্লাটফর্ম এনে দিয়েছে, যাতে অসংখ্য মানুষের মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগ করতে পারাটা এখন পূর্বেকার যেকোন সময়ের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। তথ্য-প্রযুক্তির কারণে মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি তথ্য পাচ্ছে। প্রাকৃতিক, সামাজিক নিয়মে বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজের তার পরবর্তী স্তরে রূপান্তর অবশ্যম্ভাবী, ‘ইনএভিট্যাবল’। গত শতাব্দীর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে এভাবে দেখলে এর সফলতা বা ব্যর্থতার চেয়ে তাই অনাগত ভবিষ্যতে সামাজিক পরিবর্তনের একটা বড় উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়, যখন ব্যক্তির চেয়ে সমষ্টিকে প্রাধান্য দেয়া হবে। ভবিষ্যত সমাজে সকল মানুষকে তার সকল সম্ভাবনাসহ বেড়ে উঠবার, জীবন-যাপনের সুযোগ নিশ্চিত করা যাবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-জন্ম নির্বিশেষে সবাই একটা ‘লেভেল-প্লেয়িং’ ক্ষেত্র পাবে। মানুষ নিজেকে প্রথমবারের মত সত্যিকারের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। দুনিয়াতে কোন পরিবর্তন আনতে হলে মানুষকে নিজেকেই সেটা করতে হবে, কোন অদৃশ্য শক্তি এসে আমাদের কিছু করে দিবে না, পূর্বেও কেউ করে দেয় নি। বর্তমান যুগান্তকারী এ সময়ে আমাদের কাজ হল আগামী দিনের সে পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া, গত শতাব্দীর অক্টোবর বিপ্লব সে লক্ষ্যে আমাদের জন্য আলোক বর্তিকা হয়ে থাকবে।