০
২৩২২ বার পঠিত
সবারই একটা টাইপ থাকে। আর টাইপ থাকাটাই স্বার্থকতা। মানুষ হন আর সাথে যদি লেখক হন, তাহলে আপনার একটা নিজস্বতা থাকবে। আপনার কাজের একটা ধরণ থাকবে। আমার নিজেরও একটা ধরণ রয়েছে, লেখারও রয়েছে।
আমি বুদ্ধিজীবীদের জন্য লিখি না। আমি লিখি মধ্যবিত্তদের জন্য। যারা মূলত সমাজ পরিবর্তনে কাজ করেন। অভিজাত শ্রেণি কখনো সমাজ পরিবর্তনে কাজ করেননি। বরং তারা নিজেদের উপযোগী সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছেন। আর সেই সমাজ পরিবর্তনের জন্যই আমি লিখি। এক শ্রেণির লিখিয়ে, যারা নিজেদের অভিজাত লেখক হিসেবে নানা ভাবে পরিচিত করার প্রয়াস চালান। তাদের সেই ‘বর্ণাশ্রমী’ চেষ্টার বিরুদ্ধেও আমার লিখা।
যারা সমাজ পরিবর্তন করতে পারে, সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি যে লেখা বুঝবে না তা লিখে কী লাভ বলতে পারেন? কিশোর বিদ্রোহের কথা মনে আছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। কিশোররা কিন্তু মার্ক্স কিংবা লেনিন পড়ে রাস্তায় নামেনি। এমন অনেক আন্দোলন রয়েছে যা হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত। ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ এর কথা বলি। হয়ে যাবার পর তাত্ত্বিকরা তাকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘প্রথম সশস্ত্র গণসংগ্রাম’ হিসেবে। এই গণসংগ্রামের শুরুটা তাত্ত্বিকদের তত্ত্ব কথায় হয়নি। হয়েছিলো জমিদার ও ইংরেজ রাজ কর্মচারিদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে, জুলুম মোকাবেলায়।
এই বিদ্রোহের পেছনে কোনো ‘বাদ’ কাজ করেনি। নিরক্ষর সাঁওতালদের কথিত ‘বাদ’ পড়া বা বোঝার সক্ষমতা ছিলো না। তাদের মাথায় ছিলো তাদের না পাওয়া। তাদের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া অন্যায়, অত্যাচার। সমাজতন্ত্রের শ্রেণি সংগ্রাম, অর্থনীতির জটিল তত্ত্ব কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্যাঁচাল তাদের মস্তিষ্ক ধারণ করেনি। সত্যিকার সব আন্দোলনই হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত, নিজেদের প্রয়োজনে।
তাই সাধারণদের বলতে হবে তাদের না পাওয়ার কথা এবং দিতে হবে দাবি তোলার সাহস। পরিবর্তিত সময়ে এটাই লিখিয়েদের কাজ। লিখার ধরণটা হবে সাধারণের, সাধারণ আঙ্গিকে। সেখানে একাডেমিক আলোচনা স্রেফ বাকোয়াজ।
আমি মধ্যবিত্তদের জন্য লিখি। বাকোয়াজ করি না। অযথা তত্ত্ব কপচাই না। যারা কপচান তারা তাদের শ্রেণির। এলিট। আমি এলিট নই। মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের ছাপোষা লিখিয়ে। নিজেকে লেখক বলেও দাবি করি না। কেউ বললে উল্টো কুণ্ঠায় থাকি, সংকুচিত থাকি। আমি চাই আমার কথা যেনো অভিজাত মানুষ ও লিখিয়ে ছাপিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায়। তারা যেনো সহজে বুঝতে পারে তাদের না পাওয়ার জায়গা এবং কারণটা। সেটাই আমার চেষ্টা। আমি ভুলেও তাত্ত্বিক লিখিয়ে হতে চাইনি। উল্টো চেষ্টা করেছি সমাজ পরিবর্তনের চিন্তায় যেনো সমাজের বাইরের কেউ না হয়ে উঠি।
ছোট একটা কথা বলি। বলতে পারেন ছোট মুখে বড় কথা। যারা নিজেদের তাত্ত্বিক শ্রেণি বলেন, তাদের বলি। কিশোর বিদ্রোহের কারণ বিশ্লেষণের জন্য আপনি তাত্ত্বিক হবেন। অর্থাৎ আপনাকে বুদ্ধিজীবী বানাবে কিশোর বিদ্রোহ। আপনি কিশোর বিদ্রোহ বানাতে পারবেন না। সোজা কথায়, আপনার সৃষ্টি নয় কিশোর বিদ্রোহ। আপনি কিশোর বিদ্রোহের সৃষ্টি। এক্ষেত্রে মনে রাখা ভালো তাত্ত্বিকদের সাজানো প্রতিটা আন্দোলনই ব্যর্থ হয়েছে। যে আন্দোলন তত্ত্ব কথা দিয়ে সৃষ্টি তা শেষ পর্যন্ত বিপথগামী হয়েছে। গোপন দলগুলোর দিকে তাকান। ‘সর্বহারা’দের কিংবা উগ্রপন্থী হিসাবে চিহ্নিত ধর্মীয় সংগঠনগুলোর দিকে। সাধারণ মানুষের মুক্তির কথা বলেও তারা সাধারণ মানুষের কেউ নন। তাদের সাফল্যের মধ্যে এইটুকুই তারা কিছু মানুষকে সাধারণের দলছুট করতে পেরেছেন। ‘বাগি’ বানিয়েছেন। সমাজ এবং সাধারণ মানুষ যাদের ভয় পায়। অভিজাত শ্রেণি এবং অভিজাত লিখিয়েরাও তাই। সাধারণ মানুষ তাদের এড়িয়ে চলে। হয়তো ভয়ও পায়।
আমি চাই না, আমার লেখা কেউ এড়িয়ে চলুক। না পড়ুক। আমি চাই আমার লেখা সাধারণ মানুষের মতন সাধারণ হয়ে উঠুক। সাধারণ মানুষের জন্য হয়ে উঠুক।
পুনশ্চ: যারা আমার লেখাকে খুব সাধারণ বলে জ্ঞানগম্যি করেন, তারা আমার লেখা পড়া থেকে দূরে থাকুন। আপনাদের মধ্যে জাগরণের কোনো সম্ভাবনা নেই। আপনারা জাগরণ রহিত। আর আপনারা জাগলে আপনাদের সমাজ পরিবর্তন হবে। অর্থাৎ স্রেফ দল বদলের মতন অবস্থান বদল হবে। সেই বদলে সাধারণের সমাজ বদলে যাবে না। ন্যুনতম দোলাও লাগবে না। কারণ আপনারা সেই সমাজের কেউ না। সুতরাং আমাকে আমার সমাজ নিয়ে থাকতে দিন। আমার সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টা করতে দিন। ব্যর্থতা বা স্বার্থকতা থাক সময়ের হাতে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন