১৬৭৯ বার পঠিত
মুক্তচিন্তার কবি অরূপ বাউল বলেন,
“শক্ত হাতে কাঁপিয়ে দেবো মৌলবাদের ভিত
ঘরে ঘরে জন্মেছে আজ হাজার অভিজিৎ।”
যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশটার সমান বয়স তাঁর। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয় ১৬ ডিসেম্বর ৭১এ, তার পরে আরো ৯ মাস পেরিয়ে ১২ সেপ্টেম্বর ৭২ সালে যে শিশুর জন্ম, মাত্র ৪৩ বছর বয়েসেই ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তার অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর দিন। শৈশব কৈশোর আর যৌবন সবই কাটে ঢাকা শহরে। পিতা অধ্যাপক অজয় রায়, বিজ্ঞানে একুশে পদকপ্রাপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ২০১৫’র একুশে বইমেলায় একটি প্রকাশনা অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির জনাকীর্ণ ভিঁড়ের মাঝে প্রকাশ্যে হামলা করে খুন করে কট্টর মৌলবাদী ইসলামি জঙ্গিরা।
আজ তাঁর জন্মদিনে, তাই ওর মৃত্যুর কথা প্রথমেই না বলে, দেখা যাক কেমন ছিল এই মানুষটি, কেনই তার এই অকাল মৃত্যুর কারণ খোঁজার আগে দেখা যাক কে ছিলো এই মানুষটি?
ড. অভিজিৎ রায়, একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বাংলাদেশী-মার্কিন প্রকৌশলী, লেখক, দার্শনিক ও ব্লগার। নব্বইর দশকের শুরুতেই বুয়েটের ছাত্র অভিজিৎ, দেশটা তখন সবেমাত্র দীর্ঘ সৈরশাসকের অবসান ঘটিয়ে আবার গণতন্ত্রিক আদর্শের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে এগিয়ে চলছে, যুবসমাজ এর মাঝেই শিখে ফেলেছে প্রশ্ন করার কৌশল, রাষ্ট্রগঠনে গণমানুষের ভূমিকা, সমাজে ধর্মের গোঁড়ামি থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রচণ্ড উচ্ছ্বাস। অভিজিৎ’ও তাই ধারা বদলাতে চায়। নব্বইর দশকের মাঝামাঝি সময় মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি নিয়ে প্রকাশিত হয় আরেক প্রতিভাধর বিজ্ঞানী পল ডেভিসের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘শেষ তিন মিনিট‘ পরবর্তীতে যার প্রভাব অভিজিতের বিভিন্ন ব্লগে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হতে থেকে। অভিজিৎ লিখতে থাকে।
“এই মহাবিশ্বটা পরমাণু দিয়ে তৈরি নয়, গল্প দিয়ে তৈরি“। উক্তিটি প্রয়াত কবি এবং রাজনৈতিক কর্মী মুরিয়েল রুকেসারের। রুকেসার উক্তিটি কী ভেবে করেছিলেন, তা এখন আর আমার মনে নেই, কিন্তু আজ এই লেখাটা লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে তিনি হয়তো ভুল বলেননি। আমরা ছোটবেলায় পদার্থবিজ্ঞানের বই খুললে দেখতাম, আমাদের চেনা জানা বস্তুজগৎ অণু পরমাণু দিয়ে তৈরি। কিন্তু আজকের দিনের জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই মহাবিশ্বের একটা বড় অংশ, সত্য বলতে কী – মহাবিশ্বের প্রায় পুরোটাই – আমাদের চেনা-জানা কোন পদার্থের অণু পরমাণু নয়, বরং অজ্ঞাত পদার্থ আর অজ্ঞাত শক্তিতে পরিপূর্ণ। আর বিজ্ঞানীদের এই নতুন আবিষ্কারগুলো জন্ম দিয়েছে নানা আকর্ষণীয় সব গল্প কাহিনীর। সেই কাহিনীর একটা বড় অংশ মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতিকে ঘিরে।
অভিজিৎ বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন আর সেই কারণেই বাংলাদেশে সরকারের সেন্সরশিপ এবং ব্লগারদের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের সমন্বয়ক ছিলেন। তিনি পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু তিনি ইন্টারনেটে তাঁর উদ্যোগে গঠিত ব্লগ তথা ‘মুক্তমনা’ সাইটে লেখালেখির জন্যই বিশেষভাবে পরিচিত।
যুক্তিবাদী এই লেখক লিখেছেন,
“ধর্মগ্রন্থগুলোতে কোনো আধুনিক বিজ্ঞান নেই, বরং আছে আধুনিক বিজ্ঞানের নামে চতুর ব্যাখ্যা এবং গোঁজামিল। সেজন্যই, ধর্মের কাছে বিজ্ঞানকে কখনও দ্বারস্থ হতে হয় না, বরং ধর্মবাদীরাই আজ প্রতিটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পর সেটিকে নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থের সাথে জুড়ে দিতে মুখিয়ে থাকে। কারণ ধর্মবাদীরা জেনে গেছে, ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান ঠিকই টিকে থাকতে পারবে, কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান ছাড়া ধর্মগুলোর বেঁচে থাকার আর কোনো উপায় নেই।”
ঢাকার একুশে বইমেলা থেকে বের হওয়ার সময় সন্ত্রাসীরা তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকেও মারাত্মক আহত করে।
অভিজিৎ শুধু লেখক আর ব্লগেরই ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন সমাজ চেতনার পথিকৃৎ ও দার্শনিক। ভারতীয় সাংবাদিক সুদীপ নাথ অভিজিৎকে প্রাচীন গ্রিস এর দার্শনিক সক্রেটিস এর সাথে তুলনা করে লেখেন,
“সক্রেটিস আর তার হেমলক পানের কথা কে না জানে। এথেনিয় সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ ক্ষমতার যুগ থেকে পেলোনেশিয় যুদ্ধে স্পার্টা ও তার মিত্রবাহিনীর কাছে হেরে যাওয়া পর্যন্ত পুরো সময়টাই সক্রেটিস বেঁচে ছিলেন। পরাজয়ের গ্লানি ভুলে এথেন্স যখন পূনরায় স্থিত হওয়ার চেষ্টা করছিল তখনই সেখানকার জনগণ সেখানকার গণতন্ত্রের সঠিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করেছিল। সক্রেটিসও সেই তথাকথিত গণতন্ত্রের একজন সমালোচক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এথেনিয় সরকার সক্রেটিসকে এমন দোষে দোষী বলে সাব্যস্ত করেছিল যাতে তার মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হতে পারে। কিন্তু তার গুণাবলী ও সত্যের প্রতি অটল মনোভাব সত্যিকারঅর্থেই তৎকালীন সরকারী নীতি ও সমাজের সাথে সংঘর্ষ সৃষ্টিতে সমর্থ হয়েছিল। ঐতিহাসিকভাবে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সমাজের চোখে তার সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল সামাজিক ও নৈতিক ক্ষেত্রসমূহ নিয়ে তার তীব্র সমালোচনা। প্লেটোর মতে সক্রেটিস সরকারের জন্য একটি বিষফোঁড়ার কাজ করেছিলেন যার মূলে ছিল বিচারব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ও ভাল কিছুর উদ্দেশ্য নিয়ে সমালোচনা। এথেনিয়দের সুবিচারের প্রতি নিষ্ঠা বাড়ানোর চেষ্টাকেই তার শাস্তির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তৎকালীন শাসকদের সাজানো বিচারে খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯ অব্দে তাঁকে হেমলক বিষপান করতে বাধ্য করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
আলেকজান্দ্রিয়ায় বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ইতিপিয়াকে প্রকাশ্য রাজপথে টুকরো টুকরো করে কেটে হত্যা করা হয়েছিল, কারণ তিনি মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেননি। তিনি তার বৈজ্ঞানিক সত্যকে চাপের মুখে গ্যালিলিওর মত মিথ্যা ঘোষণা দিতে অস্বীকার করেছিলেন। তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী ও মহিলা শহীদ।
রোমান দার্শনিক সেনেকাও সম্রাট নিরোর আদেশে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এমন শত শত মুক্তচিন্তার ও সত্যের সাধককে যুগে যুগে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, প্রচলিত ধ্যান-ধারণার সমালোচনা করার জন্যে। অগণিত সাধককে বন্দি করে রাখা হয়েছে যুগে যুগে। নানাভাবে অত্যাচার করা হয়েছে অপ্রিয় সত্যি কথা বলার জন্যে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ঠিক একই কারণে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে বিজ্ঞান লেখক তথা মুক্তচিন্তার অগ্রদূত ড. অভিজিৎ রায়কে।”
অভিজিৎ ২০০১ সালে কয়েকজন প্রগতিশীল লেখককে নিয়ে তৈরি করেন ‘মুক্তমনা’ ব্লগটি। ২০০৭ সালে ধীরে ধীরে মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার আর মানবাধিকার ও সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সম্যক অবদান রাখার জন্যে তার মুক্তমনা সাইট অর্জন করেছে ‘শহীদ জননী জাহানারা ইমাম‘ স্মৃতি পদক। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এই ব্লগটিকে জাহানারা ঈমাম স্মৃতি পদক দিয়ে ভূষিত করে। এই পদকে উল্লেখ করা হয়,
“বাংলাদেশে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মুক্তচিন্তার আন্দোলনে বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ ও সংগঠনের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে ‘মুক্তমনা’ ওয়েবসাইট। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশে ও বিদেশে সামাজিক যোগাযোগের কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে সেক্যুলার মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধকরণের পাশাপাশি তাদের বিজ্ঞানমনষ্ক করবার ক্ষেত্রে ‘মুক্তমনা’ ওয়েবসাইটের জগতে এক বিপ্লবের সূচনা করেছে।”
২০০১ খ্রিস্টাব্দের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু যে নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল, ‘মুক্তমনা’ তখন ওই নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনের পাশাপাশি আর্ত মানুষের সেবায় এগিয়ে এসেছিল।
বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের সমানাধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বিশেষ অবদানের জন্য ‘মুক্তমনা’
The Bobs Award Ceremony 2015
‘জাহানারা ঈমাম স্মৃতি পদক ২০০৭’ পায়। এবং ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্লগ হিসেবে ডয়চে ভেলের অন্যতম পুরস্কার The BOBs (Best of the Blogs) লাভ করে।
এ পর্যন্ত অভিজিৎ রায় এর লেখা ১০টি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলো হলো-আলো হাতে চলছে আঁধারের যাত্রী, মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে, স্বতন্ত্র ভাবনা: মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি, অবিশ্বাসের দর্শন, বিশ্বাসের ভাইরাস, ভালোবাসা কারে কয়, সমকামিতা: বৈজ্ঞানিক সমাজ-মনস্তাত্তিক অনুসন্ধান, শুন্য থেকে মহাবিশ্ব, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি বিদেশিনীর খোঁজে এবং বিশ্বাস ও বিজ্ঞান।
বাঙালি জাতিকে আলোর পথে এগিয়ে নেয়ার সাধনায় অভিজিৎ ও তার সহযোদ্ধারা যে পথ দেখিয়ে গেছেন তা অবিস্মরণীয়। মুক্তচিন্তা দীর্ঘজীবী হোক। অভিজিতের জন্মদিনে শুভেচ্ছা।
– মোনাজ হক
বার্লিন, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন