৯০৫ বার পঠিত
“কেউ যদি আমাদের অরণ্য মাকে কেড়ে নিতে চায়, কেউ যদি আমাদের জাতিকে খারাপ বলে, কেউ যদি আমাদের ধর্মকে ধর্ম মনে না করে, কেউ যদি আমাদের শুধু শোষণ করে তবে আমি বিদ্রোহ করবই।”
আদিবাসীদের নিজস্ব জীবনের জন্য, জল-জঙ্গল-মাটির ন্যায্য অধিকারের জন্য যিনি লড়াই করে জীবন দিয়েছিলেন, উনিশ শতকে যাঁর নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম আদিবাসী বিদ্রোহ অথবা বলা যায় অবিভক্ত ভারতবর্ষের প্রথম ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াই, এই কথাগুলো তিনিই বলেছিলেন। আজ তাঁর ১১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। ৯ই জুন ১৯০০ সালে জেলের মধ্যে খাবারে বিষ মিশিয়ে তাঁকে খুন করে তৎকালীন ইংরেজ সরকার।
তিনি বিরসা মুন্ডা। আদিবাসীদের কাছে ভগবান বিরসা। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ভোরের পাখি। এ রকম ভোরের পাখিদের কলকাকলীই তো বয়ে এনেছিল স্বাধীনতার সোনালি সকাল। দুঃখের বিষয় এটাই বিরসা মুন্ডা তথা মুন্ডা বিদ্রোহের ইতিহাস স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষের বেশীরভাগ ছেলেমেয়েই জানে না। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কথা নাহয় বাদ ই দিলাম। অবশ্য তাতে তাদের তেমন দোষ ও তো দেখি না। কারন বৃটিশ পরবর্তী ভারতবর্ষের ইতিহাস বিরসা দের চিরকাল ব্রাত্যই রেখেছে। পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাসে রাষ্ট্র শুনিয়েছে (এখনোও) মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী, নেহরু, প্রমূখ রাই ভারত নামক রাষ্ট্রটিকে স্বাধীন করিয়েছেন। (২০১৪ পরবর্তী ভারতবর্ষ অবশ্য নেহরু, গান্ধীদেরও খলনায়ক আখ্যা দিয়ে সাভারকরদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নতুন নায়ক হিসেবে পাঠ্যপুস্তকে হাজির করিয়েছে)। নিদেনপক্ষে ভারতীয় সিনেমা ভগৎ সিং, মঙ্গল পান্ডেদের নিয়ে সিনেমা করিয়ে বলেছে না না এঁরাও ছিলেন। কিন্তু উনিশ শতকে প্রথম বৃটিশ উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন যে আদিবাসী মুন্ডারা গড়ে তুলেছিলেন, সে কথা আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলো খুব সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছে। এখনো যায়।
এর কারন হয়তো, মুন্ডা বিদ্রোহ মূলত ইংরেজদের বিরুদ্ধে হলেও আসলে তো এই বিদ্রোহের ভিত ছিল সর্বপ্রকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে। এবং সেই শোষক শুধুমাত্র বৃটিশ রা ছিল না, ভারতের ভিন্নভাষার, ভিন্ন বর্গের – বিহারি, পাঞ্জাবী, বাঙ্গালী, রাজপূত, জমির মালিকরা ও ছিল। আদিবাসীদের ভাষায় ‘দিকু’। এরা আদিবাসীদের নানাভাবে শোষন করতো। চড়া ঋণের দায়ে ফেলে, সুদের জালে আটকে তাদের জমিজমা কেড়ে ভূমিদাসে পরিণত করত। আজ ও করছে। হয়তো জমিদারি প্রথার বদলে কর্পোরেট আদলে। কেড়ে নিত বা নিচ্ছে তাদের জল-জমি-অরণ্যের অধিকার। খাবার, ঘরবাড়ী, জমি, জঙ্গল হারিয়ে অসহায় হয়ে টাঙি, বর্শা নিয়ে রাষ্ট্রের গুলির সামনে এসে দাড়াতে হয় তাদের আজ ও। তাই এদের কথা রাষ্ট্র তার পাঠ্যপুস্তকে দিতে ভয় পায়। তার নাগরিকদের জানাতে ভয় পায়।
ঊনিশ শতকের গোড়ার দিক। মুন্ডারা দেখল তাদের পরিষ্কার করা জমি বণিক ও মহাজন বেশে আসা জায়গিরদার ও ঠিকাদারের হাতে ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। মুন্ডাদের জমি হারানোর এই প্রক্রিয়া ব্রিটিশদের ভারতে আসার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল কিন্তু ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে আদিবাসী অঞ্চলে অ-আদিবাসীদের আসা-যাওয়া ভীষণভাবে বৃদ্ধি পায়। সাথে বাড়তে থাকে বলপূর্বক শ্রম এর ঘটনা। একদিকে মহাজন ও জমিদারদের অকথ্য অত্যাচার, নির্যাতন, অপরদিকে বৃটিশ সরকারের উচ্চহারে কর আদায়। একদিকে অনাহারে মানুষের দিন কাটছে অন্যদিকে খাদ্যের লোভ দেখিয়ে একশ্রেণীর মিশনারিরা মুন্ডাদের খ্রীষ্টান ধর্মে ধর্মীন্তরিত করার প্রবল চেষ্টা চালাচ্ছে। বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে তখন শুরু হয় গ্রামের পতিত জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলন।
সমস্ত দেশের অসংখ্য আদিবাসীরা একে একে বিরসা মুন্ডার ডাকে সাড়া দিয়ে বিদ্রোহে সামিল হয়। ভয় পেয়ে বৃটিশ সরকার বিরসা মুন্ডাকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করে এবং শেষে ১৮৯৫ সালে বিরসা মুন্ডাকে দুবছরের জন্য কারাগারে বন্দি করে। মহাজন, জায়গীরদাররা মুন্ডাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে।
জেল থেকে বেরিয়ে বিরসা মুন্ডা নতুন কূটনীতির আশ্রয় নেন। এক গভীর জঙ্গলে নৈশ ভোজন করার জন্য জায়গীরদার, মহাজন, হাকিম ও খ্রিষ্টানদের আমন্ত্রণ করেন তিনি। একদিকে ভোজের আয়োজন তার সাথে আদিবাসীদের গান ও সুরা এসবের মধ্যেই বিভোর হয়ে থাকে তারা। অন্যদিকে বিরসার ইশারায় ঝোপঝাড়ের মধ্যে থেকে উড়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর। মুহূর্তের মধ্যে প্রাণ হারায় বেশ কয়েকজন জায়গীরদার, মহাজন, হাকিম ও মিশনারি।
ব্রিটিশদের অমানুষিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে ১৮৯৯ সালে বড়দিনের আগে মুন্ডারা রাঁচি ও সিংভূম জেলার ছয়টি থানায় আগুন লাগায়। এই কান্ডকলাপে ব্রিটিশরা বিরসার উপর আরও খেপে ওঠে এবং চরম প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। বিরসা মুন্ডা সহ তার সমগ্র বিপ্লবী দলকে বন্দী করতে সমর্থ হয় ব্রিটিশ সরকার। চারিদিকে তখনও বিক্ষিপ্তভাবে চলছিলো মুন্ডা বিদ্রোহীদের আন্দোলন। ব্রিটিশ সরকার এই আন্দোলনকে একেবারে নির্মূল করার জন্য ৩০০ র উপর বিদ্রোহীকে হত্যা করার পাশাপাশি অসংখ্য বিদ্রোহীকে কারারুদ্ধ করে। বিরসা মুন্ডাকে জেলের মধ্যেই খাবারে বিষ মিশিয়ে হত্যা করা হয়।
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রথম দশক থেকেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের যে ভীত রচিত হয়েছিল তার সামনের সারিতে ছিলেন আদিবাসী সম্প্রদায়ের লড়াকু মানুষেরা। “বাবা তিলকার লড়াই” (১৭৭৫-৮৫), “সিদো-কানহুর হুল” (১৮৫৫-৫৬), “বীরসা মুন্ডার উলগুলান” (১৮৭২-১৯০০), “ভগীরথ মাঝি এবং জ্ঞান পারগনানার আন্দোলন”, “দুবিয়া গোঁসাইয়ের খেরওয়াল আন্দোলন” (১৮৮০) সেদিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল।
অথচ সভ্য ভারতবর্ষ তার অরণ্যের কালো ছেলে- মেয়েগুলোকে ঠিক আপন বলে চিনতে পারেনি আজোও। এদের অভাব-অভিযোগের নালিশকে বর্বর, কালা আদমির অভ্যুত্থান বলে নাক সিটকেছে। কখনো উগ্রপন্থী, মাওবাদী তকমায় ভূষিত করেছে এদের বেঁচে থাকার লড়াইকে। নিজের অধিকার আদায়ের লড়াইকে। ঋকবেদেও দেখা যায় এদের রাক্ষস, অসুর, জন ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে।
সুতরাং একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় সভ্যতার শুরু থেকে আজ অব্দি ভারত নামক ভূখন্ডের আদি বাসিন্দারাই সবচেয়ে বেশী অবহেলা, নির্যাতন আর শোষনের শিকার। বৃটিশদের হাতেও শোষিত হয়েছে এরা আবার নিজ ভূখন্ডের অন্যান্য বাসিন্দাদের হাতে আজোও শোষিত হয়ে যাচ্ছে।
সংবিধানের ৩৪২ (১) নং ধারায় আদিবাসীদের অধিকারের বিভিন্ন কথা ফলাও করে লিপিবদ্ধ করা আছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল সেগুলি আছে শুধু কাগজে কলমেই। স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরেও কেড়ে নেওয়া হয় তাদের পাট্টা, বর্গা, ফাঁসানো হয় মিথ্যা মামলায়! বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রকল্পে বহু সংখ্যক আদিবাসী বিনা ক্ষতিপূরণ বা নামমাত্র ক্ষতিপূরণে উৎখাত হোন নিজেদের জমি থেকে। ভারতীয় সংবিধানের পঞ্চম তফসিলে আদিবাসী এলাকার দখলে থাকা জমি হস্তান্তরে গ্রাম সভার অনুমতি বাধ্যতামূলক। কিন্তু সংবিধানকেও বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কোন প্রকার অনুমতি ছাড়াই শিল্প স্থাপন ও খনিজ উত্তোলনের জন্য কেন্দ্র ও অনেক রাজ্য সরকার বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানি, কর্পোরেট সংস্থাকে দিয়ে যাচ্ছে!
তাই আজকের সময়ে দাড়িয়ে আবার একজন বিরসা মুন্ডার খুব প্রয়োজন। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর হাত থেকে নিজেদের জল-জমি-অরণ্যের অধিকার ছিনিয়ে আনতে আরেকটা উলগুলান আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাক আগামীর বৃহত্তম লড়াইয়ের ময়দানে। সংঘবদ্ধ করে তুলুক আমাদের।
শেষ করা যাক শবর সম্প্রদায়ের একটা গান দিয়ে,
“বাস করি ধুঁদে ঝাড়ে
ব্যাঙ, ইঁদুর মারে খাই
বোইল্যে দে-ন ভাই
ইটাকে কি বাঁচা বলা যায়?
বন-বাদাড় হ’রে লিল-শিকড় বাকড় ফুরাঞ গেল
কেমন ক’রে কাল কাটাই?”
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
জুন ১০, ২০১৯; ৪:৫৮ অপরাহ্ন
অনেক জরুরী লেখা। বীরসা মুন্ডার আত্মত্যাগ আজ অবধিও যথাযোগ্য মর্যাদায় মনে রাখা হচ্ছে দেখে ভাল লাগল। আমাদের যতই ইতিহাসবিমূখ বলা হোক, এর পাশাপাশিই চলছে ‘মানুষের ইতিহাস’ চর্চা। অভিনন্দন নেবেন সুমনা।