০
৫৪৭ বার পঠিত
অনেকগুলো ছেলে খাঁ খাঁ রোদে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তায় সারিবেঁধে তারা প্রতিবাদ জানাচ্ছে সাংবাদিক ফাগুন রেজা হত্যার। ওদের একজনের হাতে একটি প্ল্যাকার্ড। যাতে লেখা, ‘I’d rather die like a man, than live like a coward… Fagun Reza’, এই লেখাটি ফাগুন তার ফেসবুকে উৎকীর্ণ করে রেখেছিলো। সেই লেখাটিই যখন দেখলাম ছেলেটির হাতের প্ল্যাকার্ডে, তখন মনে হলো ফাগুনের আত্মত্যাগ সম্ভবত বৃথা যায়নি।
ছবিতে মনে হলো, ছেলেটি প্রায় ফাগুনের সমবয়সী কিংবা ছোট। কিন্তু ওর চোখেমুখে একটা প্রত্যয় ছিলো। এই প্রত্যয় আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিটাকে বাঁচানোর জন্য বড় প্রয়োজন। আমাদের প্রিয় দেশটি ক্রমেই আলোর উল্টো দিকে হাঁটছে। ক্রমেই সেঁধিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে।
ফাগুনের মৃত্যুর পর ওরই সমবয়সী অনেকগুলো ছেলে মারা গেছে। কেউ ছিনতাইকারীর আঘাতে, কেউ সড়ক দুর্ঘটনায়, কেউবা হন্তারকদের হাতে। এই যে মৃত্যু, এই যে লাশ; রেললাইনের পাশে, ঝোপের ধারে, ডোবা-নালায় প্রতিদিনই পড়ে থাকছে! প্রতিদিনই ঝরছে কোনো সম্ভাবনাময় প্রাণ, দেশ হারাচ্ছে প্রতিশ্রুতিশীলতা। এমন দেশ কি আমরা চেয়েছিলাম?
ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে মারা গেলো প্রায় চল্লিশ জন মানুষ, যার বেশিরভাগই তরুণ। তারা কী কারণে দেশ ছেড়েছিল, এ প্রশ্ন কি কারো মনে জাগে? হয়তো জাগে না। জাগলে, অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য, ভালোভাবে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষায় তারা দেশ ছাড়তো না।
সেদিন দেখলাম ভারতে কয়েকজন বাংলাদেশি আটক হয়েছেন। তারা কাজের আশায় ভারত গিয়েছিলেন। এক সময় ভারতের লোকজন আমাদের জীবনযাত্রার মান দেখে আফসোস করতো। আজ কি এমন সময় এলো যাতে আমাদের ভারতে কাজ খুঁজতে যেতে হয়।
রাস্তায় বাচ্চা-বুড়ো কারোরই নিরাপত্তা নেই। সড়কে প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছে বাচ্চারা, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন-ই তার প্রমাণ। পুরো বিশ্বকে নাড়া দেয়া একটি আন্দোলনের পরেও কি নিরাপদ হয়েছে এ দেশের সড়ক? হয়নি। হলে প্রতিদিনই দুর্ঘটনার খবর করতে হতো না গণমাধ্যমকর্মীদের।
গণমাধ্যমকর্মীরাই কি নিরাপদ? ফাগুনের মৃত্যুই তার প্রমাণ। গণমাধ্যমকর্মীরা রয়েছেন চরম অনিরাপত্তার মধ্যে। খবরে দেখলাম আমার পার্শ্ববর্তী জেলা জামালপুরের এক গণমাধ্যমকর্মী মোস্তফা মনজু আহত হয়েছেন দুর্বৃত্তদের দ্বারা। এমন ঘটনা এখন নিত্যকার।
ডিবিসি নিউজে দেখলাম, জেলা পরিষদের এক কর্মকর্তার বক্তব্য নিতে গিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির সংবাদকর্মী। তাদের ধমকে রুম থেকে বের করে দিয়েছেন সেই কর্মকর্তা। সঙ্গে করেছেন চরম রূঢ় আচরণ। এই তো গণমাধ্যমকর্মীদের অবস্থা।
অনেকে গণমাধ্যমকর্মীদের দোষ দেন নানা কারণে। স্বীকার করি দোষের কারণও রয়েছে। তারা আপোষ করেন, কোন ক্ষেত্রে অসৎও হয়তো হন। প্রশ্ন করি, আপোষ না করে কি করবেন? তরুণ সাংবাদিক ফাগুন রেজা আপোষ করেনি, অসৎ হয়নি, প্রতিবাদ করেছিল।
তাতে লাভটা হয়েছে কী। একটি অতি মেধাবী সাংবাদিককে হারাতে হয়েছে আমাদের। একজন বাবার যতটুকু ক্ষতি হয়েছে, তার থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে গণমাধ্যমের, সর্বোপরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশ। একজন ‘নেতাজীবী’কে প্রায়ই উপদেশ দিতে শুনি, মেধাবীরা যেন দেশ ছেড়ে না যায়। ‘নেতাজীবী’ মানে যার জীবনধারণের সাইনবোর্ড একটাই, তিনি ‘নেতা’।
অমন নেতাদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই কেন? নেপালের মতন ছোট একটি দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম থাকতে পারলে, আমাদের দেশের ঘাটতিটা কোথায়? অবশ্য এর একটা বড় ‘ইয়ে’ জাগানিয়া উত্তর দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট একজন। বলেছেন, তারা টাকা দিতে পারেননি বলে তাদের জায়গা হয়নি তালিকায়। আহারে, অজুহাত। যাকগে, যা বলছিলাম- বুড়োদের রিপ্লেসমেন্ট হলো তরুণরা। একটি দেশকে এগিয়ে দেয়ার সাধ্য রয়েছে তরুণদের। সেই তরুণরা যদি নিখোঁজ হন, নিহত হন হন্তারকদের হাতে, অবলীলায় প্রাণ হারান সড়কে, তবে দেশের এগিয়ে যাবার গতি কি থেমে যাবে না? বয়োবৃদ্ধদের এই ভারি বোঝা সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়বে না? যেমন আমার ক্রমেই অসম্ভব হয়ে পড়ছে, ক্রমেই বেঁচে থাকার ইচ্ছা নিদারুণ অনিচ্ছায় পরিণত হচ্ছে।
পুনশ্চ: সামনে ঈদ। কত সড়ক, ছিনতাইকারীর ছুরি, মলমপার্টির মলম, অজ্ঞান পার্টির ক্লোরোফর্ম তৈরি হয়ে আছে মানুষের প্রাণ সংহারে, তা কে জানে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন